ভাইরাস মানুষকে নানাভাবে কাবু করতে পারে৷ যেমন এই মুহূর্তে মার্স ও সার্স-এর মতো ভাইরাস গোটা বিশ্বকে দুশ্চিন্তায় রেখেছে৷ জার্মান বিজ্ঞানীরা এই ভাইরাসের মোকাবিলায় কিছুটা সাফল্য পেয়েছেন৷
বিজ্ঞাপন
ভাইরাসের টিকার সম্ভাবনা উজ্জ্বল
04:19
বিপজ্জনক খুনি কি এরকম দেখতে? যাকে ধরবে, তার বাঁচার সম্ভাবনা ‘ফিফটি-ফিফটি'৷ এতকাল বিশেষজ্ঞদের এমনটাই মনে হয়েছে৷ মধ্যপ্রাচ্যের শ্বাসনালীর অসুখ ‘মার্স'-এ উৎস করোনা ভাইরাসের গোত্র থেকে৷ বিপজ্জনক ‘সার্স' এবং সাধারণ সর্দি-কাশির ভাইরাসও তার মধ্যে পড়ে৷
জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্ট৷ খুব খারাপ কেসে ফুসফুসে সংক্রমণ ও কিডনি ফেলও করতে পারে৷ দক্ষিণ কোরিয়ায় ‘মার্স' ছড়িয়ে পড়ার সময় এই সব লক্ষণ দেখা গিয়েছিল৷ হাসপাতাল কর্মী, রোগী ও তাদের আত্মীয়স্বজনরাই মূলত সংক্রমণের শিকার হয়েছিলেন৷ বন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ক্রিস্টিয়ান ড্রোস্টেন বলেন, ‘‘দক্ষিণ কোরিয়ায় আত্মীয়স্বজনরাও সেবা-শুশ্রূষার কাজে হাত লাগিয়েছিলেন৷ তাছাড়া হাসপাতালের এমারজেন্সি বিভাগে মানুষ ঘনঘন যাতায়াত করেন৷ অনেক রোগী আরও ভালো চিকিৎসার আশায় এক হাসপাতাল থেকে আরেকটিতে ভর্তি হন৷ এভাবে ভাইরাস আরও ছড়িয়ে পড়তে পারে৷'''
ছত্রাক, ভাইরাস ও ব্যাকটিরিয়া সম্পর্কে যেগুলো জানা জরুরি
বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য ছিল খাদ্য নিরাপত্তা৷ তাহলে দেখা যাক আমাদের খাদ্যে অনুজীবের ভূমিকা কি? ছত্রাক, ভাইরাস, ব্যাকটিরিয়া আপনার খাবারকে যেমন নষ্ট করতে পারে, তেমনি এদের কিছু উপকারিতাও আছে৷
ছবি: imago/Gerhard Leber
ওহ!
এই ছত্রাক দেখে কি মুখ ফিরিয়ে নিতে ইচ্ছে করছে? তবে এ ধরনের ছত্রাকে ভরা স্যান্ডইউচ কিন্তু ক্ষতিকারক নয়৷ কিছু ছত্রাক বিষাক্ত না হলেও ক্যামেমবার্ট পনিরের মতো অনেক ছত্রাকই ক্ষতিকর৷ ভয়াবহ বিষাক্ত ছত্রাকের সংস্পর্শে এলে মানুষের দেহের প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে৷
ছবি: imago/imagebroker
অনুঘটক হিসেবে ছত্রাক
ছত্রাক অনেক ক্ষেত্রে কার্যকরী৷ অন্য কোনো অনুজীবের তুলনায় ছত্রাক কার্বন হাইড্রেটটস, চর্বি ও আমিষকে দ্রুত ভেঙে ফেলতে পারে৷ বিভিন্ন শিল্পকারখানায় খাবার প্রক্রিয়াকরণ ও ডিটারজেন্ট তৈরিতে এনজাইম হিসেবে ব্যবহৃত হয় এসব ছত্রাক৷
ছবি: BASF
সালামি
সসেজ তৈরির পদ্ধতিতে যদি কোনোরকম ভুল হয় বা মাংস ও সবজি রক্ষণাবেক্ষণের সময় পচন ধরে তাহলে খাবার বিষাক্ত হয়ে যায়৷ ঐ ব্যাকটিরিয়া এমন এক বিষে পরিণত হয় যা জীবননাশক হতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
অক্সিজেন ছাড়া জীবন
অক্সিজেন না পেলে অর্থাৎ সেরকম পরিবেশে ক্লসট্রিডিয়াম বটুলিনাম ব্যাকটিরিয়া মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে৷ এই ব্যাকটিরিয়া কসমেটিক সার্জারির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ, কেননা ত্বককে মসৃণ করার স্নায়ু এজেন্ট বোটক্স তৈরি হয় এ থেকে৷ কিন্তু খাদ্যে যদি এটি উৎপন্ন হয়, সেটা খেলে মানুষ প্যারালাইজড বা পক্ষাঘাতগ্রস্ত হতে পারে৷ প্রথমে শরীরের কিছু অংশ পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়, তারপর ধীরে ধীরে মৃত্যুর পথে এগিয়ে যায় মানুষ৷
ছবি: picture alliance/OKAPIA
তাজা শাকসবজি সবসময় ভালো নয়
২০১১ সাল পর্যন্ত মেথি’র অঙ্কুর জার্মানদের কাছে স্বাস্থ্যকর খাবার হিসেবে পরিচিত ছিল৷ সে বছর বীজ থেকে ছড়িয়ে পড়া মহামারি ইকোলি ব্যাকটিরিয়ায় মারা যায় ৫৩ জন, অসুস্থ হয়ে পড়ে কয়েক শত৷ এই ব্যাকটিরিয়া অন্ত্রের দেয়ালকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, পরে মস্তিষ্ককে আক্রান্ত করে৷ তাই সবজি ও মাংস রান্না করে খেলে এই ব্যাকটিরিয়াগুলো মরে যায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ভালো ব্যাকটিরিয়া
তবে সবধরনের ইকোলি ব্যাকটিরিয়া ক্ষতিকর নয়৷ মানবদেহের বৃহদন্ত্রে এ ধরনের ব্যাকটিরিয়া ‘ভিটামিন কে’ তৈরি করে, যা হাড়, কোষ ও রক্তের জন্য খুব উপকারি৷ এছাড়া ইনসুলিন ও গ্রোথ হরমোন তৈরিতে এই ব্যাকটিরিয়া ব্যবহৃত হয়৷
ছবি: Harvard’s Wyss Institute
খাদ্য সংরক্ষণে ব্যবহার
দই, পনির এসব দুগ্ধজাত পণ্য তৈরির জন্য দরকার হয় ব্যাকটিরিয়া৷ হাজার হাজার বছর ধরে ল্যাকটিক এসিড ব্যাকটিরিয়া এসব দ্রব্য উৎপাদনে ব্যবহৃত হচ্ছে৷
ছবি: ZDF
ভয়াবহ ডায়রিয়ার কারণ
ক্যামপিলোব্যাকটার এবং স্যালমোনেলি দেখতে রডের মতো৷ এসব ব্যাকটিরিয়ার কারণে অসুস্থতা এবং মৃত্যু দুটোই হতে পারে৷ কম রান্না করা গরু, শুকর ও মুরগীর মাংসে এ ধরনের ব্যাকটিরিয়া জন্ম নেয়৷ এটি খাবার পর পাতলা পায়খানা শুরু হয়৷
খাদ্যে পচন
নরোভাইরাস বা পাকস্থলীর ফ্লু বমি এবং মলের মাধ্যমে মানুষ থেকে মানুষে ছড়িয়ে পড়ে৷ মাত্র ১০০টা অতিক্ষুদ্র ভাইরাস মানুষের দেহে সংক্রমণের জন্য যথেষ্ট৷
ছবি: Foto: Gudrun Holland/Robert-Koch-Institut
9 ছবি1 | 9
ভাইরোজিস্ট ক্রিস্টায়ান ড্রস্টেন বিশ্বের হাতে গোনা ‘মার্স' বিশেষজ্ঞদের অন্যতম৷ সহকর্মীদের সঙ্গে মিলে তিনি ১০ বছর আগে ‘সার্স' ভাইরাস শনাক্ত করেছিলেন৷ এই ভাইরাসের আচরণ আজও রহস্য থেকে গেছে৷ কারণ সব ক্ষেত্রে সংক্রমণ জোরালো হয় না৷ কিছু ক্ষেত্রে তার অস্তিত্বই টের পাওয়া যায় না৷ অধ্যাপক ড্রস্টেন বলেন, ‘‘বিভিন্ন সূত্র অনুযায়ী এই ভাইরাসের কারণে অর্ধেক রোগীর মৃত্যু হতে পারে৷ এটা সবচেয়ে বিপজ্জনক ভাইরাসগুলির অন্যতম৷ তবে একই সঙ্গে মনে রাখতে হবে, যে কিছু স্টাডি অনুযায়ী কিছু ক্ষেত্রে এর প্রভাব খুবই কম৷ অর্থাৎ সেই সব রোগীর শরীরে সংক্রমণের লক্ষণ থাকলেও তারা কঠিন রোগের কথা মনে করতে পারেন না৷''
এর কারণ এখনো জানা যায়নি৷ তবে এটুকু জানা গেছে যে উট গোত্রের প্রাণী এই সংক্রমণের উৎস৷ শুধু আরব উপদ্বীপেই নয়, সুদান ও ইথিওপিয়ায়ও এমন প্রাণীদের ক্ষেত্রে – বিশেষ করে তাদের নাকের লালার মধ্যে ‘মার্স' ভাইরাস পাওয়া গেছে৷ অধ্যাপক ড্রস্টেন বলেন, ‘‘বিশেষ করে কমবয়সি প্রাণীদের ক্ষেত্রে এটা বেশি দেখা যায়৷ উটের সংস্পর্শে এলে মানুষও সংক্রমিত হতে পারে৷ তবে এমনটা খুব ঘনঘন ঘটে না৷ তারপর এক মানুষ থেকে অন্য মানুষ সংক্রমিত হতে পারে৷ কিন্তু সেই প্রক্রিয়া মোটেই সহজে ঘটে না, যেমনটা ইনফ্লুয়েঞ্জার ক্ষেত্রে দেখা যায়৷ এক্ষেত্রে সেটা অনেক বিরল৷''
ইবোলা ভাইরাসের আতঙ্ক সারা বিশ্বে
পশ্চিম আফ্রিকায় ইতিমধ্যে ৪,০০০ মানুষ ইবোলা সংক্রমণে মারা গেছে৷ ইউরোপ এবং অ্যামেরিকায় ইবোলার প্রথম সংক্রমণের পর মহামারির রূপ নিতে পারে এমন আতঙ্ক বাড়ছে৷ দেখুন ইবোলার বিস্তার এবং আতঙ্ক নিয়ে আজকের ছবিঘর৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ডালাস, অ্যামেরিকা
টেক্সাসের এক হাসপাতালের একজন নার্স ইবোলা ভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ায় তাঁর বাড়িতে ঢোকার রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে স্থানীয় পুলিশ৷ স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদেও একজন ইবোলায় সংক্রমিত হয়েছেন৷ আক্রান্ত হওায়ার আগে ইবোলায় আক্রান্ত রোগীর সেবা করেছিলেন তিনি৷
ছবি: Reuters/Jaime R. Carrero
মিলান্ডু, গিনি
গিনির গ্রাম মিলান্ডুতে গত বছর ইবোলার সূত্রপাত হয়৷ এ রোগে আক্রান্ত হয়ে গত বছরের ৬ ডিসেম্বর দু’বছরের এক শিশু মারা যায়৷ সম্ভবত ওই শিশুটিই ছিল সাম্প্রতিক কালে মহামারির রূপ নেয়া ইবোলার প্রথম শিকার৷ তারপরই এই ভাইরাসে মারা যায় শিশুটির বোন, মা এবং নানি৷ এ বছরের মার্চ মাসে গিনির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ডাব্লিউএইচও-কে ইবোলার প্রাদুর্ভাবের কথা জানায়৷
মনরোভিয়া, লাইবেরিয়া
গিনির পর ইবোলা আঘাত হানে পার্শ্ববর্তী দেশ সিয়েরা লিওন ও লাইবেরিয়ায়৷ লাইবেরিয়ায় নার্সদের ধর্মঘটে ইবোলা রোগীদের সংকট কিছুটা বেড়ে যায়৷ তবে আশার কথা, সেনেগাল এবং নাইরেজিয়ায় এরই মধ্যে ইবোলা সংক্রমণের হার কিছুটা কমেছে৷
জেনেভা, সুইজারল্যান্ড
ইবোলা একটি সংক্রামক রোগ৷ রক্ত, বীর্য, যোনিরস, লালা বা দেহ নির্গত অন্য পদার্থ যেমন মলমূত্র বা বমির সংস্পর্শে এ রোগ ছড়ায়৷ আক্রান্ত রোগীদের পরিবারের সদস্য, ডাক্তার ও সেবাকর্মীদের এ রোগে আক্রান্ত হবার আশঙ্কা বেশি৷ তবে সংক্রমণ নিরোধক পোশাক এবং জীবাণুনাশক ব্যবহার করলে ইবোলায় সংক্রমিত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়, মনে করেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞরা৷
ছবি: Getty Images/P. Guyot
লাইপসিশ, জার্মানি
গত মঙ্গলবার জার্মানিতে আসা জাতিসংঘের দু’জন কর্মীর মধ্যে একজন লাইপসিশে মারা গেছেন, যিনি লাইবেরিয়াতেই ইবোলা ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছিলেন৷ আর একজনকে বিশেষ ব্যবস্থায় ফ্রাংকফুর্ট শহরে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে৷ জার্মান স্বাস্থ্যমন্ত্রী হ্যারমান গ্যোহে অবশ্য আশার কথা শুনিয়েছেন৷ তাঁর মতে, ‘‘জার্মানিতে ইবোলা সংক্রমণের আশঙ্কা খুবই কম৷’’
ছবি: Reuters/R. Orlowski
5 ছবি1 | 5
দক্ষিণ কোরিয়া থেকে দুঃসংবাদের পর ভাইরোলজিস্টরা ভাইরাসের বর্তমান প্রজন্ম ভালোভাবে পরীক্ষা করেছেন৷ নানা রকম মিউটেশনের মাধ্যমে এই ভাইরাস আরও সংক্রামক ও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে কিনা, সেটা তাঁরা জানতে চেয়েছিলেন৷ অধ্যাপক ক্রিস্টিয়ান ড্রস্টেন বলেন,‘‘নতুন ভাইরাসের মিউটেশন ঘটলেই মনে হয়, আরও খারাপ কিছু সৃষ্টি হচ্ছে৷ ‘মার্স' ভাইরাসের ক্ষেত্রে কিন্তু ব্যাপারটা অন্যরকম৷ কারণ মানুষ বার বার এমন ভাইরাসে আক্রান্ত হলেও এক মানুষ থেকে অন্য মানুষের শরীরে সংক্রমণ ঘটে না৷ তাই ভাইরাসও নিজেকে পরিবর্তন করতে পারে না৷''
ভাইরাসের হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করতে সারা বিশ্বে বিজ্ঞানীরা টিকা তৈরির চেষ্টা করছেন৷ বন শহরের ভাইরোলজি ইনস্টিটিউট থেকে এবার সুখবর পাওয়া যাচ্ছে৷ ইনফ্লুয়েঞ্জার টিকার ক্ষেত্রে নিয়মিত রদবদলের প্রয়োজন পড়লেও পরিচিত সব ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ শক্তি গড়ে তুলতে একটি টিকাই যথেষ্ট৷ অধ্যাপক ড্রস্টেন বলেন, ‘‘মার্স ভাইরাসের জন্য আমরা ল্যাবে পরীক্ষা করেছি এবং মার্স ভাইরাসের সব পরিচিত স্ট্রেন পরখ করে দেখেছি৷ দেখে মনে হয় তাদের মধ্যে যথেষ্ট মিল রয়েছে৷ তাই একটি টিকাই যথেষ্ট হবে৷''
এমন টিকার সম্ভাবনা যথেষ্ট উজ্জ্বল৷ চূড়ান্ত ওষুধ তৈরি হওয়া পর্যন্ত মার্স ভাইরাস মিউটেশনের মাধ্যমে আরও ভয়ংকর হয়ে উঠবে না – এমনটা আশা করা যায়৷ এই মুহূর্তে আতঙ্কের কোনো কারণ নেই৷ কিন্তু ভাইরাস তার জিনোম ঘনঘন বদলে ফেলে বলে পরিস্থিতি দ্রুত বদলে যেতে পারে৷ তাই সতর্কতা বজায় রাখা উচিত৷