ভারতের বন্দি হাতিদের দুর্দশা, বাড়ছে বন্যপ্রাণের মৃত্যুমিছিল
১ জুলাই ২০১৮
দক্ষিণ ভারতীয় রাজ্য কেরলে বিভিন্ন ধরনের ধর্মীয় পার্বণে হাতির ব্যবহার বহু যুগের পরম্পরা৷ প্রথা পালনের নামে কার্যত বন্দি করে রাখা হয়েছে এই বন্যপ্রাণকে৷
বিজ্ঞাপন
মন্দিরকে কেন্দ্র করে উৎসব হোক বা ধর্মীয় শোভাযাত্রা, কেরলে প্রতি বছর হাজার দশেক এমন অনুষ্ঠান হয়ে থাকে৷ এর মধ্যে অধিকাংশতেই হাতির উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়৷ হাতিকে নানা অলঙ্কারে রূপবান করে তোলা হয়৷ থাকে নানা রঙিন সাজসজ্জা৷ কোনো ভারী ধর্মীয় বিগ্রহের অধিষ্ঠান থাকে হাতির পিঠের উপর৷ এই অবস্থায় হাতিগুলিকে অনেক পথ পরিক্রমা করতে হয়৷ এর সঙ্গে থাকে বিপুল সংখ্যক মানু্য৷ ক্রমাগত হস্তীবাহিনীকে ঘিরে উচ্চগ্রামে বাজতে থাকে নানা বাদ্যযন্ত্র৷
নিঃসন্দেহে এই শোভাযাত্রা দারুণ আকর্ষণীয়৷ শুধু ভারত নয়, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকরা আসেন তা উপভোগ করতে৷ এই পর্যটনের ফলে রাজ্যের কোষাগার সমৃদ্ধ হয়৷ কিন্তু, বছরের পর বছর উৎসবের নামে হাতিদের যেভাবে বন্দি করে রাখা হয়, চিন্তা তা ঘিরেই৷
হাতির পিঠে না চড়াই ভালো
একটি আন্তর্জাতিক পশু অধিকার সংস্থা বলছে, পর্যটকরা যে নানা দেশে হাতির পিঠে চড়ে আনন্দ করেন, তার মাধ্যমে আসলে প্রকারান্তরে হাতিদের ওপর ভয়ংকর নিপীড়নকেই উৎসাহিত করা হয়৷ তাই সবাইকে হাতির পিঠে চড়তে নিরুৎসাহিত করেছেন তারা৷
ছবি: Jennifer Pastorini/Centre for Conservation and Research Sri Lanka
হাতিদের নিয়তি
লন্ডনভিত্তিক ‘ওয়ার্ল্ড অ্যানিমেল প্রোটেকশন’ (ডাব্লিউএপি) এশিয়ার কয়েকটি দেশ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে হাতিদের কাজ করতে বাধ্য করার প্রমাণ পেয়েছে৷ তাদের এক সমীক্ষার তথ্য প্রকাশ করে ডাব্লিউএপি জানিয়েছে, এশিয়ার অনেক দেশে, বিশেষ করে পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় কিছু স্থানে প্রতি চারটি হাতির মধ্যে তিনটিকেই নির্যাতন করে নানা ধরনের কাজ করতে বাধ্য করা হয়৷
ছবি: Picture alliance/dpaepa/H. H. Young
দুঃসহ যন্ত্রণা
ডাব্লিউএপি জানাচ্ছে, থাইল্যান্ড, লাওস, কম্বোডিয়া, নেপাল, শ্রীলঙ্কা এবং ভারতে বুনো হাতিদের ওপর ভয়াবহ নির্যাতন চালানো হয়৷ মূলত নির্যাতন করেই বশ করা হয় তাদের৷ এশিয়ায় হাতি কমছে৷ তবে এখনো এ অঞ্চলে ৫০ হাজারের মতো হাতি আছে বলে জানিয়েছে ডাব্লিউএপি৷
ছবি: Getty Images/AFP/N. Celis
হাতিশিশু নির্যাতন
বশ করার কাজটা সাধারণত শুরু করা হয় হাতিদের একেবারে শৈশব থেকে৷ শিশু হাতিকে প্রথমে মায়ের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়৷ কয়েক সপ্তাহ বন্দি রাখা হয় তাকে৷ বন্দিদশায় অনেক ধরনের নির্যাতনও সইতে হয় হাতিশিশুকে৷ সার্কাস বা অন্য কাজের জন্য ভবিষ্যতে যা যা তাকে করতে হবে, সেগুলো রপ্ত করতে দেরি হলে পিটুনি তো চলেই, কোথাও কোথাও নাকি ছুরিও চালানো হয় শিশুদেহে৷
থাইল্যান্ড, লাওস, কম্বোডিয়া, নেপাল, শ্রীলঙ্কা এবং ভারতের মোট ২২০টি পর্যটন কেন্দ্রের তিন হাজার হাতির অবস্থা দেখে ডাব্লিউএপি জানিয়েছে, হাতিগুলোকে অনেকক্ষেত্রে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়৷ খুব কম ক্ষেত্রেই পর্যাপ্ত এবং উপযুক্ত খাবার দেয়া হয় বলে অপুষ্টিতেও ভোগে হাতিরা৷
ছবি: picture-alliance/dpa/J. S. Peifer
কালোবাজারে হাতি
মধ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর বেশ কিছু ওয়াইল্ড লাইফ টুরিজম সেন্টারে গিয়েও হাতিদের দুরবস্থা দেখেছে ডাব্লিউএপি৷ দেখা গেছে, সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সরকারের হাতি সংরক্ষন কর্মসূচির ফাঁক গলে কালো বাজারে হাতি ক্রয়-বিক্রয়ও চলছে দেদার৷ মানুষের হাতির পিঠে চড়ার শখের শিকার করতে থাইল্যান্ডে একটা বাচ্চা হাতি নাকি ২৫ হাজার ডলারেও বিক্রি করা হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Y. Kochetkov
হাতি শুধুই আয়ের উৎস
থাইল্যান্ডে পোষা হাতি আছে ৪ হাজারের মতো৷ প্রায় সব হাতিই পর্যটকদের বিনোদনে নিয়োজিত৷ এর বাইরে প্রায় আড়াই হাজার বুনো হাতিকেও মানুষের কাজ করতে বাধ্য করা হচ্ছে৷ এশিয়ার আরেক দেশ মিয়ানমারেও বিপুল সংখ্যক হাতিকে ‘কর্মজীবী’ হতে বাধ্য করা হয়৷ সে দেশে সরকারি হিসেবেই ২৮৫০টি হাতি বনাঞ্চলে গাছ বহন করে জীবিকা নির্বাহ করে৷
ছবি: Jennifer Pastorini/Centre for Conservation and Research Sri Lanka
পর্যটনই শত্রু?
এশিয়ার হাতিদের সবচেয়ে বেশি দুর্দশা পর্যটন শিল্পে৷ থাইল্যান্ড সরকারের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, সে দেশে পর্যটকদের শতকরা অন্তত ৪০ ভাগই নাকি হাতির পিঠে চড়তে না পারলে ভ্রমণসুখ যথার্থ হয়েছে বলে মনে করেন না৷ হাতিনিপীড়ন কমাতে পর্যটকদের তাই হাতির পিঠে চড়তে নিরুৎসাহিত করছে ডাব্লিউএপি৷
ছবি: Reuters/J. Silva
7 ছবি1 | 7
ভারতে যত হাতিকে বন্দি করে রাখা হয়েছে, তার মধ্যে এক-তৃতীয়াংশই কেরলে৷ সংখ্যাটা ৫০০-র বেশি৷ এই রাজ্যে হাতির মালিক হয় মন্দির, নয় কোনো ধনী ব্যক্তি৷ সামন্ততান্ত্রিক যুগের মতো এখনও হাতি পোষা সম্মানের ব্যাপার৷ হাতির এই মর্যাদার কথা ছেড়ে দিলেও আর্থিক দিকটিও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ৷ প্রতিদিন একটি হাতি থেকে তার মালিকের রোজগার হতে পারে ৫ হাজার টাকা৷ অনেক বন্দি হাতিকে আবার কাঠের ব্যবসাতেও কাজে লাগানো হয়৷
একথা বলতেই হয়, ধর্মীয় অনুষ্ঠানে আকর্ষণের কেন্দ্রে থাকলেও এই হাতির দল খুবই দুর্দশাগ্রস্ত৷ এর জেরে হাতির মৃত্যুও হচ্ছে৷ গত জানুয়ারি থেকে ১৭টি বন্দি হাতি মারা পড়েছে৷ এর মধ্যে তিনটি স্ত্রী হাতি৷ প্রতিটিরই অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে৷ বন্যপ্রাণ সংরক্ষণের জন্য আন্দোলনকারী সংগঠনগুলির বক্তব্য, দিনের পর দিন নির্যাতন ও অবহেলার ফলে মারা পড়েছে হাতিগুলি৷
এত মৃত্যুর পর সরকার নড়েচড়ে বসেছে৷ তারা কিছু বিধি আরোপ করেছে৷ তবে আন্দোলনকারীদের বক্তব্য, যত দিন না হাতির মালিক, মাহুত ও আধিকারিকরা বন্যপ্রাণের সুরক্ষাকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন, তত দিন এই সমস্যার সমাধান হবে না৷
হাতিদের চরম দুর্দশা
হেরিটেজ অ্যানিমাল টাস্ক ফোর্স-এর কর্তা ভি কে ভেঙ্কিতাচলম ডয়চে ভেলেকে বলেন, হাতিদের অধিকাংশই শ্রবণশক্তি হারিয়েছে৷ কয়েক ঘণ্টা ধরে নিয়মিত এদের কানের গোড়ায় তীব্র শব্দে ড্রাম পেটানো হয় বলে এই অবস্থা৷ হাতিদের ত্বকে ক্ষত রয়েছে, অনেকে দৃষ্টিহীন৷ এসবই সুন্দর অলঙ্কার ও সাজসজ্জা দিয়ে ঢেকে রাখা হয়৷ হাতিকুলের দেখভাল ঠিকঠাক হয় না বলে অধিকাংশই ফুসফুস ও অন্ত্রের গুরুতর সমস্যায় ভোগে৷ ভেঙ্কিতাচলম জানান, যে হাতিগুলির মৃত্যু হয়েছে, সেগুলির বয়স ২২ থেকে ৪৫ বছরের মধ্যে৷ অধিকাংশই অবহেলা ও নিপীড়নের ফলে মারা যায়৷ মূলত উৎসব চত্বরেই তাদের মৃত্যু হয়৷
মানুষ ও বন্যপ্রাণী
বন্যপ্রাণী নিধনে মানুষের রয়েছে সীমাহীন দায়৷ আবার একথাও ঠিক দায় থেকে, ভালোবাসা থেকে মানুষ দাঁড়িয়েছে সে বন্যপ্রাণী রক্ষায়৷ সেরকম কিছু ছবি দেখে আসা যাক-
ছবি: Getty Images/AFP/P. Pardo
পাণ্ডার রক্তের নমুনা
জিনজিন নামের মেয়ে পাণ্ডার খাঁচার ভেতর থেকে রক্তের নমুনা নিচ্ছেন একজন পশু চিকিৎসক৷ ছবিটি মেক্সিকো সিটির একটি চিড়িয়াখানা থেকে তোলা৷
ছবি: Reuters/G. Riquelme
হাতির পা
তেরো বছর বয়সি সেলেনডাং নামের এ হাতিটির পা ফাঁদে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল৷ একজন মাহুত তার পায়ের পরিচর্যা করছেন৷ ছবিটি মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর থেকে তোলা৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Vatsyayana
কুমির রক্ষার জন্য
ইন্দোনেশিয়ার পালু নদীতে থাকা এ নোনাপানির কুমিরটির ঘাড়ে গাড়ির চাকা আটকে গেছে৷ সেখানকার পশু কর্মকর্তারা বছর খানেক ধরে কুমিরটি ধরে তার ঘাড় থেকে রাবারের চাকাটি অপসারণের চেষ্টা করছেন৷
ছবি: Getty Images/AFP/ARFA
বাচ্চা
চিতা বাঘের এই বাচ্চাটি মেক্সিকোতে বন্দি অবস্থায় জন্ম নিয়েছিল৷ এক দম্পতি বেআইনিভাবে মা চিতাকে ধরার পর সে দুটি বাচ্চা দেয়৷ পরে ওই দুই বাচ্চাকে মেক্সিকোর এক পরিবেশ কর্মী উদ্ধার করে তা যথাযথ কর্তৃপক্ষকে সমর্পণ করেন৷
ছবি: Getty Images/AFP/P. Pardo
পিংক ফ্লেমিংগো
বুনো পিংক ফ্লেমিংগোটি চোরা কারবারিদের হাতে ধরা পড়েছিল৷ পাচারের সময় সে সহ ১০৭টি বন্যপ্রাণী উদ্ধার করেন কলম্বিয়ার বন কর্মকর্তারা৷ পুনরায় বনে ফিরিয়ে দিতে তাকে পরিচর্যা করছেন একজন জীববিজ্ঞানী৷
ছবি: Getty Images/AFP/L. Robayo
দুই কচ্ছপ
পিংক ফ্লেমিংগোর মতো এই হিকোটিয়া গোত্রের কচ্ছপ দুটিও চোরাকারবারির হাত থেকে উদ্ধার করা হয়৷
ছবি: Getty Images/AFP/U. Ruiz
6 ছবি1 | 6
আকার অনুযায়ী ৫ থেকে ১২০টি পর্যন্ত হাতি অংশ নেয় মন্দিরের একটি শোভাযাত্রায়৷ ত্রিচূড়ের একটি শোভাযাত্রায় ১০০টি হাতি অংশ নেয়৷ অভিযোগ, এই উৎসব আদতে পরিচালনা করে মাফিয়ারা৷ হাতির মালিকরা পশুটিকে একটি শোভাযাত্রায় ১২ ঘণ্টার জন্য ভাড়া দেন৷ এটি শেষ হলে ট্রাকে করে অন্য একটি উৎসবের জন্য অন্যত্র চালান করেন৷ পুরো পথটা হাতিগুলিকে দাঁড়িয়ে সফর করতে হয়৷
অবহেলিত ও নিপীড়িত
গত কয়েক বছরে হাতির মৃত্যুর জন্য দায়ী করা হচ্ছে অতিরিক্ত পরিশ্রম, অপর্যাপ্ত বিশ্রাম, জল ও খাদ্যের অভাবকে৷ সরকারি বিধি অনুযায়ী, সকাল ১১টা থেকে বিকেল ৪টে পর্যন্ত হাতিদের নিয়ে শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ হলেও প্রচণ্ড গরমের মধ্যে অবলা পশুগুলিকে হাঁটানো হয়৷ নভেম্বর থেকে এপ্রিলে যৌন সঙ্গমের মরশুমেও সঙ্গীদের থেকে বঞ্চিত রাখা হয় হস্তীকুলকে৷ এই সময় পুরুষ হাতির মধ্যে হরমোনের ক্রিয়ার ফলে আগ্রাসী আচরণ দেখা যায়৷ এই সময়টায় মালিকরা হাতিকে এমন ইনজেকশন দেন যাতে ওই হরমোন শরীরে কাজ করতে না পারে৷ মৃত হাতির ময়নাতদন্তে দেখা গিয়েছে, এই ইনজেকশনের ফলে বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নষ্ট হয়ে গিয়েছে৷ অন্ত্রে পাওয়া গিয়েছে পোকা৷
২০১৬ ও ২০১৭ সালে কেরলে বন্দি ৪৬টি হাতির মৃত্যু হয়েছে৷ এর পর সরকার হাতির মালিকদের নোটিস পাঠিয়েছে৷ কিন্তু তাতে পরিস্থিতির আদৌ উন্নতি হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে৷ অ্যাকশন ফর এলিফ্যান্ট ইউকে নামে সংগঠন কেরলকে হাতিদের প্রতি অত্যাচারের গ্রাউন্ড জিরো বলে আখ্যা দিয়েছে৷ তাদের মতে, কেরলের মতো বন্যপ্রাণের প্রতি অত্যাচার পৃথিবীর অন্য কোথাও হয় না৷
সরকারি উদ্যোগ
কেরল সরকার খতিয়ে দেখছে, বন্যপ্রাণ রক্ষার পক্ষে আন্দোলনকারীদের অভিযোগ কতটা ঠিক৷ মৃত্যুগুলি বিচ্ছিন্ন, না একই কারণে হাতি মারা পড়ছে৷ রাজ্যের প্রধান বনপাল ও পশু সংরক্ষক পি কে কেশবন ডয়চে ভেলেকে বলেন, এখনও পর্যন্ত একটি অন্তর্বর্তী রিপোর্ট এসেছে৷ তবে তিনি স্বীকার করেছেন, এত হাতির পরপর মৃত্যুর মধ্যে অস্বাভাবিকত্ব রয়েছে৷ মালিকের সঙ্গে হাতির পরম্পরাগত সম্পর্ক এখন পাল্টে গিয়েছে, আর্থিক লাভ বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে৷ সরকারকে তাই পরিস্থিতির উপর বিশেষ নজর রাখতে হবে৷ চালু বিধি কাজে না এলে নয়া কঠোরতর বিধি প্রণয়ন করতে হবে বলে মনে করেন কেশবন৷ হাতির মৃত্যু বাড়তে থাকা ও এই সংক্রান্ত প্রচারের জের কেরলের পর্যটনেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে৷
জার্মানির চিড়িয়াখানার ইতিহাস
প্রতি বছর কোটি কোটি মানুষ জার্মানির চিড়িয়াখানা পরিদর্শন করে৷ একজন দর্শনার্থী চিড়িয়াখানায় গিয়ে এখন যা দেখেন, তা এ রকম ছিল না৷ সময়ে সময়ে বদলেছে ধরণ, সমৃদ্ধ হয়েছে কালে কালে৷
ছবি: picture alliance/blickwinkel/K. Hennig
জার্মানির প্রথম চিড়িয়াখানা
প্রাণীবিদ্যার অধ্যাপক মার্টিন হিনরিশ লিশটেনস্টাইন লন্ডনে জুলোজিক্যাল গার্ডেন দেখে এ বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন৷ এরপর তাঁর মধ্যে এ বিষয়ে কিছু একটা করার ইচ্ছা জাগে৷ ১৮৪১ সালে প্রুশিয়ার রাজা চতুর্থ ফ্রিডরিশ ভিলহেল্মকে রাজি করান৷ রাজা এক ডিক্রির মাধ্যমে বার্লিনের টিয়ারগার্টেনে ৫৪ একর জমি বরাদ্দ দেন৷ সেখানেই গড়ে ওঠে জার্মানির প্রথম জুলোজিক্যাল গার্ডেন৷
ছবি: picture alliance/dpa/arkivi
প্রথম প্রাণী
১৮৪৫ সালের মধ্যে দু’টি কোয়াটি, তিনটি সুমেরুর শিয়াল, একটি লাল শিয়াল, দু’টি ব্যাজার, ২৪টি বানর এবং তিনটি সাইবেরিয়ার ভাল্লুক এখানেআনা হয়৷ ১৮৪৬ সালে সিংহ এবং বাঘকে পৃথক ভবনে নিয়ে আসা হয়৷ ১৮৫৭ সালে প্রথম হাতি আনা হয়৷ ১৮৬১ সালে আনা হয় প্রথম জেবরা৷ তবে তখন প্রাণীর মৃত্যুর হার ছিল অত্যন্ত বেশি৷
ছবি: picture alliance/dpa/arkivi
রোল মডেলের ভূমিকায় ভিয়েনা
ভিয়েনার শ্যোনব্রুন চিড়িয়াখানা ছিল একেবারে অন্য রকম৷এ জগতে নানা সংযোজনে তাদের অবদান রয়েছে৷ ১৯০৬ সালে এখানে প্রথম হাতির বাচ্চা জন্মগ্রহণ করে৷ ৭২৭ প্রজাতির ৩৫শ’ প্রাণী নিয়ে ১৯১৪ সালে এটি পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম চিড়িয়াখানায় পরিণত হয়৷ এটা বার্লিনের চিড়িয়াখানার রোল মডেল হয়ে দাঁড়ায়৷ এটি বিদ্যমান সবচেয়ে পুরাতন চিড়িয়াখানাগুলোর একটি৷ বলা হয়ে থাকে, ইউরোপের মধ্যে এই চিড়িয়াখানাতেই সবচেয়ে বেশি দর্শনার্থী যায়৷
ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে জার্মান ভাষাভাষী দেশগুলোতে বহু চিড়িয়াখানা গড়ে ওঠে৷ তবে এসব চিড়িয়াখানার পূর্বসুরী হিসাবে রয়েল পার্কের কথাই বলা হয়৷ এটাও প্রুশিয়ার রাজপরিবার গড়ে তুলেছে৷ সেখানে রাজা কেবল শিকারই করতেন না, বরং এখানে প্রকৃতি গবেষকদের বসবাস করার অনুমতি দেয়া হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/P.Pleul
ভবন সংরক্ষণ এবং প্রাণী সুরক্ষা
বার্লিন জুলোজিক্যাল গার্ডেনে অবস্থিত অ্যান্টিলোপ হাউজের মতো অনেক ভবনই ঊনিশ শতকে নির্মাণ করা হয়৷ এর মাধ্যমে এখানে প্রাণীদের জন্য একটা ভিন্ন আবহ আনার চেষ্টা করা হয়৷ কিন্তু এটা যতটা না নান্দনিক করা হয়েছে, নির্মাণের সময় সংশ্লিষ্ট প্রজাতির প্রাণীদের সুবিধার কথা ততটা ভাবা হয়নি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/dpaweb/B. Setnik
শিক্ষা
২০ শতকে এসে জার্মানি জুড়ে অনেক চিড়িয়াখানা হয়৷ মানকি পার্ক, ওশান পার্ক, বার্ড পার্ক প্রভৃতি ক্রেজ জেঁকে বসে৷ এমনকি মানুষ সাফারি পার্কের মাঝে নিজেদের গাড়ি বা বাস নিয়ে যাওয়ারও সুযোগ পায়৷ ৫০ ও ৬০-এর দশকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ছোট ছোট শহরগুলোও চিড়িয়াখানা বা প্রাণী পার্ক গড়ে তোলে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/F. Leonhardt
গতির ঝড়
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানিতে চিড়িয়াখানা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে একটা উন্মাদনা দেখা দেয়৷ দূর দূর ভূখণ্ডের প্রাণী দেখতে মানুষ আকুল হয়ে উঠে৷ একটা সময়ে এসব চিড়িয়াখানা জীবন্ত ক্লাসরুমে পরিণত হয়৷ কিন্তু প্রাণীদের রাখার ক্ষেত্রে তাদের উপযোগী করে পরিবেশ তৈরির বিষয়টি তখনও অগ্রাধিকারে ছিল না৷ ৭০-এর দশকের পর প্রাণী-মনস্তত্ত্ব নিয়ে নতুন নতুন দিক বের হয়ে আসে৷ তখন চিড়িয়াখানাগুলো তাদের ডিজাইন বদলাতে শুরু করে৷
ছবি: picture alliance/blickwinkel/K. Hennig
প্রকৃতিতে ফিরে আসা
চিড়িয়াখানা ডিজাইনে বিস্তৃত পরিসর রাখার বিষয়টি পুরো ব্যাপারটাই বদলে দেয়৷ যেমনটা হয়েছিল হামবুর্গের কার্ল হাগেনবেকে৷ সিংহ বাস করত জিরাফ, হাতি এবং জেব্রার কাছাকাছি৷ চিড়িয়াখানায় অঞ্চলভেদেও বিভক্তি ছিল৷ যেমন, চিড়িয়াখানার আফ্রিকা অঞ্চল৷ ছবিতে উঠে আসা কোলন চিড়িয়াখানার গ্রিনজোনের সব প্রাণী, যারা তাদের নিজস্ব প্রাকৃতিক পরিবেশে থাকতে পারে৷
ছবি: DW/Nelioubin
ভবিষ্যতের চিড়িয়াখানা
চিড়িয়াখানার ভবিষ্যৎ কেমন হবে, তা নির্ভর করবে দক্ষ ব্যবস্থাপনার উপর৷ কিছু কিছু চিড়িয়াখানা কিছু প্রাণী রাখা বন্ধ করে দিচ্ছে৷ যেমন, ফ্রাঙ্কফুট চিড়িয়াখানা তাদের হাতির ঘর বন্ধ করে দিচ্ছে৷ শহরের মাঝখানে ২৭ একর জমি নিয়ে গড়ে ওঠা এই চিড়িয়াখানা প্রাণীদের পর্যাপ্ত জায়গা দিতে পারছে না৷
ছবি: picture-alliance/dpa/P. Zinken
আসছে পান্ডা
চড়ার জন্য গাছ, কৃত্রিম নদী, পছন্দসই গাছ– এ সবই করা হচ্ছে চীনের দুই পান্ডা জিয়াও কুয়িং (ছবিতে) এবং মেং মেং-এর জন্য৷ আগামী ২৪ জুন বিমানের প্রথম শ্রেণির আসনে চড়ে তারা আসছে জার্মানিতে৷ তারা আসার পর বার্লিন জুলোজিক্যাল গার্ডেনে চালু করা হবে পান্ডাপ্লাজা৷ দুই পান্ডার জন্য এত সব আয়োজনই বলে দিচ্ছে, চিড়িয়াখানায় এসব প্রাণীর জীবন পাল্টে গেছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
চিড়িয়াখানা গবেষণা
চিড়িয়াখানার নতুন নতুন প্রজাতির জন্ম হচ্ছে, যাদেরকে তাদের নিজস্ব পরিবেশে ছেড়ে দেয়া হবে৷ পরিবেশ সংরক্ষণেও তারা কাজ করছে এবং প্রাণীর প্রাকৃতিক বাসস্থান সম্পর্কে দর্শনার্থীদের জানাচ্ছে৷ কিন্তু সমালোচকরা বলছেন, বিভিন্ন প্রাণীর কিছু কিছু প্রজাতিকে কেবল চিড়িয়াখানায় বাঁচিয়ে রাখা অনৈতিক৷ অবিকৃত প্রাকৃতিক বাসস্থান দেয়া লক্ষ্য হওয়া উচিত৷
জার্মানিতে খেলাধুলার চেয়ে চিড়িয়াখানায় বেশি দর্শনার্থী যায়৷ মানুষ বিনোদনের জন্য এই দিকে বেশি ঝুঁকছে৷ সম্প্রতি কোলন চিড়িয়াখানায় একটা ছোট্ট খামার উদ্বোধন করা হয়েছে৷ সেখানে দর্শনার্থীরা গরু ও ছাগলের যত্ন নিতে পারবেন৷ চিড়িয়াখানা এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে, কোনো কিছুই এর স্থলাভিসিক্ত হতে পারে না৷ এটা কেবল প্রাণীকে মানুষের সঙ্গে যুক্ত করতেই ভূমিকা রাখছে না৷ বরং বহু বিপন্ন প্রাণীর সংরক্ষণেও কাজ করছে৷