তুরস্কের রেচেপ তাইয়েপ এর্দোয়ান- কি নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় আসবেন নাকি প্রেসিডেন্ট পদে বিরোধী প্রার্থী কিরিচদারোলুর ? এই প্রশ্নই এখন সবার মনে ঘুরপাক খাচ্ছে৷
বিজ্ঞাপন
তুর্কি ভোটাররা প্রেসিডেন্ট এমন একটা সময়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন, যার তিন মাস আগেই ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পে তছনছ হয়ে গিয়েছিল দেশ৷
বিভিন্ন জরিপে বিরোধী প্রার্থী ধর্মনিরপেক্ষ রিপাবলিকান পিপলস পার্টির নেতা (সিএইচপি) কেমাল কিরিচদারোলু বর্তমান প্রেসিডেন্ট এর্দোয়ানের থেকে সামান্য এগিয়ে রয়েছেন৷
মূল লড়াইটা হচ্ছে পিপলস অ্যালায়েন্স যাতে রয়েছে এর্দোয়ানের ইসলামপন্থি রক্ষণশীল একে পার্টি, ন্যাশনালিস্ট এমএইচপি এবং অন্য কয়েকটি দল৷ অন্যদিকে, কিরিচদারোলুর জোটে রয়েছে তুরস্কের প্রবাদপ্রতিম নেতা মুস্তাফা কামাল আতাতুর্ক প্রতিষ্ঠিত ধর্মনিরপেক্ষ রিপাবলিকান পিপলস পার্টিসহ ছয়টি দলের জোট৷
প্রেসিডেন্ট এবং সংসদ উভয়ই পাঁচ বছরের মেয়াদের জন্য নির্বাচিত করা হবে৷ প্রথম রাউন্ডে প্রেসিডেন্ট পদে জিততে হলে প্রার্থীকে প্রাপ্ত ব্যালটের ৫০ ভাগের বেশি ভোট পেতে হবে৷ যদি কোনো প্রার্থী তা অর্জন না করে, তাহলে ২৮ মে দুই নেতৃস্থানীয় মধ্যে একটি রানঅফ অনুষ্ঠিত হবে৷
প্রায় ৬ দশমিক ৮ কোটির বেশি তুর্কি ভোটার এক লাখ ৯২ হাজার ভোটকেন্দ্রে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করছেন৷ ৬০ লাখেরও বেশি ব্যক্তি প্রথমবারের মতো ভোট দিচ্ছেন৷ বিদেশে ভোটার রয়েছে ৩৪ লাখ৷
তুরস্কের নির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ৷ ২০১৮ সালে প্রায় ৮৭ ভাগ ভোট দিয়েছিলেন৷ নির্বাচনের দিন তুরস্কে মদ বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে৷
বেশিরভাগ জার্মান কিরিচদারোলুকেচায়
একটি সমীক্ষা বলছে, জার্মানির দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ বলছেন, দুই দশক ক্ষমতায় থাকার পর তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এর্দোয়ানকে আর এই পদে দেখতে চান না৷
গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইউগভের দেশব্যাপী সমীক্ষায় জিজ্ঞাসা করা হয়েছে- ‘আগামী রোববার, তুরস্কে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে৷ আপনি কি প্রেসিডেন্ট এর্দোয়ানকে পুনরায় নির্বাচিত বা দেখতে চান নাকি এর্দোয়ানের ক্ষমতাচ্যুত হওয়া দেখতে চান?'
প্রায় ৭০ ভাগ উত্তরদাতারা বলেছিলেন, এর্দোয়ানের সরে যাওয়া উচিত৷ ১০ ভাগ ভেবেছিল ইসলামপন্থি এই নেতার থাকা উচিত৷ অন্য ২০ ভাগ বলেছেন যে ,তারা জানেন না বা কোন উত্তর দেননি৷
জার্মানিতে প্রায় ১৫ লাখ নিবন্ধিত তুর্কি ভোটার রয়েছে, তারা ভোটে অংশগ্রহণকারী বৃহত্তম প্রবাসী৷ যদিও এর্দোয়ান এবং তার একেপি পার্টির সমর্থকরা প্রায়ই জার্মানিতে বিতর্ক তৈরি করেছে৷ কিন্তু তুরস্কের এই নেতার পক্ষে বিশাল সমর্থন রয়েছে৷
জার্মান বুন্দেসটাগের পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান মাইকেল রথ বলেছেন, দুই দশক পর গণতান্ত্রিকভাবে এর্দোয়ানকে ক্ষমতা থেকে সরানোর জন্য বিরোধীদের জন্য ‘সম্ভবত শেষ সুযোগ' এই নির্বাচন৷
রথ জার্মান মিডিয়া গ্রুপ আরএনডিকে বলেছেন, নির্বাচন খুব সম্ভবত সুষ্ঠু হবে না৷ এর্দোয়ান এবং তার সমর্থকরা গণতন্ত্র, নির্বাচন কমিশন এবং বিচারবিভাগের উপর তাদের দখল বজায় রেখেছে৷
রথ বলেছেন, রাশিয়া বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণার মাধ্যমে এর্দোয়ান-বিরোধীদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে৷
রথ জানান, ‘‘দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং আর্থিক পরিস্থিতি ধ্বংসাত্মক অবস্থায় রয়েছে৷''
তুরস্কের রেচেপ তাইয়েপ এর্দোয়ান কে?
ইসলামপন্থি তরুণ অ্যাক্টিভিস্ট থেকে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট– রাজনীতিতে নিজের ক্যারিয়ার ভালোভাবেই গড়েছেন রেচেপ তাইয়েপ এর্দোয়ান৷ তবে রাজনৈতিক জীবনে বহুবার বিতর্কে জড়িয়েছেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/E. Morenatti
এর্দোয়ানের উত্থান
তুরস্কে এবং বিদেশে রেচেপ তাইয়েপ এর্দোয়ান সম্পর্কে নানা ধরনের মতামত রয়েছে৷ তাঁকে নব্য-অটোমান ‘সুলতান’ হিসেবে যেমন বিবেচনা করা হয়, তেমনি কারো কারো চোখে তিনি একজন স্বৈরাচারী নেতা৷ রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই ইসলামপন্থিদের বিভিন্ন দাবিদাওয়ার ব্যাপারে সচেতন ছিলেন তিনি৷ পাশাপাশি ন্যাটোতে তাঁর নেতৃত্বে বড় ধরনের অবদান রাখছে তুরস্ক৷ এর্দোয়ানের উত্থান নিয়ে এই ছবিঘর৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/E. Morenatti
ইস্তানবুলের কারাবন্দি মেয়র
তুরস্কে ইসলামপন্থিদের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত দল ওয়েলফেয়ার পার্টিতে নিজের অবস্থান দ্রুতই পাকাপোক্ত করেছিলেন এর্দোয়ান৷ ১৯৯৪ সালে তিনি সেই দল থেকে ইস্তানবুলের মেয়রও নির্বাচিত হন৷ কিন্তু এর্দোয়ান মেয়র হওয়ার চার বছরের মাথায় সেই দলটিকে সে দেশের সরকার তুরস্কের ধর্মনিরপেক্ষ নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় ঘোষণা দিয়ে নিষিদ্ধ করে৷ এরপর জনসমক্ষে বিতর্কিত কবিতা আবৃত্তির দায়ে জেলে যান এর্দোয়ান৷ চার মাস জেল খাটেন৷
তুরস্কের একেপি পার্টির সহপ্রতিষ্ঠাতা এর্দোয়ান৷ ২০০২ সালের নির্বাচনে দলটি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করে৷ আর ২০০৩ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রী হন৷ দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম বছরগুলোতে এর্দোয়ান দেশবাসীকে সামাজিক সুযোগ-সুবিধা প্রদান, অর্থনীতির উন্নয়ন এবং বিভিন্ন গণতান্ত্রিক সংস্কারের দিকে মনোযোগী হন৷ তবে কেউ কেউ এটাও মনে করেন যে, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি রাজনীতিতে ধর্মের মিশ্রণ ঘটানোয় ভূমিকা রেখেছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/B. Ozbilici
ইসলামপন্থিদের স্বার্থ রক্ষা
যদিও তুরস্কের সংবিধান দেশটির ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থানকে সমর্থন করে, তারপরও এর্দোয়ান কট্টর ইসলামপন্থিদের মন জয়ের নানা চেষ্টা করেছেন৷ তুরস্কের এই শীর্ষনেতা একসময় বলেছিলেন যে, তাঁর লক্ষ্যগুলোর একটি হচ্ছে এক ‘ধার্মিক প্রজন্ম’ গড়ে তোলা৷ এর্দোয়ানের সমর্থকরা এই লক্ষ্যের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন, কেননা, তাঁরা মনে করেন, ধর্মচর্চা করা মুসলমানরা তুরস্কে নানাভাবে বঞ্চিত হচ্ছিল৷
ছবি: picture-alliance/AA/C. Ozdel
ক্যু থেকে রক্ষা
২০১৬ সালের জুলাইয়ে এর্দোয়ানের বিরুদ্ধে সে দেশের সেনাবাহিনীর এক অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়৷ তবে সেই ঘটনায় দু’শ’র বেশি বেসামরিক নাগরিক এবং সেনা সদস্য নিহত হন৷ সেই ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানের পর এর্দোয়ান আরো ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠেন এবং জরুরি অবস্থা ঘোষণার পাশাপাশি সেনাবাহিনীতে ‘শুদ্ধি অভিযান’ শুরু করেন৷
ছবি: picture-alliance/AA/K. Ozer
দেশজুড়ে অভিযান
ব্যর্থ সেই সেনা অভ্যুত্থানের পর দেশজুড়ে অভিযান পরিচালনা করে তুর্কি কর্তৃপক্ষ৷ এতে সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিচার ব্যবস্থা, স্কুল এবং গণমাধ্যম থেকে পঞ্চাশ হাজারের বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ এর্দোয়ান সেই সেনা অভ্যুত্থানের পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসিত ধর্মীয় নেতা এবং তাঁর প্রাক্তন সঙ্গী ফেতুল্লাহ গুলেনের হাত রয়েছে বলে দাবি করেন৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/E. Gurel
বিভেদ সৃষ্টিকারী রাজনীতিবিদ
যদিও নিজের দেশে এবং বিদেশে বসবাসরত তুর্কিদের একটি বড় অংশের সমর্থন রয়েছে এর্দোয়ানের প্রতি, তা সত্ত্বেও তিনি তাঁর কঠোর নীতি এবং কুর্দিদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালানোয় কড়া সমালোচনার মুখে পড়েছেন৷ চলতি বছরের জানুয়ারিতে আফরিনে মারাত্মক আক্রমণ পরিচালনা করেন এর্দোয়ান, যার সমালোচনা করে মানবাধিকা সংস্থাগুলো৷
ছবি: picture- alliance/ZUMAPRESS/Brais G. Rouco
ব্যাপক ক্ষমতাধর
২০১৭ সালে এক গণভোটের মাধ্যমে দেশটির সংবিধান সংশোধন করা হয়৷ সংসদীয় গণতন্ত্র থেকে রাষ্ট্রপতি শাসিত প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয় তুরস্ক৷ ২০১৮ সালের ২৪ জুন নতুন করে ৫ বছরের জন্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তিনি৷ দেশটির ইতিহাসে এতো ক্ষমতাবান প্রেসিডেন্ট এর আগে আসেননি৷ শপথ নেয়ার দিন নিজের জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি- একেপির সদস্যদের এর্দোয়ান বলেন, ‘তুরস্ক নতুন যুগে প্রবেশ করেছে’৷