ভারতের হায়দ্রাবাদ শহরে তেলেগু অভিনেত্রী শ্রী রেড্ডি প্রকাশ্যে তাঁর বেশবাস অপসারণ করে তেলুগু ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে নারীদের শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন৷ অভিনব প্রতিবাদের সেই ভিডিও দেখা হয়েছে কোটি বার!
বিজ্ঞাপন
একজন ভারতীয় নারীর পক্ষে জনসমক্ষে – অর্থাৎ পুরুষদের সামনে তাঁর জামাকাপড় খুলে ফেলাটা যে কতটা সাহস বা দুঃসাহসের কাজ, তা পশ্চিমের ‘ফেমেন' থেকে শুরু করে ‘#মিটু' আন্দোলনের নারীবাদীদের পক্ষে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়৷
অপরদিকে ভারতের মতো দেশে শ্রী রেড্ডির ‘নগ্ন প্রতিবাদ' যে প্রতিবাদের পাশাপাশি – এমনকি তার পরিবর্তে নগ্নতাকেই বেশি গুরুত্ব দেবে, এতেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই৷
অথচ পূর্ব কিংবা পশ্চিমের ‘সমৃদ্ধ' ও ‘সংস্কারমুক্ত' দেশ কিংবা ভারতের মতো দারিদ্র্যের সাগর থেকে মাথা তুলে দাঁড়াতে প্রয়াসী সনাতনপন্থি ও রক্ষণশীল দেশ – সর্বত্রই নারীদের পুরুষদের লালসা ও শোষণের শিকার হতে হয়৷ হলিউড থেকে শুরু করে বলিউড বা তেলেগু ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি, সর্বত্রই সুন্দর মুখ এবং সেই সঙ্গে সুন্দর শরীরের চাহিদা, যেমন সেলুলয়েডের পর্দায়, তেমনই তথাকথিত ‘কাস্টিং কাউচ'-এর উপর৷ এক কথায়, পুরুষ শাসিত ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে উঠতি অভিনেত্রীদের কাছ থেকে অনেক ক্ষেত্রে যে বিশেষ মূল্যটি দাবি করা হয়, তা দৃশ্যত ক্যালিফোর্নিয়া থেকে তেলেঙ্গানা, সর্বত্রই এক৷
তফাৎটা হলো এই যে, সেই শোষণের বিরুদ্ধে তেলেঙ্গানায়‘নগ্ন প্রতিবাদ' জানালে একটির বদলে দু'টি ইস্যু এসে পড়ে, একটির বদলে দু'টি ভীমরুলের চাকে ঢিল ছোঁড়া হয়৷ প্রথমত, পুরুষ কর্তৃক নারীর শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ; দ্বিতীয়ত, সেই প্রতিবাদের অস্ত্র হিসেবে নারীর প্রকাশ্য নগ্নতা৷ শ্রী রেড্ডি যখন প্রথম ইস্যুটির কথা বলতে চাইছেন, তখন অনেকেই দেখছেন শুধু শ্রী রেড্ডির নগ্নতা, খোলা রাস্তায় ক্যামেরার সামনে তাঁর সালোয়ার-কামিজ ও বক্ষাবরণী খুলে ফেলে হাত দিয়ে বুক ঢেকে দাঁড়ানো এবং পরে পর্যায়ক্রমে আবার বেশবাস পরা৷
পশ্চিমের ‘ফেমেন' গোষ্ঠীর প্রতিবাদে নগ্ন বক্ষদেশ প্রদর্শিত হয় বটে, কিন্তু তা থেকে শ্রী রেড্ডির এই ‘স্ট্রিপ প্রটেস্ট' বা জামাকাপড় খোলার প্রতিবাদের অনেক ফারাক৷ শ্রী রেড্ডি প্রতিবাদের এই পন্থা বেছে নিয়েছেন, কেননা, তেলুগু ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে দৃশ্যত উঠতি অভিনেত্রীদের কাছ থেকে এ ধরনের নগ্ন ভিডিও ও নগ্ন ফটো দাবি করা হয়ে থাকে৷ বস্তুত তিনি তেলেগু ফিল্ম চেম্বার অফ কমার্সের সামনের কার পার্কে তাঁর ‘নগ্ন প্রতিবাদের' উপস্থাপনা করেন৷ তাঁর এই প্রতিবাদের আরেকটি লক্ষ্য ছিল নাকি মুভি আর্টিস্টস অ্যাসোসিয়েশন বা এমএএ, যারা তাঁকে কয়েকটি ফিল্মে অভিনয় করা সত্ত্বেও তাঁদের সদস্য করেনি৷ তৃতীয়ত, শ্রী রেড্ডির দাবি হলো যে, তেলেগু চলচ্চিত্রে ৭০ ভাগ ভূমিকা তেলুগু অভিনেত্রীদের জন্য সংরক্ষণ করা উচিত৷
নগ্ন মানুষের ছবি
২০০ নগ্ন মানুষের ছবি তুলেছেন রোমানিয়ার ফটোগ্রাফার তিবেরিউ কাপুদিয়ান৷ সব সাদা-কালো ছবি৷ সেখান থেকে কয়েকটি ছবি ও ছবির মানুষের গল্প থাকছে এই ছবিঘরে৷ ছবিগুলো দেখে বলুন তো, এই নগ্নতাকে ভয়ংকর খারাপ কিছু মনে হয় কিনা?
ছবি: Tiberiu Capudean
ওয়াই, দর্জি, ফ্রান্স
আমার বাবার জন্ম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়৷ তাঁকে আমার যৌনপরিচয় নিয়ে কখনো কিছু বলিনি৷ মাকেও কিছু বলিনি৷ আমি ডাক্তারি পড়েছি৷ গ্র্যাজুয়েশনের পর এক পুরুষের প্রেমে পড়ি৷ আমার পরিবার মনে করেছিল সে শুধু আমার সেরা বন্ধু৷ দুর্ভাগ্যজনকভাবে ১৬ বছর পর ও মারা যায়৷ এখন আমি দর্জির কাজ করি৷ ভাবতে ভালো লাগে, ফ্রান্সে এখন একটা পুরুষ আরেকটি পুরুষকে বিয়ে করতে পারে৷ তবে আমার মনে হয় এটা অনেক আগে থেকেই শুরু হতে পারতো৷
ছবি: Tiberiu Capudean
জে, দোকানের কর্মী, স্পেন
স্পেনের গ্রামাঞ্চলে বড় হয়েছি আমি৷ স্কুলে সবসময় আমাকে দুয়ো দেয়া হতো৷ বয়স যখন ১৩, একদিন স্কুলের বেঞ্চে বসে পড়ছি৷ বড় একটা ছেলে এসে বলল, ‘তুমি নোংরা’৷ তারপর সে বোতলের সব চকোলেট মিল্ক আমার গায়ে ঢেলে দিলো৷ ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলাম৷ সারা শরীর ভিজে গিয়েছিল৷ অথচ আশপাশ থেকে সবাই এমনভাবে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছিল যেন আমি অদ্ভুত কোনো জীব৷
ছবি: Tiberiu Capudean
এস, আইটি প্রোজেক্ট ম্যানেজার এবং মাসাজ থেরাপিস্ট, জার্মানি
প্রথমে বাবার যে প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, সেটা সামাল দেয়া বেশ কঠিন ছিল৷ উনি স্পষ্ট করে জানিয়েছিলেন, ছেলে হিসেবে বাড়িতে সব সময় আমি স্বাগত৷ কিন্তু আমার বয়ফ্রেন্ডকে কখনোই বাড়িতে ঢুকতে দেয়া হবে না৷ আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল৷ অনেক কেঁদেছিলাম৷ তারপর আট বছর তার সঙ্গে আর যোগাযোগ রাখিনি৷ এখন তার স্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই, কেননা তার কারণে শুধু সেই বয়ফ্রেন্ডই নয়, আমার সব বয়ফ্রেন্ডই দেখা করতে আসতে পারে৷
ছবি: Tiberiu Capudean
এ, ফ্যাশন ডিজাইনার, স্পেন
আমি এমন এক পরিবেশে আছি যেখানে পুরুষদেরই আধিপত্য৷ আমাকে যদিও কেউ দুয়ো দেয় না, তবে আমার যেসব সমকামী সহকর্মী আছে, তাদের সঙ্গে কী করা হয় তা আমি দেখি৷ আসলে ‘পৌরুষ’ মানে কী? আমাদের সবাইকেই কি কমবয়সি আর শক্তসমর্থ হতে হবে? সবার দেহই কি পেশিবহুল হতে হবে? আমরা কি শুধুই আকাঙ্খার বস্তু?
ছবি: Tiberiu Capudean
ডি, আইটি ম্যানেজার, বেলজিয়াম
বাবার সঙ্গে যখন ছিলাম, তখন স্থানীয় একটি বেকারিতে রাতের শিফটে কাজ করতাম৷ একদিন ভোরে গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফিরে ঘুমিয়েছি৷ হঠাৎ আমার মা এসে জানতে চাইলেন, ‘‘তুমি যে এমন, এটা কাকে বলেছো?’’ আসলে হয়েছে কি, কে যেন আমার গাড়ির চাদে লিখে দিয়েছিল, ‘হোমো’৷ মনে হয়েছিল সেটা যেন আমার জন্য সম্মানের স্মারক৷
ছবি: Tiberiu Capudean
এম, রাগবি খেলোয়াড়, স্পেন
মানুষ যখন জানলো যে আমি উভকামী (বাইসেক্সুয়াল), তাদের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ছিল, ‘‘তুমি কত ভাগ্যবান! বেছে নেয়ার সব পথই তোমার সামনে খোলা৷’’ কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ অন্যরকম৷ উভকামী হওয়াটা কোনো সম্পর্ক স্থাপনের পথে বাধা হিসেবে কাজ করে৷ প্রায়ই জানতে চাওয়া হয়, শেষ কবে আমি কোনো মেয়ের সঙ্গে ছিলাম৷ যেন আমি যে এখনো ‘সক্ষম’ তা প্রমাণ করে দেখাতে হবে৷
ছবি: Tiberiu Capudean
ডি, অভিনেতা, নৃত্যশিল্পী ও পরিচালক, রোমানিয়া
একদিন বয়ফ্রেন্ডকে নিয়ে একটা সুপারমার্কেটে গিয়েছি৷ মুভি দেখতে যাবো বলে দুই বোতল পানি, স্ন্যাকস আর চকলেট কিনতে লাইনে দাঁড়ালাম৷ হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন, ‘‘সমকামী, সমকামী’’ বলে উঠল৷ লোকটিকে অনেক কথা বলা যেত৷ কিন্তু এমন আচরণের প্রতিবাদ করতে গেলে সহিংসতা শুরু হয় বলে নিজেকে শান্ত রেখেছিলাম৷
ছবি: Tiberiu Capudean
এস, ইলাস্ট্রেটর, স্পেন
এক রাতে কোরুনা শহরের এক পার্কে বসে এক বন্ধুর সঙ্গে কথা বলছি৷ হঠাৎ ছয়-সাতটা ছেলে এসে ‘ফাগটস’ (সমকামী পুরুষ) বলেই আমাদের মারতে শুরু করলো৷ আমরা রুখে দাঁড়ালাম৷ কিন্তু ঝগড়ার এক পর্যায়ে একটি ছেলে আামাকে ছুরি মেরে দিলো৷
ছবি: Tiberiu Capudean
ডি, সেলস ম্যানেজার, ইটালি
আমি সবসময়ই একটু মোটাসোটা৷ ১৪ বছর বয়সেই আমার শরীর রোমে ভরে যায়৷ স্কুলে সবাই আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করত৷ ইটালির ছোট একটা শহরে থাকতাম৷ তাই কোনোদিনই নিজের যৌন পরিচয়টা কাউকে বলিনি৷ ৩০ বছর বয়সে সমকামী হিসেবে ভালোভাবে জীবনযাপনের আশায় ফ্রান্সে চলে যাই৷ কিন্তু সেখানেও সমস্যা হওয়ায় সারা শরীরের রোম ‘ওয়াক্স’ করে তুলে ফেললাম৷ খুব খারাপ লেগেছিল সেদিন৷ এখন অবশ্য বাস্তবতা মেনে নিয়েছি৷ এখন শরীর নিয়ে আমি সুখী৷
ছবি: Tiberiu Capudean
সি, দোকান কর্মচারি, স্পেন
সেদিন মা, বোন আর এক আন্টিকে নিয়ে ‘ফিফটি শেডস অফ গ্রে’ দেখতে গিয়েছি৷ মুভিটা শেষ হতেই ২০ থেকে ২৫ বছর বয়সি দু’টি মেয়ে আমাদের ‘সমকামী’ বলল৷ এই ২০১৮ সালে দাঁড়িয়েও মানুষ যে এমন করতে পারে আমি ভাবতেই পারিনি৷ আমার ছোট বোন ওদের সঙ্গে ঝগড়া বাধিয়ে দিলো৷ আরেকটি দম্পতিও এগিয়ে এসে মেয়ে দু’টিকে থামতে বলল, আরো বলল না থামলে পুলিশ ডাকা হবে৷ এ কথা শুনে মেয়ে দু’টি পালিয়ে গেল৷
ছবি: Tiberiu Capudean
তিবেরিউ কাপুদিয়ান, ফটোগ্রাফার এবং এলজিবিটি অ্যাক্টিভিস্ট
আমার কাছে ছবির এই মানুষগুলো যে নগ্ন এটা সবচেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়৷ এ সব ছবির মাধ্যমে আমি দেখাতে চেয়েছি যে, যৌনপরিচয়, শরীরের গঠন, বয়স বা জাতি ইত্যাদি বিষয়ের বৈচিত্র্য আসলে খুব স্বাভাবিক ব্যাপার৷
ছবি: Javier Santiago
11 ছবি1 | 11
তাঁর নগ্ন প্রতিবাদ থেকে শ্রী রেড্ডি এযাবৎ যা পেয়েছেন, তা হলো অসংখ্য ট্রলস আর ইন্টারনেটে নারীবিদ্বেষী গালিগালাজ৷ এছাড়া পবন কল্যাণের মতো নামকরা অভিনেতা ও তাঁর ফ্যানদের সঙ্গে তাঁর কাজিয়া বেঁধেছে৷ ইন্ডাস্ট্রির অন্যান্য অভিনেত্রীর আচরণ সম্পর্কে ইঙ্গিত করেও তিনি তাঁর শত্রুর সংখ্যা বাড়িয়েছেন৷ অর্থাৎ, তাঁর প্রতিবাদ শেষ হলেও, তার ফলশ্রুতি শেষ হতে এখনও অনেক বাকি৷
তবে শ্রী রেড্ডির কাপড় খুলে প্রতিবাদ জানানোর ভিডিও সব মাধ্যম মিলিয়ে কোটি বারেরও বেশি দেখা হয়েছে৷ ইউটিউবে ওপরের ভিডিওটিই দেখা হয়েছে ২৮ লক্ষ ৭১ হাজার বার৷