নিষিদ্ধ হবার পরও ভারতীয় মন্দিরগুলোয় দেবদাসী প্রথা কেন বন্ধ হয়নি – কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে তার জবাব চেয়েছে সুপ্রিম কোর্ট৷ ওদিকে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে নতুন করে নির্দেশিকা পাঠানো হয়েছে রাজ্য সরকারগুলির কাছেও৷ কিন্তু...
বিজ্ঞাপন
World in Progress: India's Devdasis
শত শত বছর ধরে ভারতীয় মন্দিরগুলোতে চলে আসছে দেবদাসী নামে এই ধর্মীয় প্রথা৷ আসলে এ প্রথা ধর্মের তকমা দিয়ে পুরুষপ্রধান সমাজে নারীকে যৌন শোষণ করার আর একটি প্রক্রিয়া মাত্র৷
মেয়ে যেভাবে মন্দির-গণিকা হয়ে যায়
গরিব ঘরের নীচু জাতের মা-বাবা তাদের কুমারী মেয়েকে ঋতুমতী হবার আগেই নিয়ে যায় মন্দিরে৷ প্রথমে কুমারী মেয়েদের নিলাম করা হয়৷ তারপর মন্দিরের প্রধান পুরোহিত উৎসর্গ করার নামে বিগ্রহের সঙ্গে কুমারী মেয়েদের তথাকথিত বিয়ে দিয়ে দেন৷ বিয়ের পর গরিব ঘরের সেই মেয়ে হয়ে যায় দেবদাসী বা যোগিনী, আক্ষরিক অর্থে সেবাদাসী৷ অর্থাৎ এরপর অন্য কোনো পুরুষকে মেয়েটির বিবাহ করতে পারে না৷ বরং খাওয়া-পরার বিনিময়ে মন্দিরে থেকেই তাদের সারা জীবন কাটে মন্দিরের প্রধান পুরোহিত থেকে শুরু করে অন্যান্য পুরুষদের যৌন লালসার শিকার হয়ে৷ অনেক সময় সমাজের উচ্চবর্গীয় ধনী কিংবা সামন্ত প্রভুদের রক্ষিতার ভূমিকাও পালন করতে হয় তাকে৷ করতে হয় কায়িক পরিশ্রমও৷ বলা বাহুল্য, উৎসর্গের পর দেবদাসীকে ভোগ করার প্রথম অধিকার থাকে মন্দিরের প্রধান পুরোহিতের হাতে৷
বাংলাদেশের যৌনকর্মীদের কথা
পৃথিবীর আদিম এক পেশা পতিতাবৃত্তি৷ বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই চালু রয়েছে এই পেশা৷ বাংলাদেশও ব্যতিক্রম নয়৷ কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কেমন আছেন বাংলাদেশের যৌনকর্মীরা? এই ছবিঘরে তাঁদের অবস্থা কিছুটা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে৷
ছবি: Getty Images
যেভাবে যৌনপল্লীতে আগমন
বাংলাদেশে অনেক ক্ষেত্রে প্রতারণার শিকার হয়ে যৌনপল্লীতে হাজির হন মেয়েরা৷ প্রত্যন্ত অঞ্চলের অতিদরিদ্র্য পরিবারের সদস্যরা কখনো কখনো অর্থের লোভে মেয়েদের বিক্রি করে দেন বলে জানিয়েছে একাধিক আন্তর্জাতিক বার্তাসংস্থা৷ এছাড়া ভালোবাসার ফাঁদে ফেলে কিংবা বিদেশ যাওয়ার লোভ দেখিয়েও মেয়েদের যৌনপল্লীতে আনা হয়৷
ছবি: Getty Images/AFP/Munir uz ZAMAN
যৌনকর্মীদের জন্য ‘গরুর ট্যাবলেট’
ফরিদপুরের সরকার অনুমোদিত যৌনপল্লীর ছবি এটি৷ অভিযোগ রয়েছে, পল্লীর মালিক নতুন আসা যৌনকর্মীদের স্টেরয়েড ট্যাবলেট সেবনে বাধ্য করেন, যা সাধারণত গরুকে খাওয়ানো হয়৷ গরুর স্বাস্থ্য বাড়াতে ব্যবহার করা এই ট্যাবলেট মানুষের দেহের জন্য ক্ষতিকর৷
ছবি: M.-U.Zaman/AFP/GettyImages
অপ্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ‘ইনজেকশন’
বাংলাদেশের এক যৌনপল্লীর মালিক রোকেয়া জানান, স্টেরয়েড ওষুধ প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে ভালো কাজে দেয়৷ কিন্তু অপ্রাপ্তবয়স্ক, বিশেষ করে ১২ থেকে ১৪ বছর বয়সি মেয়েদের ক্ষেত্রে এটি কার্যকর নয়৷ অপ্রাপ্তবয়সিদের স্বাস্থ্য ভালো করতে বিশেষ ধরনের ইনজেকশন ব্যবহার করা হয় বলে জানান ৫০ বছর বয়সি রোকেয়া৷
ছবি: picture-alliance/ZUMA Press/M. Candela
অধিকাংশ যৌনকর্মী ‘স্টেরয়েড আসক্ত’
আন্তর্জাতিক উন্নয়নসংস্থা একশনএইড ইউকে এক সমীক্ষার ভিত্তিতে ২০১০ সালে জানায় যে, বাংলাদেশের প্রায় ৯০ শতাংশ যৌনকর্মী ওরাডেক্সন বা অন্যান্য স্টেরয়েড ট্যাবলেট নিয়মিত গ্রহণ করে৷ তাঁদের গড় বয়স ১৫-৩৫ বছর৷ বাংলাদেশে দু’লাখের মতো যৌনকর্মী রয়েছে বলে ধারণা করা হয়৷
ছবি: picture-alliance/ZUMA Press/M. Candela
সচেতনতা সৃষ্টির উদ্যোগ
স্টেরয়েড ব্যবহারের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে প্রচারণা চালাচ্ছে একশনএইড৷ সংস্থাটির বাংলাদেশ অংশের কর্মকর্তা লুৎফুন নাহার জানিয়েছেন, ‘‘ওরাডেক্সন গ্রহণ করার পর শুরুতে মেয়েদের শরীরে চর্বির পরিমাণ বাড়তে থাকে৷ কিন্তু এটি নিয়মিত সেবন করলে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, চামড়ায় ক্ষতসহ বিভিন্ন রোগ দেখা দেয়৷’’
ছবি: GMB Akash
এইচআইভি সংক্রমণ
বাংলাদেশে যৌনকর্মীদের মধ্যে এইচআইভি সংক্রমণ বা এইডস রোগ হওয়ার খবর মাঝে মাঝে পত্রিকায় প্রকাশ হয়৷ তবে ঠিক কতজন যৌনকর্মী এইচআইভি আক্রান্ত তার হালনাগাদ কোনো হিসাব পাওয়া যায়নি৷ অনেকক্ষেত্রে কনডম ব্যবহারে খদ্দেরের অনীহা যৌনকর্মীদের মাঝে যৌনরোগ ছড়াতে সহায়ক হচ্ছে৷ (ফাইল ফটো)
ছবি: AP
‘অপ্রাপ্তবয়স্ক’ যৌনকর্মী
বাংলাদেশের যৌনপল্লীগুলোতে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের জোর করে যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করানোর অভিযোগ রয়েছে৷ আর এই পেশায় যাঁরা একবার প্রবেশ করছেন, তাঁদের জীবনেও নানা ঝুঁকি থাকে৷ পতিতাপল্লীতে হামলার খবর কিন্তু মাঝেমাঝেই শোনা যায়৷ (ফাইল ফটো)
ছবি: M.-U.Zaman/AFP/GettyImages
শত বছরের পুরনো পল্লী উচ্ছেদ
মাদারিপুরের পতিতাপল্লীটি ছিল শত বছরের পুরনো৷ গত বছর এই পল্লী উচ্ছেদ করেছেন স্থানীয়রা৷ এমনকি পল্লীটি জোরপূর্বক উচ্ছেদ না করার হাইকোর্টের আদেশও এক্ষেত্রে উপেক্ষা করা হয়েছে৷ সেখানে পাঁচশ’র মতো যৌনকর্মী বাস করতেন৷ কিছুদিন আগে টাঙ্গাইলের একটি পতিতাপল্লীও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে৷ এ রকম উচ্ছেদের আতঙ্কে রয়েছেন আরো অনেক যৌনকর্মী৷
ছবি: M.-U.Zaman/AFP/GettyImages
মধ্যপ্রাচ্যে ‘যৌনদাসী’ বাংলাদেশের মেয়েরা!
বাংলাদেশের বেশ কয়েক নারীকে মধ্যপ্রাচ্যে যৌনদাসী হিসেবে ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে৷ তাঁদের পাচার করে সিরিয়ায় নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে একাধিক বার্তাসংস্থা৷ এ সব নারীকে ফিরিয়ে আনতে সরকারি উদ্যোগের কথা বলা হচ্ছে৷ তবে শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, প্রতিবেশী দেশ ভারতের বিভিন্ন পতিতালয়েও বাংলাদেশি নারীদের জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তিতে নিয়োগ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ আছে৷
ছবি: Getty Images/A. Joyce
9 ছবি1 | 9
আইন হয়েছে, কিন্তু কোনো কাজ হয়নি
১৯৮৮ সালে দেবদাসী প্রথা নিষিদ্ধ করা হলেও, এখনও তা বন্ধ হয়নি৷ বিশেষ করে ভারতের দক্ষিণী রাজ্যগুলিতে এবং মহারাষ্ট্রের কিছু অঞ্চলের মন্দিরগুলিতে এই প্রথা আজও চলছে৷ খুব সম্প্রতি তার প্রমাণও পাওয়া গেছে৷ বিষয়টিকে কেন্দ্র করে এক জনস্বার্থ মামলায় সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্রীয় সরকারকে জবাবদিহি করতে বলার পর, ৮০-র দশকের সেই নিষেধাজ্ঞা অবিলম্বে পালন করার জন্য রাজ্য সরকারগুলির কাছে নির্দেশিকা পাঠায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রদপ্তর৷ নির্দেশিকায় বলা হয় – কোনো অজুহাত বা ধর্মীয় ছদ্মনামে এ প্রথা যেন আর চালানো না হয়৷ আর এর জন্য বিশেষ অভিযান চালিয়ে জীবিত দেবদাসীদের খুঁজে বের করে তাদের পুনর্বাসনের কথাও বলা হয়৷ বলা হয়, এই কাজে বিভিন্ন বেসরকারি বা স্বয়ংসেবী সংস্থাগুলোরও সাহায্য নেয়া হতে পারে৷
সমাজবিদদের মতে, দেবদাসী প্রথার পেছনে নানা কারণ থাকতে পারে৷ যেমন ধর্মীয় বিশ্বাস ও কুসংস্কার, জাতিভেদ, পুরুষতান্ত্রিকতা, যৌন শোষণ এবং দারিদ্র্য৷ অনেকে আবার ভারতে বৌদ্ধধর্মের পতনের সঙ্গে দেবদাসী প্রথাকে যুক্ত করতে চান৷ এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, অতীতে জমিদার বা ভূস্বামীদের সঙ্গে উচ্চবর্গীয় ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের অশুভ ষড়যন্ত্রের ফলে নীচু জাতের খুব গরিব মেয়েদের দেবদাসী বানানো হতো৷ পরে এরা যাথারীতি যৌন লালসার শিকার হতো, এমনকি শেষ পর্যন্ত অনেকের ঠিকানা হতো যৌনপল্লিতে৷ সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা যায়, তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্নাটক এবং মহারাষ্ট্রের কিছু এলাকায় আজও রয়েছে অন্ততপক্ষে ৩৫ হাজার দেবদাসী৷ এদের মধ্যে যৌবন-উত্তীর্ণ অনেকের শারীরিক ও মানসিক অবস্থা শোচনীয়৷ এদের অনেকেই আজ রাস্তার ভিখারি৷ রূপ-যৌবন হারানোর পর, এদের যেন কোথাও ঠাঁই নেই – না মন্দিরে, না ধনীদের ঘরে৷