বাংলাদেশে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বাধীন গণআন্দোলনে উৎখাত হওয়ার পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হেলিকপ্টারে বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যান ভারতে৷ বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতের জন্য এখন কূটনৈতিক মাথাব্যথা হয়ে উঠেছেন হাসিনা৷
বিজ্ঞাপন
১৫ বছরের শাসনামলে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং বিরোধীদের দমন-পীড়নের প্রতিবাদে এই গণআন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাদের দাবি, শেখ হাসিনাকে ভারত থেকে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করা হোক৷
কিন্তু ৭৬ বছর বয়সি হাসিনাকে ফেরত পাঠাতে হলে দক্ষিণ এশিয়ায় অন্যান্য প্রতিবেশীদের কাছে ভারতের অবস্থান ক্ষুণ্ণ হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে৷ বিশেষ করে, দক্ষিণ এশিয়ায় আধিপত্য বিস্তারে যখন চীনের সঙ্গে দ্বৈরথ চলছে, এমন একটা সময়ে এই উদাহরণ অনেকে ভালো দৃষ্টিতে নাও নিতে পারেন৷
গণআন্দোলনে ভূমিকা রাখা কার্টুনের প্রদর্শনী
কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে সরকার পতন ও অন্তর্বর্তী সরকার গঠন পর্যন্ত মানুষকে প্রভাবিত করেছে ও হাস্যরস জুগিয়েছে বিভিন্ন কার্টুন৷ সেগুলো নিয়ে ঢাকায় চলছে ‘কার্টুনে বিদ্রোহ’ শীর্ষক প্রদর্শনী৷ চলবে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত৷
ছবি: Johny Hoque
৮২ কার্টুনিস্ট, ১৭৫টি কার্টুন
কার্টুনে সরস ভঙ্গিতে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরেছেন নবীন-প্রবীণ কার্টুনিস্টরা৷ সরকার পতনের ঐক্য গঠনে এই কার্টুনের ভূমিকা কম নয়৷ ৮২ জন কার্টুনিস্টের এমন ১৭৫টি কার্টুন নিয়ে ১৬ আগস্ট থেকে ঢাকায় শুরু হয়েছে ‘কার্টুনে বিদ্রোহ’ শীর্ষক এক প্রদর্শনী৷ বাংলাদেশ কার্টুনিস্ট অ্যাসোসিয়েশন, দৃক এবং ডিজিটাল মাধ্যম ‘ই-আরকি’ যৌথভাবে এর আয়োজন করেছে৷
ছবি: Johny Hoque
দর্শনার্থীদের উপচেপড়া ভিড়
প্রদর্শনীর সমন্বয়ক ফৌজিয়া আফরোজ ডয়চে ভেলেকে জানান, ২০ আগস্ট পর্যন্ত প্রদর্শনীর প্রথম পাঁচদিনে প্রায় ১০ হাজার দর্শনার্থীর সমাগম হয়েছে৷ তিনি বলেন, ‘‘এখানে তাদের সামনে ফিরে এসেছে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের উত্তাল সময়৷ এটি তারা এক ধরনের উদযাপন হিসেবে নিয়েছেন৷’’
ছবি: Johny Hoque
শিশু-কিশোরদের আনন্দ
কার্টুনে রাজনৈতিক অসঙ্গতির সঙ্গে রয়েছে হাস্যরস৷ বেশিরভাগ কার্টুনে কিছু লেখা নেই, কিন্তু সেসব বিদ্রূপ বোঝা যায় অনায়াসে! বড়দের পাশাপাশি সোনামনিদের কাছে এগুলো উপভোগ্য লাগছে৷ অভিভাবকদের হাত ধরে প্রদর্শনীতে এসেছে বেশ কিছু শিশু-কিশোর৷
ছবি: Johny Hoque
কলকাতার কার্টুনিস্টের স্কেচ
কার্টুনিস্ট আহসান হাবিব, মেহেদী হক, মানিক-রতন, মোরশেদ মিশু, সৈয়দ রাশেদ ইমাম তন্ময়, রিশাম শাহাব তীর্থ, মাহতাব রশিদ, আরাফাত করিম, মেহরাব সিদ্দিক সাবিত, আনিসুল ইসলাম সামির, দেবাশীষ চক্রবর্তী, অদ্রিতা জামান, নাতাশা জাহানসহ ঢাকার কার্টুনিস্টদের পাশাপাশি প্রদর্শনীতে রয়েছে কলকাতার কৌশিক সরকারের আঁকা স্কেচ৷ এতে ফুটে উঠেছে গুলিতে নিহত হওয়ার আগে রংপুরের আবু সাঈদের প্রতিবাদের মুহূর্ত৷
ছবি: Johny Hoque
মুগ্ধ, পানি লাগবে... পানি
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি)-র প্রয়াত শিক্ষার্থী মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধর প্রতি সম্মান জানিয়েছেন আয়োজকরা৷ গ্যালারির একপাশে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে ‘মুগ্ধ, ‘পানি লাগবে... পানি?’ লেখা ১৭টি পানির বোতল৷ গত ১৮ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর আগে পানির বোতল হাতে রাজপথে ছিলেন তিনি৷
ছবি: Johny Hoque
দড়ি ধরে মারো টান!
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্যারিক্যাচার করা তিনটি কাট-আউট রাখা হয়েছে গ্যালারিতে৷ এরমধ্যে একটিতে লেখা ‘স্টেপ ডাউন হাসিনা’৷ হাসিনার এই কাট-আউটে কয়েকটি দড়ি বাঁধা৷ অনেকে দড়ি টান দেওয়ার ভঙ্গিতে ছবি তুলেছেন৷
ছবি: Johny Hoque
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী
দর্শনার্থী জাহিন ফেরদৌস ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘প্রায় এক মাস কঠিন সময় পাড়ি দিতে হয়েছে আমাদের৷ এখন স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে কার্টুন প্রদর্শনী উদযাপন করছি৷ এখানে এসে মনে হচ্ছে, আমাদের সবারই চাওয়া ছিল এক৷ দুঃশাসনের অবসান হওয়ার আনন্দ উপভোগের ঐক্য দেখে খুব ভালো লাগছে৷’’
ছবি: Johny Hoque
দর্শনার্থীদের মনোভাব প্রকাশ
প্রদর্শনীতে আসা দর্শনার্থীরা যেন নিজেদের মনোভাব প্রকাশ করতে পারেন সেজন্য রয়েছে কমেন্ট বুক৷ শেখ হাসিনার সরকার পতন ও তার দেশত্যাগ নিয়ে ব্যাঙ্গাত্মক কথা লিখেছেন অনেকে৷ কেউ কেউ আন্দোলনের বিভিন্ন স্লোগান তুলে ধরেছেন কমেন্টে৷
ছবি: Johny Hoque
সংহতি দেয়াল
গ্যালারির দুই পাশে দুটি সংহতি দেয়ালিকা রাখা আছে৷ ছাত্র-জনতার আন্দোলন, জেন-জির জয়গান ও দৃষ্টিভঙ্গি এবং সাবেক সরকারের সমালোচনা করে মনের আনন্দে দেয়াল দুটি ভরে ফেলেছেন দর্শনার্থীরা৷
ছবি: Johny Hoque
‘কার্টুনিস্টদের প্রতি এক ধরনের সম্মান এই প্রদর্শনী’
দৃক গ্যালারির কিউরেটর এ এস এম রেজাউর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘কার্টুন সবসময়ই জনপ্রিয় মাধ্যম৷ দুঃখজনক হলেও সত্যি, সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন চাপ ও সেন্সরশিপ থাকায় কার্টুনিস্টরা আঁকা কমিয়ে দিয়েছিলেন৷ তবে গণ-আন্দোলনে তরুণ কার্টুনিস্টরা ভয় ভেঙে প্রচুর এঁকেছেন৷ তাদের প্রতি এই প্রদর্শনী এক ধরনের সম্মান বলা যায়৷ দর্শকদের সঙ্গে কার্টুনিস্টদের সম্মিলন ঘটানো এই প্রদর্শনীর বড় সফলতা৷’’
ছবি: Johny Hoque
প্রদর্শনীর সময় বাড়লো
ঢাকার পান্থপথে দৃকপাঠ ভবনের লেভেল-৮-এ দৃক গ্যালারিতে ১৬ আগস্ট ‘কার্টুনে বিদ্রোহ’ প্রদর্শনীর উদ্বোধন হয়৷ ২৩ আগস্ট এর সমাপনী হওয়ার কথা থাকলেও দর্শকদের অনুরোধে সময়সীমা ৩১ আগস্ট পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে৷ প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত দেখা যাবে কার্টুন প্রদর্শনী৷
ছবি: Johny Hoque
রাজনৈতিক আলাপ নিষেধ নয়!
গ্যালারিতে ঢোকার প্রবেশপথের পাশে অস্থায়ী বুটিক শপে জুলাই গণঅভুত্থানের চিত্রকর্ম সংবলিত পোস্টার বিক্রি হচ্ছে ১০ টাকায়৷ ধোয়া ওঠা চায়ের কাপের সঙ্গে ‘রাজনৈতিক আলাপ নিষেধ নয়’ লেখা টি-শার্ট ৪৫০ টাকা, টোট ব্যাগ ৩৫০ টাকা ও নোটবুক ৩৫০ টাকা৷ এই তিনটি পণ্য একসঙ্গে কিনলে পড়বে ৭৯৯ টাকা৷
ছবি: Johny Hoque
12 ছবি1 | 12
বিরোধ সমাধান বিষয়ক থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের টমাস কিন বার্তা সংস্থা এএফপিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘‘ভারত স্পষ্টতই তাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে চায় না৷ এর ফলে নয়া দিল্লির সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকা এই অঞ্চলের অন্যান্য নেতাদের কাছে একটা বার্তা পাঠানো হবে... যে শেষ পর্যন্ত, ভারত আপনাকে রক্ষা করবে না৷ বিষয়টা ভারতের জন্য খুব ইতিবাচক হবে না৷''
গত বছর মালদ্বীপে এমন এক রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন, যিনি জেতার পরপরই নয়া দিল্লির বদলে কৌশলগতভাবে বেইজিংয়ের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন৷
হাসিনার পতনের ফলে ভারত এই অঞ্চলে তার ঘনিষ্ঠতম মিত্রকে হারিয়েছে৷
শেখ হাসিনার অধীনে যারা নির্যাতিত হয়েছেন, তারা তার সরকারের সংঘটিত নির্যাতনের জন্য ভারতকেই অনেকাংশে দায়ী করেন৷ ভারতের হিন্দু-জাতীয়তাবাদী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কূটনীতিও সেই বৈরিতা ছড়াতে ভূমিকা রেখেছে৷
৮৪ বছর বয়সি নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী ড. মুহম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারকে সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন মোদী৷ বাংলাদেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের রক্ষা করার জন্য ইউনূসের প্রশাসনকে বারবার অনুরোধ করেছেন মোদী৷
ভারতের স্বাধীনতা দিবসে সপ্তদশ শতকের লাল কেল্লা থেকে দেয়া ভাষণে মোদী বাংলাদেশি হিন্দুদের বিপদে পড়ার বিষয়টি উল্লেখ করেন এবং পরবর্তীতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে ফোনালাপেও বিষয়টি উত্থাপন করেন৷
শেখ হাসিনার পতনের পর বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে হিন্দু ধর্মাবলম্বী এবং মন্দিরের ওপর কিছু হামলার ঘটনা ঘটে৷ এসব ঘটনার নিন্দাও জানানো হয়েছে বাংলাদেশের আন্দোলনকারী এবং অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে৷ কিন্তু ভারতের সরকার সমর্থক বেশকিছু সংবাদমাধ্যমে এসব ঘটনার অতিরঞ্জিত বিবরণ দেশটিতে বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা ছড়িয়েছে৷
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ভারত হাসিনাকে সমর্থন করে ‘তার সব ফল এক ঝুড়িতে রেখে দিয়েছে' এবং পরিস্থিতি কীভাবে বদলাতে হবে সেটা বুঝতে পারেনি৷
‘তাহলে কি ফিরছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা?’
05:31
হাসিনার আমলে গ্রেপ্তার হওয়া হাজার হাজার বিএনপি নেতাকর্মীদের একজন মির্জা ফখরুল এএফপিকে বলেন, ‘‘বাংলাদেশের জনগণ ভারতের সাথে ভালো সম্পর্ক চায়, কিন্তু সেটা নিজেদের স্বার্থের বিনিময়ে নয়৷''
তিনি বলেন, ‘‘দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভারতের মনোভাব এই আত্মবিশ্বাস তৈরির জন্য অনুকূল নয়৷''
এমন অনাস্থা এবং অবিশ্বাসের পরিস্থিতিতেই আগস্ট মাসে ভয়াবহ বন্যা আক্রান্ত হয় দুই দেশই৷ অনেক বাংলাদেশির পক্ষ থেকে ভারতকে এই বন্যার জন্য দায়ী করা হয়৷
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার এখনও প্রকাশ্যে নয়া দিল্লির কাছে শেখ হাসিনার ভারতে আশ্রয় নেওয়ার বিষয়টি উত্থাপন করেনি৷ কিন্তু কূটনৈতিক পাসপোর্ট বাতিল করার কারণে নয়া দিল্লির কাছে একটি সামরিক বিমানঘাঁটিতে অবস্থান করা হাসিনার অন্য কোনো দেশে যাওয়াটাও কঠিন হয়ে পড়েছে৷
তবে চুক্তির একটি ধারায় অপরাধ ‘রাজনৈতিক চরিত্রের' হলে ফেরত পাঠানোর অনুরোধ প্রত্যাখ্যানের সুযোগও দেয়া হয়েছে দুই দেশকে৷
বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী এএফপিকে বলেন, শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনার চাপ দেওয়ার চেয়ে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক রক্ষা বাংলাদেশের জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ৷
তিনি বলেন, ‘‘যে কোনো বুদ্ধিমান সরকার বুঝতে পারবে যে হাসিনার ভারতে থাকার বিষয়টিকে ইস্যুতে পরিণত করা তাদের জন্য কোনো সুবিধা তৈরি করবে না৷''