নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকার গঠনের জন্য বাংলাদেশের মন্ত্রিসভার সদস্যরা সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পদত্যাগ-পত্র জমা দেন৷ এর মধ্যে যাঁরা সর্বদলীয় সরকারের মন্ত্রিসভায় থাকবেন না, তাঁদের পদত্যাগ-পত্র গ্রহণ করা হবে৷
বিজ্ঞাপন
সোমবার সচিবালয়ে বর্তমান সরকারের মন্ত্রিসভার শেষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে৷ বৈঠক শেষে সেখানেই বর্তমান সরকারের মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগ-পত্র জমা দেন৷ ৫২ সদস্যের মন্ত্রিসভার একমাত্র প্রধানমন্ত্রী ছাড়া সব সদস্যই পদত্যাগ-পত্র জমা দেন৷ মন্ত্রিপরিষদের সচিব মোশাররফ হোসেন ভুঁইঞা জানান, এঁদের মধ্যে যাঁরা নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকারে থাকবেন না তাঁদের পদত্যাগ-পত্র গ্রহণ করবেন প্রধানমন্ত্রী৷ আর যাঁরা সর্বদলীয় সরকারের থাকবেন তাঁদের পদত্যাগ-পত্র গ্রহণ করা হবে না৷ তিনি জানান, নতুন এই মন্ত্রিসভায় যাঁরা নতুন করে অন্তর্ভুক্ত হবেন তাঁদের শপথ নিতে হবে৷ সর্বদলীয় সরকারের মন্ত্রিসভায় কতজন সদস্য থাকবেন, তা না জানালেও এর আকার ছোট হবে বলে জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব৷ এদিকে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, প্রধান বিরোধী দল বিএনপি সর্বদলীয় সরকারে অংশ না নিলে সর্বদলীয় সরকারে কিছুটা ত্রুটি থেকে যাবে৷ তবে সরকার আশা করছে যে, তাদের সঙ্গে সংলাপের মাধ্যমে পরিস্থিতির উন্নতি হবে এবং তারা সর্বদলীয় সরকার এবং নির্বাচনে অংশ নেবে৷ তিনি জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৪ই নভেম্বর শ্রীলঙ্কা সফরে যাবেন৷ সেখান থেকে ফিরে আসার পর তিনি সর্বদলীয় সরকার গঠনের কাজ শুরু হবে৷ তবে সর্বদলীয় সরকার গঠনের আগ পর্যন্ত পদত্যাগ-পত্র জমা দেয়া এই মন্ত্রীরাই দায়িত্ব পালন করে যাবেন৷ একমাত্র জামায়াতে ইসলামী ছাড়া জাতীয় সংসদে যে সব দলের আসন আছে, সেই সব দলের সংসদ সদস্যদের নিয়েই সর্বদলীয় সরকার গঠন হবে৷ এই সরকার নির্বাচনকালীন সরকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে৷
মন্ত্রীদের পদত্যাগ-পত্র জমা দেয়ার প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রহুল কবীর রিজভী বলেন, জাতি এখন প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের জন্য উন্মুখ হয়ে আছে৷ প্রধানমন্ত্রী যদি পদত্যাগ করতেন, তাহলে একটি ইতিবাচক অবস্থার সৃষ্টি হতো৷ কিন্তু প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ না করে মন্ত্রীদের পদত্যাগের মানে হলো সরকার একদলীয় নির্বাচনের নীলনক্সা বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে৷ সরকার চায় বিএনপিকে বাইরে রেখে একতরফা নির্বাচন করে ক্ষমতা ধরে রাখতে৷ কিন্তু সরকারের সে চেষ্টা সফল হবে না বলে মনে করেন রিজভী৷
অন্যদিকে বিকল্প ধারা বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী যদি নির্বাচনের ব্যাপারে আন্তরিক হন তাহলে তাঁর পদত্যাগ করা উচিত৷
প্রসঙ্গত, আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বাধীন জাতীয় পর্টি (জেপি) সর্বদলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে৷
বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকট থামছে না
আগামী বছরের সূচনায় জাতীয় নির্বাচন, কিন্তু দুই মুখ্য রাজনৈতিক জোটের টানাপোড়েন অব্যাহত৷ অথচ দেশে-বিদেশে অনেকেই চান সংকট নিরসনে দুই বৈরী জোটের মধ্যে আলোচনা৷ কিন্তু সেটা কি আদৌ সম্ভব হবে?
ছবি: AP
দু’দলের দ্বন্দ্ব
বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন নির্দিষ্ট হয়েছে ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে৷ তবে মুখ্য বিরোধী দল বিএনপি এখনো নির্বাচনে অংশ নিতে রাজি নয়৷ তারা চায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন, শাসক আওয়ামী লীগের কাছে যা সংবিধান লঙ্ঘনের সমান৷
ছবি: Getty Images/AFP/FARJANA K. GODHULY
জাতিসংঘ চায় সংলাপ
জাতিসংঘ ইতিমধ্যেই দুই বিবাদী জোটের মধ্যে সংলাপের উদ্যোগ নিয়েছে৷ মহাসচিব বান কি-মুন গত ২৩ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে টেলিফোনে কথাবার্তা বলেছেন৷ জাতিসংঘের মহাসচিব উভয় নেতার প্রতি চলতি রাজনৈতিক সংকটের শান্তিপূর্ণ অবসানের জন্য আলাপ-আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছেন৷
ছবি: Reuters
হাসিনা চান সংসদে আলোচনা
জাতিসংঘ বাংলাদেশি রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে মহাসচিবের ফোনালাপের কোনো খুঁটিনাটি প্রকাশ করেনি৷ তবে বাংলাদেশের একাধিক দৈনিকে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী হাসিনা ‘‘জাতিসংঘের প্রধানকে জানিয়েছেন যে, তিনি সংবিধান অনুযায়ী সরকারের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন অনুষ্ঠান করার পরিকল্পনা করছেন৷’’ বিরোধীপক্ষ যদি গোটা প্রসঙ্গটি সংসদে আলোচনা করার কোনো প্রস্তাব দেয়, তবে তিনি তাকে স্বাগত জানাবেন, এমন আভাসও দিয়েছেন হাসিনা৷
ছবি: dapd
সরকারের তত্ত্বাবধানে নির্বাচনে বিএনপির ‘না’
বান কি-মুনের সঙ্গে ফোনালাপে বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়াও সংকট সমাধানে সংলাপের সপক্ষে মতপ্রকাশ করেছেন, কিন্তু এ-ও স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, ‘‘বিরোধীপক্ষ আওয়ামী লীগ সরকারের তত্ত্বাবধানে আয়োজিত সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না৷’’
ছবি: Reuters
তত্ত্বাবধায়ক সরকার কি ও কেন?
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মূল কাজ হলো মুক্ত ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করা৷ ১৯৯১ সালে এই পদ্ধতি চালু করা হয় কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার ২০০৯ সালে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সেই পদ্ধতি বাতিল করে৷ বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিরোধী পক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার দাবি তুলেছে৷
ছবি: AP
জার্মানি সংলাপ সমর্থন করে
সংলাপকে বাংলাদেশের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক জোটের মধ্যে অচলাবস্থা নিরসনের একমাত্র পন্থা বলে মনে করে জার্মানি৷ ‘ঢাকা কুরিয়ার’ নামক সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ঢাকায় জার্মান রাষ্ট্রদূত ড. আলব্রেশট কনৎসে বলেছেন, ‘‘দু’টি মুখ্য রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংলাপ হলো বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা সমাধানের একমাত্র পথ৷’’
ছবি: DW/R. Manzoor
ইউনূস তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ডাক দিলেন
বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল পুরস্কার বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস একটি ‘‘নির্দলীয় নিরপেক্ষ (নির্বাচনকালীন) সরকার’’ বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি তাঁর প্রকাশ্য সমর্থন ব্যক্ত করেছেন৷ গত ২২ আগস্ট ইউনূস একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘‘নির্বাচন অতি অবশ্য হওয়া উচিত এবং তা একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হওয়া উচিত৷’’
ছবি: Getty Images
আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি)
হাসিনা সরকারের সৃষ্ট আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল বা আইসিটি-র উদ্দেশ্য মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার৷ কিন্তু তা শাসকদল এবং বিরোধীপক্ষের মধ্যে একটি বিতর্কিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ আইসিটি এখন পর্যন্ত ছ’জন অভিযুক্তকে শাস্তি দিয়েছে৷ বিরোধীপক্ষ এই বিচার প্রক্রিয়াকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত আখ্যা দিয়েছে৷ তাদের মতে এই প্রক্রিয়ার বাস্তবিক উদ্দেশ্য ন্যায়বিচার নয়, পুরাতন শত্রুতার প্রতিশোধ৷
ছবি: AP
আন্তর্জাতিক সমালোচনা
হিউম্যান রাইটস ওয়াচও আইসিটি-র সমালোচনা করেছে৷ এইচআরডাব্লিউ বিবৃতিতে বলেছে, জামায়াতে ইসলামীর সাবেক প্রধান গোলাম আযমের বিচার প্রক্রিয়া ‘‘গভীরভাবে ত্রুটিপূর্ণ’’ ছিল৷ প্রতিক্রিয়া হিসেব সরকারি কৌঁসুলির তরফ থেকে এইচআরডাব্লিউ-এর বিরুদ্ধে আদালতের অবমাননার অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে৷ ইতিমধ্যে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মোজেনা বলেছেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে এইচআরডাব্লিউ-এর ‘‘একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা’’ রয়েছে৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
ট্র্যাক রেকর্ড
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসে৷ বিদ্যুৎ উৎপাদন কিংবা কৃষি খাতে সরকারের সাফল্যের খতিয়ান যাই হোক না কেন, বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পের অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়ানোর পর হাসিনা সরকারের অন্য সব সাফল্য ঐ একটি কেলেঙ্কারির আড়ালে ধামাচাপা পড়ে গেছে৷ আগামী নির্বাচনেও পদ্মা সেতু প্রকল্প প্রসঙ্গটি প্রভাব ফেলতে পারে বলে পর্যবেক্ষকদের ধারণা৷