পাহাড়ের নেতারা সমতলে নেমে এসে বৈঠক করে গেলেন পশ্চিমবঙ্গের সদর সচিবালয় নবান্নে৷ পাহাড়ে বসে বিমল গুরুং হুঙ্কার ছাড়লেন, বনধ চলছে, চলবে৷
বিজ্ঞাপন
দার্জিলিং পাহাড়ের অচলাবস্থা কাটাতে মঙ্গলবার পশ্চিবমবঙ্গ রাজ্য সচিবালয় নবান্নে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সরাসরি বৈঠক করে গেলেন গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার বিনয় তামাং ও আরও চার নেতা ৷ বৈঠকে ছিলেন গোর্খা ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্টের তিন নেতা, জন আন্দোলন পার্টির পাঁচ নেতা এবং দার্জিলিং জেলার তৃণমূল কংগ্রেসের নেতারা, যেহেতু এটা তৃণমূল নেত্রী নয়, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁদের প্রশাসনিক বৈঠক৷ এবং এই বৈঠক শেষ হওয়ার পর মমতা ব্যানার্জি মুখ্যমন্ত্রীর উপযুক্ত নৈর্ব্যক্তিক ঢঙেই বললেন, বৈঠকে ওঁরা পৃথক গোর্খাল্যান্ডের দাবি তুলেছেন৷ সে তুলতেই পারেন৷ গণতান্ত্রিক কাঠামোয় সবাই নিজেদের বক্তব্য পেশ করতে পারে৷ আলাদা রাজ্যের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এক্তিয়ার যে রাজ্য সরকারের নয়, জবাবে সেটাও ওদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ তবে পাহাড়ে লাগাতার বনধের কারণে তৈরি হওয়া অচলাবস্থা কাটাতে এই আলোচনা অত্যন্ত সদর্থকভাবে শেষ হয়েছে৷ এ নিয়ে পরবর্তী আলোচনা হবে ১২ সেপ্টেম্বর উত্তরবঙ্গের সচিবালয় উত্তরকন্যায়৷
মমতা ব্যানার্জি
এর কিছুক্ষণের মধ্যেই সিকিমে বসে মোর্চা সুপ্রিমো বিমল গুরুংয়ের ক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া, যখন সরকার বলল আলাদা গোর্খাল্যান্ডের বিষয়টি তাদের হাতে নেই, তখনই কেন বেরিয়ে এলেন না পাহাড়ের নেতারা? সরাসরি কেন্দ্রের সঙ্গেই তা হলে আলোচনা হবে৷ এর পরই বিমল গুরুংয়ের ঘোষণা, এই বৈঠক নিয়ে তিনি খুশি নন৷ পাহাড়ে গত ৭৮ দিন ধরে চলা বনধও তুলে নেওয়ার কোনো প্রশ্ন নেই৷ এর আগে তিনিই বলেছিলেন, এই বৈঠকে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার নেতাদের যাওয়া নিয়ে তাঁর আপত্তি ছিল৷ তাঁকে না জানিয়েই কিছু মোর্চা নেতা বৈঠক করতে চলে গেছেন৷
শৈলরানি দার্জিলিং
কলকাতার গরম থেকে বাঁচতে ব্রিটিশরা খুঁজে বের করেছিলেন শৈলশহর দার্জিলিংকে৷ ‘কুইন অফ হিলস্’ নামটা তাদেরই দেওয়া৷ এখনও দলে দলে দেশি-বিদেশি পর্যটক বছরভর বেড়াতে যান উত্তরবঙ্গের এই হিল স্টেশনে, যার পথেঘাটে এখনও থমকে আছে সময়৷
ছবি: DW
তাকালেই কাঞ্চনজঙ্ঘা
দার্জিলিংয়ের অভিভাবকের মতো দাঁড়িয়ে আছে মহাকায় কাঞ্চনজঙ্ঘা শৃঙ্গ৷ যে কোনো জায়গা থেকে নজর কেড়ে নেয় তার অপরূপ সৌন্দর্য৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
দুরপিন হিল
দার্জিলিং শহরের আকর্ষণের অন্যতম কেন্দ্র এই ভিউ পয়েন্ট, স্থানীয় ভাষায় দুরপিন, বা দুরবিন হিল৷ এখান থেকে সরাসরি দেখা যায় কাঞ্চনজঙ্ঘা৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
ছায়াময় রাস্তা
দার্জিলিং মানেই পাইন, পপলারের ছায়ামাখা, আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা৷ দিনভর যে রাস্তায় হেঁটে বেড়ালেও ক্লান্তি আসে না৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
রঙিন প্রার্থনা
দার্জিলিংয়ের আরও একটা চেনা বৈশিষ্ট্য, শ্যাওলায় ঢাকা পাথুরে দেওয়ালের গায়ে সার দিয়ে টাঙানো, প্রার্থনা লেখা বর্ণময় কাপড়ের পতাকা৷ মূলত বৌদ্ধধর্মের এই প্রেয়ার ফ্ল্যাগ পাহাড়ি এলাকার অন্যান্য ধর্মস্থানেও দেখা যায়৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
ধর্মীয় শিলালিপি
প্রার্থনার মন্ত্র লেখা রাস্তার ধারের পাথরের গায়ে৷ বিজ্ঞাপনে মুখ ঢাকা শহরের দেওয়াল দেখতে দেখতে ক্লান্ত চোখ আরাম পায় এই সহজ, সরল, অনাড়ম্বর ধর্মাচরণের সৌন্দর্যে৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
সাবেকি ডাকবাক্স
ব্রিটিশ আমলের ডাকবাক্স৷ রাজকীয় চেহারা৷ এই ই-মেল, মোবাইল মেসেজের যুগেও এখনও সচল৷ চিঠি ফেললে পৌঁছে যায় ঠিক ঠিকানায়৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
কলোনিয়াল
ব্রিটিশরাই খুব যত্নে গড়ে তুলেছিল দার্জিলিংকে৷ এখনও পুরনো বাতিস্তম্ভে পাওয়া যায় সেই কদরের চিহ্ন৷ এখন যদিও বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলে৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতি
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সেনাদের ঘাঁটি ছিল দার্জিলিংয়েও৷ সেই সময়ের কিছু অতিকায় ল্যান্ডরোভার গাড়ি এখনও দেখা যায় শহরের রাস্তায়৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
দার্জিলিং মল
দার্জিলিংয়ের চৌরাস্তা বা বিখ্যাত মল৷ সময় থমকে আছে যেখানে৷ পুরনো সব দোকান ঘেরা চত্বরে এই ঘোড়াওয়ালারাও আছে সেই প্রথম থেকেই৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
কিউরিওসিটি শপ
কিউরিওর দোকান ছাড়া দার্জিলিং অসম্পূর্ণ৷ এই সব দোকান একেকটি রত্নভাণ্ডার৷ প্রাচীন তিব্বতি পুঁথি, মুখোশ থেকে শুরু করে রত্নখচিত অলংকার, সব পাওয়া যায় এখানে৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
10 ছবি1 | 10
যাঁর নেতৃত্বে মোর্চা প্রতিনিধিদল নবান্নের এই বৈঠকে হাজির ছিল, সেই বিনয় তামাং কথাটা শুনে বলেছেন, দলের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে নেওয়া সিদ্ধান্ত, রীতিমাফিক গুরুংকে জানিয়েও দেওয়া হয়েছিল৷ তারপরেও গুরুং কেন এ সব কথা বলছেন, তিনি জানেন না৷ এরপর বিনয় তামাং যা বলেছেন, তার ভাবার্থ হলো, পাহাড়ের জনজীবনের সঙ্গে সম্পর্ক না থাকলে লোকে এ রকমই মন্তব্য করে!
বিনয় তামাংয়ের এই মন্তব্যের প্রভাব কিন্তু অনেক সুদূরপ্রসারী৷ সামনেই দুর্গাপুজোর ছুটির মরশুম, যেসময় পাহাড়ে পর্যটকদের ঢল নামে৷ পর্যটন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত পাহাড়ের মানুষদের সারা বছরের খোরাকির একটা বড় অংশ জোগাড় হয় এই ছুটির মরশুম থেকেই৷ গুরুংয়ের জেদে যদি পাহাড়ে বনধ চলতেই থাকে, তা হলে অবধারিতভাবে বহু মানুষ বেঁকে বসবে৷ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দার্জিলিংয়ের এক হোটেল মালিক জোর দিয়ে বললেন, বনধ তুলতেই হবে, গুরুংও সেটা ভালোভাবেই জানেন৷ নয়ত, গুরুংয়ের ইচ্ছে-অনিচ্ছে যে পাহাড়ে আর শেষ কথা নয়, সেটা আরও বেশি করে প্রমাণ হয়ে যাবে! বস্তুত নবান্নের বৈঠকে যোগ দেওয়া নিয়ে গুরুংয়ের আপত্তি এবং সে নিয়ে বিনয় তামাংয়ের মন্তব্য থেকেই পরিষ্কার, বনধ নিয়ে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার ভেতরেই স্পষ্ট দ্বিমত তৈরি হয়েছে৷
মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি সেই সুযোগটাই নিয়েছেন, এবং সেটাও একেবারে মোক্ষম সময়েই৷ এর আগে গোর্খার বাইরে পাহাড়ের অন্য জনগোষ্ঠীকে আলাদা দল গড়তে উৎসাহ দিয়ে তিনি গোর্খাল্যান্ডের আন্দোলনকে কিছুটা দুর্বল করেছিলেন৷ এবার পর্যটন মরশুমের ঠিক আগে তিনি পরের চালটি দিলেন৷ দার্জিলিংয়ে সাম্প্রতিক রহস্যময় বোমা বিস্ফোরণ এবং সেই সূত্রে বহির্দেশীয় যোগসাজশের অভিযোগ ওঠায় বিমল গুরুং এমনিতেই এখন বেকায়দায়৷ তাঁকে এবার নিজেরই দলে আরও একঘরে করে দিতে চান মমতা৷ লক্ষণ স্পষ্ট যে, দার্জিলিং জেলায় এই বনধ আর বেশিদিন চলবে না৷ এমনকি বিল গুরুংও তাতে সায় দিতে বাধ্য থাকবেন৷
দার্জিলিংয়ের ঐতিহ্যবাহী ‘টয় ট্রেন’
দার্জিলিংয়ের টয় ট্রেন ইউনেসকো ঘোষিত একটি ঐতিহ্যবাহী রেলওয়ে হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত৷ টয় ট্রেনের ওয়ার্কশপটাকে এখন দেখলে মনে হয় যেন একটা মিউজিয়াম, যে ঐতিহ্য দার্জিলিং তো বটেই, এক সময় যা সারা বাংলার গর্ব ছিল৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ে
আদত নামটা এমন হলেও, পর্যটক এবং স্থানীয় মানুষজন আদর করে ডাকেন ‘টয় ট্রেন’৷ এই ট্রেন ইউনেসকো ঘোষিত একটি ঐতিহ্যবাহী রেলওয়ে হিসেবে আন্তর্জাতিক স্তরে স্বীকৃত৷ আগে এই টয় ট্রেন চলত নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে দার্জিলিং পর্যন্ত৷ এখন অবশ্য তার যাত্রা সীমাবদ্ধ দার্জিলিং আর ভারতের সর্বোচ্চ রেলস্টেশন ঘুম-এর মধ্যে, দিনে চারবারের জয় রাইডে৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
বাষ্পচালিত ইঞ্জিন
কাজেই টয় ট্রেনের বাষ্পচালিত ইঞ্জিনগুলো এখন কার্যত অবসর জীবন কাটায় দার্জিলিংস্টেশনের লাগোয়া লম্বা এক শেডের তলায়৷ যদিও মাঝেমধ্যে জয় রাইডে যাওয়ার জন্য এদেরও ডাক পড়ে৷
ছবি: DW/Zeljka Telisman
সচল ওয়ার্কশপ
দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ের নিজস্ব কারিগরি বিভাগের কর্মীরা তাই রোজই এই ওয়ার্কশপে আসেন, ব্যস্ত থাকেন মেরামতিতে, যাতে ইঞ্জিনগুলো সচল থাকে৷টয় ট্রেনের বিরাট ওয়ার্কশপটাকে এখন দেখে মনে হয় যেন এক মিউজিয়াম, যেখানে সংরক্ষিত আছে ইতিহাস আর ঐতিহ্য, যে ঐতিহ্য দার্জিলিং তো বটেই, সারা বাংলার গর্ব ছিল এক সময়৷
ছবি: S. Bandopadhyay
প্রবীণ কারিগর
এই প্রযুক্তি-কর্মীদের অনেকেই ডিএইচআর-এ বহু বছর ধরে কাজ করছেন৷ যেমন এই প্রবীণ মুসলিম কারিগর, যিনি তাঁর অধস্তন এক ছোকরা মেকানিককে বকাবকি করছিলেন যে তারা কোনো কাজ ঠিকঠাক করতে পারে না৷ তাতে সবারই নাম খারাপ হয়৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
যেন জুল ভার্নের কল্পকাহিনি
কিন্তু আসল সমস্যা আদ্যিকালের এইসব ইঞ্জিনের পুরনো যন্ত্রাংশ৷ টয় ট্রেনের চালকের ঘরটা দেখলে মনে হয়, যেন সোজা জুল ভার্নের কল্পবিজ্ঞানের কাহিনি থেকে উঠে এসেছে৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
মান্ধাতা আমলের যন্ত্রাংশ
যন্ত্রপাতিগুলো দেখতে নেহাতই সহজ-সরল হলেও সবই অতি পুরনো, মান্ধাতার আমলের৷ ফলে এগুলোকে সারানো বা এর যন্ত্রাংশ জোগাড় করাটাই কারিগরদের জন্যে আজকাল মস্ত বড় সমস্যা৷ কাজেই একাধিক বাষ্পচালিত ইঞ্জিন আজকে স্থানু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ওয়ার্কশপে৷ যদি কোনোভাবে তাদের সারিয়ে তোলা যায়, সেই অপেক্ষায়৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
রোজকার দৌড়
তবে কিছু ইঞ্জিন এখনও রোজ নিয়ম করে রেল লাইনের উপর দিয়ে ছুটতে বের হয়৷ পাহাড়ি রাস্তায় পাতা ন্যারো গেজ রেললাইন ধরে তারা এঁকে-বেঁকে দৌড়ায়, নিজেদের ফিট রাখে৷ কে জানে, কখন কী কাজের ডাক আসে!দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গা ঘামানোর মতো ইঞ্জিনগুলোর থেকে ধোঁয়া বেরোয়, কলকব্জার ধাতব আওয়াজ হয় সারা শরীর জুড়ে৷ যেন পাহাড়ি রাস্তায় ছুটতে যাবে বলে সবাই খুব উত্তেজিত৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
নামেই যায় চেনা
টয় ট্রেনের সব ইঞ্জিনেরই একটা করে নাম আছে৷ আর সেই নামগুলো কোনো না কোনো শক্তিধর প্রাণীর নামে৷ খাড়াই রাস্তায় আস্ত একটা ট্রেন টেনে নিয়ে যাওয়ায় এদের যে বিক্রম, সম্ভবত তা-ই বোঝাতে৷কখনও ইঞ্জিনের নাম দাঁতাল হাতির নামে, ‘টাস্কার’৷ কখনও হিমালয়ের পরাক্রমশালী ঈগল পাখির নামে তার নাম৷ এখনও খুব যত্ন নিয়ে পিতলের নাম-ফলকগুলো ঘষে-মেজে চকচকে রাখা হয়৷