বিধানসভা ভোটের আগে দলের মধ্যে অসন্তোষ সামাল দিতে তৎপর তৃণমূল কংগ্রেস৷ তবে যারা দল ছেড়ে গেছেন, তাদের সঙ্গে সরাসরি বিরোধে যাচ্ছেন নেতা-নেত্রীরা৷
বিজ্ঞাপন
মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি সোমবার নন্দীগ্রামের তেখালির জনসভায় নন্দীগ্রামে থেকে ভোটে দাঁড়ানোর কথা বলে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করলেন নন্দীগ্রাম তথা পূর্ব মেদিনীপুরের ভূমিপুত্র, দলত্যাগী শুভেন্দু অধিকারীকে৷ বললেন, বিজেপিকে এক ইঞ্চি রাজনৈতিক জমিও বিনা লড়াইয়ে ছাড়বে না তৃণমূল কংগ্রেস৷ বস্তুত গত কয়েক দিনে দলের যে ক'জন সাংসদ, বিধায়ক দলের বিরুদ্ধে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন, তাদের সঙ্গে কথা বলে, বুঝিয়ে সবাইকেই নিরস্ত করেছে তৃণমূল নেতৃত্ব৷
সাংসদ অভিনেত্রী শতাব্দী রায় ফেসবুক লাইভ করে নিজের নতুন সিদ্ধান্ত ঘোষণার কথা জানিয়েছিলেন৷ পরদিনই তার দিল্লি যাওয়ার কথা ছিল৷ সেখানে অমিত শাহ'র সঙ্গে দেখা করার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেননি শতাব্দী৷ কিন্তু দলের আরেক সাংসদ, মমতার ভাইপো অভিষেক ব্যানার্জির সঙ্গে বৈঠকের পর শতাব্দী ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে জানান, কাজ করতে গেলে এরকম অভাব অভিযোগ থাকতেই পারে৷
উত্তরবঙ্গে তৃণমূলের দাপুটে নেতা গৌতম দেব অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন প্রকাশ্যেই৷ সিনিয়র নেতা সুব্রত বক্সির সঙ্গে ফোনে কথা বলার পর তিনিও ‘ঠান্ডা' হয়েছেন৷ হাওড়ার তৃণমূল সাংসদ, প্রাক্তন জাতীয় ফুটবলার প্রসূন ব্যানার্জি প্রকাশ্যে ‘অভিমান' জানিয়েছিলেন৷ তিনিও এখন শান্ত৷
এক নজরে ভারতের আঞ্চলিক দল
২০১৯ সালে ভারতের লোকসভা নির্বাচন৷ ইতিমধ্যে কেন্দ্রে ও রাজ্যে সরকার গড়া এবং টিকিয়ে রাখায় আঞ্চলিক দলগুলির ভূমিকা অনস্বীকার্য হয়ে উঠেছে৷ জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা এই দলগুলি নিয়েই এই ছবিঘর৷
ছবি: Getty Images/AFP/Strdel
মা-মাটি-মানুষের তৃণমূল কংগ্রেস
১৯৯৮ সালে পশ্চিমবঙ্গে জাতীয় কংগ্রেস ভেঙে জন্ম৷ দলের প্রতিষ্ঠাতা সভানেত্রী রাজ্যের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ প্রতীক জোড়া ঘাসফুল ও স্লোগান ‘মা-মাটি-মানুষ’৷ ৩৪ বছরের বাম শাসনের অবসান ঘটিয়ে ২০১১ সালে এককভাবে ১৮৪টি আসন পেলেও কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বিধানসভার ২২৭ টি আসন নিয়ে প্রথমবারের মতো সরকার গঠন করে৷ ২০১৬ সালে বিধানসভা ভোটে ২৯৪টি আসনের মধ্যে এককভাবে ২১১টি আসন পেয়ে আবার ক্ষমতায়৷
ছবি: UNI
দলিতের দল বহুজন সমাজ পার্টি
উত্তরপ্রদেশের বহুজন সমাজ পার্টি (বিএসপি) দলিত ও পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের পার্টি৷ ভারতীয় সংবিধান রচনার প্রাণপুরুষ, দলিত নেতা ডক্টর বি. আর আম্বেদকরের আদর্শে ১৯৮৪ সালে দলটি গঠন করেন কাঁসিরাম৷ ২০০১ সালে দলের ভার নেন উত্তরপ্রদেশের চারবারের মুখ্যমন্ত্রী মায়াবতী৷ রাজ্যের প্রথম দলিত মুখ্যমন্ত্রী তিনি৷ নির্বাচনী প্রতীক চিহ্ন হাতি৷ বর্তমানে সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় বিএসপির চারজন থাকলেও লোকসভায় একজনও নেই৷
ছবি: Bahujan Samaj Party
ক্ষমতার আশায় সমাজবাদী পার্টি
১৯৯২ সালে মূল জনতা দল ভেঙে গঠিত সমাজবাদী পার্টি (এসপি) উত্তরপ্রদেশে খুবই প্রভাবশালী৷ প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মুলায়েম সিং যাদব, তবে বর্তমান দলনেতা অখিলেশ সিং যাদব৷ দলের মতাদর্শ গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র৷ নির্বাচনী প্রতীক সাইকেল৷ ২০১২ সালের বিধানসভা ভোটে শাসক দল বহুজন সমাজ পার্টিকে পরাজিত করে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে উত্তরপ্রদেশে সরকার গঠন করে৷ লোকসভা এবং রাজ্যসভায় বর্তমান আসন সংখ্যা যথাক্রমে ৭টি এবং ১৩টি৷
ছবি: picture-alliance
দাঁড়িপাল্লায় অকালী দল
পাঞ্জাব ও হরিয়ানার শিখ ও পাঞ্জাবি জাতীয়তাবাদী আঞ্চলিক দল শিরোমণি অকালী দল৷ সব থেকে পুরানো এবং প্রভাবশালী আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলটি ‘অকালী’ নামেই পরিচিত৷ নির্বাচনি প্রতীক দাঁড়িপাল্লা৷ বর্তমান সভাপতি সুখবীর সিং বাদল৷ গুরুদোয়ারার মতো শিখ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলি নিয়ন্ত্রণ করে তাঁর দল৷ প্রতিষ্ঠা ১৯২০ সালে৷ বর্তমানে সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভায় অকালী দলের সাংসদ চারজন, বিধানসভায় ১১৭ টি আসনের মধ্যে মাত্র ১৫টি৷
ছবি: Getty Images/AFP/S. Panthaky
দক্ষিণ ভারতের এআইএডিএমকে
অখিল ভারত আন্না দ্রাবিড় মুনেত্র কড়গম, বা সংক্ষেপে এআইএডিএমকে, ভারতের তামিল নাডু রাজ্যের রাজনৈতিক দল৷ ১৯৭২ সালে এম.জি. রামচন্দ্রন কর্তৃক এই দলটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল৷ দলীয় প্রতীক জোড়া পাতা৷এই দল সংসদে তৃতীয় বৃহত্তম দ্রাবিড় আঞ্চলিক পার্টি৷ ‘আম্মা’ জয়ললিতার নেতৃত্বে ১৯৮৯ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতা ধরে রাখে এআইএডিএমকে৷ রাজ্যের ইতিহাসে সবচেয়ে সফল দল এআইএডিএমকে৷
ছবি: Getty Images/AFP/A. Sankar
উদীয়মান ডিএমকে?
দ্রাবিড় মুনেত্র কড়গম, সংক্ষেপে ডিএমকে তামিলনাড়ু রাজ্যের পুরনো আঞ্চলিক দল৷ প্রতিষ্ঠাতা সি.এন আন্নাদুরাই৷ ‘জাস্টিস পার্টি’ হিসেবে পরিচিত দ্রাবিড় কড়গম পার্টি ভেঙে গঠিত হয় ১৯৪৯ সালে৷ ১৯৬৯ সাল থেকে আমৃত্যু দলের নেতৃত্ব দেন করুণানিধি৷ মতাদর্শ সামাজিক গণতন্ত্র ও আঞ্চলিকতাবাদ এবং নির্বাচনি প্রতীক উদীয়মান সূর্য৷ বিরোধীনেত্রী জয়ললিতার মৃত্যুর পর আগামী ভোটে কেমন ফল করে ডিএমকে, এখন তা-ই দেখার অপেক্ষা৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/A. Sankar
আম জনতার আম আদমি পার্টি
২০১২ সালে গঠিত আম আদমি পার্টি বর্তমানে দিল্লির শাসক দল৷ ২০১১ সালে জন লোকপাল বিল পাস করানো নিয়ে দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনকারী আন্না হাজারে ও অরবিন্দ কেজরিওয়ালের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দেয়৷ ২০১৩ সালে দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে নামে আম আদমি পার্টি ও সরকার গঠন করে৷ অবিলম্বে লোকপাল বিল আনার শর্ত পূরণ হবার সম্ভাবনা না থাকায় ৪৯ দিনের মাথায় ইস্তফা দিলেও ২০১৫ সালের বিধানসভা ভোটে ফের ক্ষমতায় আসে৷
ছবি: Reuters/A. Mukherjee
বিজু-র জয়রথ কি বজায় থাকবে?
১৯৯৭ সালে গঠিত বিজু জনতা দল বর্তমানে ওড়িষায় ক্ষমতাসীন৷ প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বিজু পট্টনায়েকের ছেলে নবীন পট্টনায়েক এখন মুখ্যমন্ত্রী৷ পিতার নামেই দলের নাম৷ দলের প্রতীক চিহ্ন শঙ্খ৷ নবীন পট্টনায়েক ২০০৯ সালের সংসদীয় নির্বাচনে দাঁড়ান এবং বিপুল ভোটে জয়ী হন৷ ২০০০ সাল থেকে বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ায় নবীন পট্টনায়ক এখন মোট চারবারের মুখ্যমন্ত্রী৷
ছবি: Getty Images/AFP/Strdel
8 ছবি1 | 8
তবে যারা এর মধ্যেই দল ছেড়ে গেছেন, তাদের বিরুদ্ধে কার্যত যুদ্ধ ঘোষণা করেছে তৃণমূল৷ মমতা যেমন নন্দীগ্রাম থেকে ভোটে লড়ার কথা বলে শুভেন্দু অধিকারী ও তার রাজনৈতিক প্রভাবশালী পরিবারকে চ্যালেঞ্জ করলেন, তেমনই প্রাক্তন মন্ত্রী ও মেয়র শোভন চ্যাটার্জির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন তৃণমূলের অন্যতম মুখপাত্র, প্রাক্তন সাংসদ কুনাল ঘোষ৷ দলে প্রাপ্য সম্মান না পাওয়ার কথা বলে বিজেপিতে গেছেন শোভন৷ কুনালের কটাক্ষ, যে দল নিজেদের পার্টি অফিসে নারদার ঘুষের টাকা নেওয়ার ভিডিও দেখিয়ে শোভনের গ্রেপ্তারি দাবি করেছিল, সেই দলে যোগ দিয়ে উনি কতটা সম্মান বাড়ালেন? অভিনেতা রুদ্রনীল ঘোষ, যিনি মমতার দাক্ষিণ্যেই এর আগে একাধিক সরকারি পদ পেয়েছেন, তিনি সম্প্রতি মুসলিমবিরোধীমন্তব্য করে স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, তিনি রাজনৈতিক আনুগত্য বদলাবেন৷ তার কারণ হিসেবে রুদ্রনীল বলেছেন, পদ দিলেও তাকে কাজ করতে দেওয়া হয়নি৷ কুনালের পাল্টা কটাক্ষ, ডিসেম্বরে সরকারি পদের মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত কিছু মনে হয়নি৷ কিন্তু যেই মেয়াদ শেষ হলো, বিবেক জাগ্রত হলো!
যারা দলত্যাগী, তাদের সম্বন্ধে কুনালের মন্তব্য, ‘‘এদের সংখ্যাটা দশমিক শূন্য এক শতাংশও নয়৷ আজকের দিনে মিডিয়ার সূত্রে তারা সামনে আসছে৷ এবার, কাজ করতে গেলে কিছু সমস্যা হয়৷ যে কোনো সংসারে হয়, পরিবারে হয়, সংগঠনেও হয়৷ হতেই পারে৷ কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, কয়েকজন, তারা দায়িত্বটা পুরো মেয়াদ ভোগ করার পর এই কথাগুলো বলছেন৷ মানুষ তাদের চিনে নিচ্ছেন৷ এটা দলের যে খুব সংকটের বিষয়, তা আদৌ নয়৷''
‘‘এটা দলের যে খুব সংকটের বিষয়, তা আদৌ নয়’’: কুণাল ঘোষ
এই পুরো মেয়াদ পদে থাকার পর হঠাৎ হৃদয় পরিবর্তন নিয়ে কটাক্ষ, বিদ্রূপ, সমালোচনা সমাজের অন্যান্য স্তরেও হচ্ছে৷ সম্প্রতি এক বিতর্কসভায় অভিনেতা রুদ্রনীল ঘোষের রঙ বদল নিয়ে সরাসরি প্রশ্ন তুলেছেন আরেক অভিনেতা সায়নী ঘোষ৷ তিনি তার আপত্তির কারণটা বোঝাতে গিয়ে বললেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গের মানুষ সব থেকে বেশি গণতন্ত্রে, বাক স্বাধীনতায় বিশ্বাসী৷ এর আগে যারা রাজনীতি করেছে, তারা সেটায় হস্তক্ষেপ করেনি৷ কিন্তু এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে, সুবিধাবাদের রাজনীতি তো অবশ্যই চলছে৷ আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, বদলের একটা পালা চলছে, যাকে আমি বলবো, ‘যেমন খুশি লাফাও প্রতিযোগিতা'! সেই জায়গা থেকে এটা অবশ্যই একটা চিন্তার ব্যাপার৷ কারণ, সুশাসনের সঙ্গে সুপরিবেশও পশ্চিমবঙ্গে নিশ্চিত করতে হবে৷''
‘‘পশ্চিমবঙ্গের মানুষ সব থেকে বেশি গণতন্ত্রে, বাক স্বাধীনতায় বিশ্বাসী’’: সায়নী ঘোষ
পরিস্থিতি বদলালে দ্রুত দল বদলে ফেলার প্রবণতা নতুন নয়৷ কিন্তু এবার সেই সুবিধাবাদী নীতি প্রকাশ্য বিরোধিতার মুখে পড়ছে৷ যে মেজাজটা ধরা পড়েছে অভিনেতা পরমব্রত চ্যাটার্জির সদ্য প্রকাশিত একটি লেখায়, যেখানে উনি বলছেন, ‘‘বিজেপিতে যেতে হলে গটগট করে যাও, কিন্তু সেটার নৈতিকতা বোঝাতে এসো না!''