ভারতীয় সেনায় কতটা গুরুত্ব বেড়েছে নারীদের?
১২ মে ২০২৫
পহেলগামের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতীয় সেনা প্রত্যাঘাত করেছে পাকিস্তানের মাটিতে। এ বিষয়ে খবরাখবর বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে ভারতের পক্ষে সংবাদমাধ্যমের সামনে হাজির হয়েছেন উইং কমান্ডার ব্যোমিকা সিং ও কর্নেল সোফিয়া কুরেশি।
দুই নারী মুখ
স্কুল জীবনে ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর (এনসিসি)-এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ব্যোমিকা। স্নাতক স্তরে পড়াশোনা করেন ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে। ২০০৪ সালে যোগ দেন সেনায়। প্রথমে ছিলেন বিমানবাহিনীতে হেলিকপ্টার পাইলট। ২০১৭ সালে উইং কমান্ডার পদে দায়িত্ব পান। জম্মু-কাশ্মীর এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের পাহাড়ি এলাকায় হেলিকপ্টার ওড়ানোর অভিজ্ঞতা রয়েছে ব্যোমিকার। তিনি খুব সাহসী সেনা আধিকারিক হিসেবে পরিচিত। ২০২০ সালে অরুণাচল প্রদেশে তার নেতৃত্বে উদ্ধার অভিযান হয়েছিল। ঝুঁকিপূর্ণ এই অভিযানে সফল হয়েছিলেন ব্যোমিকা।
সোফিয়া কুরেশি গুজরাটের বাসিন্দা। বায়োকেমিস্ট্রিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি আছে তার। সোফিয়ার দাদাও সেনাবাহিনীতে ছিলেন, ঠাকুরদাও৷ তার বাবা সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৯৯ সালে সোফিয়া ভারতীয় সেনাতে যোগদান করেন। সে বছর চেন্নাইয়ের অফিসার্স ট্রেনিং অ্যাকাডেমিতে প্রশিক্ষণ নেন। তিনি সেনাবাহিনীতে লেফটেন্যান্ট হিসেবে কমিশন লাভ করেন। ২০০৬ সালে সোফিয়া কঙ্গোয় রাষ্ট্রপুঞ্জের শান্তিরক্ষা মিশনে সামরিক পর্যবেক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
নারীর গুরুত্ব
ভারতের বিদেশ সচিব বিক্রম মিশ্রির পাশে সাংবাদিক বৈঠকে দেখা গিয়েছে ব্যোমিকা ও সোফিয়াকে। এটাকে উত্তরণ হিসেবে দেখা হলেও সেনাবাহিনীতে নারীদের সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করার লড়াই সহজ ছিল না।
২০২৩ সালে প্রকাশিত সবশেষ সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে, ভারতের সেনাবাহিনীতে প্রায় সাত হাজার নারী আধিকারিক ও কর্তা রয়েছেন। বিমানবাহিনীতে এই সংখ্যা এক হাজার ৬০০ জনের বেশি। নারীর সংখ্যা বাড়লেও তাদের পদমর্যাদা, চাকরির মেয়াদ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
ভারতীয় সেনায় নারী আধিকারিক নিয়োগ করে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেয়া হয়। কিন্তু একটি নির্দিষ্ট সময়ের পরে তাদের অবসরে পাঠানোই ছিল নিয়ম। তাদের চাকরি জীবনের মেয়াদ ছিল সংক্ষিপ্ত। তারা ‘পার্মানেন্ট কমিশন'-এর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না। যারা এর অন্তর্ভুক্ত, তারা অবসরের বয়স পর্যন্ত চাকরি করতে পারেন। তাদের পদোন্নতি হয় ও আর্থিক সুযোগ-সুবিধা সময়ের সঙ্গে বাড়তে থাকে। নারীরা এই অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিলেন সেনাবাহিনীতে। এমনকী তাদের পেনশন পাওয়ার অধিকারও ছিল না।
প্রশ্ন উঠেছিল, কেন শুধু স্টাফ হিসেবে বিবেচিত হবেন মহিলারা। কেন তারা কম্যান্ডার পদ পাবেন না। এ নিয়ে মামলা গড়ায় সর্বোচ্চ আদালতে। এই মামলার শুনানির সময়ে কেন্দ্রীয় সরকার প্রশ্নের মুখে পড়ে।
২০২০–এর ১৭ ফেব্রুয়ারির রায়ে শীর্ষ আদালত বলে, যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়াই সেনাবাহিনীতে কম্যান্ডার পদে নারীদের বিবেচনা না করে, শুধু স্টাফ হিসেবে সীমাবদ্ধ রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণযোগ্য নয়।মহিলা অফিসারদের কম্যান্ডার পদের জন্য বিবেচনা না করা আইনসম্মত নয়। এটাকে মধ্যযুগীয় চিন্তাধারার তকমা দিয়েছিল আদালত।
সোফিয়ার দৃষ্টান্ত
সোফিয়া কুরেশি এখন আলোচনায় উঠে এলেও তার কথা অতীতে শোনা গিয়েছিল সুপ্রিম কোর্টে। ‘পার্মানেন্ট কমিশন' মামলার রায় দিতে গিয়ে এই সোফিয়ার কৃতিত্বের কথা তুলে ধরেছিল আদালত।
তাদের বক্তব্য, যে বিভাগে সোফিয়ার মতো দক্ষ আধিকারিক রয়েছেন, সেখানে কেন নারীদের ‘পার্মানেন্ট কমিশন' নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। সেই সময়ে সোফিয়া লেফটোন্যান্ট কর্নেলের পদে ছিলেন। ২০২০ সালের রায়ের পরে শীর্ষ আদালত সেনার তিন বাহিনী ও উপকূলরক্ষী বাহিনীতে নারী অফিসারদের ‘পার্মানেন্ট কমিশন' নিয়ে একাধিক নির্দেশ দিয়েছে।
এই সংক্রান্ত মামলা এখনো চলছে সর্বোচ্চ আদালতে। মামলাকারী কর্নেল গীতা শর্মার আইনজীবী সাম্প্রতিক শুনানিতে সোফিয়া কুরেশির উদাহরণ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, "সোফিয়াকেও পার্মানেন্ট কমিশন সংক্রান্ত আবেদন নিয়ে শীর্ষ আদালতে আসতে হয়েছিল। সেই অফিসার এখন দেশকে গর্বিত করছেন।"
ভারতীয় সেনার অভ্যন্তরীণ কর্মী কাঠামো ও নারীর ভূমিকা নিয়ে এমন চর্চা চলতে থাকলেও, ব্যোমিকা ও সোফিয়াকে সামনে এনে ভারত যে মাস্টার স্ট্রোক দিয়েছে, তার কোনো জবাব পাকিস্তানের কাছে ছিল না।
কী বার্তা?
শুধু পাকিস্তান নয়, গোটা বিশ্বের কাছে কী বার্তা দিল ভারত সরকার?
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মইদুল ইসলাম ডিডাব্লিউকে বলেন, "সুপরিকল্পিতভাবে দুই নারী সেনা আধিকারিককে সামনে আনা হয়েছে। পাকিস্তানের জঙ্গিরা বেছে বেছে হিন্দু পুরুষদের হত্যা করেছে। এই যে ধর্মের ভিত্তিতে তৈরি একটা জাতিরাষ্ট্র এবং তার যে মতাদর্শ, তার বিপক্ষে ভারতের আধুনিক জাতিরাষ্ট্র অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শের মুখ দেখানো হয়েছে দুই নারীর মাধ্যমে।"
তবে নারী আন্দোলনের কর্মীরা এই ঘটনাপ্রবাহে ভেসে যেতে রাজি নন। তাদের যুক্তি, ভারতের রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী পদে নারী দায়িত্ব পেলে যেমন দেশের নারী সমাজের হাল বদলে যায় না, তৃতীয় বিশ্বের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যোমিকা ও সোফিয়ার উত্তরণকে সেভাবেই দেখতে হবে।
নারী আন্দোলনের কর্মী ও রাজ্য মহিলা কমিশনের সাবেক চেয়ারপার্সন সুনন্দা মুখোপাধ্যায় ডিডাব্লিউকে বলেন, "এটা নিয়ে খুব বেশি উদ্বেলিত হওয়ার কিছু নেই। এটাই নারী উন্নয়নের সূচক নয়, অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থানে নারীদের অবস্থান পিছিয়ে। সেগুলি দেখা দরকার।"
যদিও পর্যবেক্ষকদের কাছে সাম্প্রতিক সংঘাতের পরিপ্রেক্ষিতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক স্তরে বার্তা পৌঁছে দেয়া। সাংবাদিক সুমন ভট্টাচার্য বলেন, "পাকিস্তানি জঙ্গিরা বেছে বেছে হিন্দুদের হত্যা করে যে বার্তা দিতে চেয়েছিল, নারী সমাজকে অবলা বলে মনে করেছিল, তারই যোগ্য প্রত্যুত্তর ভারত দিয়েছে। পাকিস্তান যতই ভারতকে হিন্দু ও মুসলমানের পরিচয় ভাগ করতে চাক না কেন, সেই ভাগে ভারত রাজি নয়। ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কাউকে হিন্দু বা মুসলমান হিসেবে দেখা হয় না। এখানে সকলেই ভারতীয়।"
মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণার মোকাবিলায় এই সিদ্ধান্ত কাজে এসেছে। মইদুলের মতে, "পহেলগাম হত্যাকাণ্ডের পর প্রচণ্ড ইসলামফোবিয়া এবং মুসলিম বিদ্বেষ শুরু হয়েছিল। এ কারণে সোফিয়া কুরেশির অন্তর্ভুক্তি ভালো চোখে দেখেনি সোশ্যাল মিডিয়ার মানুষজন। এটা প্রতিরোধ করার জন্যও এই নারীদের বেছে নেয়া হয়েছে। অবশ্যই তাদের নিয়োগ করা হয়েছে যোগ্যতার ভিত্তিতে। এটা নতুন ভারতের দিশা। এখানে হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে দেশকে সেবা করে। এ ধরনের একটা ইতিবাচক বার্তা দেওয়া হয়েছে।"
সুমন বলেন, "ভারত এবং পাকিস্তানের এই সংঘাত কোনও ধর্মীয় লড়াই ছিল না। বরং একটি সভ্য দেশ, গান্ধী-নেহরু-আজাদদের তৈরি করে যাওয়া গণতন্ত্রের সঙ্গে জিন্নার ‘জিহাদি পাকিস্তানের' লড়াই চলছিল। ভারতের ‘অপারেশন সিঁদুর' আর পাকিস্তানের ‘অপারেশন বুনিয়ান-আল-মারসুস' কখনই দুইটি ধর্মের লড়াই ছিল না। দুই ধরনের সভ্যতা এবং সংস্কৃতির বিরোধ।ব্যোমিকা ও সোফিয়ার মাধ্যমে সেটাই প্রকাশিত হয়েছে।"