ক্যানাডার লা মালবে শহরে জি-সেভেন শীর্ষ বৈঠকে মার্কিন প্রেসিডেন্টের বাণিজ্য নীতির বিরুদ্ধে একজোট হচ্ছে ক্যানাডা ও ইউরোপ৷ ট্রাম্প নিজেও সংঘাতের পথে যেতে প্রস্তুত৷ জি-সেভেন গোষ্ঠীর ভাঙনের আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না৷
বিজ্ঞাপন
শিল্পোন্নত দেশগুলির গোষ্ঠী জি-সেভেন শীর্ষ সম্মেলন এতকাল নানা গোষ্ঠীর প্রতিবাদ-বিক্ষোভের মুখে পড়তো৷ এবার সেইসঙ্গে সদস্য দেশগুলির মধ্যেই যে অসন্তোষ দেখা যাচ্ছে, তা সত্যি তুলনাহীন৷ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ‘অ্যামেরিকা ফার্স্ট' নীতির আওতায় বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু করে কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন৷ জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থ তুলে ধরে ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়াম আমদানির উপর বাড়তি শুল্ক চাপিয়ে তিনি প্রবল সমালোচনার পাত্র হয়েছেন৷ গাড়ি আমদানির উপরেও তিনি শুল্ক চাপানোর ইঙ্গিত দিয়েছেন৷ অ্যামেরিকার বাণিজ্য ঘাটতি কাটাতে প্রয়োজনে তিনি আরও কড়া পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত৷
আয়োজক দেশ ক্যানাডা ও ইউরোপ ট্রাম্পকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছে যে, তারা এই ভয়ভীতির সামনে নতি স্বীকার করবে না৷ তারা একযোগে ট্রাম্পের নীতির বিরোধিতার ইঙ্গিত দিয়েছে৷ ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাক্রোঁ ইংরেজি ভাষায় লেখা এক টুইট বার্তায় স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন যে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট একঘরে হয়ে থাকতে হয়তো প্রস্তুত৷ কিন্তু বাকি নেতারাও প্রয়োজনে ৬টি দেশের আলাদা চুক্তি করতে প্রস্তুত৷ তাঁর মতে, এই ৬টি দেশ কিছু মূল্যবোধ ও এক অর্থনৈতিক বাজারের প্রতিনিধিত্ব করে৷ ঐতিহাসিকভাবে এই জোট এক আন্তর্জাতিক শক্তি হয়ে উঠেছে, বলেন মাক্রোঁ৷
ট্রাম্প এমন বার্তার জবাব দিতে বিলম্ব করেননি৷ তিনি এক টুইট বার্তায় মন্তব্য করেন, ‘‘দয়া করে প্রধানমন্ত্রী ট্রুডো ও প্রেসিডেন্ট মাক্রোঁকে বলুন যে, তাঁরা অ্যামেরিকার উপর বিশাল পরিমাণ শুল্ক চাপাচ্ছেন এবং আর্থিক নয়, এমন অনেক বাধা সৃষ্টি করছেন৷'' এ প্রসঙ্গে তিনি মনে করিয়ে দেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়নের উদ্বৃত্তের মাত্রা ১৫,১০০ কোটি ডলার৷ ক্যানাডাও মার্কিন কৃষিপণ্য ও অন্যান্য পণ্য আমদানি করে না৷ জি-সেভেন সম্মেলনে তিনি এই সব বিষয় তুলে ধরার ইঙ্গিত দিয়েছেন৷
এমন প্রেক্ষাপটে অনেকে জি-সেভেন কাঠামোয় ভাঙনের আশঙ্কা করছেন৷ অ্যামেরিকাকে বাইরে রেখে জি-সিক্স প্লাস ওয়ান নামের এক কাঠামোর কথাও শোনা যাচ্ছে৷
জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল আশঙ্কা করছেন যে, দুই দিনের সম্মেলনের শেষে যৌথ ঘোষণাপত্র নিয়ে ঐকমত্য সম্ভব হবে কিনা, তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে৷ তবে আপোষের বদলে মতপার্থক্য মেনে নিয়ে ঘোষণাপত্র না প্রকাশ করাই সততার পরিচয় হবে বলে তিনি মনে করেন৷
এই মুহূর্তে জি-সেভেন শীর্ষ সম্মেলনের তুলনায় ট্রাম্প আগামী সপ্তাহে উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের সঙ্গে শীর্ষ সম্মেলন নিয়ে বেশি ব্যস্ত রয়েছেন৷ ওয়াশিংটনে তিনি জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করেন৷ জি-সেভেন শীর্ষ সম্মেলন শেষ হবার আগেই শনিবার সকালে তিনি সিঙ্গাপুরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবেন৷
জাপানের প্রধানমন্ত্রী আবে ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট মাক্রোঁ ট্রাম্পের সঙ্গে ব্যক্তিগত স্তরে উষ্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলির ক্ষেত্রে তাঁর মতবদল করতে ব্যর্থ হয়েছেন৷ এবারের সম্মেলনে তাঁদের খোলামেলাভাবে ট্রাম্পের বিরোধিতা করতে দেখা যাবে বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে৷
বাণিজ্য যুদ্ধ হলে কী ক্ষতি হবে?
ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর ‘অ্যামেরিকা ফার্স্ট’ নীতি রূপায়ন করতে আমদানির পথে বাধা সৃষ্টি করছেন৷ সেই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফলে আন্তর্জাতিক মুক্ত বাণিজ্য কাঠামোর মারাত্মক ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে৷ তারই কিছু দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হলো৷
ছবি: Imago/Ralph Peters
বাণিজ্য যুদ্ধের অর্থ কী?
কোনো দেশ কোনো এক বা একাধিক পণ্য আমদানির উপর কর, শুল্ক বা অন্য কোনো আর্থিক বোঝা চাপালে বাকি দেশগুলিও পালটা পদক্ষেপ নিতে পারে৷ বিশেষ করে অ্যামেরিকা ও চীনের মতো বিশাল দেশের সংঘাতের জের ধরে গোটা বিষয়টি আন্তর্জাতিক স্তরে বাণিজ্য যুদ্ধের আকার নিতে পারে, যা নিয়ন্ত্রণে আনা মোটেই সহজ হবে না৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/T. Peter
অতীত দৃষ্টান্ত
১৯৩০-এর দশকে শেষ বাণিজ্য যুদ্ধের জের ধরে ‘গ্রেট ডিপ্রেশন’ বা বিশাল মন্দা আরও মারাত্মক আকার ধারণ করেছিল৷ মার্কিন প্রেসিডেন্ট হার্বার্ট হুবার সে বছর শুল্ক সংক্রান্ত নতুন আইন কার্যকর করার ফলে ২০ হাজারেরও বেশি পণ্যের উপর শুল্ক চাপানো হয়েছিল৷ ট্রাম্প প্রশাসন অবশ্য দাবি করছে যে, এ ক্ষেত্রে শুধু নির্দিষ্ট কিছু পণ্য ও দেশের জন্য শুল্ক চাপানো হচ্ছে৷
ছবি: Reuters/Library of Congress
ট্রাম্প কেন বাণিজ্য যুদ্ধের পথে এগোচ্ছেন?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য প্রতিকূল বাণিজ্য ঘাটতির বিরুদ্ধে শুরু থেকেই তোপ দেগে এসেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প৷ তবে সমালোচকদের মতে, এমন সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির ফলে তিনি অ্যামেরিকার সার্বিক বাণিজ্যিক সম্পর্কের স্বার্থ দেখতে পাচ্ছেন না৷ কারণ, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক কাঠামো তোলপাড় হয়ে গেলে আখেরে অ্যামেরিকারই ক্ষতি হবে৷ ডলারের বিনিময় মূল্য বেড়ে যাবে, রপ্তানি কমে যাবে এবং প্রবৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হবে৷
ছবি: picture-alliance/K. Ohlenschläger
পালটা পদক্ষেপ
ট্রাম্প প্রশাসন একের পর এক শাস্তিমূলক পদক্ষেপ ঘোষণা করলে বাকি দেশগুলিও হাত গুটিয়ে বসে থাকবে না৷ ক্যানাডা, মেক্সিকো, চীন, জাপান, ব্রাজিল ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন অ্যামেরিকার বিরুদ্ধেও পালটা পদক্ষেপের প্রস্তুতি নিচ্ছে৷ এমন বাণিজ্য যুদ্ধ এড়াতে দ্বিপাক্ষিক বোঝাপড়ার চেয়ে বহুপাক্ষিক সমাধানসূত্রের পরামর্শ দিচ্ছেন অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরা৷
ছবি: Reuters/W. Rattay
অ্যামেরিকার ক্ষতি
সব সাবধানবাণী উপেক্ষা করে ট্রাম্প যদি সত্যি আমদানির উপর বাড়তি শুল্ক চাপান, তার পরিণতি অ্যামেরিকার জন্যও ইতিবাচক হবে না৷ যেমন, ইস্পাত আমদানির উপর শুল্ক চাপালে অ্যামেরিকার বাজারেও তার মূল্য বেড়ে যাবে৷ তার ফলে মার্কিন ইস্পাত কোম্পানিগুলির লাভ হলেও ক্রেতাদের বাড়তি মূল্য গুনতে হবে৷ যে কোম্পানিগুলি ইস্পাত ব্যবহার করে পণ্য উৎপাদন করে, তাদের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে৷
ছবি: picture alliance/dpa/R. Weihrauch
পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া
অ্যামেরিকায় ইস্পাত রপ্তানি করতে না পারলে চীন ইউরোপের বাজারে তা আরও সস্তায় বিক্রি করার চেষ্টা করতে পারে৷ স্বাভাবিক বাণিজ্য ব্যাহত হলে এমন আরও দৃষ্টান্ত দেখা যেতে পারে৷ সামগ্রিকভাবে এমন অস্বাভাবিক প্রবণতা নানাভাবে সাধারণ মানুষের জন্য ক্ষতিকর হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে৷ সাম্প্রতিক নানা সংকট কাটিয়ে বিশ্ব অর্থনীতি যখন সবে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে, তখন নতুন করে এমন বিপদ দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠছে৷
ছবি: picture alliance/dpa/XinHua
আইনি লড়াই
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংগঠন ডাব্লিইউটিও সাম্প্রতিক কালে বিশ্ব বাণিজ্যের বিধিনিয়ম স্থির করে এসেছে এবং বিবাদ মেটানোর চেষ্টা করেছে৷ বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু হলে মামলার সংখ্যা আরও বেড়ে যাবে৷ সব পক্ষ ডাব্লিইউটিও-র রায় না মানলে এই সংগঠন অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়তে পারে৷ এমন কাঠামো তার কার্যকারিতা হারালে ভবিষ্যতে সেই ক্ষতি পূরণ করা সহজ হবে না৷