নিজের অভিজ্ঞতা দিয়েই শুরু করা যাক। বন শহরের মাটির তলায় ট্রাম স্টেশনে ঢুকেছি। প্ল্যাটফর্মে আমি এবং আমার বন্ধু পাশাপাশি যাচ্ছি। উল্টোদিক থেকে আসছিল কিছু জার্মান তরুণ। তারমধ্যে একজন আমার বন্ধুকে একটু ধাক্কা দিল। তারপর কিছুটা দূরে গিয়ে জার্মান ভাষায় কিছু একটা বললো। আমার বন্ধু ঘুরে দাঁড়িয়ে ইংরেজিতে জিজ্ঞাসা করলো, কী হয়েছে? আবার জার্মান ভাষায় কিছু শব্দ উড়ে এলো। সে তেড়ে আসার চেষ্টাও করছিল। তার বন্ধুরা তাকে টেনে নিয়ে চলে গেল। আমার কিঞ্চিত জার্মান জানা বন্ধু জানালো, তার উদ্দেশ্যে কিছু বর্ণবাদী কটূক্তি করেছিল ওই তরুণ।
দ্বিতীর অভিজ্ঞতা লন্ডনে। সেখানে ট্রেন স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছি। বোর্ডে দেখছি, কোন প্ল্যাটফর্মে ট্রেন দেবে। মেয়ের সঙ্গে বাংলায় কথা বলছি দেখে এক ভদ্রলোক এগিয়ে এসে বললেন, কোথাকার বাঙালি, বাংলাদেশ নাকি ভারতের? বললাম, ভারতের। ভদ্রলোক পেশায় আইনজীবী। একসময় বাংলাদেশ থেকে এসেছিলেন। এখন যুক্তরাজ্যের নাগরিক। তার কাছ থেকে জানতে চেয়েছিলাম, কখনো বর্ণবাদ টের পেয়েছেন? মৃদু হেসে বললেন, ''পাওয়া যায়। এখানে থাকুন। আপনিও টের পাবেন। কখনো মুখে বলবে, কখনো বুঝিয়ে দেবে, আপনি অনাকাঙ্ক্ষিত। কারণ আপনার গায়ের রঙ সাদা নয়।''
সেই যুক্তরাজ্য তো এখন শাসন করছেন একজন ভারতীয় মূলের প্রধানমন্ত্রী। তিনি হিন্দুও। সেই ঋষি সুনাকও দিন কয়েক আগে জানিয়েছেন, তিনিও বর্ণবাদের শিকার হয়েছেন।
২০০৪ সালে যখন ভারতে বাজপেয়ীর নেতৃত্বাধীন এনডিএ-কে হারিয়ে সোনিয়া গান্ধীর নেতৃত্বে ইউপিএ ক্ষমতায় এলো, তখন তো প্রয়াত বিজেপি নেত্রী ও সাবেক মন্ত্রী সুষমা স্বরাজ বলেছিলেন, সোনিয়া প্রধানমন্ত্রী হলে তিনি মাথা কামিয়ে ফেলবেন, মাটিতে শোবেন। উমা ভারতীও বলেছিলেন, সর্বশক্তি দিয়ে সোনিয়াকে রুখবেন। কারণ, সোনিয়া গান্ধী বিদেশিনী। এই স্লোগান নিয়ে বিজেপি নেতা-নেত্রীরা যে কতবার প্রচারে নেমেছেন তার ইয়ত্তা নেই। একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী, একটু দেরিতে হলেও যিনি ভারতের নাগরিকত্ব নিয়েছেন, তাকে কী করে বিদেশিনী বলে প্রচার করা হয়? এরমধ্যেও কি কোথাও ঢুকে থাকে উগ্র জাতীয়তাবাদের সঙ্গে বর্ণবাদের গন্ধ?
ঘটনা হলো, যে ভারতীয়রা বিদেশে গেলে বর্ণবাদ নিয়ে সোচ্চার হন, দেশে যখন আফ্রিকার ছাত্রছাত্রীদের লাঞ্চিত করা হয়, তখন তারা টু শব্দ করেন না। আফ্রিকা তো দূরস্থান, দিল্লিতে ভারতের উত্তরপূর্বের মানুষদের নিয়মিত গালাগালসূচক বেআইনি একটি শব্দ দিয়ে ডেকে অপমান করা হয়, তাদের বাড়ি ভাড়া দেয়া হয় না, তখনো বর্ণবাদ নিয়ে কোনো কথা ওঠে না। দলিত ও সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে অপরাধও তো ধর্মীয় বর্ণবাদের রকমফের।
এই প্রসঙ্গে পরে আসা যাবে। আগে দেখে নেয়া যাক, বিদেশে ভারতীয়দের কী ধরনের পরিস্থিতিতে পড়তে হয়।
বিদেশের বর্ণবাদ ও ভারতীয়রা
প্রতিবছর হাজার হাজার ভারতীয় পড়ুয়া বিশ্বের ৮৫টি দেশে পড়তে যান। ২০২১ সালের হিসাব, প্রায় ১১ লাখ ভারতীয় পড়ুয়া বিভিন্ন দেশে পড়াশুনা করছেন। সেই পড়ুয়াদের নিয়ে গুগল সার্চ করতেই কম্পিউটারে ভেসে উঠলো, কোন তিন দেশ ভারতীয় পড়ুয়াদের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ। ওই ওয়েবসাইটের মতে, তালিকায় প্রথমে আছে ক্যানাডা, দ্বিতীয় স্থানে অস্ট্রেলিয়া ও তৃতীয় স্থানে নিউজিল্যান্ড।
কিন্তু কিছুদিন আগেও তো অস্ট্রেলিয়ায় পরপর কয়েকজন ভারতীয় পড়ুয়া বর্ণবাদী আক্রমণের মুখে পড়েছেন। ইউরোপ, অ্যামেরিকায় ভারতীয়দের বিরুদ্ধে বর্ণবাদী হামলা, গালাগাল নিত্যদিনের ঘটনা। গতবছরই টাইমস নাও একটা রিপোর্ট করেছিল, ভারতীয়দের বিরুদ্ধে হেটওয়েভ বাড়ছে । পোল্যান্ডে পরপর কয়েকজন ভারতীয়কে শুনতে হয়েছে, ‘‘তোমরা তো প্য়ারাসাইট। কেন আমাদের দেশে এসে বসে আছ? কেন ভারতে ফিরে যাচ্ছ না? দশদিনের মধ্যে তিনজন ভারতীয়কে শুনতে হয়েছে এই বর্ণবাদী কথা।’’
অ্যামেরিকার পরিস্থিতি
২০২১ সালে জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অফ পেনলিসভানিয়া ও কার্নেগি এনডাওমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস একটা রিপোর্ট প্রকাশ করে। তার শিরোনাম ছিল, 'ইন্ডিয়ান অ্যামেরিকান অ্যাটিটিউড সার্ভে'। তাতে বলা হয়, প্রতি দুইজন ইন্ডিয়ান অ্যামেরিকানদের মধ্যে একজন বর্ণবাদের বা বঞ্চনার শিকার হয়েছেন।
সমীক্ষায় বলা হয়েছিল, এশিয়ান অ্যামেরিকানদের বিরুদ্ধে অপরাধ বাড়ছে।
তিরিশ শতাংশ ইন্ডিয়ান অ্যামেরিকান বলেছেন, তাদের গায়ের রঙের জন্য তারা বঞ্চনার শিকার হয়েছেন। ১৮ শতাংশ হয়েছেন ধর্ম বা লিঙ্গের কারণে। যে এক হাজার দুইশ ভারতীয় মূলের মানুষ এই সমীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে ৭৭ শতাংশ এখন মার্কিন নাগরিক।
যুক্তরাজ্যের কাহিনি
যুক্তরাজ্যের ইন্ডিপেন্ডেন্ট কমিশন ফর ইক্যুইটি ইন ক্রিকেট ৩১৭ পাতার একটা রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, যুক্তরাজ্যের ক্রিকেটের সব স্তরে প্রবল ও গভীরভাবে ঢুকে রয়েছে বর্ণবাদ, লিঙ্গবৈষম্য, এলিটিজম এবং শ্রেণিগত পক্ষপাত।
এরপরই যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ঋণি সুনাক শুনিয়েছেন, তিনি এবং তার ভাই ও বোন যখন ইংল্যান্ডে বড় হচ্ছেন, তখন কীভাবে তাদের বর্ণবাদের মুখে পড়তে হয়েছিল। ঋষি বলেছেন, ''আমি জানি বর্ণবাদ আছে। আমার নিজের সেই অভিজ্ঞতা হয়েছে। এটা এমনভাবে আঘাত করে যে খারাপ লাগবেই। কিছু মানুষ আমাদের এমন কথা বলতেন যে আমাদের অসম্ভব খারাপ লাগত।''
ঋষি বলেছেন, এখন ক্রিকেট থেকে বর্ণবাদ ও অন্য বিভেদ দূর করতে তিনি বদ্ধপরিকর।
সুনাকের কথা শুনেই আমার লন্ডনের স্টেশনে বাংলাদেশি ভদ্রলোকের কথা মনে পড়ছিল।
অতীত থেকেই তো ভারতীয়রা বিদেশে গিয়ে এই ধরনের বর্ণবাদের মুখে পড়েছেন। এই ব্যাপারে তো সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয় হলো, ১৮৯৩ সালে গান্ধীজিকে দক্ষিণ আফ্রিকায় ট্রেনের কামরা থেকে ফেলে দেয়ার ঘটনা। যে ঘটনা গান্ধীজির চোখ খুলে দিয়েছিল। ভারতীয়দের বিরুদ্ধে বর্ণবাদ নিয়েই তো তিনি শুরু করলেন অহিংস অসহযোগ আন্দোলন ও আইন আমান্য। যা পরিণতি পেল ভারতে।
এখন আর ট্রেন থেকে কাউকে ফেলে দেয়া হয় না, কিন্তু বুঝিয়ে দেয়া হয়, সাদাদের দেশে কালো বা বাদামিদের অনেকেই মন থেকে মানতে পারছেন না। সেই ট্রাডিশন সমানে চলছে।
ঋষি সুনাক আশা করেছেন, তার ছেলেমেয়েদের বর্ণবাদী আক্রমণের মুখে পড়তে হবে না। কিন্তু সত্যিই কি তাই? ইউরোপের অনেক দেশেই দক্ষিণপন্থার প্রভাব বাড়ছে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে, বাদামি চামড়ার বিরুদ্ধে আক্রমণ, কটাক্ষ, গালাগালির ঘটনা। যারা নিজেদের এতটা সভ্য বলে মনে করে, তাদের ভিতরে কী করে সঞ্চিত থাকে এই ঘৃণার স্রোত? নাকি, এটাই মানুষের চরিত্র। যখনই যে সুযোগ পায়, তারাই নিজেদের মতো করে বর্ণবাদী হয়ে যায়। আমাদের গোটা উপমহাদেশে কালো মেয়েদের ও কিছু ক্ষেত্রে ছেলেদের কেন সারাজীবন ধরে শুনতে হয়, তারা কালো। তাদের নিয়ে কত রসিকতা, কত রঙ্গব্যাঙ্গের স্রোত। বর্ণবাদ তো উপচে পড়ে আমাদেরই আচরণে। এজন্য়ই তো ফেয়ার অ্য়ান্ড লাভলি, থুড়ি গ্লো অ্য়ান্ড লাভলির বিক্রি কেবল বাড়ে। বিশেষ করে বিয়ের আগে মেয়েরা সমানে মাখতে থাকে এই ফর্সা হওয়ার ক্রিম।
ভারতের কথা
২০১৩ সালের ওয়ার্ল্ড ভ্যালু সার্ভে বলছে, সামাজিক মনোভাবের নিরিখে ভারত, বাংলাদেশ, জর্ডন ও হংকং হলো সবচেয়ে বর্ণবাদী দেশ।
অথচ, এখানেই উচ্চারিত হয়ছিল সেই মন্ত্র, 'গোটা বিশ্ব তোমার পরিবার'। কিন্তু বাস্তব কি বলছে? উত্তরপূর্বের মানুষদের চীনা বলে মনে করে উত্তর ভারতের মানুষ। এক বছর আগে গ্রেটার নয়ডায় চারজন নাইজেরিয়ার ছাত্রকে মাদকপাচারকারী বলে মারা হয়েছিল। বেঙ্গালুরুতে তাঞ্জানিয়ার এক ছাত্রকে গাড়ি থেকে বের করে পেটানো হয়। এক আফ্রিকান অ্যামেরিকানের অভিজ্ঞতা, তিনি যখন লখনউ চিড়িয়াখানায় গিয়ে জিরাফ দেখছেন, তখন আশপাশের জনা পঞ্চাশ মানুষ হাঁ করে তাকে দেখছে। কারণ, তার গায়ের রঙ কালো।
দেশে হোক বা বিদেশে, ভারতীয় নাগরিক হোক বা বিদেশি নাগরিকত্ব নেয়া ভারতীয়, তাদের ভিতরেও তো ঢুকে আছে ওই বর্ণবাদ। ফর্সা-কালোর বিভেদ। ইংরেজদের সাহস আছে, তাই তারা জোরগলায় বর্ণবাদ, লিঙ্গবৈষম্য, এলিটিজম, শ্রেণিবৈষম্য়ের কথা স্বীকার করে। আমরা করি না। সবকিছু গোপন করতে চাই। অথবা আমরা এব্যাপারে সচেতনই নই যে আমরা ঘোর বর্ণবাদী।
সক্রেটিস বলেছিলেন, অন্যদের সঙ্গে তার প্রভেদ হলো, তিনি জানেন যে, তিনি কিছু জানেন না। অন্যরা জানে না যে, ওরা কিছু জানে না। আর এক্ষেত্রে অন্যরা জানে যে, তারা বর্ণবাদী, আমরা জানি না যে, আমরা ঘোর বর্ণবাদী। তাই কালো নিয়ে এত ছুৎমার্গ আমাদের গ্রাস করে থাকে। তাই আমরা অনায়াসে মনে করতে পারি, সাদা মানে সুন্দর, কালো মানেই দেখতে খারাপ। আমরা কালোদের হেনস্থা করি। তারপরেও আমরা বর্ণবাদ নিয়ে প্রতিবাদী হই। হায়রে, কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়!