ভারতে ভ্যাকসিন নিয়ে লড়াই। তাও আবার ছাড়পত্র পাওয়া দুই ভ্যাকসিন উৎপাদকের মধ্যে।
বিজ্ঞাপন
করোনার ভ্যাকসিন দেয়া এখনো শুরু হয়নি, সবেমাত্র ছাড়পত্র পেয়েছে সেরাম ইনস্টিটিউট এবং ভারত বায়োটেক। এর মধ্যেই দুই উৎপাদক সংস্থার প্রধান কর্তা কথার লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়লেন। শুরু হয়ে গিয়েছে কাদা ছোড়াছুড়ি। অভিযোগের বন্যা। সেরাম-কর্তা আদার পুনাওয়ালা যেমন ভারত বায়োটেকের টিকার কার্যকারিতা নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন। আর ভারত বায়োটেকের কর্তা কৃষ্ণ এম এল্লার অক্সফোর্ডের টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে অভিযোগ করেছেন।
শুরু করেছেন পুনাওয়ালা। তিনি ভারত বায়োটেকের নাম না করে বলেছিলেন, বায়োনটেক, মডার্না ও অক্সফোর্ডের টিকার কার্যকারিতা প্রমাণিত। বাকি সবই জলের মতো নিরাপদ। তিনি যখন এই কথা বলছেন, তখন ভারত বায়োটেকের টিকা ড্রাগ কন্ট্রোলারের অনুমোদন পেয়ে গিয়েছে। ফলে আক্রমণ কোন দিকে তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
এরপরই গর্জে উঠেছেন হায়দরাবাদ ভিত্তিক ভারত বায়োটকের প্রধান। কৃষ্ণ এম এল্লারের দাবি, তাঁদের টিকায় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া মাত্র ১৫ শতাংশ। আর অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনের ৬০ শতাংশ। যাঁদের টিকা দেওয়া হয়েছে, তাঁদের চার গ্রাম প্যারাসিটামল দেয়া হয়েছে। তারপরেও এই অবস্থা। এখানেই থামেননি তিনি। রীতিমতো আবেগতাড়িত হয়ে কৃষ্ণা বলেছেন, ''আমরা বিজ্ঞানী। আমরা ২৪ ঘণ্টা কাজ করি। তারপর কেন আমাদের এই ধরনের আক্রমণ সহ্য করতে হবে?''
করোনা ভ্যাকসিন: কোন দেশের কী কৌশল
এক বছরেরও কম সময়ে করোনার কার্যকরী একাধিক ভ্যাকসিন আবিস্কার করেছে বিভিন্ন কোম্পানি৷ সেগুলো অনুমোদনও পেতে শুরু করেছে৷ আগেভাগে সংগ্রহে দেশগুলোর মধ্যে তোড়জোড় যেমন চলছে; তেমনি নাগরিকদের টিকা প্রদানে নেয়া হয়েছে বিভিন্ন কৌশল৷
ছবি: Allan Carvalho/NurPhoto/picture-alliance
পথ দেখালো যুক্তরাজ্য
আট ডিসেম্বর বায়োনটেক ও ফাইজারের টিকার প্রথম ডোজ নেন ৯০ বছরের মার্গারেট৷ যুক্তরাজ্যে প্রথম আট লাখ টিকা পাবেন তার মতো প্রবীণ, সামনের সারির স্বাস্থ্যকর্মীসহ বাকি বয়স্ক নাগরিকরা৷ ফাইজারের কাছে মোট চার কোটি ডোজ টিকার অর্ডার দিয়েছে দেশটি; যার মাধ্যমে দুই ডোজ করে দুই কোটি মানুষের ভ্যাকসিনের নিশ্চয়তা মিলছে৷ পাঁচ কোটি ত্রিশ লাখ নাগরিকের সবাইকে টিকা দিতে যুক্তরাজ্যকে নির্ভর করতে হবে অন্য কোম্পানিগুলোর উপরে৷
ছবি: Jacob King/AP Photo/picture alliance
প্রস্তুত যুক্তরাষ্ট্র
বায়োনটেক-ফাইজারের টিকার প্রয়োগ শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্রও৷ দেশব্যাপী ছড়ানো বিতরণ কেন্দ্রগুলোতে ২৯ লাখ ডোজ টিকার প্রথম চালান পৌঁছেছে৷ ফাইজার থেকে আরো ২০ লাখ আর মডার্নার ৫৯ লাখ ডোজের চালান ছাড় হতে পারে আসছে সপ্তাহে৷ এই দুই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেই ৩০ কোটি ডোজ ভ্যাকসিনের চুক্তি যুক্তরাষ্ট্রের৷ প্রথম ধাপে স্বাস্থ্যকর্মী, নার্সিং হোমে বসবাসরত, জরুরি সেবায় নিয়োজিত এবং দীর্ঘস্থায়ী ব্যধিতে আক্রান্তরা টিকা পাবেন৷
ছবি: Bran Woolston/REUTERS
ক্যানাডার তোড়জোড়
মডার্নার কাছ থেকে এক লাখ ৬৮ হাজার ডোজ ভ্যাকসিন পেতে সম্প্রতি চুক্তি করেছে ক্যানাডা৷ শর্ত অনুযায়ী অনুমোদন পাওয়ার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে এই চালান ছাড় শুরু করবে কোম্পানিটি৷ তবে তার আগেই ফাইজারের টিকা পৌঁছে গেছে দেশটিতে৷ ১৬ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়েছে প্রয়োগও৷
ছবি: Adrian Wyld/REUTERS
দেরি করেনি সৌদি
আরব নিউজের সংবাদ অনুযায়ী, ১৬ ডিসেম্বর সৌদি আরবে বায়োনটেক-ফাইজারের টিকার প্রথম চালান পৌঁছায়৷ পরের দিন থেকেই শুরু হয়েছে প্রয়োগ৷ টিকা পেতে একদিনে মোট দেড় লাখ মানুষ অনলাইনে নিবন্ধন করেছেন৷ সবাইকে বিনামূল্যে দেয়ার কথা থাকলেও অগ্রাধিকারভিত্তিতে পাবেন ৬৫ বছরের বেশি বয়সি, বিভিন্ন ব্যাধিতে আক্রান্ত রোগী আর স্বাস্থ্যকর্মীরা৷
ছবি: Ahmed Yosri/REUTERS
শুরু হচ্ছে ইসরায়েলে
ইসরায়েলের গণমাধ্যম হারিৎস-এর তথ্য অনুযায়ী ১৯ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু প্রথম টিকা নেবেন দেশটিতে৷ এরপর প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে পাবেন বাকি জ্যেষ্ঠ নেতৃবৃন্দ ও স্বাস্থ্যকর্মীরা৷ সাধারণ নাগরিকদের টিকা প্রদান শুরু হবে আসছে সপ্তাহে৷ শুরুতে অগ্রাধিকার পাবেন বয়স্করা৷ প্রাথমিক পর্যায়ে ফাইজারের কাছ থেকে কয়েক লাখ ভ্যাকসিন নিচ্ছে দেশটি৷ দ্বিতীয় ধাপের ট্রায়ালে রয়েছে নিজেদের উদ্ভাবিত একটি ভ্যাকসিনও৷
ছবি: Abir Sultan/REUTERS
অপেক্ষায় জার্মানি
নভেম্বরের শুরুতেই টিকা কর্মসূচির কৌশল নির্ধারণ করেছে জার্মানির সরকার৷ ইইউর মাধ্যমে ৩০ কোটি টিকার অর্ডার দিয়েছে দেশটি৷ টিকা পাওয়া মাত্র দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ৬০ টি বিতরণ কেন্দ্রে সেগুলো পৌঁছে দেবে সরকার৷ তবে সাধারণ মানুষকে এর আওতায় আসতে বেশ কয়েক মাস অপেক্ষায় থাকতে হবে৷ কেননা, শুরুতে প্রাধান্য পাবেন বয়স্ক ও স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে থাকা নাগরিকরা৷ এই তালিকায় আছেন স্বাস্থ্যকর্মী ও করোনা চিকিৎসায় নিয়োজিতরাও৷
ছবি: Ralph Orlowski/REUTERS
জাপানে মহাযজ্ঞ
নিজেদের ১২ কোটি জনগোষ্ঠীর সবার জন্য আগামী জুনের মধ্যে করোনার টিকা নিশ্চিত করতে চায় জাপান সরকার৷ এজন্য ফাইজার, আস্ট্রাজেনেকা, মডার্নার কাছ থেকে ২৯ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন কেনার চুক্তি হয়েছে৷ জনগণকে বিনা খরচেই এই টিকা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেশটির সরকার গত অক্টোবরেই৷ ভ্যাকসিন সংরক্ষণে এরই মধ্যে সাড়ে দশ হাজার ডিপ ফ্রিজার কেনাসহ মহাযজ্ঞ হাতে নেয়া হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/Kyodo/MAXPPP
শেষ ধাপে চীন
পরীক্ষার শেষ ধাপে রয়েছে চীনের বিভিন্ন কোম্পানির বেশ কয়েকটি টিকা৷ সেগুলো চূড়ান্ত অনুমোদন না পেলেও জরুরি ভিত্তিতে এরই মধ্যে ১০ লাখ স্বাস্থ্যকর্মী ও ঝুঁকিতে থাকা নাগরিককে পরীক্ষামূলক টিকা দেয়া হয়েছে৷ বিভিন্ন প্রদেশের সরকার আগেভাগেই কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে জনসংখ্যার হিসাবে টিকার অগ্রিম অর্ডার দিয়ে রেখেছে৷ কারা আগে ভ্যাকসিন পাবেন তার অগ্রাধিকার তালিকাও তৈরি করছে প্রশাসন৷
ছবি: Wang Zhao/AFP/Getty Images
একাধিক টিকার অপেক্ষায় ভারত
আগামী ছয় থেকে আট মাসের মধ্যে ৩০ কোটি নাগরিককে টিকা দেয়ার পরিকল্পনা মোদী সরকারের৷ প্রথম ধাপের এই টিকা কর্মসূচীর আওতায় আসবেন স্বাস্থ্যকর্মী ও পঞ্চাশোর্ধ্বরা৷ এতে খরচ হবে ১৪০ থেকে ১৮০ কোটি ডলার৷ পুরো প্রক্রিয়ায় জড়িত থাকবে ২৩টি মন্ত্রণালয়৷ যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ও আস্ট্রাজেনেকা, রাশিয়ার স্পুটনিক এবং ভারতীয় জাইডাস কেডিলা ও ভারতী বায়োটেকের টিকা আছে সম্ভাব্য প্রাপ্তির তালিকায়৷
ছবি: Dado Ruvic/REUTERS
চীনে চোখ পাকিস্তানের
চীনের একটি টিকার তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল চলছে পাকিস্তানে৷ ভ্যাকসিন কেনার জন্য ইমরান খান সরকারের এখন পর্যন্ত ঘোষিত বাজেট ২৫ কোটি ডলার৷ এই অর্থ দিয়ে একাধিক টিকা কোম্পানির সঙ্গে চুক্তির পরিকল্পনা তাদের৷ প্রথম পর্যায়ে অগ্রাধিকার পাবেন কোভিড চিকিৎসায় নিয়োজিত স্বাস্থকর্মী এবং ৬৫ বছরের বেশি বয়সীরা৷ পরবর্তী ধাপে গুরুত্ব দেয়া হবে বাকি স্বাস্থ্যকর্মী এবং ষাটোর্ধ্বদের৷
ছবি: Aamir Qureshi/AFP/Getty Images
অক্সফোর্ডের ভরসায় বাংলাদেশ
অক্সফোর্ড-আস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন পেতে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে চুক্তি করেছে বাংলাদেশের বেক্সিমকো৷ যার মাধ্যমে পাওয়া যাবে তিন কোটি টিকা৷ এতে দেড় কোটি মানুষকে টিকার আওতায় আনা যাবে৷ টিকা প্রদানে অগ্রাধিকারের জন্য ১০ ধরনের জনগোষ্ঠীর তালিকা করেছে সরকার৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/J. Cairns
11 ছবি1 | 11
তাঁর দাবি, ''অ্যাস্ট্রাজেনেকার মতো পরীক্ষা যদি ভারতে করা হতো, ভারতীয় রেগুলেটার তা হলে কোম্পানি বন্ধ করে দিত।'' আসলে অক্সফোর্ডের টিকা পরীক্ষার সময় অনিচ্ছাকৃত ভুল হয়েছিল। একটা গ্রুপকে প্রথমে অর্ধেক ডোজ এবং পরে পুরো ডোজ দেয়া হয়। কৃষ্ণার কটাক্ষ সেদিকেই। তাঁর দাবি, ভারত বায়োটেকের টিকা ২৫ হাজার ভারতীয়ের উপর পরীক্ষা করা হচ্ছে। আর কোনো কোম্পানির ভারতে এই রেকর্ড নেই।
কৃষ্ণার অভিযোগ. অক্সফোর্ডের টিকা প্রথম বছরে দুই বার দেয়ার পর দ্বিতীয় বছরে আর দেয়া যাবে না। দরকার হলেও নয়। কিন্তু তাঁদের টিকা দেয়া যাবে।
সেরাম কর্তা অবশ্য এই সব অভিযোগের কোনো জবাব দেননি। তবে প্রশ্ন উঠেছে, কেন দুই টিকা উৎপাদক সংস্থা এই ভাবে একে অপরকে আক্রমণ করলেন? প্রবীণ সাংবাদিক শরদ গুপ্তা ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ''দুই সংস্থার লক্ষ্য হলো ভারত তো বটেই, অন্য দেশের বাজার দখল করা। তাই নিজেদের টিকা কতটা ভালো তা তাঁরা বেশি করে দেখাতে চাইছেন। আর ভারত বায়োটেক নিয়ে যেহেতু বিরোধীরাও প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন, তাই তাঁদের উপর চাপ আরো বেশি ছিল। সে জন্যই এই আক্রমণ ও প্রতি আক্রমণ।''