মৎস্য ও প্রাণি সম্পদ মন্ত্রী কয়েকদিন আগেই দাবি করেছিলেন, বাংলাদেশ এখন গবাদি পশুতে স্বয়ংসম্পূর্ণ৷ ঈদের পশুর হাটে সত্যিই এবার ভারতীয় গরু নজরে পড়ছে না৷
বিজ্ঞাপন
শুক্রবার মন্ত্রী ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ‘‘আমাদের জানা মতে একটি ভারতীয় গরুও এবার আসেনি৷ ভারত থেকে গরু আমদানির কোনো অনুমতি নেই৷’’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০১৪ সালে মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশে ভারতীয় গরু আসা বন্ধ করে দেয়৷ আর সেটাই হয়েছে বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদ৷ এখন বাংলাদেশ গবাদি পশুতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে গরুর মাংস রপ্তানিও শুরু করেছে৷
এবার কোরবানির ঈদে গবাদি পশুর যে চাহিদা তার চেয়ে বেশি পশু প্রস্তুত রয়েছে৷ চাহিদার চেয়ে কোরবানির পশু বেশি৷ সরকারি হিসেব বলছে, দেশে এবার দেশে কোরবানির জন্য ৯৭ লাখ ৭৫ হাজার গরু-ছাগলের চাহিদা রয়েছে৷ কিন্তু প্রস্তুত আছে এক কোটি ২৫ লাখ ২৪ হাজার৷
বিবিএস-এর জরিপ
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সর্বশেষ যে হিসেব দিয়েছে তাতে দেশে গরু ছাগলের সংখ্যা আগের চেয়ে বেড়েছে৷ গত মাসে তারা কৃষি শুমারির প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে৷ তাতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ এখন গরু-ছাগলে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ৷
রীতিমতো একটা বিপ্লব হয় এই সেক্টরে: শাহ ইমরান
শুমারির ফল থেকে জানা যায়, দেশে এখন গরুর সংখ্যা দুই কোটি ৪০ লাখ ১৪ হাজার ১৪৪, ২০০৮ সালে যা ছিল ২ কোটি ৫৭ হাজার ৮৫৩৷ এক যুগের ব্যবধানে গরু বেড়েছে ৪০ লাখের বেশি৷ অন্যদিকে দেশে বর্তমানে ছাগলের সংখ্যা এক কোটি ৬২ লাখ ৯৫ হাজার ২০০, যা এক যুগ আগে ছিল এক কোটি এক লাখ ৫৯ হাজার ৫০৯৷ এক যুগে ছাগল বেড়েছে প্রায় ৬১ লাখ৷
২০২০ সালে বিবিএস এই কৃষি শুমারি পরিচালনা করে, যার প্রাথমিক রিপোর্ট চলতি বছরে তারা প্রকাশ করে৷ বিশ্লেষকরা বলেছেন গত দুই বছরে পশু সম্পদের আরো উন্নতি হয়েছে৷
গত এক যুগে ভেড়ার উৎপাদন বেড়েছে তিন গুণ৷ বর্তমানে ভেড়ার সংখ্যা ১৩ লাখ ৪১ হাজার ৬১৯টি৷ ২০০৮ সালে ছিল চার লাখ ৭৮ হাজার ১৭৷ মহিষের সংখ্যাও বেড়েছে শতকরা ৩০ ভাগ৷ এখন ছয় লাখ ২৯ হাজার ৬৪০টি মহিষ আছে৷ ২০০৮ সালে এই সংখ্যা ছিল চার লাখ ৩১ হাজারের মতো৷ আর সব মিলিয়ে দুধ দেয় এমন গরু, মহিষ ও ছাগল আছে ১৮ লাখের মতো৷
যেভাবে আসে সাফল্য
গাজীপুরের গিয়াসউদ্দিন সরকার ২০১৫ সালে মাত্র একটি গরু দিয়ে শুরু করেন তার গরুর ফার্ম ‘সাফ গ্রিন অ্যাগ্রো'৷ তার খামারে এখন ১৬০টিরও বেশি গরু রয়েছে৷ তিনি একই সঙ্গে মাংস এবং দুধ উৎপাদন করেন তিনি৷ প্রতিদিন দুধ পান ৭০০ লিটার৷ তিনি বলেন, ‘‘একটি খামার দুই-তিন বছরের মধ্যেই লাভে চলে যায়৷” এইরকম সাফল্যের কাহিনি বাংলাদেশে এখন প্রত্যেক এলাকায়ই পাওয়া যাবে৷ তার কথা, "সরকার যদি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়, তাহলে এখন ছোট খামারিরাও দুধ এবং মাংস দেশের বাইরে রপ্তানি করতে পারবে৷”
২০১৪ সালে ভারতে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশে সেখান থেকে গরু আসা বন্ধ করে দেয়৷ আর সেটাই বাংলাদেশের জন্য শাপে বর হয়েছে৷ চাহিদা মেটানোর জন্য বাংলাদেশে গবাদি পশুর লালনপালন বেড়ে যায়৷ আর সেটাই বাংলাদেশকে এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছে৷ বাংলাদেশে এখন ছোট-বড় মিলিয়ে ২০ লাখ খামার আছে৷
এর আগে প্রতি বছর ভারত থেকে প্রতি বছর ৩০ লাখের মতো গরু-ছাগল আসতো বৈধ এবং অবৈধ পথে৷ শুধু কোরবানির ঈদেই আসতো ২০-২২ লাখের মতো৷ মিয়ানমার থেকেও আসতো৷ ২০১৮ সালেও ভারত থেকে এক লাখ ৫০ হাজার গরু আসে৷ কিন্তু এখন চিত্র পুরোই পাল্টে গেছে৷ উল্টো প্রতি বছর দেশি গরুরই একটি অংশ অবিক্রিত থেকে যাচ্ছে৷
কোরবানির পশুর হাটে জমে উঠেছে কেনাবেচা
পবিত্র ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে প্রতিবারের মতো রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন স্থানে পশু বেচাকেনা চলছে। ঈদের আর বাকি একদিন। শেষের দিকে এসে জমতে শুরু করেছে হাট। ঢাকার কয়েকটি কোরবানির হাট দেখুন ছবিতে৷
ছবি: Rajib Paul
ট্রাকে করে হাটে
দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ট্রাকে করে গরু-ছাগল ঢাকার হাটগুলোতে বিক্রির জন্য আনা হয়। ব্যাপারিরা বলছেন, গতবারের তুলনায় এবার গরু কম এসেছে। ট্রাক থেকে নামানোর সময় গরুকে নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে থাকেন ব্যাপারি ও রাখালরা। ছবিটি গাবতলী হাটে তোলা।
ছবি: Rajib Paul
দুই সিটিতে ১৯ হাট
ঈদুল আজহা উপলক্ষে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন স্থানে এবার ১৯টি পশুর হাট বসেছে। এর মধ্যে স্থায়ী হাট ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) গাবতলী এবং দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) সারুলিয়া। অস্থায়ী হাটগুলোর মধ্যে ডিএসসিসি এলাকায় বসবে ১০টি আর ডিএনসিসি এলাকায় রয়েছে ৭টি।
ছবি: Rajib Paul
নারীদের উপস্থিতি
কোরবানির পশুর হাটে সাধারণত বয়স্ক ও তরুণ পুরুষ ক্রেতা সমাগম বেশি হয়ে থাকে। তাদের পাশাপাশি নারীরাও আসেন। তবে তাদের সংখ্যা খুব কম। মোহাম্মদপুরের বসিলায় বুদ্ধিজীবী সড়ক সংলগ্ন খালি জায়গায় অস্থায়ী পশুর হাটের চিত্র।
ছবি: Rajib Paul
বিনামূল্যে মাস্ক
পশুর হাটে ডিএনসিসি এবং বেসরকারি সংস্থা শক্তি ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে বিনামূল্যে মাস্ক বিতরণ করা হচ্ছে। আফতাবনগরে ইস্টার্ন হাউজিং ব্লক-ই-এফ-জি-এইচ পর্যন্ত এলাকার খালি জায়গায় বসানো কোরবানির হাটে এমন একটি গাড়ি থাকে দিনভর।
ছবি: Rajib Paul
হাটের প্রবেশমুখে দড়ি-খড়
আফতাবনগর হাটের প্রবেশমুখে বাঁশ ও ত্রিপল দিয়ে সাজিয়ে রাখা হয়েছে দড়ি। আকারভেদে প্রতিটির দাম ১৫০ থেকে ৩০০ টাকা। দড়ির পাশাপাশি গরুর অন্যতম খাদ্য খড় বিক্রি হয় ২০-৩০ টাকা কেজিতে।
ছবি: Rajib Paul
বাহারি মালা
কোরবানির পশুকে সাজালে সবার মধ্যে অন্যরকম আনন্দ হয়। ক্রেতা-বিক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে ব্যাপারিরাও উদ্যোগ নেন। এজন্য বিভিন্ন হাটে গরু-ছাগল সাজানোর বাহারি জিনিস ফেরি করেন মৌসুমি বিক্রেতারা। গরুর গলার মালার দাম ৭০ থেকে ২০০ টাকা। একটু বড় আকারের মালার দাম ১০০ থেকে ৩৫০ টাকা। আফতাবনগর হাটে ছবিটি তোলা।
ছবি: Rajib Paul
গরুর জন্য ফ্যান
বাংলাদেশের এখন ভীষণ গরম। হাটে গরম আরো বেশি। এ কারণে আফতাবনগর হাটে একটি গরুর সামনে এভাবে স্ট্যান্ডিং ফ্যান চালিয়ে রাখতে দেখা গেল।
ছবি: Rajib Paul
গরমে কাহিল ২৫ লাখ টাকার ‘বিগ বস’
কিশোরগঞ্জ থেকে গাবতলী হাটে আসা ‘বিগ বস’ গরমে পরিশ্রান্ত হয়ে একপর্যায়ে এভাবে শুয়ে পড়ে। ৪৩ মণ ওজনের পশুটির দাম হাঁকা হচ্ছে ২৫ লাখ টাকা।
ছবি: Rajib Paul
পশুর খাবার
গরু-ছাগলের খাদ্য হিসেবে কাঁচা ঘাস কিনে থাকেন ব্যাপারিরা। তাদের জন্য মৌসুমি বিক্রেতারা পসরা সাজিয়েছেন। আফতাবনগর সড়কে এই দৃশ্য চোখে পড়লো। একেক আঁটি ঘাসের দাম ২০ থেকে ২৫ টাকা। ঢাকার কেরানীগঞ্জ ও বসিলা থেকে আসে ঘাস।
ছবি: Rajib Paul
হাটে খাওয়া-দাওয়া
কোরবানির হাটে গরুর পরিচর্যা করতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে রাখালসহ অন্যান্য কাজের লোকেরা ঢাকায় আসেন। খরচ কমাতে তারা নিজেরাই হাটের এককোণে রান্না করেন। এরপর সবাই মিলে খেয়ে নেন। মোহাম্মদপুরের বসিলা থেকে ছবিটি তোলা।
ছবি: Rajib Paul
নিরাপত্তা ব্যবস্থা
আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ঢাকার প্রতিটি কোরবানির হাটে পুলিশ ও র্যাবের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ রয়েছে।
ছবি: Rajib Paul
খুলনা বিভাগের ‘সুলতান’
আফতাবনগর হাটে সবচেয়ে সুদৃশ্য গরু ‘সুলতান’। খুলনা থেকে আসা ৪৫ মণ ওজনের এই পশুর দাম হাঁকা হচ্ছে ২৫ লাখ টাকা। ব্যানারে দাবি করা হয়েছে, এটি খুলনা বিভাগের সবচেয়ে বড় গরু।
ছবি: Rajib Paul
বিজ্ঞাপনে বরিশালের ‘রাজা বাবু’
‘‘মাশা-আল্লাহ! দর্শকের দৃষ্টিতে গাবতলী হাটের শ্রেষ্ঠ গরু’’– এমন কথা দিয়ে সাজানো ব্যানার মনযোগ আকর্ষণ করছে অনেকের। বরিশাল থেকে আনা গরুটির দাম হাঁকা হচ্ছে ২০ লাখ টাকা।
ছবি: Rajib Paul
ডিজিটাল পেমেন্ট বুথ
কোরবানির পশু বেচাকেনার লেনদেন নিরাপদ ও সহজ করতে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ স্মার্ট হাট’ প্রতিপাদ্য নিয়ে গাবতলী হাটে ডিজিটাল পেমেন্ট বুথ দিয়েছে ডিএনসিসি। এখানে ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলনের এটিএম মেশিন আছে। ব্যাপারিরা চাইলে মোবাইল ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে গরু বিক্রির টাকা পাঠাতে পারছেন। এর কার্যক্রম চালাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
ছবি: Rajib Paul
‘ভাই, কত নিলো?’
হাট থেকে গরু-ছাগল কিনে হেঁটে বাড়ি ফেরার পথে একটা প্রশ্ন সবাইকেই শুনতে হয়, ‘ভাই. কত নিলো?’ উত্তর দেওয়ার পাশাপাশি কোরবানির পশুর সঙ্গে সেলফিও তোলেন অনেকে। আফতাবনগর এলাকা থেকে ছবিটি তোলা।
ছবি: Rajib Paul
হাসিল ঘর
গরু-ছাগল কিনে নিয়ম অনুযায়ী ক্রেতাকে হাসিল দিতে হয়। এটি হলো পশুর হাটের ভাড়া। হাট কর্তৃপক্ষ এই টাকা পেয়ে থাকে। পশুর হাটে হাসিল ঘরে প্রতিদিন ক্রেতাদের ভিড় লেগে থাকে। গাবতলী হাটের চিত্র।
ছবি: Rajib Paul
ছাগলের হাট
কোরবানির জন্য গরু কেনাবেচা হয় বেশি। তবে ছাগলের প্রতিও আগ্রহ দেখা যায় অনেকের। আফতাবনগরে খোলা আকাশের নিচে বিশাল জায়গা জুড়ে ছাগল বিক্রির জন্য এনেছেন ব্যাপারিরা।
ছবি: Rajib Paul
ব্যস্ত কামারপট্টি
কোরবানির ঈদ ঘনিয়ে এলে কামারদের ব্যস্ততা পুরোদমে বেড়ে যায়। ছুরি, চাপাতি, দা, বটি তৈরি এবং যন্ত্রের মাধ্যমে শান দেওয়ার কাজ করছেন তারা। রাজধানী ঢাকার কাওরান বাজারে কামারপট্টি এখন টুংটাং টুংটাং শব্দে মুখর।
ছবি: Rajib Paul
ঈদের আগের দিনের অপেক্ষা
কাওরান বাজারে বিভিন্ন দোকানের সামনে এভাবে সাজিয়ে রাখা হয় কোরবানির পশু জবাই ও মাংস কাটাকাটির বিভিন্ন সরঞ্জাম। তবে ক্রেতা কম। ঈদের আগের দিন বেশি বিক্রি হয়ে থাকে। তাই বিক্রেতারা সেজন্য অপেক্ষা করেন।
ছবি: Rajib Paul
১ কোটির বেশি পশু
বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, এবারের ঈদুল আজহায় দেশে কোরবানিযোগ্য মোট পশু রয়েছে ১ কোটি ২১ লাখ ২৪ হাজার ৩৮৯টি। এরমধ্যে গরু ৪৪ লাখ ৩৭ হাজার ৮৯৭টি, মহিষ ১ লাখ ৭৩ হাজার ৫০৪টি, ছাগল ৬৫ লাখ ৭৩ হাজার ৯১৫টি, ভেড়া ৯ লাখ ৩৭ হাজার ৬৮২টি এবং ১ হাজার ৪০৯টি অন্যান্য পশু রয়েছে।
ছবি: Rajib Paul
ডিজিটাল হাট
গতবারের মতো এবারও ডিজিটাল কোরবানির হাট বাস্তবায়ন করেছে ডিএনসিসি, ই-ক্যাব ও বিডিএফএ। কারিগরি সহযোগিতায় এটুআই’র অনলাইন প্ল্যাটফর্ম একশপ। এছাড়া বেসরকারি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান অনলাইনে কোরবানির পশু সরবরাহ করছে।
ছবি: digitalhaat.gov.bd
21 ছবি1 | 21
বাংলাদেশে দুধের উৎপাদনও বেড়ে গেছে তিনগুণ৷ বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শাহ ইমরান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা আগে থেকেই ভারতীয় গরু আসার বিপক্ষে ছিলাম৷ কারণ, ভারতীয় গরুর কারণে খামারিরা দাঁড়াতে পারছিল না৷ এই অবস্থায় ভারত থেকে গরু আসা বন্ধ হওয়ার পর আমরা গবাদি পশু লালন-পালনের প্রশিক্ষণের ব্যাপক উদ্যোগ নিই৷ আর এটা আমরা করি অনলাইনে৷ এর ফলে দেশে এবং দেশের বাইরে অবস্থানরত তরুণরা ব্যাপক আগ্রহী হয়ে ওঠেন৷ দেশে তো বটেই বিদেশে পড়াশুনা শেষ করে অনেক শিক্ষিত তরুণ গরুর খামার প্রতিষ্ঠা করে৷ তাদের এই উদ্যোগ স্থানীয় পর্যায়ের সাধারণ মানুষকেও উৎসাহী করে৷ ফলে রীতিমতো একটা বিপ্লব হয় এই সেক্টরে৷’’
তিনি জানান, এখন আমাদের মূল চ্যালেঞ্জ হলো গরু, তথা মাংসের দাম কমিয়ে আনা৷ সরকারের কিছু নীতি সংশোধন কললেই এই দাম কমে আসবে৷ বিশেষ করে পশু খাদ্যের আমদানি নীতিতে পরিবর্তন দরকার৷ আর দরকার অ্যামেরিকা ও ইউরোপের কিছু গরুর ক্রস ব্রিডিংয়ের অনুমতি৷ এখন আমরা অনেকটাই অষ্ট্রেলিয়ার ফ্রিজিয়ানা জাতের ওপর নির্ভরশীল৷ আর ছাগলের ক্ষেত্রে আমরা প্রাধান্য দিচ্ছি ব্ল্যাক বেঙ্গল গোটের ওপর৷ কিন্তু আমরা চাই আফ্রিকার কিছু ছাগল, যা দ্রুত বাড়ে তার অনুমতি দেয়া হোক৷’’
একই সাথে সরকারের ঋণ ও নীতি সহায়তার কথাও বলেন তিনি৷ বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ননী গোপাল দাস বলেন, ‘‘এখানে বিদেশ থেকে উন্নত জাতের গরু এনে ক্রস ব্রিডিংয়ের সুবিধা দেয়ায় এই খাতটি দ্রুত এগিয়ে যায়৷ আর বাংলাদেশে মাংসের বিশাল একটি বাজার আছে৷ ফলে খামারিরা সহজেই লাভ করতে পারেন৷ এখানকার পরিবেশ এবং সরকারের নীতি সহায়ক হওয়ায় দ্রুতই গবাদি পশুর উৎপাদন বেড়ে যায়৷’’
‘আমাদের জানা মতে একটি ভারতীয় গরুও এবার আসেনি’
তিনি বলেন, ‘‘সবচেয়ে বড় কথা হলো এই খাতে তরুণরা এগিয়ে এসেছেন৷ তারা পথপ্রর্দশকের কাজ করেছেন৷ এখন বড় বড় বিনিয়োগকারী এই খাতে বিনিয়োগ করছেন৷’’ গত সাত-আট বছরের মধ্যে বাংলাদেশে গবাদি পশু উৎপাদনের এই বৈপ্লবিক সাফল্যের জন্য মৎস ও প্রাণি সম্পদ মন্ত্রী শ. ম রেজাউল করিম বেসরকারি উদ্যোক্তাদেরই কৃতিত্ব দিয়েছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘যারা এগিয়ে এসেছেন তাদের আমরা স্বল্প সুদে ঋণ দিয়েছি৷ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছি৷ চিকিৎসা এবং ঔষধ সহজলভ্য করেছি৷ পশু খাদ্য আমদানি সহজ করেছি৷ আর বিদেশ থেকে উন্নত জাতের গরু এনে কৃত্রিম প্রজনের ব্যবস্থা করেছি৷’’
তার কথা, ‘‘এবার ভারত থেকে আমরা একটি গরুও আমদানি করতে দেইনি৷ এখন আমদানি বন্ধ আছে৷ ভবিষ্যতেও প্রয়োজন হবে বলে মনে করি না৷’’
গরুর মাংস রপ্তানি
শ. ম রেজাউল করিম জানান, বালাদেশ থেকে এরইমধ্যে বেঙ্গল মিটসহ আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বেসরকারি উদ্যোগে বিদেশে হিমায়িত গরুর মাংস রপ্তানি শুরু করেছে৷ বিশ্বের ৩০টি দেশে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের গরুর মাংসের চাহিদার কথা জানা গেছে৷
তিনি বলেন, ‘‘এখানে কিছু টেকনিক্যাল বিষয় আছে সেগুলোর সমাধান করে আমরা গরুর মাংস রপ্তানি বাড়াতে চাই৷ আমাদের প্রস্তুতি চলছে৷ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান অচিরেই রপ্তানি শুরু করবে৷” তিনি জানান, বাংলাদেশ এখন আর বিদেশ থেকে গরুর মাংস আমদানি করে না৷ কিছু ভেড়ার মাংস আমদানি করা হয়৷ প্রসঙ্গত বাংলাদেশে এখন বছরে গরুর মাংসের চাহিদা ৭০ লাখ টন৷
তাদের ঈদ ভাবনা
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের স্বপ্নের সেতুর উদ্বোধন, প্রথমবারের মতো মহাসড়কের মোটরবাইক নিষিদ্ধকরণ, করোনার চতুর্থ ঢেউয়ের আশঙ্কা৷ এর মধ্যে বাংলাদেশের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের ঈদ ভাবনা থাকছে ছবিঘরে৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
‘মানুষ কেজি দরে গরুর দাম বলে’
বিক্রির উদ্দেশে ঢাকার গাবতলীতে পশুর হাটে কুষ্টিয়া থেকে ছয়টি গরু এনেছেন মো. বিল্লাল মিয়া৷ তিনি জানান, ‘‘এবারের হাটে এখন পর্যন্ত ক্রেতার সংখ্যা কম৷ ভোজ্য এবং জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির পর গো-খাদ্যের মূল্য ৫০ ভাগ পর্যন্ত বেড়েছে৷ অথচ হাটে মানুষ গরুর দাম বলছে মাংসের কেজির হিসাব করে৷’’ এতে গরু লালন-পালনের খরচও উঠবে না বলে দাবি করেন বিল্লাল মিয়া৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
‘কোরবানি দিতে পারতেসি না এইবার’
ঢাকার গুলিস্তান মোড়ে নতুন টাকার ব্যবসা করেন হারুনুর রশীদ৷ তিনি প্রায় ২০ বছর যাবত এই পেশায় আছেন৷ গত বছর কোরবানি দিলেও এবার সেই সামর্থ্য হচ্ছে না৷ বলেন, ‘‘মানুষের এইবারের মতো খারাপ অবস্থা আগে দেখি নাই৷ আমার নিজের অবস্থাই তো করুণ৷ গত বছর বাচ্চাদের শখ পূরণ কইরা একটা ছোট ছাগল কুরবানি দিসিলাম, কিন্তু এইবার কোনভাবেই সম্ভব হইতেসে না৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
‘পদ্মা সেতু দিয়ে পার হবো’
ঢাকার সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালের নোঙর করা ঢাকা-হাতিয়া রুটে চলাচলকারী এমভি তাসরিফ-১ এর কর্মচারী মোঃ নাসির হোসেনের বাড়ি পটুয়াখালি৷ কিন্তু তিনি নিজেই পদ্মাসেতু দিয়ে বাসে করে এবার বাড়ি যাবেন৷ দক্ষিণবঙ্গের মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পদ্মাসেতু হওয়ায় তিনি খুশি৷ আবার নিজের পেশায় এর নেতিবাচক প্রভাবও টের পাচ্ছেন৷ এবার ঈদে বোনাস পাবেন কিনা জানতে চাইলে বলেন, ‘‘এইবার বোনাস চাইলে মালিক নিশ্চিত মাইর দিবে৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
তবুও লঞ্চেই যাচ্ছেন জুনায়েদ
ঈদ করতে ঢাকার সদরঘাট থেকে লঞ্চে সপরিবারে হাতিয়ায় গ্রামের বাড়ি যাচ্ছেন জুনায়েদ হোসেন৷ পদ্মা সেতু দিয়ে না গিয়ে কেন লঞ্চে যাচ্ছেন জানতে চাইলে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরিজীবী জুনায়েদ জানান, বাসে যাওয়ার চেয়ে পরিবার নিয়ে লঞ্চে যাওয়াই তার জন্য সাশ্রয়ী ও সুবিধাজনক৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
‘দুইটা টাকা কামাই করে সংসার চালানো কি অন্যায়?’
ঢাকার কারওয়ান বাজার মোড়ে কথা হয় রাইড শেয়ারিং সার্ভিসের একজন মোটরবাইক চালকের সাথে৷ শুরুতে পদ্মা সেতুতে, পরে ঈদ উপলক্ষে মহাসড়কে মোটরবাইক নিষিদ্ধে ক্ষুব্ধ তিনি৷ তিনি বলেন, ‘‘কিছু হইলেই আমাদের উপর বিধিনিষেধ আসে৷ লকডাউনে সব চলছে, রাইড শেয়ারিং বন্ধ, ট্রাফিক পুলিশ কথায় কথায় জরিমানা করে, এখন আবার মহাসড়কে আমাদের চলাচল নিষেধ৷ আমাদের উপর কেন সব ঝড় আসে? দুইটা টাকা কামাই করে সংসার চালানো কি অন্যায়?’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
‘এবার ঈদে আয় নাই’
মো. আবুল বাশার ঢাকার গুলিস্তানের ফুটপাথে দর্জির কাজ করে পরিবার চালান৷ ঈদ এলে তার কাজ বাড়ে, আয়ও বাড়ে৷ কিন্তু এবার খুশি নন তিনি৷ বাশার বলেন, ‘‘গত বছর লকডাউন থাকলেও সাত দিনে যা আয় করেছি এবার ঈদ চলে আসলেও সেই তুলনায় তেমন আয়ই হয়নি৷ তেলের দাম বৃদ্ধি আর প্রতিদিনের খরচ দুইগুণ বেড়েছে৷ খরচ মেটানোর পর হাতে আর কোনো টাকা থাকে না৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
খুশি নন বাসচালক শরীফ
গুলিস্তান-নারায়ণগঞ্জ রুটের শীতল পরিবহণের চালক মো. শরীফ বলেন, ‘‘দেশে সেতু, মেট্রোরেলসহ বিভিন্ন উন্নয়ন হচ্ছে৷ এতে আমরা খুশি৷ কিন্তু রাস্তা-ঘাটে যানজট বেড়েই চলেছে৷ গত কোরবানির ঈদে লকডাউন থাকায় রাস্তায় গাড়ি কম ছিল, ট্রিপ বেশি মারতে পারায় বেতনও ছিল বেশি৷’’ রাস্তায় তীব্র জ্যামে এই ঈদে গতবারের তুলনায় আয় অর্ধেকও হবে না বলে জানান তিনি৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
ঈদের দিন বাড়ি যাবেন জব্বার
ঢাকার সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে কুলির কাজ করেন মো. জব্বার৷ ঈদ নিয়ে তার বাড়তি কোনো ভাবনা নেই৷ কোরবানি দেয়ার সামর্থ্যও নেই৷ তিনি বলেন, ‘‘গরিব মানুষের ঈদ নাই৷ ঈদ হলো ধনী মানুষের জন্য৷‘’ তার মতে, দেশে প্রতিবছর বড়লোক আরো বড়লোক হচ্ছে, গরিব আরো গরিব হচ্ছে৷ ‘‘ঢাকায় যে কয়টা প্রাইভেট গাড়ি আছে, সে কয়জনই শুধু টাকাওয়ালা, বাকিদের অবস্থা খারাপ,’’ বলেন জব্বার৷ ঈদের দিন পর্যন্ত কাজ করে লঞ্চে বাড়ি ফিরবেন তিনি৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
‘আয় না বাড়লেও খরচ বাড়ছে ম্যালা’
তৈয়ব মিয়া ঢাকার রাস্তায় ফেরি করে শুকনো খাবার বিক্রি করেন৷ করোনাকালীন সময়ের চেয়ে তার আয় বেড়েছে৷ কিন্তু তার চেয়েও পাল্লা দিয়ে বেড়েছে খরচ৷ তৈয়ব মিয়া বলেন, ‘‘করোনার সময় রাস্তাঘাটে মানুষ কম থাকায় আমাগো ইনকাম কম আছিল৷ কিন্তু এমনিতে আমগো ইনকাম প্রায় একই৷ তয় এই কথা ঠিক যে এহন মানুষের আয় না বাড়লেও খরচ বাড়ছে ম্যালা৷’’ ঈদের আগের দিন পিরোজপুরে গ্রামের বাড়ি যাবেন তিনি৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
‘ঈদ আগের মতো নেই’
ঢাকার মিরপুর ১০ সার্কেলের একটি পোশাক তৈরির কারখানার কর্মী সালেহা আক্তার৷ প্রতিষ্ঠানটিতে তিনি দুই বছর যাবত কাজ করেন৷ এই মাসে তার বেতন বেড়েছে এক হাজার টাকা৷ কিন্তু সার্বিক খরচ বেড়েছে ৩০-৪০ ভাগ পর্যন্ত৷ তাই বেতন কিছুটা বাড়লেও তিনি পুরোপুরি খুশি হতে পারছেন না৷ তিনি বলেন, ‘‘আগের বেতন দিয়ে যেভাবে ঈদ পালন করতাম এখন বেতন বাড়ার পরেও তা সম্ভব হয় না৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
‘ঈদ নিয়ে বাড়তি পরিকল্পনা নেই’
ঢাকার পল্টনের ফুটপাথের হোটেল ব্যবসায়ী হাবিবুর রহমান বলেন, ‘‘এখন জিনিসপত্রের দাম বাড়তি হইলেও সাধারণ মানুষের কথা ভাইবা হোটেলের খাবারের দাম বাড়াই নাই৷ কিন্তু তা-ও কাস্টমার আগের মতন নাই৷ মানুষ দুপুরে ভাতের জায়গায় চা-রুটি খায়, যে ১০-২০ টাকা বাঁচে, সেইটাই এখন অনেক টাকা৷’’ তিনি বলেন, গত বছরের ধার-দেনায় এখনও আটকে আছেন, তাই ঈদে বাড়তি কিছু করার পরিকল্পনা তার নেই৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
ঈদে নতুন জামা
ঈদ উপলক্ষে ফুটপাথ থেকে নতুন জামা কিনছেন মো. আল আমিন৷ নরসিংদী থেকে ঢাকায় পড়তে এসেছেন দশম শ্রেণির এই ছাত্র৷ কেনাকাটা সেরে পরিবারের সঙ্গে ঈদ করতে বাড়ি যাবে সে৷ অন্যবার শপিং মল থেকে জামা-কাপড় কিনলেও এবার জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় ফুটপাথেই কেনাকাটা সারছেন বলে জানান৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
ঈদ কাটবে সড়কে
ঢাকার গুলিস্তান মোড়ে কথা হয় এই ট্রাফিক পুলিশের সাথে৷ ১৫ বছরের চাকরিজীবনে হাতেগোনা কয়েকটি ঈদ তিনি বাড়িতে পরিবারের সঙ্গে কাটিয়েছেন৷ এবারও তাকে ঈদের দিন রাস্তায় দায়িত্ব পালন করতে হবে৷ নাম না প্রকাশের শর্তে তিনি বলেন, ‘‘আমরা সরকারি চাকরি করি, কিছু বলতে পারি না৷ বেতন যা পাই, বউ-বাচ্চা গ্রামে রেখে পালতেও কষ্ট হয়া যায়৷ তা-ও তো আমরা নিয়মিত বেতন পাই, সাধারণ নিম্ন আয়ের মানুষ কিভাবে চলে আল্লাহই ভালো জানেন৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
‘আমরাই সবচেয়ে হতাশাগ্রস্ত’
একটি সরকারি ব্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবু নাসের৷ ঈদ আসলেও দেশের সার্বিক পরিস্থিতিতে হতাশ তিনি৷ তিনি বলেন, ‘‘খুব সম্প্রতি পত্রিকায় দেখলাম আমরা ১২২টি দেশের মধ্যে হতাশা ও দুঃখে সপ্তম অবস্থানে আছি, প্রথমে আছে যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান৷ আমার মতে, বাংদেশের যে সার্বিক পরিস্থিতি, আফগানিস্তান নয়, আমাদেরই তালিকায় এক নাম্বারে থাকা উচিত৷’’