‘ভাত পাই না মাস্ক কিনবো কী দিয়ে?'
১ জুন ২০২০মাস্ক পরার আদেশ দেয়া হলেও সাধারণ মানুষ কোন ধরনের মাস্ক ব্যবহার করবেন তার কোনো নির্দেশনা দেয়া হয়নি। আর মাস্কের দামের ব্যাপারেও নেই কোনো নীতিমালা। বাজারে সাধারণ সার্জিক্যাল মাস্ক এখন প্রতিটি ১৫-২০ টাকা দামে বিক্রি হয়। আর এগুলো একবারই ব্যবহার করা যায়। পাঁচ সদস্যের একটি পরিবার বাইরে বের হলে এখন তাই দিনে ৭৫ থেকে ১০০ টাকা মাস্কের পিছনে ব্যয় করতে হবে। কয়টি পরিবারের পক্ষে তা সম্ভব?
সোমবার ঢাকার শাহবাগ এলাকায় দেখা গেছে, যারা বাইরে বের হচ্ছেন তাদের একটি অংশ মাস্ক ব্যবহার করছেন না। যারা ব্যবহার করছেন, তাদের অনেকেই আবার অননুমোদিত কাপড়ের মাস্ক পরছেন। কারো কারো কাপড়ের মাস্ক আবার বেশ পুরনো। কেউ আবার মাস্ক পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। রিকশাচালক মোসলেম উদ্দিন মাস্কই ব্যবহার করছেন না। তার কথা, ‘‘এখন পেটের ভাত জোগাড় করাই কষ্টের, মাস্ক কিনবো কী দিয়ে?'' তিনি অবশ্য মনে করেন, মাস্ক পরার দরকার আছে। আর জেল জরিমানার খবরও তিনি শুনেছেন। তবে তার একটাই কথা, ‘‘আল্লায় যা করে।''
বাংলাদেশে ২৬ মার্চ থেকে লকডাউন শুরু হওয়ার পর একটি সার্জিক্যাল মাস্কের দাম ১২০ থেকে ১৫০ টাকা হয়েছিল। ভোক্তা অধিদপ্তরের অভিযানের পর তা কমে আসে। এখন প্রতিটি সার্জিক্যাল মাস্কের দাম ১৫-২০ টাকায় নেমে এসেছে বলে জানান রমনা ফার্মেসির মালিক এজাজ উদ্দিন। তিনি বলেন , ‘‘ স্থানীয়ভাবেও এখন মাস্ক তৈরি হচ্ছে। অনেকেই চীন থেকে মেশিন এনে মাস্ক তৈরি করে বাজারে ছাড়ছেন। তবে সব মাস্ক মানসম্মত নয়। আর এ নিয়ে কোনো নীতিমালাও নেই।'' তিনি আরো বলেন, ভালো মানের এক জোড়া হ্যান্ডগ্লোভসেরর দাম ২২-২৫ টাকা। আর এন-৯৫ মাস্কের দাম ৮০০ টাকা।''
আর কাপড়ের নানা ধরনের মাস্ক সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘‘এগুলো আসলে যে যার মতো বানিয়ে বিক্রি করছে। এর কোনো অনুমোদন নেই। আমরা বিক্রিও করি না।''
ওষুধ প্রশাসন জানিয়েছে, একটি সাধারণ মাস্কের দাম ৩০ টাকার বেশি হতে পারবে না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ডা. নাসিমা সুলতানা তার আদেশে বলেছেন, ঘরের বাইরে মাস্ক ব্যবহার না করলে ২০১৮ সালের সংক্রমণ আইনের ২৪ (১,২), ২৫(১-এর ক,খ) এবং ২৫ (২) ধারায় ব্যবস্থা নেয়া হবে। এই ধারা অনুযায়ী মাস্ক ব্যবহার না করলে শাস্তি সর্বোচ্চ ছয় মাসের জেল এবং এক লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে। তবে জেলা প্রশাসকদের সতর্কতার সাথে আইনটি ব্যবহারের জন্য বলা হয়েছে। এরই মধ্যে মাস্ক ব্যবহার ও স্বাস্থ্যবিধি মানাতে সারাদেশে মোবাইল কোর্ট কাজ করবে বলেও জানানো হয়েছে। কিন্তু এই নির্দেশনায় কোন ধরনের মাস্ক ব্যবহার করতে হবে সে ব্যাপারে কিছু বলা হয়নি।
অতিরিক্ত মহাপরিচালক ডা. নাসিমা সুলতানা বলেন, ‘‘আমরা মাস্কের সাথে অন্যান্য স্বাস্থ্য নিরাপত্তা, সামাজিক দূরত্বও বাধ্যমূলক করেছি। সাধারণ মানুষ তিন স্তরের কাপড়ের মাস্ক ধুয়ে ব্যবহার করলে খরচ অনেক কম হবে।''
বাজারে তিন স্তরের কোনো অনুমোদিত কাপড়ের মাস্ক নেই জানালে তিনি বলেন, ‘‘এটা তো আমাদের দায়িত্ব নয়। সরকার এবং সরকারের অনেক সংস্থা আছে, তাদের উদ্যোগ নেয়া উচিত। গরিব মানুষ যাতে কম দামে, অথবা বিনা মূল্যে মাস্ক পায়. তার ব্যবস্থা করা দরকার। অনেকে তো ত্রাণ দেন, তারা মাস্কও দিতে পারেন।''
যাদের খাওয়ার টাকাই নেই ,তাদের মাস্কের জন্য জেল, জরিমানা কতটুকু যৌক্তিক? ডা. নাসিমা সুলতানা বলেন, ‘‘আমরা এ কারণেই আইনটি সতর্কতার সাথে প্রয়োগ করতে বলেছি। যার পেটে ভাত নেই, তাকে তো মাস্কের জন্য জেল, জরিমানা করা যায় না। আইনটি মানবিকভাবে প্রয়োগ করতে হবে।''
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্বিবিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. জাহিদুর রহমান খান বলেন, ‘‘সাধারণ ব্যবহারের জন্য সার্জিক্যাল মাস্কই যথেষ্ট। এটা তিন স্তরের। আমরা বলে থাকি এই মাস্ক ৬০ থেকে ৬৫ ভাগ ভাইরাস বা জীবাণু প্রতিরোধ করে। আর এন-৯৫ মাস্ক চিকিৎসকদের জন্য। এটা ৯৫ ভাগ পর্যন্ত প্রতিরোধ করে। তবে এই মাস্ক যাদের শ্বামকষ্ট আছে, যারা হার্টের রোগী, তারা ব্যবহার করলে বিপদে পড়তে পারেন। কারণ, এই মাস্কে অক্সিজেন সরবরাহ কম হয়।''
তিনি জানান, ‘‘তিন লেয়ারের সার্জিক্যাল মাস্ক একবার ব্যবহার করেই ফেলে দিতে হবে। ধুয়ে ব্যববহারের সুযোগ নেই। আর তথাকথিত কাপড়ের মাস্ক আসলে কোনো কাজে আসে না। দিনের পর দিন না ধুয়ে এই কাপড়ের মাস্ক ব্যবহার করলে উল্টো ক্ষতির কারণ হতে পারে।''
তিনি আরো বলেন, ‘‘সাধারণ মানুষের হ্যান্ড গ্লাভস ব্যবহারের প্রয়োজন নেই। এটাও চিকিৎসকদের দরকার। বরং সাধারণ মানুষ হ্যান্ড গ্লাভস ব্যবহার করলে ক্ষতি হতে পারে। সারাদিন এটা পরে থাকলে তাতে নানা জীবাণু লেগে থাকতে পারে। হাত খালি থাকলে বারবার সাবান দিয়ে ধোয়া যায়।''
তিনি মনে করেন, ‘‘মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার আগে এর দাম সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা দরকার। আর গরিব মানুষকে বিনামূল্যে নিয়মিত মাস্ক সররবাহের ব্যবস্থা করতে হবে। জানাতে হবে কোন ধরনের মাস্ক ব্যবহার করা যাবে। নয়তো তারা শাস্তি এড়াতে ময়লা কাপড় দিয়ে, লুঙ্গি ও গামছার কাপড় দিয়ে মাস্ক বানিয়ে পরা শুরু করবে। তা আরো বড় বিপদ ডেকে আনবে।''
এই আইনটি বাস্তবতার নিরিখে করা হয়নি বলে মনে করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার ছায়েদুল ইসলাম সুমন। তিনি বলেন, ‘‘যারা আইন করেন, তারা আইন করার জন্য এটা করেছেন। কার্যকর করা সম্ভব কিনা তা ভেবে দেখেননি।''
‘যেখানে দেশের অনেক দরিদ্র মানুষ খাবার পাচ্ছে না, সেখানে এই আইন দিয়ে কী হবে। গরীব মানুষ মাস্ক কেনার পয়সা কোথায় পাবেন? মানুষকে ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিয়ে বলা হচ্ছে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক, নয়তো জেল, জরিমানা হতে পারে। এটা কেমন কথা?'' প্রশ্ন এই আইনজীবীর।
তিনি বলেন, ‘‘ সরকারের এখন উচিত হবে গরিব মানুষকে নিয়মিত বিনামূল্যে মাস্ক দেয়ার ব্যবস্থা করা। আর সাধারণ মানুষের জন্য কম দামে মাস্ক নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে বিষয়টি নিজ দায়িত্বে বাঁচা মরার মতো হয়ে যাবে।''
২৬ মার্চের আগে বাংলাদেশে একটি সার্জিক্যাল মাস্কের পাইকারি দাম ছিল দেড় টাকা। আর সর্বোচ্চ খুচরা দাম ছিল ৫ টাকা। এখন ২০ টাকা। মাস্কের চাহিদার কারণে এখন নিম্ন মানের মাস্কও স্থানীয়ভাবে তৈরি হচ্ছে। ফুটপাতে এখন মাস্কের মৌসুমি পসরা সাজিয়ে বসছেন অনকেই। মান নিয়ন্ত্রণের নেই কোনো ব্যবস্থা। র্যাব এবং ভ্রাম্যমান আদালত মাস্কের নকল কারখানাও আবিস্কার করেছে। ব্যবহৃত ফেলে দেয়া মাস্ক আবার ধুয়ে ও শুকিয়ে বিক্রির ঘটনাও ধরা পড়েছে।
ডা. জাহিদুর রহমান খান বলেন, ‘‘এটা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনা না গেলে মাস্ক নতুন বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।''