সানাই সম্রাট বিসমিল্লাহ খানের বাড়ি ভেঙে ফেলা হলো। প্রবল নিন্দায় তাঁর অগণিত ভক্ত।
বিজ্ঞাপন
বারাণসীর ডালমান্ডির সরাই হারাহা। এখনও সেই গলিতে ঢুকলে ইতিহাস গ্রাস করে সংগীতপ্রেমীদের। দুই দশক আগেও এই গলিতে ঢুকলে বেহাগ রাগ ভেসে আসত কানে। ওই গলিরই তিনতলা একটি বাড়ির উপরতলায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা সংগীত অভ্যাস করতেন সানাই সম্রাট বিসমিল্লাহ খান। গোটা পৃথিবী যাঁর সুরে পাগল। তাঁকে ঘিরে বসে থাকতেন শ্রোতা, ভক্ত আর ছাত্রছাত্রীরা। ১২ অগাস্ট ভেঙে ফেলা হলো সেই হেরিটেজ বাড়ি। অচিরেই সেখানে তৈরি হবে কমার্শিয়াল কমপ্লেক্স। অথচ এত বড় খবরটা না কি জানাই ছিল না বারাণসীর প্রশাসনের।
বারাণসীর এই তিনতলা বাড়িটিই ছিল বিসমিল্লাহ খানের সব চেয়ে পছন্দের জায়গা। পৃথিবীর বহু দেশ তাঁকে সেখানে গিয়ে থাকার এবং সানাই শেখানোর অনুরোধ করেছে। কিন্তু বরাবরই বিসমিল্লাহ বলেছেন, বারাণসীর ওই বাড়ি ছাড়া তাঁর ঘুম আসে না। নিজের জায়গা ছেড়ে কোথাও চলে যাওয়ার কথা কল্পনাই করতে পারেন না তিনি। ওই বাড়ির, ওই তিনতলার ঘরেই ২০০৬ সালে মৃত্যু হয়েছে তাঁর। অনেকেই তার পর সেই ঘরটিতে বিসমিল্লাহ খানের নামাঙ্কিত মিউজিয়াম তৈরি করতে চেয়েছেন। কিন্তু রাজি হননি তাঁর নাতিরা। বিসমিল্লাহর সংগীত যাপন গ্রহণ করেননি নাতিরা।
কিছুদিন আগে দাদুর চারটি সানাই এক ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করে দিয়েছিলেন এক নাতি। তাও মাত্র ১৭ হাজার টাকায়। পরে অবশ্য উত্তরপ্রদেশ পুলিশের স্পেশাল টাস্ক ফোর্স সেই সানাই উদ্ধার করেছিল। গ্রেফতার করা হয়েছিল এক নাতিকেও। কিন্তু তাতেও তাঁদের দমিয়ে রাখা যায়নি। স্থানীয় এক বাহুবলী রাজনীতিকের কাছে বাড়িটি বিক্রি করে দিয়েছেন নাতিরা। গত ১২ অগাস্ট বাড়ির তিনতলা ভেঙে ফেলা হয়েছে। গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বিসমিল্লাহ খানের ঘর। কিছু দিনের মধ্যেই সেখানে একটি বিশাল কমার্শিয়াল কমপ্লেক্স তৈরি হওয়ার কথা। শোনা যাচ্ছে, ওই কমপ্লেক্সের অর্ধেক দোকান এবং ফ্ল্যাট পাবে বিসমিল্লাহর পরিবার। বাকি অর্ধেক থাকবে নির্মাণকারী সংস্থার। যা বিক্রি করা হবে।
ভারতের প্রভাবশালী শিল্পীরা
মনের ভাব প্রকাশে শিল্প ও সাহিত্য চিরদিনই সবচেয়ে প্রভাবশালী মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হয়েছে৷ ক্লাসিক্যাল মিউজিক, বলিউডের দাপট, সব মিলিয়ে তাই ভারতীয় শিল্পী-সাহিত্যিকদের বিশ্বজুড়ে গর্বিত পদচারণা৷
ছবি: Manjunath Kiran/AFP/Getty Images
ওস্তাদ রবি শংকর
গত শতকের পঞ্চাশের দশকে পশ্চিমা বিশ্বে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতকে যাঁরা জনপ্রিয় করে তুলেছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ওস্তাদ রবি শংকর৷ সেতারে তাঁর শাস্ত্রীয় সংগীতের মূর্ছনা অনুপ্রাণিত করেছে বিখ্যাত সব পশ্চিমা শিল্পীকেও৷ বিখ্যাত বেহালাবাদক ইয়েহুদি মেনুহিন থেকে শুরু করে জনপ্রিয় ব্যান্ড বিটলসের জর্জ হ্যারিসনও তাঁদের একাধিক মিউজিকে ব্যবহার করেছেন ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত৷
ছবি: AP
লতা মঙ্গেশকর
ভারতের মারাঠায় জন্ম নেয়া কিংবদন্তী গায়িকা লতা মঙ্গেশকর এক হাজারের বেশি ভারতীয় ছবিতে গান করেছেন৷ এছাড়া বাংলাসহ ভারতের ২০টি ভাষায় গান গেয়ে বিশ্ব রেকর্ডও করেছেন তিনি৷ ২০০১ সালে কেবল দ্বিতীয় সংগীতশিল্পী হিসেবে ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান পেয়েছেন লতা৷
ছবি: AP
ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খান
বিয়েতে বধূবিদায়ে সানাইয়ের করুণ সুর একসময় প্রায় বাধ্যতামূলক ছিল৷ সেই সানাই বাজিয়ে যে কেউ বিশ্বখ্যাত হতে পারে, তা প্রমাণ করে গেছেন ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খান৷ ১৯৩৭ সালে কলকাতায় অল ইন্ডিয়া মিউজিক কনফারেন্সে সানাই বাজিয়ে এই যন্ত্রে ভারতীয় সংগীতের মূল মঞ্চে নিয়ে আসেন তিনি৷ ২০০৬ সালে মৃত্যুর আগে পেয়েছেন ভারতের চারটি বেসামরিক সম্মান- ভারতরত্ন, পদ্মবিভূষণ, পদ্মভূষণ এবং পদ্মশ্রী৷
ছবি: SAJJAD HUSSAIN/AFP/Getty Images
অমিতাভ বচ্চন
১৯৭০-এর শুরুতে বলিউড চলচ্চিত্র জগতে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন অমিতাভ এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তিশালী অভিনেতা হিসেবে স্থান করে নেন৷ পাঁচ দশকের বেশি সময়ের অভিনয় জীবনে ১৯০টির অধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন৷ ৭৬ বছর বয়সেও সমান তালে তরুণদের সাথে পাল্লা দিয়ে বলিউডে রাজত্ব করে চলেছেন বলিউডের শাহেনশাহ৷
ছবি: picture alliance/dpa/J. Kalaene
জুবিন মেহতা
এই তারকা মায়েস্ত্রো ১৯৩৬ সালে জন্ম নেন ভারতের মুম্বাইয়ে৷ ১৮ বছর বয়সে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় যান পড়াশোনা করতে৷ ইউরোপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েলে সফল ক্যারিয়ার গড়ে তুলেছেন মেহতা৷ কিন্তু পশ্চিমা মিউজিকের সাথে সম্মিলন ঘটিয়েছেন ভারতীয় দ্যোতনার৷ পশ্চিমা ক্লাসিক্যাল মিউজিক ভারতে পরিচিত করাতে গড়ে তুলেছেন নিজের ফাউন্ডেশন৷
ছবি: Getty Images/AFP/J. Jordan
যশ চোপড়া
অনেকেই বলে থাকেন, যশ চোপড়াকে ছাড়া বলিউড ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি কখনোই বিশ্বজুড়ে এত প্রভাব বিস্তার করতে পারতো না৷ ভারতীয় চলচ্চিত্রে যশ চোপড়া পরিচিত ‘রোমান্সের রাজা’ হিসেবে৷
ছবি: Getty Images/AFP/C. Court
শাহ রুখ খান
বলিউডের বাদশাহ শাহ রুখ খানকে আর নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কিছু নেই৷ হলিউডের অভিনেতা জনি ডেপ ও টম ক্রুজের একত্রে যত ভক্ত আছেন, বিশ্বজুড়ে ‘এসআরকে’ নামে পরিচিত এই সুপার স্টারের ফ্যান তার চেয়েও অনেক বেশি৷ মেলোড্রামাটিক সিনেমাতে দুর্দান্ত অভিনয়ের জন্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রাজত্ব করে চলেছেন শাহ রুখ৷
ছবি: Getty Images/AFP/S. Verma
সুবোধ গুপ্ত
ইন্স্টলেশন মাস্টার সুবোধ গুপ্ত বিশ্বজুড়ে পরিচয় করিয়েছেন ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’ নামের নতুন এক ট্রেন্ড৷ তাঁর কাজ সবচেয়ে বেশি অর্থের বিনিময়ে বিক্রির রেকর্ডও করেছে একাধিকবার৷ প্রায় সব কাজেই নিজের জন্মস্থান বিহারে কাটানো শৈশব এবং বিশ শতকে ভারতের পরিবর্তনের চিত্র ফুটিয়ে তুলতে তাঁর প্রয়াস দেখা যায়৷
ছবি: Imago/H. Förster
অরুন্ধতী রায়
২০১৪ সালে টাইম ম্যাগাজিনের বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ১০০ ব্যক্তির তালিকায় স্থান করে নিয়েছিলেন ভারতীয় ঔপন্যাসিক ও অ্যাক্টিভিস্ট অরুন্ধতী৷ তিনি পরিচিত হয়ে আছেন তাঁর পুরস্কার বিজয়ী উপন্যাস দ্য গড অব স্মল থিংস-এর জন্য৷ ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত এ উপন্যাসটি ১৯৯৮ সালের ম্যান বুকার পুরস্কার লাভ করেছিল৷
ছবি: picture-alliance/ANSA/G. Onorati
এ আর রহমান
এ আর রহমান পুরো নাম আল্লাহ রাখা রহমান৷ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের সাথে ইলেকট্রনিক মিউজিক এবং পশ্চিমা অর্কেস্ট্রাল মিউজিকের সম্মিলনের জন্যে বিখ্যাত এ আর রহমান৷ চলচ্চিত্রে মিউজিক পরিচালনার জন্য তিনি দুটি অস্কার পেয়েছেন৷ ২০০৪ সালে টাইমস ম্যাগাজিন তাঁকে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে৷
ছবি: Getty Images/AFP/J. Samad
10 ছবি1 | 10
স্বাভাবিক ভাবেই সানাই সম্রাটের বাড়ি ভেঙে ফেলার খবর প্রচার হতেই শোকের ছায়া নেমে এসেছে পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে থাকা অগণিত বিসমিল্লাহ ভক্তের মধ্যে। ঘটনার নিন্দা করেছেন বিসমিল্লাহর এক ছেলে এবং পাতানো মেয়ে। বিসমিল্লাহর ছোট ছেলে নাজিম হুসেইন তবলাবাদক। বাবার বাড়ি ভেঙে দেওয়ার তীব্র প্রতিবাদ করে তিনি বলেছেন, বারাণসীর প্রশাসনের কাছে তিনি আবেদন করেছেন, যাতে দ্রুত বাড়ি ভাঙার কাজ বন্ধ করা হয়। সংগীত শিক্ষার সূত্রেই বিসমিল্লাহ খান মেয়ে হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন সোমা ঘোষকে। সোমা সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ''বাবার ওই ঘর শুধুমাত্র একটি বাসস্থান নয়, আমাদের কাছে মন্দির। এ ঘটনা মেনে নিতে পারছি না। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের কাছে আবেদন করছি, দ্রুত হস্তক্ষেপ করুন। বাড়িটি বাঁচান।''
বারাণসীর প্রশাসন অবশ্য জানিয়েছে, বিসমিল্লাহর বাড়ি ভাঙা হচ্ছে, এমন খবরই তাদের কাছে ছিল না। তবে হেরিটেজ রক্ষা আন্দোলনের কোনো কোনো কর্মীর প্রশ্ন, প্রশাসনকে না জানিয়ে ওই বাড়ি ভাঙা হয়েছে, এমন ভাবার কারণ নেই। বিষয়টির মধ্যে সম্ভবত রাজনীতির মহারথীরা আছেন। তাই বাড়ি ভাঙা আটকানোর সাহস দেখাচ্ছেন না কেউ।