জার্মানির বাভেরিয়ায় রাজ্যের অনেক ভবনে খ্রিষ্টানদের ধর্মীয় প্রতীক ‘ক্রস' টাঙানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী৷ তাঁর এ সিদ্ধান্ত নিয়ে চলছে তুমুল বিতর্ক৷
বিজ্ঞাপন
পহেলা জুন থেকে জার্মানির দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য বাভেরিয়ার অনেক ভবনেই শোভা পাবে ‘ক্রস'৷ সব স্কুলেও থাকবে এই প্রতীক৷ বাভেরিয়ার নবনির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী মার্কুস স্যোডার এই সিদ্ধান্ত নিয়েই বসে থাকেননি, মঙ্গলবার মিউনিখের স্টেট চ্যান্সেলারির লবিতে নিজের হাতে লাগিয়েও দিয়েছেন একটি ক্রস৷
আঙ্গেলা ম্যার্কেলের দল সিডিইউ-এর সহযোগী সংগঠন সিএসইউ-র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত স্যোডার আকস্মিক এ উদ্যোগের পক্ষে যুক্তি দেখাতে গিয়ে বলেছেন, ‘‘ এটি (ক্রস) বাভেরিয়ার পরিচয়ের স্বীকৃতি৷'' তবে এর মাধ্যমে রাজ্য প্রশাসনের ধর্মীয় নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ণ হবে কিনা এমন প্রশ্ন উঠেছে৷ স্যোডার মনে করেন, তাতে ধর্মীয় নিরপেক্ষতা অটুট থাকবে, এমনকি এর মাধ্যমে সংবিধানেরও লঙ্ঘন হবে না৷
এএফডি নেতাদের আপত্তিকর যত মন্তব্য
জার্মানির ডানপন্থি পপুলিস্ট পার্টি অল্টারনেটিভ ফর জার্মানির (এএফডি) নেতারা গত কয়েকমাস ধরে একের পর এক উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন৷ তাদের সেরকম কয়েকটি বক্তব্য এখানে তুলে ধরা হলো৷
ছবি: picture alliance/ZB/H. Schmidt
ফ্রাউকে পেট্রি
‘অবৈধভাবে জার্মানিতে প্রবেশকারী শরণার্থীদের দিকে গুলি ছোড়া উচিত জার্মানির বর্ডার পুলিশের’, বলেছিলেন এএফডি’র কো-চেয়ার৷ ২০১৬ সালে জার্মানির একটি আঞ্চলিক পত্রিকাকে তিনি জানান, পুলিশ অফিসাররা সীমান্তে অবৈধ অনুপ্রবেশ রোধে প্রয়োজনে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করতে পারে৷ সর্বশেষ সাবেক কমিউনিস্ট পূর্ব জার্মানির নেতা এরিক হ্যোনেকার এ ধরনের কথা বলেছেন৷
ছবি: Getty Images/T. Lohnes
বও্যর্ন হ্যোকে
জার্মানির থ্যুরিঙ্গা রাজ্যের এএফডির প্রধান বার্লিনের হলোকস্ট মেমোরিয়ালকে ‘মন্যুমেন্ট অফ শেইম’ আখ্যা দিয়ে জার্মানিতে নাৎসি অতীতের জন্য প্রায়শ্চিত্ত করা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন৷ গুরুত্বপূর্ণ এক নির্বাচনের বছরে এই মন্তব্য করায় তাকে বহিস্কার করার পথে যেতে বাধ্য হয়েছেন এএফডির সদস্যরা৷
ছবি: picture-alliance/Arifoto Ug/Candy Welz
আলেক্সান্ডার গাউলান্ড
এএফডির ডেপুটি চেয়ারম্যান আলেক্সান্ডার গাউলান্ড গতবছর বলেন, জার্মানির জাতীয় ফুটবল দলের রক্ষণভাগের খেলোয়াড় জ্যেরম বোয়াটেংকে তাঁর পারফর্মেন্সের জন্য অনেকে প্রশংসা করলেও, তাঁর মতো কাউকে কেউ প্রতিবেশী হিসেবে চাইবে না৷ কৃষ্ণাঙ্গ বোয়াটেংকে নিয়ে এমন মন্তব্য সমালোচনার ঝড় তোলে জার্মানিতে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Murat
বিট্রিক্স ফন স্টর্চ
প্রাথমিকভাবে এএফডি ইউরো এবং বেইলআউটের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়েছিল৷ কিন্তু পরবর্তীতে দ্রুতই শরণার্থীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় দলটি৷ ইউরোপের এই আইনপ্রণেতা বলেছেন, ‘‘যারা সীমান্তে আমাদের থামার নির্দেশ গ্রহণ করে না, তারা আক্রমণকারী৷ আর সেসব আক্রমণকারীকে প্রতিহত করতে হবে৷’’
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Murat
মার্কুস প্রেতজেল
এএফডির নর্থ রাইন-ওয়েস্টফেলিয়া রাজ্যের চেয়ারম্যান মার্কুস প্রেতজেল৷ ফ্রাউকে পেট্রির নতুন স্বামীও তিনি৷ বার্লিনে গত বছর ক্রিসমাস মার্কেটে প্রাণঘাতি হামলার পর তার মন্তব্য, ‘‘ম্যার্কেলের কারণেই প্রাণ হারিয়েছে এরা৷’’
ছবি: picture alliance/dpa/M. Murat
আন্দ্রে ভেন্ডট
স্যাক্সনি রাজ্যের সাংসদ সম্প্রতি জানতে চেয়েছেন অভিভাবকহীন অপ্রাপ্তবয়স্ক শরণার্থীর পেছনে রাষ্ট্র কতটা খরচ বহন করবে৷ তাঁর এই বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা হয়েছে৷ গত বছরের জুলাই অবধি ৫২,০০০ অভিভাবকহীন অপ্রাপ্তবয়স্ক শরণার্থী জার্মানিতে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছে৷
ছবি: picture alliance/ZB/H. Schmidt
6 ছবি1 | 6
এমনিতেই খ্রিষ্টান অধ্যূষিত রাজ্য বাভারিয়া৷ ২০১৬ সালের এক জরিপ অনুযায়ী, সেখানে মোট জনসংখ্যার শতকরা ৫০ দশমিক ৪ ভাগ রোমান ক্যাথলিক এবং ১৮ দশমিক ৮ ভাগ প্রটেস্ট্যান্ট৷ এ অবস্থায় মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে কাজ শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই স্যোডারের এই পদক্ষেপকে খ্রিষ্টানদের ধর্মানুভূতিকে কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার কৌশল হিসেবে দেখছেন অনেকে৷
ভোট আদায়ের হাতিয়ার?
চলতি বছরের শেষের দিকে বাভেরিয়ায় নির্বাচন৷ তাই স্যোডারের এই সিদ্ধান্তের কঠোর সমালোচনা করেছেন বাম দলের নেতা ইয়ান কর্টে৷ তাঁর প্রশ্ন, ‘‘সব পর্যায়ে জনগণকে বিভক্ত না করে সিএসইউ কেন কখনো সবাইকে একতাবদ্ধ করার কথা ভাবতে পারে না?'' তাঁর মতে, স্যোডারের এ সিদ্ধান্ত সংবিধান পরিপন্থি তো বটেই, এটি ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক সুবিধা আদায়েরও চেষ্টা৷
এফডিপি দলের প্রধান নেতা ক্রিস্টিয়ান লিন্ডনার স্যোডারকে তুলনা করেছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এর্দোয়ানের সঙ্গে৷ তাঁর মতে, ‘‘মার্কুস স্যোডার এবং সিএসইউ-র রাজনীতিতে ধর্ম ব্যবহারের কৌশল এর্দোয়ানের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে৷ সংবিধানের কিন্তু কোনো ধর্ম নেই!''
তবে জার্মানির প্রটেস্ট্যান্ট চার্চ ফেডারেশন (ইকেডি)-র সভাপতি হাইনরিশ বেডফোর্ড-স্ট্রোম মনে করেন, বাভেরিয়া রাজ্যের ভবনগুলোতে ক্রস টাঙানোতে দোষের কিছু নেই৷ এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে ক্রস-এর মাহাত্ম্য মনে রেখেই তা ব্যবহার করার অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি৷
বেন নাইট/এসিবি
ধর্ম ও রাষ্ট্রের মধ্যে পৃথককরণ
তৃতীয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসনের আমল থেকে ‘‘ধর্ম ও রাষ্ট্রের মধ্যে বিচ্ছেদ’’ কথাটি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে চালু৷ বিভিন্ন দেশের সংবিধানে এই সমস্যার মূল্যায়ন ও সমাধান আজও আলাদা৷ তার কিছু নমুনা৷
ছবি: Jewel Samada/AFP/Getty Images
অস্ট্রেলিয়া
কমনওয়েলথ দেশটির সংবিধানে কোনো ধর্ম প্রতিষ্ঠা বা সরকারি পদ গ্রহণের জন্য কোনো ধর্ম পরীক্ষা নিষেধ করা আছে৷ অপরদিকে যে কোনো ধর্ম মুক্তভাবে পালন করার অধিকার দেওয়া হয়েছে৷ (ছবিতে সিডনির সংসদ ভবনের উপর অস্ট্রেলিয়ার লোগো)৷
ছবি: picture-alliance/dpa/L. Coch
ব্রাজিল
ব্রাজিলের বর্তমান সংবিধানে ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে; কোনো রাষ্ট্রীয় গির্জা প্রতিষ্ঠা নিষিদ্ধ করা হয়েছে৷ সরকারি কর্মকর্তাদের ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে কোনো ধরনের ‘‘জোট গঠন বা নির্ভরতা’’ নিষিদ্ধ৷ (ছবিতে ব্রাজিলের কনগ্রেসো নাসিওনাল বা জাতীয় কংগ্রেস, যার দুই কক্ষ হলো সেনেট এবং চেম্বার অফ ডেপুটিজ)৷
ছবি: Voishmel/AFP/Getty Images
চীন
গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের সংবিধানে বলা হয়েছে, ‘‘কোনো সরকারি বিভাগ, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি নাগরিকদের কোনো ধর্মে বিশ্বাস করতে বা না করতে বাধ্য করতে পারবে না; এছাড়া যে সব নাগরিক কোনো ধর্মে বিশ্বাস করেন অথবা করেন না, তাদের বিরুদ্ধে বৈষম্য করা চলবে না৷’’ (ছবিতে বেইজিং-এর গ্রেট হল অফ দ্য পিপল, যেখানে প্রতিবছর ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেসের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়)৷
ছবি: picture-alliance/dpa/How Hwee Young
ফ্রান্স
ধর্ম ও রাষ্ট্রের বিচ্ছেদকে ফরাসিতে বলা হয় ‘লাইসিতে’৷ ফ্রান্সে ধর্ম ও রাজনৈতিক ক্ষমতাকে পরস্পরের থেকে আলাদা রাখার চেষ্টা করা হয়েছে৷ একদিকে যেমন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলিকে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ থেকে সুরক্ষিত করার চেষ্টা করা হয়েছে, অপরদিকে সরকারি ক্ষমতাকে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলির প্রভাবমুক্ত রাখার চেষ্টা করা হয়েছে৷ (ছবিতে প্যারিসের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি বা জাতীয় সম্মেলন)৷
ছবি: picture-alliance/ZB/M. Tödt
জার্মানি
জার্মান সংবিধানে ধর্মের স্বাধীনতার গ্যারান্টি দেওয়া হয়েছে, যদিও জার্মানিতে গির্জা ও রাষ্ট্রের মধ্যে পুরোপুরি বিচ্ছেদ নেই৷ সরকারিভাবে স্বীকৃত গির্জাগুলিকে পাবলিক কর্পোরেশনের মর্যাদা দেওয়া হয়, তাদের প্রাপ্য কিছু কিছু কর সরকার আদায় করে দেন – তবে বিনামূল্যে নয়৷ ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক পাঠ্য বিষয় নয়৷ (ছবিতে বার্লিনের বুন্ডেসটাগ বা জার্মান সংসদ)৷
ছবি: imago/Schöning
জাপান
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন দখলদারির সময় ধর্ম ও রাষ্ট্রের বিচ্ছেদ সংক্রান্ত মার্কিন ধ্যানধারণা জাপানে আরোপিত হয়৷ জাপানের সংবিধানে ধর্মপালনের স্বাধীনতা সুরক্ষিত করা হয়েছে, অপরদিকে সরকার ধর্মপালনের জন্য কোনোরকম চাপ দিতে পারবেন না, অথবা কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের কল্যাণে সরকারি অর্থ ব্যয় করতে পারবেন না৷ (ছবিতে টোকিও-র সংসদভবন)৷
ছবি: Reuters
সুইজারল্যান্ড
সুইশ কনফেডারেশনের ফেডারাল সংবিধানে ‘‘ধর্ম ও বিবেকের স্বাধীনতা’’-র গ্যারান্টি দেওয়া হয়েছে৷ বিশেষভাবে বলা হয়েছে যে, ‘‘কোনো ব্যক্তিকে একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ে যোগ দিতে বা অঙ্গ হতে, কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে বা ধর্মীয় নির্দেশ অনুসরণ করতে বাধ্য করা চলবে না’’৷ (ছবিতে বার্ন শহরের বুন্ডেসহাউস বা ফেডারাল প্যালেস, যেখানে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির অধিবেশন বসে)৷
ছবি: picture-alliance/dpa/P. Klaunzer
যুক্তরাজ্য
যুক্তরাজ্যের চার্চ অফ ইংল্যান্ডের প্রধান হলেন ব্রিটিশ নৃপতি স্বয়ং, তিনিই গির্জার উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের নিয়োগ করেন৷ হাউস অফ লর্ডস-এও ২৬ জন বিশপের আসন আছে৷ সব সত্ত্বেও যুক্তরাজ্যে গির্জা ও রাষ্ট্রের মধ্যে যোগাযোগ সীমিত, যুক্তরাজ্যে সরকারি শাসনও অপেক্ষাকৃতভাবে ধর্মনিরপেক্ষ৷ ব্রিটেনের অলিখিত সংবিধান অনুযায়ী অপরাপর ধর্মীয় গোষ্ঠীও ব্যাপক স্বাধীনতা উপভোগ করে৷ (ছবিতে প্যালেস অফ ওয়েস্টমিনস্টার)৷
ছবি: Mohammad Karimi
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
গির্জা ও রাষ্ট্রের বিচ্ছেদ সম্পর্কে জেফারসনের প্রখ্যাত উক্তি মার্কিন সংবিধানে উল্লিখিত নেই৷ ফার্স্ট অ্যামেন্ডমেন্টে বলা হয়েছে যে, ‘‘(মার্কিন) কংগ্রেস কোনো ধর্ম প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে, বা মুক্তভাবে ধর্মপালন নিষিদ্ধ করে কোনো আইন প্রণয়ন করবে না’’৷ (ছবিতে ক্যাপিটল হিল-এ মার্কিন কংগ্রেসের আসন)৷