ভারতীয় কূটনীতি কি শক্তিশালী হয়েছে?
১৭ ডিসেম্বর ২০২৩করোনার কিছুদিন আগে থেকেই ভারতের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে বিবিধ প্রশ্ন তুলছিলেন বিশেষজ্ঞেরা। অনেকেই মনে করছিলেন, বিশেষত প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। এবং তার একমাত্র কারণ, ভুল পররাষ্ট্রনীতি।
মনে রাখা দরকার, এই সময়েই নেপালের মতো রাষ্ট্রের সঙ্গেও বিতর্ক জড়িয়ে পড়েছিল ভারত। বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কার সঙ্গেও পররাষ্ট্র সম্পর্কে একের পর এক উত্তেজনার পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছিল।
যে বিশেষজ্ঞেরা সে সময় ভারতের পররাষ্ট্রনীতির সমালোচনা করছিলেন, তারাই পরবর্তী সময়ে ভারতের আন্তর্জাতিক কূটনীতিকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। তাদের অনেকেই মনে করেন, করোনার সময় থেকে ভারত দেশের পররাষ্ট্রনীতি যেভাবে চালিত করেছে, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রনিধানযোগ্য। বস্তুত, হালের ক্যানাডা-বিতর্ক এবং কাতার-সমস্যার প্রেক্ষাপটেও বিশেষজ্ঞেরা ভারতের পররাষ্ট্রনীতিকে শক্তিশালী বলেই মনে করছেন। তাদের বক্তব্য, এই দুই ক্ষেত্রেও ভারত যেভাবে 'ডিল' করছে, তা দেশের কূটনীতির পক্ষে স্বাস্থ্যকর। বছরচারেক আগেও যা ততটা স্বাস্থ্যকর বলে মনে হচ্ছিল না।
দ্রুত একবার বর্তমান সময়ের দিকে চোখ রাখা যাক। খালিস্তানি সমস্যা ভারতে নতুন নয়। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ইন্দিরা গান্ধী অপারেশন ব্লু স্টার পরিচালনা করেছিলেন অমৃতসরের স্বর্ণ মন্দিরে। এর কিছুদিনের মধ্যেই নিজের শিখ দেহরক্ষীর গুলিতে নিহত হন ইন্দিরা। এই সবই খালিস্তান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত।
ইন্দিরা সরকারের সঙ্গে সে সময় ক্যানাডা সরকারের বিতর্ক হয়েছে খালিস্তানপন্থি নেতাদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য। সময়ের স্রোতে সেই বিতর্ক কখনো কমেছে, কখনো বেড়েছে। সম্প্রতি সেই বিতর্ক ফের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। ভারত-ক্যানাডা কূটনৈতিক সম্পর্ক কার্যত স্তব্ধ হয়ে পড়েছে।
সাবেক সেনা কর্মকর্তা লেফটন্যান্ট জেনারেল উৎপল ভট্টাচার্যের বক্তব্য, ''এক খালিস্তানি নেতাকে হত্যার বিষয়ে ক্যানাডা যে অভিযোগ করছে, সেই বিতর্কে ঢোকার প্রয়োজন নেই। দেখার বিষয় হলো, এই বিতর্ক ঘিরে যে দড়ি টানাটানি চলছে, তাতে ভারত নিজের অবস্থানে স্থির থাকছে। ক্যানাডার চাপে নিজের অবস্থান বদলে নেয়নি। এটা শক্তিশালী কূটনীতির পরিচয়।'' শুধু তা-ই নয়, ক্যানাডা চেষ্টা চালিয়েছে, বৃহৎশক্তিগুলিকে নিজের দিকে টেনে নিতে। কিন্তু ভারতীয় কূটনীতি সে কাজ করতে দেয়নি। ভারত বুঝিয়ে দিতে পেরেছে, এই বিতর্কে অ্যামেরিকার মতো শক্তি সরাসরি ক্যানাডাকে সমর্থন করলে অন্য বিতর্কে ভারত অ্যামেরিকার পাশে থাকবে না। উৎপলের বক্তব্য, এটাই কূটনীতির খেলা। এবং সেখানে ভারত নিজের ভূমিকা পালনে সফল হয়েছে।
শুধু ক্যানাডা নয়, সম্প্রতি কাতার আট সাবেক ভারতীয় নৌসেনাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেছিল। অভিযোগ, তারা সেখানে গিয়ে চরবৃত্তি করছিলেন। এই ঘটনাতেও ভারত কাতারের সঙ্গে লাগাতার আলোচনা চালিয়েছে। এবং শেষপর্যন্ত কাতারের আদালতে মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ তৈরি করে নিয়েছে। এটিও ভারতের কূটনৈতিক বিজয় বলে মনে করছেন উৎপলের মতো একাধিক কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞ।
অর্থনীতিবিদ এবং কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞ দীপঙ্কর মুখোপাধ্যায় মনে করেন, একদিনে ভারত এই শক্তিশালী কূটনৈতিক অবস্থানে পৌঁছায়নি। গত কয়েকবছরে ঘটে যাওয়া বেশ কিছু ঘটনা এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের অবস্থান দেশকে এই শক্তিশালী কূটনৈতিক অবস্থানে নিয়ে গেছে।
করোনার সময় চীনের সঙ্গে সংঘাতে গিয়েও ভারত যেভাবে প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করেছে এবং সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন দীপঙ্কর। পাশাপাশি শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকট ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলিকে চীন থেকে ভারতের দিকে দৃষ্টি ঘোরাতে সাহায্য করেছে বলেও তিনি মনে করেন। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ভারতের নিরপেক্ষ অবস্থান এবং তেল বাণিজ্য ভারতের পররাষ্ট্রনীতির গুরুত্ব গোটা বিশ্বে আলোচনার বিষয় হয়েছে। অ্যামেরিকা এবং রাশিয়া দুইপক্ষই ভারতের এসে বৈঠক করতে বাধ্য হয়েছে।
দীপঙ্করের মতে, বর্তমান কূটনৈতিক অবস্থান এই অনেকগুলি সাম্প্রতিক ফ্যাক্টরের উপর দাঁড়িয়ে আছে। কূটনৈতিকভাবে ভারতের উপর চাপ তৈরি এখন আর সম্ভব নয়। কারণ ভারত প্রমাণ করেছে, তারাও পাল্টা চাপ তৈরি করতে পারে। সম্প্রতি ক্যানাডার ঘটনা সে কথাই স্পষ্ট করছে।
দীপঙ্কর এবং উৎপলের অভিমত এই মুহূর্তে ভারতের বহু কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞই মানেন। তবে কেউ কেউ এই ন্যারেটিভ নিয়ে কিছু প্রশ্নও তোলেন। কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইন্দ্রজিৎ রায়ের প্রশ্ন, ভারতের কূটনীতিকে যতটা শক্তিশালী দেখানোর চেষ্টা হচ্ছে, আসলেই কি তা ততটা শক্তিশালী? যদি তা-ই হতো, তাহলে শ্রীলঙ্কা বা মলদ্বীপের মতো রাষ্ট্র এখনো চীনপন্থি অবস্থান নিত না। চীনের যুদ্ধ জাহাজ প্রশান্ত মহাসাগরে ঢুকে মলদ্বীপ বা শ্রীলঙ্কায় নোঙর করার কথা ভাবতো না। ফলে উপমহাদেশে চীনের প্রভাব এখনো যথেষ্টই। ভারতীয় কূটনীতি এখনো চীনকে সমানে সমানে টেক্কা দেওয়ার জায়গায় পৌঁছায়নি বলেই ইন্দ্রজিৎ মনে করেন। তবে একইসঙ্গে তার বক্তব্য, গত কয়েকদশকে ভারতীয় কূটনীতি আগের চেয়ে অনেকটাই শক্তিশালী হয়েছে। এবং তা সম্ভব হয়েছে ভারতের বাজারের উপর বৃহৎপুঁজির দেশগুলি মুখাপেক্ষী বলেই।