ভারতে ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে মুসলিমদের ভোট রাজনৈতিক দলগুলির কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ? ভোট বিন্যাসে কতটা প্রভাব ফেলতে পারে সংখ্যালঘু ভোট? একাধিক সমীক্ষা বলছে, মুসলিম ভোটাররা কিছুটা বিভ্রান্ত৷ তাঁরা নাকি রয়েছেন দোটানায়৷
বিজ্ঞাপন
ভারতে ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচন দরজায় কড়া নাড়ছে৷ একাধিক জনমত সমীক্ষা নিয়ে চলেছে অনুপুঙ্খ বিচার-বিশ্লেষণ৷ এক সমীক্ষা বলছে, ১৬০ থেকে ২০০-র বেশি আসনে মুসলিম ভোটারদের গুরুত্ব অপরিসীম৷ তাঁদের ভোটই হবে জয়পরাজয়ের নির্ণায়ক৷ কিন্তু সেই ভোট কি যাবে বিজেপির ঝুলিতে?
অন্য এক সমীক্ষা বলছে, ধর্মীয় মেরুকরণের হাওয়া অতটা বিজেপি বিরোধী নয়৷ সেটা বুঝেই ভোট ময়দানে মুসলিমদের মন জয় করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নরেন্দ্র মোদী৷ গৈরিক বিভাজনের নীতিকে পাথর চাপা দিয়ে নির্বাচনি অভিযানে তুলে ধরছেন সব সম্প্রদায়ের বিকাশের ধ্বজা৷ মোদী তথা বিজেপি উপলব্ধি করেছে যে, মুসলিম ভোটব্যাংক ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর গদি দখলের স্বপ্ন সাকার হবে না৷ তাই ২০০২ সালের গুজরাট হিংসা বিজেপির ভোটব্যাংকে ছাপ ফেলতে পারে মনে করে সেই ক্ষত মুছিয়ে দিতে বিজেপি সভাপতি রাজনাথ সিং ক্ষমা চেয়ে আর একবার বিজেপিকে সুযোগ দেবার আবেদন জানিয়েছেন মুসলিম ভাইদের কাছে৷ মোটকথা, মুসলিম ভোট নিজেদের দিকে টানা বিজেপি নেতৃত্বের কাছে বড়সড় নির্বাচনি চ্যালেঞ্জ৷ পাল্টা আক্রমণে কংগ্রেস অবশ্য বলেছে, ক্ষমা চাইবেন রাজনাথ সিং নয়, ক্ষমা চাইতে হবে মোদীকে৷ তিনিই আসল নাটের গুরু৷
দিল্লিতে সাধারণ মানুষের জয়
দুর্নীতিবিরোধী দল ‘আম আদমি পার্টি’ দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে চমক দেখিয়েছে৷ ক্ষমতাসীন কংগ্রেসকে হারিয়ে শুধু দিল্লির দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করেনি, ভারতের রাজনীতিতে বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিতও দিয়েছে তারা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বিকল্পে স্বস্তি খোঁজা
আত্মপ্রকাশের কয়েক মাসের মধ্যেই দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে ৭০টি আসনের মধ্যে ২৮টিতে জিতেছে আম আদমি পার্টি৷ অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক নতুন একটি দলের এমন সাফল্যকে দেখছেন ‘সাধারণ মানুষের জয়’ হিসেবে৷ তাদের এ জয় কংগ্রেস তো বটেই, এমনকি এ নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি আসন পাওয়া ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)-র জন্যও বড় চ্যালেঞ্জ৷আম আদমি পার্টি লোকসভা নির্বাচনের জন্য ভোটারদের সামনে বিকল্প পছন্দ হিসেবে উঠে এসেছে৷
ছবি: Getty Images/Afp/Narinder Nanu
দুর্নীতির বিরুদ্ধে ক্ষোভ
আম আদমি পার্টির প্রতিষ্ঠাতা অরবিন্দ কেজরিওয়াল জানিয়েছেন, তাঁর দল ৩২টি আসন পাওয়া ডানপন্থী দল বিজেপির সঙ্গে জোট গড়ে রাজ্য সরকারে অংশীদার হবে না৷ ঘুস কেলেঙ্কারির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল আম আদমি পার্টি৷ অরবিন্দ কেজরিওয়াল ছিলেন সেই আন্দোলনের পুরোভাগে৷ দিল্লির নির্বাচনে এ বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বলে ধারণা করা হয়৷
ছবি: Reuters
কংগ্রেসের ভরাডুবি
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময় থেকেই ভারতীয় রাজনীতিতে বড় দল কংগ্রেস৷ এবারের দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে সেই দল হেরে গেছে নবাগত আম আদমি পার্টির কাছে৷ ভোটাররা যে দিল্লিতে অন্তত কংগ্রেসের শাসনে ক্ষুব্ধ এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই৷ মুখ্যমন্ত্রী শীলা দিক্ষিতের নেতৃত্বে টানা ১৫ বছর রাজ্য সরকার পরিচালনা করেছে কংগ্রেস৷ এবার শীলা দিক্ষিত নিজেই হেরেছেন অরবিন্দ কেজরিওয়ালের কাছে৷ মাত্র ৮টি আসন পেয়েছে কংগ্রেস৷
ছবি: Reuters
নতুন পথের বাঁকে
ভারতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জোরদার আন্দোলন শুরু করেছিলেন আন্না হাজারে৷ ৭৪ বছর বয়সি এই সমাজকর্মী সংসদে ‘জন লোকপাল বিল’ পাস করানোর দাবিতে শুরু করেছিলেন অনশন৷ অরবিন্দ কেজরিওয়ালও ছিলেন তখনকার সেই দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনে৷ পরে আম আদমি পার্টি গড়েন৷ ‘আম আদমি’, অর্থাৎ সাধারণ জনগণের সমর্থন নিয়ে কেজরিওয়াল এবার এক নতুন পথের বাঁকে এনে দাঁড় করিয়েছেন ভারতের রাজনীতিকে৷
ছবি: Reuters
‘গণতন্ত্রবিরোধী’ দাবি!
কোনো কোনো বিশ্লেষকের মতে, দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্বে যাঁরা আছেন তাঁরা দুর্নীতিকে বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করলেও এর সমাধানের উপায় নিয়ে কথা বলতে গিয়ে অদূরদর্শীতার পরিচয় দিয়েছেন৷ কংগ্রেস সমর্থকরা বলছেন, আম আদমি পার্টি এবং এর বাইরের সমাজকর্মীরা প্রকারান্তরে অনির্বাচিতদের কর্তৃত্বের কথা বলছেন, অথচ গণতন্ত্র নির্বাচিত প্রতিনিধির ওপরই জনগণের সেবার দায়িত্ব অর্পণ করে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ধর্ষণের বিরুদ্ধে রায়
গত এক বছরে বেশ কয়েকটি গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে দিল্লিতে৷ ধর্ষণ রোধ করে দিল্লির নারীদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার৷ এ ব্যর্থতার জন্য দিল্লির ভোটাররা রাজ্য সরকারকেই দায়ী মনে করে৷ বিশ্লেষকদের মতে, নারীর নিরাপত্তা বিধানে রাজ্য সরকারের ব্যর্থতার কারণে জনমনে জন্ম নেয়া হতাশারও প্রতিফলন ঘটেছে দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে৷
ছবি: Reuters
নতুন চ্যালেঞ্জার
দিল্লির মতো রাজস্থান, ছত্তিশগড় আর মধ্য প্রদেশের নির্বাচনেও বিজেপির কাছে হেরেছে কংগ্রেস৷ আগামী বছর অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ড্রেস রিহার্সেলে এমন পরাজয় কংগ্রেসের জন্য নিশ্চয়ই খুব বড় ভাবনার বিষয়৷ আম আদমি পার্টি বিধানসভা নির্বাচনে শুধু দিল্লিতেই অংশ নিয়েছে৷ তবে আগামী বছরের লোকসভা নির্বাচনেও অংশ নেয়ার পরিকল্পনার কথা ইতোমধ্যে জানিয়ে দিয়েছে দলটি৷ বিজেপির জন্যও এটা কিন্তু নতুন চ্যালেঞ্জ!
ছবি: picture-alliance/dpa
7 ছবি1 | 7
সব সমীক্ষাতেই বলা হয়েছে, নির্বাচনি ফলাফল বিজেপির ভালো হবে এবং কংগ্রেসের ফলাফল আশানুরূপ হবে না৷ রাহুল গান্ধীর চেয়ে এগিয়ে থাকবেন নরেন্দ্র মোদী৷ কংগ্রেসের উপর মুসলিম ভোটারদের আস্থা টলে গেছে নানা কারণে৷ দুর্নীতি ও মূল্যবৃদ্ধি রোধে ব্যর্থতার পাশাপাশি মুসলিম সম্প্রদায়কে দেয়া প্রতিশ্রুতি পালনে ব্যর্থ হয়েছে কংগ্রেস৷ ২০০৪ এবং ২০০৯ সালের নির্বাচনে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন জোট সরকার মুসলিমদের সার্বিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সাচার কমিটির সুপারিশ কার্যকর করার অঙ্গীকার আজও দিনের আলো দেখেনি৷ এই পরিস্থিতিতে মুসলিম ভোটাররা পড়েছে দোটানায়৷
তাহলে কাকে ভোট দেয়া ঠিক হবে? ধর্ম-ভিত্তিক রাজনীতিতে মুসলিম সমাজ কার্যত বীতশ্রদ্ধ৷ কোনো দলই মুসলিমদের অভাব অভিযোগের প্রতিকারে আন্তরিক চেষ্টা করেনি৷ তা সে কংগ্রেস হোক বা মুলায়েম সিং-এর সমাজবাদী পার্টি হোক, মমতা বন্দোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস হোক কিংবা মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টি হোক৷ উত্তর প্রদেশের মুজফ্ফরনগরে হালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে৷
এই প্রেক্ষাপটে মুসলিম ভোটারদের একাংশ মনে করছে দেখাই যাক না বিজেপিকে আর একবার সুযোগ দিয়ে৷ অতীতের ভুল সংশোধন করে মুসলিম ধর্মবিশ্বাসকে আঘাত না করে বিজেপি যদি কিছ করে মুসলিম সমাজের কল্যাণের জন্য? অন্য অংশ মনে করছে, মোদী যদি গদি দখলের সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করে মুসলিমদের? তাহলে? কাজেই মুসলিমদের ভোট দেয়া উচিত কোনো দলকে নয়, প্রার্থী বিচার করে৷ এই অবস্থায় ভারতের মুসলিম নেতাদের এক কমিটি স্থির করবেন মুসলিমদের স্বার্থরক্ষায় কাকে ভোট দেয়া উচিত৷
উল্লেখ্য, ভারতে ১৩ শতাংশ ভোটদাতা মুসলিম৷ ১০০টি সংসদীয় কেন্দ্রে ১৫-২০ শতাংশ, ৩৫টি কেন্দ্রে ৩০ শতাংশ এবং ৩৮টি আসনে মুসলিম ভোটদাতাদের সংখ্যা ২০ থেকে ৩০ শতাংশের মতো৷ কাজেই আসন্ন সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম ভোটবাক্স নির্ণায়ক ভূমিকা নিতে পারে বলে মনে করছেন ভোট বিশেষজ্ঞরা৷