অপরাধ জগতের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের জুড়ে দেয়ার এক আশ্চর্য প্রবণতা আছে ভারতে। বাস্তবের সঙ্গে যার বিশেষ মিল নেই।
বিজ্ঞাপন
২০১৮ সাল। তখন পশ্চিমবঙ্গে একটি প্রথম সারির দৈনিক পত্রিকার কর্মী হিসেবে রিপোর্টিং করি। সেপ্টেম্বর মাসে পর পর দুইটি জাতীয় সংবাদমাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গের রোহিঙ্গা ক্যাম্প নিয়ে পাতাজোড়া রিপোর্ট বার হলো। তা দেখে সম্পাদক মহাশয়ের চক্ষুচড়কগাছ। কেন আমরা সেই খবর পাইনি, তা নিয়ে দীর্ঘ চোটপাটের পর স্থির হলো, নতুন অ্য়াঙ্গেলে এই স্টোরি আমাদের ধরতে হবে।
কলকাতা থেকে কয়েকঘণ্টার দূরত্বে বারুইপুর লাগোয়া হারদা গ্রামে পৌঁছানো গেল। সেখানে একটি ব্যক্তিগত জমিতে বাঁশের ঘর বেঁধেছেন সাকুল্যে ৪০ টি রোহিঙ্গা পরিবার। মূলত দিল্লি এবং জম্মু থেকে পশ্চিমবঙ্গ এসেছেন তারা কিছু কাজের খোঁজে। আর পাঁচটি উদ্বাস্তু পরিবারের মতোই দিন কাটছে তাদের। ২৫-২৬টি পরিবারের কাছে ইউএনএইচসিআর-এর রিফিউজি কার্ড ছিল। বাকিরা দরখাস্ত করেছেন। যত মানুষ সেই ক্যাম্পে ছিলেন, তার ৫০ ভাগ নারী, ১৫ ভাগ শিশু এবং বাকি পুরুষ। এর মধ্যে শয্যাশায়ী বৃদ্ধ পুরুষের সংখ্যা অন্তত ১০।
অথচ জাতীয় কয়েকটি সংবাদমাধ্যম এই সব কোনো সংখ্যাতত্ত্বে না গিয়ে সরাসরি লিখে দিয়েছিল, দক্ষিণ ২৪ পরগনার ওই রোহিঙ্গা ক্যাম্প তৈরি হওয়ার পর এলাকায় অপরাধের সংখ্যা বাড়ছে। বলা হয়েছিল, বাংলাদেশ থেকে সীমান্ত পার করে তারা পশ্চিমবঙ্গে ঢুকছেন এবং অপরাধ জগতের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন। অথচ বিএসএফ এই সাংবাদিককে অন রেকর্ড জানিয়েছিল, দক্ষিণ ২৪ পরগনার ওই রোহিঙ্গারা অধিকাংশই ভারতের অন্য জায়গা থেকে পশ্চিমবঙ্গে ঢুকেছেন। তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো যোগ নেই। রীতিমতো রেকর্ড খুলে বিএসএফ দেখিয়েছিল, এক বছরে বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে ৭০ জন রোহিঙ্গা ঢুকেছেন।
নির্বাসিত রোহিঙ্গাদের জীবন ও বাংলাদেশের উভয় সংকট
গত আট দশক ধরে নির্বাসন ও প্রত্যাবাসনের চক্রে আটকা পড়েছেন রোহিঙ্গারা৷ সবশেষ যে আশার আলো দেখা গিয়েছিল তা-ও নতুন বাস্তবতায় ফিকে হতে শুরু করেছে৷ রোহিঙ্গাদের ঘরছাড়া করার ও ঘরে ফেরানোর প্রচেষ্টার কাহিনি থাকছে ছবিঘরে...
ছবি: Mohibulla Mohib
রোহিঙ্গা কারা
বাংলাপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, আরাকান রাজ্যে বসবাসকারী মুসলিমরা রোয়াইঙ্গা, যাম্ভইকা, কামানচি, জেরবাদি ও দিন্নেত এই পাঁচটি জাতিগোষ্ঠীতে বিভক্ত৷ এর মধ্যে রোয়াইঙ্গা জাতিগোষ্ঠিই রোহিঙ্গা নামে পরিচিত৷ উদ্ভব নিয়ে নানা মত থাকলেও বাংলাপিডিয়া বলছে, ‘‘চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে আরাকান রাজ্যে বসতিস্থাপনকারী চট্টগ্রামি পিতার ঔরসজাত ও আরাকানি মাতার গর্ভজাত বর্ণসংকর জনগোষ্ঠীই রোয়াইঙ্গা বা রোহিঙ্গ্যা৷’’
ছবি: Zobaer Ahmed/DW
প্রথম দাঙ্গা
১৯৪০ সাল থেকে আরাকানে বৌদ্ধ মগ জনগোষ্ঠী ও মুসলিম রোহিঙ্গাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার শুরু হয়৷ ১৯৪২ সালে এক লাখ রোহিঙ্গা হত্যার শিকার হন৷ অনেকে আরাকান ছেড়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন৷ ১৯৪৮ সালে তৎকালীন বার্মার স্বাধীনতার পর এবং ১৯৬২ সালে পুনরায় তারা নিপীড়ন, নির্যাতন ও উচ্ছেদের শিকার হন৷ এ সময় বাংলাদেশে উদ্বাস্তু হয়ে আসতে বাধ্য হন তারা৷
স্বাধীন বাংলাদেশে রোহিঙ্গারা
আরাকানে জাতিগত আন্দোলন দমনের জন্য মিয়ানমারের (তখন বার্মা) তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেনারেল নে-উইন (ছবিতে) ১৯৭৮ সালে ‘নাগামিন ড্রাগন অপারেশন’ নামের অভিযান চালান৷ আরাকান ন্যাশনাল লিবারেশন পার্টির সঙ্গে রোহিঙ্গাদের সম্পৃক্ততার কারণে নির্বিচারে তাদের হত্যা করা হয়৷ অভিযানের কারণে প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালাতে বাধ্য হন৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
প্রথম প্রত্যাবাসন
সমস্যার দ্রুত সমাধানের জন্য বাংলাদেশের তখনকার সরকার আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের আবেদন জানায়৷ জাতিসংঘসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক ফোরামের চাপের মুখে নে-উইন সরকার বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের ফেরাতে সম্মত হয়৷ দুই দেশের চুক্তি অনুযায়ী, ১৯৭৯ সালের ৬ অক্টোবর থেকে ২৪ ডিসেম্বরের মধ্যে রোহিঙ্গাদের বড় অংশ নিজ দেশে ফিরে যান৷ থেকে যান ১৫ হাজার৷ ছবিটি ২০১৮ সালের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের জন্য বানানো একটি ‘মডেল গ্রাম’৷
ছবি: Getty Images/AFP/P. H. Kyaw
আবারও সংকট
মিয়ানমার সরকারের আইন ও নীতির কারণে ১৯৯১ সালে আবারও রোহিঙ্গাদের একটি অংশ ঘরছাড়া হন৷ ৯০ সালের নির্বাচনে জয়ী অং সান সুচিকে বন্দি করার পর সেনাবাহিনী আবারও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে জড়িত রাখাইনসহ রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতন শুরু করে৷ রোহিঙ্গাবিরোধী অভিযানের কারণে ১৯৯১ সালের ২৬ জুনের মধ্যে আড়াই লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেন৷
ছবি: picture alliance/dpa
দ্বিতীয় প্রত্যাবাসন
দুই দেশের সরকারের মধ্যে ১৯৯২ সালের ২৮ এপ্রিল একটি সমঝোতা চুক্তি হয়৷ সে অনুযায়ী, এই দফায় আগতদের দুই লাখ ৩১ হাজার জনকে মিয়ানমার সরকার ফিরিয়ে নেয়৷ বাকি থাকে ২২ হাজার৷ তাদের ফেরানোর অঙ্গীকার করলেও তা বাস্তবায়ন করেনি দেশটি৷ প্রত্যাবাসনের অপেক্ষায় তারা কক্সবাজার জেলার উখিয়া থানার কুতুপালং এবং টেকনাফ থানার নয়াপাড়া শরণার্থী শিবিরে অবস্থান করেন৷
ছবি: picture alliance/AP Photo/K. Huda
২০১৬ সালের পর
মিয়ানমারে নির্যাতনের জেরে ২০১৬ সালের পর থেকে আবারও বড় আকারে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসতে শুরু করেন৷ বাংলাদেশের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের (আরসিসিসি) হিসাবে ২০১৬ সালে ৮৭ হাজার এবং ২০১৭ সালের আগষ্ট থেকে ২০১৮ সালের জানুয়ারির মধ্যে প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন৷ ইউএনএইচসিআর-এর হিসাবে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় নয় লাখ ৭২ হাজারে৷
ছবি: DW/M.M. Rahman
তিনটি ব্যর্থ উদ্যোগ
২০১৭ সালের পর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের তিনটি উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল৷ ২০১৮ সালে, ২০১৯ ও ২০২৩ সালে নেয়া এসব উদ্যোগের কোনোটিরই ফল মেলেনি৷ এর মধ্যে ২০১৮ সালে আট লাখ ৮৮ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীর তালিকা মিয়ানমারকে দিয়েছিল বাংলাদেশ৷ তার প্রেক্ষিতে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে ৬৮ হাজার রোহিঙ্গার একটি ফিরতি তালিকা পাঠানো হয়৷ পাইলট প্রকল্পের অংশ হিসেবে ১১৪০ জনকে পাঠানোর উদ্যোগ নেয়া হলেও পরে তা ভেস্তে যায়৷
ছবি: bdnews24.com
উদ্যোগী চীন
গত বছর রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের সবশেষ উদ্যোগটি শুরু হয়৷ প্রথমবারের মতো রোহিঙ্গাদের একটি দল পরিস্থিতি দেখতে মিয়ানমারে যান৷ প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনার জন্য চীনের বিশেষ দূত ডেং জিজুন দেশটি সফরে যান এবং রোহিঙ্গারা যাতে ক্যাম্পে না, নিজ গ্রামে ফিরতে পারেন তার উদ্যোগ নেন৷ সেপ্টেম্বরে আলোচনার জন্য মিয়ানমারে যায় বাংলাদেশের একটি দল৷ এর অধীনে সে বছর ১২ হাজার জনকে পাঠানোর পরিকল্পনা করে বাংলাদেশ৷
ছবি: picture-alliance/dpa/J. Qing
দুই ঝড়
এই পরিকল্পনায় প্রথম আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় হামুন৷ এরপর সম্ভাবনাটিকে আরো ফিকে করে দেয় মিয়ানমারের সামরিক জান্তাবিরোধী বিদ্রোহের নয়া ঝড়৷ ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স আর্মি, তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি এবং আরাকান আর্মি সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রবল লড়াই শুরু করে৷ আরাকান আর্মি রাখাইনে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে জান্তার ১৬০টি ঘাঁটি দখল করে৷
ছবি: Handout/Kokang Information Network/AFP
আন্তর্জাতিক বাধা
মিয়ানমারের পরিস্থিতি বিবেচনায় শুরু থেকেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে আসছিল আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থাগুলো৷ সম্প্রতি নতুন সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাসান মাহমুদের সাথে সাক্ষাৎ শেষে জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি বলেছেন, ‘‘রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য এটি ভালো সময় নয়৷’’
ছবি: AFP
‘ভারাক্রান্ত বাংলাদেশ’
সম্প্রতি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছেন, ‘‘রোহিঙ্গা ডিসপ্লেসড পিপলের কারণে আমরা ভারাক্রান্ত। প্রতি বছর ৩৫ হাজার করে নতুন সন্তান জন্মগ্রহণ করে৷ এই পরিস্থিতিতে আসলে; মানবিকতার কারণে তখন আমরা রোহিঙ্গাদের স্থান দিয়েছিলাম৷ আমরা মনে করি, মিয়ানমারে পরিস্থিতি উত্তরণের মাধ্যমেই এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব৷’’ রাখাইনে পরিস্থিতির পরিবর্তন হলে দ্রুত প্রত্যাবাসন শুরু হবে বলে তিনি আশাবাদী৷
ছবি: Arafatul Islam/DW
শিবিরে বন্দি জীবন
বাংলাদেশে সীমিত জায়গায় বিপুল রোহিঙ্গা শরণার্থী মানবেতর জীবন যাপন করেন৷ কিছুদিন পরপর আগুনে তাদের ঘর পোড়ে, ঝড়ে বিপদে পড়েন৷ ঘটে চলেছে সহিংসতাও৷ তাদের সন্তানেরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত, নেই কর্মসংস্থানও৷ এর মধ্যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অর্থ সহয়তার হারও চাহিদার চেয়ে ক্রমাগত কমছে৷ সর্বশেষ ২০২৩ সালে যা ৪৭ ভাগে নেমে এসেছে৷
ছবি: AFP via Getty Images
ভাসমান জীবন
ভাগ্যবদলের চেষ্টায় মিয়ানমার ও বাংলাদেশ থেকে পালানোর চেষ্টা করছেন অনেক রোহিঙ্গা৷ ইউএনএইচসিআর-এর হিসাবে, ২০২৩ সালে সাড়ে চার হাজার রোহিঙ্গা মিয়ানমার ও বাংলাদেশের শিবির থেকে নৌকায় সাগরপথে রওনা দেন, যাদের দুই-তৃতীয়াংশ ছিলেন নারী ও শিশু৷ বঙ্গোপসাগর ও আন্দামান পেরুতে গিয়ে মারা গেছেন বা নিখোঁজ হয়েছেন ৫৬৯ জন, যা ২০১৪ সালের পর সর্বোচ্চ৷ সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়ার উপকূলে তাদের আগমনে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছেন স্থানীয়রা৷
ছবি: Chaideer Mahyuddin/AFP/Getty Images
14 ছবি1 | 14
তাহলে জাতীয় সংবাদমাধ্যমে বাংলাদেশ এবং অপরাধ শব্দ দু'টিকে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কেন জড়িয়ে দেওয়া হলো? কয়েক মাসের মধ্যেই তা স্পষ্ট হলো।
২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে এসে কেন্দ্রীয় শাসকদলের নেতারা বার বার বাংলাদেশি অনুপ্রবেশ এবং রোহিঙ্গা শব্দ দুটিকে মিলিয়ে দিচ্ছিলেন। এবং তার সঙ্গেই জুড়ে দেয়া হচ্ছিল 'অপরাধ' শব্দটিকে। অর্থাৎ, বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে ঢুকে অপরাধ জগতের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুরা। এবং তারা নাকি সকলেই বাংলাভাষী! অপরাধ করতেই তারা পশ্চিমবঙ্গে ঢুকেছে।
ওই ঘটনার পর পাঁচ বছর কেটে গেছে। আবার এক লোকসভা ভোটের মুখোমুখি আমরা। এবং আবার পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে রোহিঙ্গা শব্দটি। সম্প্রতি তৃণমূল নেতা শাহজাহান শেখের বাড়িতে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) তল্লাশি চালাতে যায়। শাহজাহানের অনুগামীরা তাদের উপর চড়াও হয়। মারধর করা হয় সিআরপিএফ এবং ইডি কর্মকর্তাদের। মারধর করা হয় সাংবাদিকদেরও। এরপর থেকে শাহজাহান নিরুদ্দেশ। ইডি আবার তার বাড়ি গেছে তল্লাশি করতে। পুলিশ শাহজাহানকে খুঁজছে। বলাই বাহুল্য, বাহুবলী শাহজাহান এমন কাণ্ড এর আগেও একাধিকবার ঘটিয়েছে। এর আগেও তাকে গা ঢাকা দিতে হয়েছে খুনের অভিযোগে। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে সুন্দরবনের এক প্রান্তিক অঞ্চল সন্দেশখালি। শাহজাহানকে ওই অঞ্চলের বেতাজ বাদশাহ বলা চলে। তার 'গুন্ডামি'র ইতিহাস কয়েক দশকের। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে শাহজাহান সেই দলের বাহুবলী হয়ে ওঠে। শোনা যায়, সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশের দিকেও তার সেফ হাউস আছে। কাঁটাতার, বিএসএফ পেরিয়ে কীভাবে সে সীমান্ত পার করে, তা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলে না।
রাজনীতি নিজস্ব কয়েনেজ আঁকড়ে ধরে বসে থাকে। শাহজাহান এবং রোহিঙ্গা মেলাতে পারলেই রাজনীতির কেল্লা ফতে। তাই আশ্চর্যজনকভাবে দেখা গেল ওই ঘটনার পরেই বিজেপির রাজ্য এবং কেন্দ্রের নেতারা একের পর পোস্ট করতে শুরু করলেন সমাজমাধ্যমে। সেখানে বলা হলো, শাহজাহানের দলে আছে ভয়াবহ রোহিঙ্গা অপরাধীরা। প্রশ্ন হলো, এই রোহিঙ্গাদের শাহজাহান পেলেন কোথা থেকে? রাজনীতিবিদেরাই বা জানলেন কী করে এখবর? যদি বা জানলেন, আইনানুগ ব্যবস্থা নিলেন না কেন? রোহিঙ্গা চিহ্নিত করা এবং তাকে জেলে ঢোকানো মোটেই কঠিন কাজ নয়।
বাস্তবে, সন্দেশখালি অঞ্চলে কোনোদিনই রোহিঙ্গা ক্যাম্প ছিল না। বারুইপুর অঞ্চলে যে ক্যাম্প ছিল, তা বহুদিন আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। ওই ক্যাম্পের অনেকেই দিল্লি লাগোয়া হরিয়ানার নু, জম্মু এবং দিল্লি-উত্তরপ্রদেশ সীমানা লাগোয়া ক্যাম্পে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। এই প্রতিটি ক্যাম্পই ভারতের রোহিঙ্গা ক্যাম্প হিসেবে নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত। বস্তুত, ২০২১-২২ সালে ওই ক্যাম্পগুলি ঘুরে দেখার সময় বেশ কিছু পুরনো মুখের সঙ্গে দেখা হয়েছিল, পশ্চিমবঙ্গের ক্যাম্পে যাদের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল।
ভারত সরকার কখনোই মিয়ানমার থেকে উৎখাত হওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে ভারতে থাকার অনুমতি দেয়নি। বাংলাদেশে যে পরিমাণ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু বসবাস করেন, তার সিকিভাগও ভারতে নেই। ভারতে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু ক্যাম্পের সংখ্যা হাতে গুণে বলে দেওয়া যায়। সেই ক্যাম্পে যারা বসবাস করেন, তারা কার্যত 'খোলা জেলে' থাকেন। বাইরে থেকে তাদের সঙ্গে সাংবাদিকেরা দেখা করতে গেলেও থানায় গিয়ে জানিয়ে আসতে হয়। রোহিঙ্গা রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য থানার অনুমতি লাগে। বাইরে গিয়ে কাজ করার অনুমতি নেই তাদের। কিছু এনজিও ক্যাম্পের চৌহদ্দির মধ্যে তাদের কাজের ব্যবস্থা করে দেয়।
এরপরেও কি কেউ বাইরে যান না? পরিচয় গোপন করে অনেকেই অনেক কাজ করেন বলে শোনা যায়। কেউ কেউ অপরাধও করেন। জেলেও যান। কিন্তু তার সংখ্যা কত? সার্বিকভাবে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী অপরাধপ্রবণ এমন কোনো তথ্য সরকারি নথিতে আছে কি? উত্তর, নেই।
কিন্তু রাজনীতিতে আছে। ভারতের দক্ষিণপন্থি রাজনীতি রোহিঙ্গাদের সঙ্গে অপরাধের একটি আশ্চর্য সমান্তরাল তৈরি করে ফেলেছে। জনমানসে সেই বার্তা গেঁথে দেয়া গেছে। ফলে সুযোগ পেলেই রাজনীতি রোহিঙ্গা জুজু জনমানসে ছড়িয়ে দেয়। বাস্তবের সঙ্গে যার কার্যত কোনো সম্পর্ক নেই। এই জনমানস জানেই না, রোহিঙ্গারা কোন ভাষায় কথা বলেন?
ফিরে আসা যাক শাহজাহানের এলাকায়। সুন্দরবন অঞ্চলে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে অবস্থিত সন্দেশখালি বরাবরই অপরাধপ্রবণ এলাকা। গরু-মানুষ-মাদক পাচারের জন্য কুখ্যাত এই এলাকা ডাকাতি-রাহাজানিরও তীর্থক্ষেত্র। ভারত-বাংলাদেশের একাধিক ক্রসবর্ডার গ্যাং এখানে মাফিয়ারাজ চালায় বলে অভিযোগ। শেখ শাহজাহানের মতো বাহুবলীরা এই সমস্ত গ্যাংয়ের সঙ্গে জড়িত বলে শোনা যায়। চোখ-কান খোলা রাখলে তার আভাসও মেলে। শাহজাহানের ডেরায় গিয়ে তাদের অস্ত্রসম্ভার দেখে এসেছে এই সাংবাদিক। কিন্তু রোহিঙ্গাদের খোঁজ পায়নি। পাওয়ার কথাও নয়। বাংলাদেশের যে অঞ্চলে রোহিঙ্গা শিবির বা রোহিঙ্গাদের যাতায়াত, তার চেয়ে বহু বহু কিলোমিটার দূরে এই সন্দেশখালি।
কিন্তু কে না জানে, রাজনীতির না আছে ভূগোল, না আছে ইতিহাস! মানবমনে উত্তেজনা তৈরির বিকৃত তথ্য বরাবরই রাজনীতির অন্যতম অস্ত্র। ভারতে 'রোহিঙ্গা' শব্দটি তেমনই এক বিকৃত রাজনৈতিক অস্ত্র।