যানজটের কারণে প্রতি বছর কত সময় ও অর্থের অপচয় হয়, তা সত্যি অবিশ্বাস্য৷ ভবিষ্যতে পিঁপড়ার অনুকরণে পরিবহণ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে পরিস্থিতির উন্নতির আশা করছেন বিশেষজ্ঞরা৷ তবে মানুষকেও আচরণ বদলাতে হবে৷
বিজ্ঞাপন
জার্মানির সবচেয়ে বড় শহর বার্লিনে মানুষের গন্তব্যে পৌঁছতে কত সময় লাগে? পরিবহণ বিশেষজ্ঞ প্রফেসার পেটার ভাগনার বলেন, ‘‘আমার মতে, টমটমের মতো ন্যাভিগেশন সিস্টেম এমন পরিসংখ্যান প্রস্তুত করেছে৷ সেই তথ্য অনুযায়ী বার্লিন শহরে প্রতিদিন কাজে পৌঁছতে প্রায় ৩০ শতাংশ সময় লাগে৷''
শুনতে বেশি মনে হয় না৷ কারণ বিশ্বের অন্য অনেক শহরে গন্তব্যে পৌঁছতে আরও অনেক বেশি সময় লাগে৷ এ ক্ষেত্রে তৃতীয় স্থানে রয়েছে কলম্বিয়ার রাজধানী বোগোটা৷ সারা বছরের গড় হিসেব অনুযায়ী মানুষ প্রায় ২৩০ ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকে, অর্থাৎ, প্রায় দশ দিন! ফলে মানুষ প্রায়ই মেজাজ হারায়৷ দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ভারতের বেঙ্গালুরু শহর৷ ২০১৯ সালে সেখানে মানুষ প্রায় ২৪৩ ঘণ্টা যানজটে আটকে ছিল৷ তবে এ ক্ষেত্রে ফিলিপাইন্সের ম্যানিলা শহর বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন৷ ২০১৯ সালে সেখানে মানুষ ২৫৭ ঘণ্টা যানজটের মধ্যে কাটিয়েছে৷
যানজট এড়াতে পিঁপড়াবিদ্যা
04:29
রাজপথে অপর্যাপ্ত জায়গায় অতিরিক্ত সংখ্যার স্বার্থপর চালকের সমাগম হলে এমনটা হবেই৷ অথচ পিঁপড়াদের হাইওয়েও দেখতে বেশ ঘিঞ্জি লাগে৷ এই প্রাণী কীভাবে যানজট এড়িয়ে সচল থাকে? বার্লিনের অ্যান্টস্টোর দোকানের মালিক মার্টিন সেবাস্টা বলেন, ‘‘পিপড়া শরীরের পেছনে গন্ধযুক্ত গ্রন্থি থেকে গন্ধ বার করে পরস্পরের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করে৷ সেই গন্ধের মিশ্রণের মাধ্যমে তথ্য সরবরাহ করে৷ যেমন বিপদ বা খাবার দেখলে খবর রটে যায়৷''
যানজট বিশেষজ্ঞ মিশায়েল শ্রেকেনব্যার্গ মানুষ ও পিঁপড়ার মধ্যে পার্থক্য তুলে ধরে বলেন, ‘‘পিঁপড়া সমাজের জন্য কাজ করে৷ তারা ‘সিস্টেম অপ্টিমাম' চায়৷ কাজের স্বার্থে এমন প্রবাহ সৃষ্টি করতে চায়, যা কোনো পিঁপড়ে এককভাবে থামাতে না পারে৷ পিঁপড়ার কাছ থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি৷ তবে আমার মতে, মানুষকে পিঁপড়ার মতো আচরণ শেখানো সম্ভব নয়৷''
পিঁপড়া সত্যি সমাজবদ্ধ জীব৷ এই প্রাণী পরিবেশ অনুযায়ী নিজেদের মানিয়ে নেয়৷ মানুষ হিসেবে আমরা পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ না করে বরং পরস্পরের বিরুদ্ধে কলকাঠি নাড়ি৷ ফলে শুধু সময় নয়, বিশাল অংকের অর্থেরও অপচয় ঘটে৷ এর উদাহরণ তুলে ধরে মিশায়েল শ্রেকেনব্যার্গ বলেন, ‘‘ধরা যাক, একটি ট্রাফিক জ্যামের ভেতরে গাড়ির গতি ঘণ্টায় দশ কিলোমিটার৷ দুই লেনের হাইওয়েতে দশ কিলোমিটার দীর্ঘ যানজটে তিন ঘণ্টা আটকে থাকতে হলো৷ অথবা চার কিলোমিটার জ্যামে দুটি লেনে তিন ঘণ্টা থমকে গেলাম৷ গতিবেগ আশির বদলে ঘণ্টায় মাত্র দশ কিলোমিটার সম্ভব হলো৷ এবার অংক করলে দেখা যাবে, সব চালকের সময় নষ্ট হবার পাশাপাশি ৫০,০০০ থেকে এক লাখ ইউরো লোকসান হলো৷ গোটা জার্মানির জন্য অংক করে দেখেছি, যে বছরে ৬,০০০ থেকে ১০,০০০ কোটি ইউরো নষ্ট হতে পারে৷ জ্যামে আটকে থাকলে গড়ে ৮,০০০ কোটি ইউরো নষ্ট হয়৷ অতএব শুধু সময়ই নষ্ট হয় না৷''
যানজটকেও আনন্দময় করবেন যেভাবে
গ্রীষ্মের ছুটিতে বহু জার্মান পরিবার গাড়িতে করে ছুটি কাটাতে যায়৷ ছুটির সময় গাড়িতে ভ্রমন মানে রাস্তায় প্রচণ্ড যানজট৷ তা সত্ত্বেও ভ্রমনকে আনন্দময় করার উপায় জেনে নিন৷
ছবি: picture-alliance/PhotoAlto/S. Olsson
আরাম করে রওনা দিন
তাড়াতাড়ি রওনা দিতে হবে, তা না হলে ছুটি থেকে একটা দিন নষ্ট হবে-এরকম ধারণা অনেকেরই৷ এক্ষেত্রে সরকারি ছুটির আগের দিন বিকেল বা ছুটির দিন সকালে নয়৷ ধীরে সুস্থে আরাম করে এক কর্মদিবসে রওনা দিন, অনেকটাই স্ট্রেসমুক্ত থাকবেন৷
ছবি: picture-alliance/Joker/M. Gloger
মানসিক চাপ
কন্টিনেন্টাল মবিলিটি সমীক্ষা ২০১৮ - এর করা এক সমীক্ষা জানায়, জার্মানদের দুই তৃতীয়াংশ মানুষ যানজটের কারণে মানসিক চাপ বোধ করেন৷
ছবি: bilderbox
সঠিক সময়
পাঁচ কোটি ৭০ লাখ যান জার্মানির রাস্তায় চলাচল করে, কাজেই কর্মস্থলে যাতায়াতের সময় বাদ দিয়ে অন্য সময় বেছে নিন, একথা বলেন জার্মানি যান চলাচল বিষয়ক মনোবিজ্ঞানী ইভেটে ওরল্ভস্কি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S. Gollnow
রাস্তা মেরামত
এই গ্রীষ্মে গড়ে জার্মানির ৫৪০টি রাস্তায় মেরামতের কাজ হচ্ছে, নির্ধারিত সময়ে বেশি লাগতেই পারে৷ সেক্ষেত্রে নেভিগেটারের সাহায্য নিন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Dedert
পরিবারের সাথে সময় উপভোগ করুন
নির্ধারিত সময়ে বেশি লাগতেই পারে, সেসময়ে কোথাও বসে খাওয়া-দাওয়া করতে পারেন কিংবা কাছাকাছি কোনো মিউজিয়াম বা সুন্দর কোনো জায়গায় বসে বাচ্চাদের নিয়ে কিছুক্ষণ আনন্দ করতে পারেন৷ ভ্রমনের দিনটিকেও ছুটি ভেবে পরিবার নিয়ে হৈ হুল্লোড় করুন৷ শুধু শুধু স্ট্রেস কেন ?
ছবি: picture alliance/zb/Hans Wiedl
খাবার বক্স
লম্বা ভ্রমনে খাবার বক্স কখনো গাড়ির পেছনে ট্রাঙ্কে না রেখে বরং পেছনের সিটে বা পায়ের কাছে রাখুন৷ কারণ খাওয়া শুধু নার্ভকেই শান্ত রাখেনা , খাবার চিবানো মস্তিষ্ককেও সচল রাখে৷
ছবি: Colourbox/PetraD
গাড়িতেও পিকনিকের আনন্দ
প্রতি ৯০ মিনিটে গাড়ির চালক বদলান অর্থাৎ মা-বাবার মধ্যে ভাগাভিগি করে নিন৷ তাছাড়া গাড়িতে ওঠার আগে বাচ্চাদের প্রিয় খেলনা, বই, ম্যাগাজিন, কম্বল, পছন্দের গান গাড়িতে তুলতে ভুলবেন না৷
ছবি: picture-alliance/JOKER
7 ছবি1 | 7
প্রশ্ন হলো, পিঁপড়ার কাছ থেকে আমরা কী নকল করতে পারি? মিশায়েল শ্রেকেনব্যার্গ মনে করেন, ‘‘ভবিষ্যতে স্বয়ংক্রিয় প্রণালী পিঁপড়ার আচরণ নকল করতে পারবে৷ সেটাই আশার আলো দেখাচ্ছে৷ তখন আজকের তুলনায় পরিবহণ ব্যবস্থার ধারণ ক্ষমতা আরও অনেক বেড়ে যাবে৷''
পিঁপড়ার ক্ষমতা অনুকরণ করে সম্ভবত অদূর ভবিষ্যতে প্রযুক্তি আমাদের আরও ভালোভাবে পরিবহণ ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাবে এবং আমাদের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করবে৷ তবে শেষ পর্যন্ত আমাদের মনোভাবের উপরেও সবকিছু নির্ভর করবে৷ গাড়ি চালানোর সময়ে সংকীর্ণ স্বার্থের বদলে সহযোগিতাকে আরো বেশি প্রাধান্য দিতে হবে৷ যেমন পারিপার্শ্বিক অনুযায়ী গতি নির্ধারণ করলে আচমকা ব্রেক কষতে হবে না৷ একমাত্র এভাবেই ভবিষ্যতে অনেক সময় ও অর্থ সাশ্রয় করা সম্ভব হবে৷
ভয়াবহ যানজটের আটটি শহর
৩৮টি দেশের ১ হাজার ৬৪টি শহরের অবস্থা পর্যালোচনা করে বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ যানজটের শহরের তালিকা করেছে ইনট্রিক্স৷ সেই তালিকায় অ্যামেরিকা আর ইউরোপের শহরই বেশি৷
ছবি: picture alliance/dpa/W.Lei
সবচেয়ে ভয়াবহ যানজটের শহর
ট্রাফিক বিশ্লেষণ করাই ইন্ট্রিক্সের কাজ৷ এবার সে কাজ করতে গিয়ে তারা দেখেছে, অফিস শুরু আর শেষের সময়টায় ট্রাফিক পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ থাকে যুক্তরাষ্ট্রের লস এঞ্জেলেসে৷ পরিসংখ্যান বলছে, সেখানকার গাড়িচালকদের প্রতি বছর পিক আওয়ারে অন্তত ১০৪ ঘণ্টা গাড়িতে বসে থাকতে হয়৷
ছবি: picture-alliance/Frank Duenzl
দ্বিতীয় স্থানে মস্কো
মস্কোর গাড়িচালকদের বছরে পিক আওয়ারে অন্তত ৯১ ঘণ্টা বসে থাকতে হয় গাড়িতে৷
ছবি: Getty Images/Y.Kadobnov
নিউ ইয়র্কও কম যায় না
যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কেও বলতে গেলে সারা বছরই পিক আওয়ারে যানজট লেগে থাকে৷ সেখানে বছরে কমপক্ষে ৮৯ ঘণ্টা যানজটের কারণে গাড়িতেই বসে থাকতে হয় চালকদের৷
ছবি: picture alliance/dpa/blickwinkel
যুক্তরাষ্ট্রের আরেক শহর
সান ফ্রান্সিসকোর গোল্ডেন গেট ব্রিজ এলাকায় পিক আওয়ারে গাড়ি যেন চলতেই চায় না৷ আর সারা শহরে যানজটের কারণে প্রতি বছর প্রত্যেক চালকের অন্তত ১৪শ ডলারের ক্ষতি হয়৷ সব চালকের ক্ষতি যোগ করলে যোগফলটা ৩০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে৷
ছবি: Getty Images/J.Sullivan
ব্রাজিলের সাও পাওলো
তালিকায় পঞ্চম স্থানে আছে ব্রাজিলের সাও পাওলো৷ সেই শহরে বছর কমপক্ষে ৭৭ ঘণ্টা জ্যামের কারণে চালকদের গাড়িতেই বসে থাকতে হয়৷
ছবি: picture alliance/dpa/C.Faga
লন্ডন
ইউরোপের যে দেশগুলোতে ট্রাফিক জ্যামের দুর্ভোগ সবচেয়ে বেশি, ইংল্যান্ড তার অন্যতম৷ ইউরোপের সবচেয়ে ভয়াবহ ট্রাফিক জ্যামের তিনটি দেশের একটি ইংল্যান্ড৷ ইংল্যান্ডের শহরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি যানজট থাকে লন্ডনে৷ সেখানে বেশি ট্রাফিক জ্যাম হয় নাকি উইন্ডো শপিংয়ের কারণে৷
ছবি: Getty Images/S.Barbour
চীন, জাপান নেই কেন?
ইনট্রিক্স চীন এবং জাপানসহ এশিয়ার বেশ কিছু দেশের যানজট পরিস্থিতি বিশ্লেষন করেনি৷ সে কারণে তালিকায় চীন, জাপানসহ এশিয়ার অনেক দেশই নেই ৷ বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাও হয়ত সে কারণেই তালিকার বাইরে৷
ছবি: picture alliance/dpa/W.Lei
আফ্রিকাও বাদ
আফ্রিকার বেশির ভাগ দেশেই যানজট নিত্যদিনের ব্যাপার৷ তারপরও তালিকায় আফ্রিকার কোনো শহরের নাম আসেনি, কারণ, ইন্ট্রিক্স এখনো ওই মহাদেশ নিয়ে কাজ শুরু করেনি৷