একটি জাতি কেমন ভবিষ্যৎ চায়,তার শুরুর বিন্দু এই প্রাথমিক বিদ্যায়তন। যদিও আমাদের দেশে সমন্বিত কোনো শিক্ষা মাধ্যম নেই এবং এ কারণে প্রাথমিকভাবে শিশুর যাত্রা শুরু হয় চূড়ান্ত গন্তব্যহীন।
বিজ্ঞাপন
পরিবারকে বলা হয় শিশুর প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্র। প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্র থেকে শিশুর প্রথম সামাজিক সংশ্লিষ্টতা শুরু হয়, মনে করেন রুমা মোদকছবি: Salim/Xinhua/picture alliance
মানুষ প্রতিদিন নিজেকে গড়ে আগামীর জন্য। প্রতিটি 'আগামীকাল' মানুষের 'আজ' হয়,এই বর্তমানেই মানুষ বাঁচে। আমাদের মতো রাষ্ট্রে, যেখানে রাষ্ট্র আমাদের খাদ্য-বাসস্থান-স্বাস্থ্য-শিক্ষা কোনো কিছুরই দায়িত্ব নেয় না, সেখানে সুনাগরিক আশা করে রাষ্ট্র গঠনের জন্য।রাষ্ট্রের একজন সুনাগরিক প্রথমত পরিবারের সম্পদ, দ্বিতীয়ত সমাজের সম্পদ, তৃতীয়ত রাষ্ট্রের সম্পদ। এই যে পরিবার,সমাজ এবং রাষ্ট্র - কোনোটিই কোনোটি থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। কোনো একটিকে যোগ্যতর করে তুললেই চলে না। বরং প্রতিটি ক্ষেত্রেই সেই যোগ্যতরের স্বীকৃতি এবং প্রাপ্য নিশ্চিত হতে হয়। এবং যোগ্যতর হয়ে গড়ে ওঠাও কোনো একক প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সম্ভব নয়।
স্বাধীনতার চুয়ান্ন বছর অতিক্রান্ত হলেও এখনো আমরা আমাদের শিক্ষানীতি এবং চূড়ান্ত কাঙ্ক্ষিত অর্জন কী হতে পারে তা নিশ্চিত করতে পারিনি। একটি দেশে একাধিক শিক্ষাক্রম একই সমান্তরালে চলছে বছরের পর বছর। যেখানে এই শিক্ষাক্রমগুলির মান এবং ধারা একটির সাথে আরেকটি কোনোভাবেই ইভালুয়েশন সম্ভব নয়। অথচ কর্মক্ষেত্রে আমরা তাদের ঠেলে দিচ্ছি একই রকম প্রতিযোগিতার দিকে। ফলে যোগ্যতা বা মেধার চেয়ে সাফল্য কিংবা অর্জনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে সুযোগ। যে সমাজে সুযোগ হয়ে ওঠে সাফল্যের নিয়ামক, সেখানে অনৈতিকতাকে আটকানোর কোনো উপায় থাকে না। যেন-তেনভাবে সুযোগ নেয়ার প্রবণতা একটি জাতির মূল্যবোধ ও নৈতিকতা নষ্ট করার জন্য যথেষ্ট।
ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি সংগীত শেখায় সমস্যা কোথায়?
সংগীত শিক্ষকের বদলে আরো ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগের দাবি জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রর মতে, এটি বিদ্বেষ ছড়ানোর চেষ্টা। ডয়চে ভেলেকে তাদের মতামত জানালেন বিভিন্ন মানুষ৷
ছবি: Imago/epd
পিছিয়ে নেওয়ার একটা চেষ্টা: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, এমিরেটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
খুবই দুঃখজনক ও অপ্রত্যাশিত। সংগীত শিক্ষা তো সংস্কৃতি চর্চার অংশ। বিদ্যালয়ে সংস্কৃতি চর্চা হওয়া অত্যান্ত প্রয়োজনীয়। আমরা যে জায়গায় পৌঁছেছিলাম, সেখান থেকে পিছিয়ে নেওয়ার একটা চেষ্টা হচ্ছে। এটা মোটেই গ্রহণযোগ্য না। এটা নিয়ে বিতর্ক তৈরি করা হলে শিক্ষার অগ্রগতিকেই ব্যহত করা হবে।
ছবি: Sirajul Islam Chowdhury
সংগীতকে ধর্মের মুখোমুখি দাঁড় করানোর চেষ্টা হচ্ছে: রাশেদা কে চৌধুরী, উপদেষ্টা, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার
সংগীতকে ধর্মের মুখোমুখি দাঁড় করানোর একটা চেষ্টা হচ্ছে। যারা সংগীত বাদ দিয়ে ধর্ম শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার দাবি করছে, তারা আসলে চাইতে পারতেন সংগীতের পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষকও নিয়োগ দেওয়া হোক। যেখানে ধর্মীয় শিক্ষক নেই, সেগুলো দ্রুত পূরণ করা হোক। তা না করে শুধুমাত্র বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা করা হচ্ছে। এতে শিক্ষা ব্যবস্থাই পিছিয়ে যাবে। সংগীত একটা বাচ্চার বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে তার জীবন গঠনে ভূমিকা রাখে।
ছবি: bdnews24.com
প্রতিটি স্কুলে সংগীত শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে: অ্যাডভোকেট সালমা আলী, উপদেষ্টা, মহিলা আইনজীবী সমিতি
প্রতিটি স্কুলে সংগীত শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কিন্তু ছোট বাচ্চারা তো পরিবার থেকেই ধর্ম শিক্ষা পায়। তাই বরং সব স্কুলে ধর্মীয় শিক্ষকের প্রয়োজন নেই। যেখানে স্কুলে ধর্ম শিক্ষা তুলে দেওয়ার দাবি ওঠার কথা, সেখানে সংগীত শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার বিরোধিতা করা হচ্ছে। আমি মনে করি, শিশুর বিকাশের জন্য অবশ্যই সংগীত শিক্ষা থাকতে হবে। প্রতিটি বিদ্যালয়ে সংগীতের শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে।
ছবি: privat
বিরোধিতাকারীরা কূপমণ্ডুকতা করছে: শিরিন হক, নারী সংস্কার কমিশনের প্রধান
সরকার সংগীতের শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার যে উদ্যোগ নিয়েছে তাকে আমি স্বাগত জানাই। গ্রামের স্কুলগুলোতে তো গরিব শিক্ষার্থীরা সংস্কৃতি চর্চার বাইরে থাকে। যারা বিরোধিতা করছে, তারা কূপমণ্ডুকতা করছে। মানুষের জীবনে ধর্মীয় শিক্ষার যেমন প্রয়োজন আছে, তেমনি সংস্কৃতি চর্চারও প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু সঙ্গীত শিক্ষক নিয়োগের বিরোধিতা করে ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগের যে দাবি করা হচ্ছে, সেটা একেবারেই অমূলক।
ছবি: Shirin Parvin Haque
সমাজকে পিছনে নিয়ে যাওয়ার ষড়যন্ত্র: ডা. ফওজিয়া মোসলেম, সভাপতি, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ
আমি নিজেই একটি স্কুল কমিটির দায়িত্বে আছি। সেখানে আমি দেখেছি, ধর্মীয় শিক্ষকের পোস্ট সেখানে আছে, সংগীত শিক্ষকের পোস্টও আছে। সংগীত শিক্ষার সঙ্গে ধর্মীয় শিক্ষার কোনো বিরোধ নেই। বরং সংগীত শিক্ষা না থাকাটা সমাজকে অনেক পিছিয়ে নিয়ে যাবে। সমাজকে সামনে নিতে সংগীতের চর্চাটা খুবই দরকার। যারা এর বিরোধিতা করছেন, তারা অত্যন্ত অন্যায়ভাবে বিরোধিতা করছেন। সমাজকে পিছনে নিয়ে যাওয়ার একটা ষড়যন্ত্র বলে আমি মনে করি।
ছবি: DW
সংগীতের পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষক থাকা উচিত: মাইনুল হাসান সোহেল, সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি
বাংলা, অংক ও ইংরেজির মতো মৌলিক শিক্ষায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বেশ দুর্বল। এটা নিয়ে কোনো কথা হচ্ছে না। সরকারের উচিত, প্রাথমিক স্তরে সংগীতের পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগসহ মৌলিক শিক্ষার মান বাড়াতে সংশ্লিষ্ট দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার ব্যবস্থা করা।
ছবি: Private
‘সংগীত শিক্ষক নিয়োগ বাতিল’ করতে হবে এমন দাবি জবরদখলী সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশ: জাবির আহমেদ জুবেল, সাধারণ সম্পাদক, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী
সারা বিশ্বেই প্রাথমিকে শিশুকে সংগীতসহ ললিতকলায় পারদর্শী করে তোলায় গুরুত্ব আরোপ করা হয়। বাংলাদেশে যখন প্রাথমিক শিক্ষায় এমন উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে, তখন ধর্মকে সামনে নিয়ে এসে ধর্মীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ যে বিরোধিতা করছেন, তা অবান্তর। সকল ধর্মের ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগ হতেই পারে, কিন্তু ‘সংগীত শিক্ষক নিয়োগ বাতিল’ করতে হবে এমন দাবি শুধু অযৌক্তিকই নয়, বরং জবরদখলী সংস্কৃতিরই বহিঃপ্রকাশ।
ছবি: Privat
সংস্কৃতি একটি জাতির অস্তিত্ব ও আত্মার প্রকাশ: তাকিম শেখ, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলো মুক্তচিন্তার জায়গা, যেখানে একজন শিশু স্বাধীনভাবে বেড়ে উঠবে। সেখানে ধর্মীয় শিক্ষা থাকবে, যার মাধ্যমে একজন শিশু ধর্মীয় মূল্যবোধ, ধর্মীয় জ্ঞান, আচার-আচরণ শিখবে। আবার সেখানে বাঙালি সংস্কৃতির চর্চাও থাকবে। বাঙালির হাজার বছরের কৃষ্টি, লোকসংগীত, নৃত্য, বাউল, ভাটিয়ালি, জারি-সারি, যাত্রাপালা যা নদীমাতৃক এই দেশের মানুষের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।
ছবি: Privat
সংস্কৃতি চর্চার গুরুত্ব থাকলেও ধর্মের অনুসারীদের মতামত উপেক্ষা করা হচ্ছে: মুহাম্মদ মুঈনুদ্দিন গাউছ, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ধর্মীয় অভিজ্ঞ শিক্ষক নিয়োগ অপরিহার্য। অথচ ধর্মীয় শিক্ষকের ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও সংগীত শিক্ষক নিয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। সংস্কৃতি চর্চার গুরুত্ব থাকলেও দেশের নব্বই ভাগ মানুষ যে ধর্মের অনুসারী, তাদের মতামত উপেক্ষা করা হচ্ছে। এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হোক, যা সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মের অনুসারীদের বিপরীতে গিয়ে দেশে নতুন সমস্যা তৈরি না করে।
শুধু ধর্মীয় বা নৈতিক মূল্যবোধ নয়, বরং সাংস্কৃতিক ও সৃজনশীল জগত সম্পর্কেও জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। ধর্ম শিক্ষকেরা যেমন নৈতিক ও আধ্যাত্মিক দিক গড়ে দেন, তেমনি সংগীত শিক্ষক শিক্ষার্থীর শিল্প-সংবেদন ও সৃজনশীলতাকে বিকশিত করতে পারেন। তাই আমি মনে করি, ধর্ম শিক্ষার ক্ষেত্রে যেমন কাউকে বাধা দেওয়া উচিত না, তেমনি যে সংগীত শিখতে চায়, তাকেও সেই সুযোগ করে দেওয়া উচিত।
ছবি: privat
যদি নতুন কোনো জ্ঞান অর্জন সম্ভব হয়, তাহলে কেন নয়: হোমায়রা আশরাফ অর্নি, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যায়েই একজন শিক্ষার্থীর আসল বিকাশ ঘটে, আপনি বাচ্চাকে যা শেখাচ্ছেন পরবর্তীতে তা নিয়েই তার আগ্রহ বাড়বে, সেই বিষয়ে কাজ করবে। আমার মতে, এই বয়সে সকল কিছু সম্পর্কে শিক্ষার্থীর ধারণা থাকা দরকার। ধর্মীয় শিক্ষক প্রতি বিদ্যালয়েই রয়েছে, যদি নতুন কোনো জ্ঞান অর্জন সম্ভব হয়, তাহলে কেন নয়?
ছবি: privat
11 ছবি1 | 11
পরিবারকে বলা হয় শিশুর প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্র।প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্র থেকে শিশুর প্রথম সামাজিক সংশ্লিষ্টতা শুরু হয়। একটি জাতি কেমন ভবিষ্যৎ চায়, কিংবা ভবিষ্যৎ কেমন হবে তার শুরুর বিন্দু এই প্রাথমিক বিদ্যায়তন। যদিও আমাদের দেশে সমন্বিত কোনো শিক্ষা মাধ্যম নেই এবং এ কারণে প্রাথমিকভাবে শিশুর যাত্রা শুরু হয় চূড়ান্ত গন্তব্যহীন।
ধর্মীয় শিক্ষাকেন্দ্রিক মাদ্রাসা শিক্ষা, ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষা, কিন্ডারগার্টেন শিক্ষা- এই তিন শিক্ষা মাধ্যমের বাইরে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। কিন্ডারগার্টেন শিক্ষা ছাড়া বাকি দুটি মাধ্যমের শিক্ষাক্রম সুনির্দিষ্ট। এ দেশে কিন্ডারগার্টেন নামে যে শিক্ষাক্রম, তা একটি হযবরল শিক্ষাক্রম, ব্যাবসায়িক উদ্দেশ্য ছাড়া এর কোনো দৃশ্যমান গন্তব্য সুনির্দিষ্ট করা যায় না। ব্যবসার উদ্দেশ্যে শিশুশিক্ষার এই মাধ্যমটি প্রয়োজনে গান-বাজনার উপর গুরুত্ব দেয়, প্রয়োজনে ধর্মীয় শিক্ষার উপর গুরুত্ব দেয়,প্রয়োজনে ইংরেজি শিক্ষার উপর গুরুত্ব দেয়। রাষ্ট্রের শতভাগ নিয়ন্ত্রণ এদের উপরে নেই। ব্যক্তিমালিকানাধীন এই শিক্ষামাধ্যম ব্যক্তির ইচ্ছাতেই চলে। বাকি থাকে সংখ্যাগরিষ্ঠ শিশুদের মাধ্যম প্রাথমিক শিক্ষা।
তহবিল সংকটে রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষা
03:48
This browser does not support the video element.
কিন্ডারগার্টেন পদ্ধতির জনক ফ্রিডরিশ ফ্রোবেল শিশুশিক্ষা সম্পর্কে বলেছেন, শিশুর হাত, মন ও হৃদয় একসঙ্গে কাজ করলে শিক্ষা পূর্ণ হয়। এজন্য তিনি খেলা, গান, নাচ, ছড়া, অভিজ্ঞতা ও শিল্পকর্মের মাধ্যমে শিক্ষার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। মনোবিজ্ঞানী মারিয়া মন্টেসরি বলেছেন সংগীত, অঙ্গভঙ্গি, নাটক, চিত্রকলা শিশুদের মনোযোগ, শৃঙ্খলা, সৃজনশীলতা বাড়ায়। জন ডিউই বলেন, গান, নাচ শিশুকে সামাজিকভাবে অধিকতর যুক্ত করে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, "শিক্ষার মূল কথা হচ্ছে আনন্দ, যেখানে আনন্দ নেই সেখানে শিক্ষা চাপা পড়ে যায়।" যে আনন্দময় শিক্ষাকে তিনি প্রায়োগিক করে তুলেছিলেন তার নিজের গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠান শান্তি নিকেতনের মাধ্যমে।
শিক্ষা মনোবিজ্ঞান বহুবিধ গবেষণালব্ধ সারমর্মে বলে, গান শিশুর ভাষা, স্মৃতি ইত্যাদি আবেগীয় বিকাশ ঘটায়, নৃত্য শরীরের সমন্বয়, আত্মবিশ্বাস ও আনন্দ জন্ম দেয় এবং অভিনয় কল্পনাশক্তি, সামাজিক দক্ষতা ও যোগাযোগ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। উন্নত সকল দেশ শিশু শিক্ষার ক্ষেত্রে আধুনিক মনোবিজ্ঞানের সূত্রগুলোকে বিবেচনা করে। দেশজ প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনের গুরুত্ব বিবেচনায় নীতি নির্ধারণপূর্বক শিশুশিক্ষার ক্ষেত্রে আনন্দময় শিক্ষা পদ্ধতিকেই গুরুত্বারোপ করে।
সম্প্রতি বাংলাদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংগীত শিক্ষক নিয়োগের তীব্র আপত্তি উত্থাপিত হয়েছে। বিপরীতে তারা দাবি করেছে ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগের। ব্যাপারটিতে যুক্তির চেয়ে আবেগ বেশি। বিবেচনার চেয়ে বিরোধিতা বেশি। যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ধর্মীয় শিক্ষকের প্রয়োজনীয়তা অধিক মনে করে, তবে আরো ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগ দিতে কোনো বাধা নেই। কিন্তু এই ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার সাথে গানের শিক্ষক নিয়োগ বাতিল করার সম্পর্ক যুক্তিগ্রাহ্য নয়। বরং এই বাতিল করার শর্তারোপ ভিন্ন ইঙ্গিত দেয়। দেশের রাজনৈতিক গতি প্রকৃতি এই ইঙ্গিতের ভিত শক্ত করে।
শিক্ষাঙ্গনে নির্বাচন নিয়ে শিক্ষার্থী ও বিশ্লেষকদের কথা
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কেন নির্বাচন হয় না? বাধা কোথায়? কলেজগুলোতেও কি ছাত্র সংসদ নির্বাচন হওয়া উচিত না? এসব বিষয়ে ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও চারটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
ছবি: DW
রাজনৈতিক কর্তৃত্ব বজায় রাখতেই নিয়মিত নির্বাচন হয় না : ডা. জাহেদ উর রহমান, রাজনৈতিক বিশ্লেষক
ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচনে সরকার-বিরোধীরাই অধিকাংশ সময় নির্বাচিত হয়। ফলে ওই সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরকারী দলের ছাত্র সংগঠনের নিয়ন্ত্রণ খর্ব হয়। এই কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সরকারগুলো নিজেদের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন দিতে চায় না।
ছবি: DW
আমি স্বতন্ত্র প্রার্থীকে চাইবো : রিফাত জাহান, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সবার আগে আমি আমি স্বতন্ত্র প্রার্থীকে চাইবো, যার কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ততা নেই এবং কোনো রাজনৈতিক সংগঠন দ্বারা প্রভাবিত হবে না। প্রার্থীর কাছে আমি প্রতিবাদ করার ক্ষমতা, সচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দাবি করতে পারি, তবে অবশ্যই সেটা শিক্ষার্থীবান্ধব হতে হবে।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি চাই না : রাতুল হাসান রাফি, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ডাকসু ঐতিহাসিকভাবে শিক্ষার্থীদের অধিকার ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিল। তবে বাস্তবে এটি প্রায়ই রাজনৈতিক দলগুলোর প্রভাবাধীন হয়ে পড়ে৷ ফলে, প্রশ্ন ওঠে- ডাকসু কি শিক্ষার্থীদের স্বার্থে কাজ করছে, নাকি দলের এজেন্ডা বাস্তবায়নের হাতিয়ার হচ্ছে? অবশ্য ডাকসুর প্রার্থীরা শিক্ষার্থীদের ভোটে নির্বাচিত হন, তবু তারা সাধারণত নিজেদের রাজনৈতিক দলের প্রতি বেশি দায়বদ্ধ থাকেন। এমন লেজুরবৃত্তিক রাজনীতি চাই না।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব সন্তোষজনক পর্যায়ে পৌঁছায়নি : অর্পিতা সাহা, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
নির্বাচনে নারী প্রার্থী এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ ও প্রতিনিধিত্ব এখনো সন্তোষজনক পর্যায়ে পৌঁছায়নি। অথচ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জাতীয় নেতৃত্ব তৈরির অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। এই নেতৃত্বে সবার কণ্ঠস্বর সমানভাবে শোনা না গেলে গণতান্ত্রিক চর্চা পূর্ণতা পায় না। তাই নারীদের পাশাপাশি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ বাড়ানো জরুরি।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর অংশগ্রহণ খুবই সামান্য : পপি রাজবংশী, শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
ছাত্র সংসদ নির্বাচনগুলোতে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ খুবই সামান্য। ছাত্র সংসদে বিভিন্ন পদে কিছু নারী শিক্ষার্থী মনোনয়ন সংগ্রহ করলেও তাদের অবস্থান ভালো না। আবার হল সংসদে অনেক পদে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীই নেই। সব মিলিয়ে মেয়েদের অংশগ্রহণও সন্তোষজনক নয়। রাকসুতে ‘জাতিসত্ত্বা বিষয়ক সম্পাদক’ পদের সংযুক্তিসহ চার দফা দাবি জানিয়েছিল ‘আদিবাসী’ ছাত্র সংগঠনগুলো। এ দাবিও উপেক্ষিত হয়েছে।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
নির্বাচিতদের দায়িত্ব অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা : নাঈম ইবনে জামান, শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
দীর্ঘ ৩৫ বছর পর রাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। আমি যাদের ভোট দিবো, তাদের কাছে আমার প্রত্যাশা, দীর্ঘদিন ছাত্র সংসদ না হওয়ায় প্রশাসনিক ও একাডেমিক যেসব অধিকার থেকে আমরা বঞ্চিত হয়েছি তা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। যেমন, একাডেমিক সিলেবাসকে যুগোপযোগী করা, শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসিক সুবিধা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন ফান্ডিং ও স্কলারশিপের ব্যবস্থা গ্রহণ।
লেজুড়বৃত্তিক ছাত্রসংগঠনগুলোর অগ্রাধিকার শিক্ষার্থীদের দাবি নয়, বরং দলীয় স্বার্থই হবে - এমন আশঙ্কা বাস্তবসম্মত। যখন ছাত্র সংসদ স্বাধীনভাবে কাজ করেছে, তখন তারা জাতীয় স্বার্থে বড় ভূমিকা রেখেছে। দলীয় রাজনীতির অতীত ইতিহাসের আলোকে বলা যায়, ছাত্র সংসদে দলীয়করণ হলে শিক্ষার্থীদের স্বতন্ত্র কন্ঠস্বর হারিয়ে যাবে, শিক্ষার্থীদের অধিকার নিশ্চিত হবে না। এককেন্দ্রিক রাজনৈতিক মতাদর্শকে হেজেমোনিক করে তুলবে।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
নির্বাচিতরা যেন শিক্ষার্থীদের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেন : সাদিয়া শরিফ শান্তা, শিক্ষার্থী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
সাধারণ শিক্ষার্থী হিসেবে আমাদের প্রত্যাশা থাকে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা রাজনৈতিক স্বার্থ নয়, শিক্ষার্থীদের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেবেন। কিন্তু যদি পূর্ণ প্যানেল বা অধিকাংশ পদে রাজনৈতিক সংগঠনের প্রার্থীরাই জয়ী হন, তাহলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের বিষয়ে তাদের সঙ্গে মুখোমুখি অবস্থার সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
সৎ ও মেরুদণ্ড থাকা নেতা চাই : মামুন ইসলাম, শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
চাকসু নেতার হতে হবে স্বচ্ছ, তার মধ্যে অবশ্যই কোনো প্রকার দ্বিচারিতা, কিংবা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর জন্য কাজ করার মানসিকতা থাকতে পারবে না। প্রশ্ন করা ও প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়ার মতো সৎ সাহস এবং ডিসিশন মেইকিংয়ের যোগ্যতা, তথা মেরুদণ্ড থাকা একান্ত জরুরি।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
সকল সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি থাকা জরুরি : অর্পিতা সুশীল অপি, শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
চাকসু নির্বাচনে অমুসলিম ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্ব অত্যন্ত জরুরি। এটি বৈষম্য রোধ, সবার ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত এবং তাদের নির্দিষ্ট সমস্যা ও চাহিদা তুলে ধরতে সহায়ক হবে। এ ধরনের প্রতিনিধিত্ব যতটা বেশি উঠে আসবে, শিক্ষার্থীদের মাঝে পারস্পরিক বোঝাপড়া এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক, বৈষম্যহীন ছাত্র সংসদ গঠনে ততবেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আমি মনে করি।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
ক্যাম্পাসে শান্তি ও শিক্ষার্থীদের কল্যাণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব : বোরহান রব্বানী, শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে অনেক বিতর্ক হচ্ছে। তবে আমরা তেমন কোনো পরিচয়ের ভিত্তিতে ভোট দেবো না। আমরা বিবেচনা করবো-কে বা কারা দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষার্থীদের অধিকার ও স্বার্থ রক্ষায় নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। যারা শিক্ষার্থীদের নায্য অধিকার আদায় করতে পারবে। এছাড়া যাদের ইশতেহারে ক্যাম্পাসের শান্তি, উন্নয়ন এবং শিক্ষার্থীদের কল্যাণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে- তাদেরই আমরা ভোট দেবো।
জাকসু নির্বাচনে নারী শিক্ষার্থীদের আগ্রহ কম থাকার অন্যতম কারণ হলো- রাজনীতির পরিবেশকে এখনো অনেকেই নিরাপদ মনে করেন না। কেননা, গণঅভ্যুত্থানে নারীদের ব্যাপক ভূমিকা থাকলেও এর পরবর্তী সময়ে নারীদের অনলাইন বুলিংয়ের মাধ্যমে রাজনীতিতে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। পাশাপাশি সামাজিক চাপ, নিরাপত্তার অভাব এবং নেতৃত্বে নারীদের সুযোগ কম থাকায় অনেকেই এগিয়ে আসতে চান না।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
12 ছবি1 | 12
আমরা জানি না এই সংগীত শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ার বিরোধীদের কাছে নতি স্বীকার করা হবে কিনা। আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। প্রতিরোধকারীদের প্রতিরোধের মুখে নারী কমিশন ঘুমিয়ে পড়েছে, পাঠ্যপুস্তক সংস্কার কমিটি মুখ থুবড়ে পড়েছে। এই দাবিটির ভবিষ্যৎ জানি না৷ তবে জাতি হিসাবে আমাদের অবিমৃষ্যকারিতা আমাদের আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোহীন পরিণতিই ডেকে আনছে। শিশুমনের বিকাশের গুরুত্ব উপলব্ধি করেন - এমন বেশির ভাগ মানুষই মনে হয় দেশ ও জাতির ভবিষ্যতের স্বার্থে এই অযৌক্তিক বিরোধিতা থেকে মুক্তি চাইবেন। প্রত্যাশা থাকবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বেড়ে উঠুক আনন্দময়তায়।