বলা হয় ২০১১ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বিপ্লব ঘটে গিয়েছিল৷ ৩৪ বছরের বাম শাসনের অবসান ঘটিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ ক্ষমতায় এসেই কলকাতা শহরের হাসপাতালগুলির আমূল সংস্কারের পরিকল্পনা করেছিলেন৷
বিজ্ঞাপন
এরপর বছর ঘুরেছে৷ ধীরে ধীরে সত্যি সত্যিই সেজে উঠেছে শতাব্দীপ্রাচীন মেডিকেল কলেজ, আরজি কর হাসপাতাল, এনআরএস কিংবা বাঙুর মেডিক্যাল কলেজ এবং হাসপাতাল৷ বড় বড় ফটক লেগেছে রাস্তার উপর৷ আধুনিক আলো লেগেছে৷ ইংরেজ আমলের লাল রং বদলে হয়েছে নীল-সাদা৷ ব্যস, ওইটুকুই৷
বিশেষজ্ঞরা বলেন, শহরের হাসপাতালগুলি বাইরে থেকে দৃষ্টিনন্দন হয়েছে কেবল৷ ভিতরে কোনও সংস্কার হয়নি৷ করোনাকালে বোঝা গেল, পুরো ভারতের স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর অবস্থাই কার্যত কলকাতার মতো৷ উপর থেকে চকচকে, ভিতরটা ফাঁপা৷
সম্প্রতি রাজধানী দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল একটি সাংবাদিক বৈঠক করেছেন৷ সেখানে তিনি বলেছেন, যে হারে করোনার সংক্রমণ বাড়ছে, তাতে হাসপাতালগুলিতে রোগীদের বেড দেওয়া সম্ভব হবে না৷ বেসরকারি হাসপাতালগুলির কাছেও সহায়তা চেয়েছিলেন তিনি৷ তাতে দেখা গিয়েছে, অধিকাংশ বেসরকারি হাসপাতালে পর্যাপ্ত আইসিইউ বেড নেই৷ নেই ভেন্টিলেটর৷ অগত্যা, ব্যাঙ্কোয়েট হল, স্টেডিয়ামে বিকল্প হাসপাতাল তৈরির কথা ভাবছে সরকার৷ কেন সরকারকে এমনটা ভাবতে হচ্ছে?
২০২০-২১ সালে স্বাস্থ্যখাতে বাজেট হয়েছে ৬৭ হাজার ১১২ কোটি টাকা৷ গত বছরের পরিবর্ধিত বাজেটের থেকে যা ৩.৫ শতাংশ বেশি৷ বাজেট এবং পরিবর্ধিত বাজেটের মধ্যে সময়ে সময়ে আকাশ পাতাল তফাত হয়ে যায়৷ সরকার যখন সকলের সামনে বাজেট পেশ করে, তখন অনেক খাতেই অতিরিক্ত বরাদ্দ ঘোষণা করা হয়৷ বছরের মাঝামাঝি গিয়ে পরিবর্ধিত বাজেটে বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া হয়৷ স্বাস্থ্যখাতেও এমন ঘটনা ঘটে৷ ফলে বছরের শুরুতে সরকার যে বাজেট দিয়েছে, বছরের শেষেও তা থাকে কি না, সে প্রথম দেখার বিষয়৷ দ্বিতীয় বিষয় হলো, এই বিপুল বাজেট খরচ হয় কোথায়? বিশেষজ্ঞদের অনেকেরই বক্তব্য, কর্মীদের বেতন দিতে এবং লোক দেখানো টেন্ডারে বহু অর্থ ব্যয় হয়ে যায়৷ সরকার জানে, মানুষকে খুশি করতে হলে বাহ্যিক চাকচিক্য প্রয়োজন৷ ফের টেনে আনতে হয় কলকাতার উদাহরণ৷ সেখানকার হাসপাতালগুলিকে বাইরে থেকে দেখলে সত্যিই মনে হয় পাঁচতারা হোটেল৷ ভিতরে ঢুকলে বোঝা যায় পরিকাঠামোর খামতি৷ দক্ষিণের কয়েকটি শহর বাদ দিলে দেশের অন্য নগরগুলিরও একই অবস্থা৷ অধিকাংশ অর্থ ব্যয় হয়ে যায় বাইরের চাকচিক্যে৷ পরিকাঠামোগত উন্নয়ন হয় না৷ যদি হতো, দেশের প্রায় প্রতিটি সরকারি হাসপাতাল আজ এভাবে ভুগতো না৷ আইসিইউতে বেড নেই৷ পর্যাপ্ত ভেন্টিলেটর নেই৷ চিকিৎসকদের জন্য যথেষ্ট পিপিই কিট নেই৷
করোনার বিরুদ্ধে কারা জেতে, কারা জেতে না
ফুটবলে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা সমানে সমানে লড়ে, কিন্তু এই লড়াইয়ে ব্রাজিল পাত্তাই পায় না৷ ৪৫ বছর আগের এক যুদ্ধের মতো পুঁচকে ভিয়েতনামের কাছে আবার লজ্জা পায় যুক্তরাষ্ট্র৷ করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধের আরো কিছু বিষয় থাকছে ছবিঘরে..
ছবি: Getty Images/AFP/S. Lima
দেশ অপ্রস্তুত আর প্রেসিডেন্ট একগুঁয়ে হলে যা হয়
চীনে করোনা সংকট দেখা দেয়ার দু’মাস পরও যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসাসামগ্রীর ঘাটতি, করোনা টেস্ট শুরু করায় বিলম্ব, ইটালিতে মৃত্যুর মিছিল দেখেও করোনাকে ট্রাম্পের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য, মধ্য এপ্রিলেই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে দিতে চাওয়া- ইত্যাদির উল্লেখ করে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিবিসি৷ বিশেষজ্ঞরা যা চান ট্রাম্প তার ঠিক বিপরীত দিকে হাঁটতে চেয়েছেন৷ ফলাফল পরাশক্তি হয়েও করোনার কাছে নাস্তানাবুদ হওয়া৷
শীতল যুদ্ধের যুগ আর নেই৷ তবে এ যুগেও কমিউনিস্ট শাসিত কিউবা আর যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক মধুর হয়নি ৷ যুক্তরাষ্ট্রে করোনায় মৃত্যু এক লাখ ১৫ হাজার ছাড়িয়েছে, অথচ কিউবায় মারা গেছে মাত্র ৮৩ জন৷ হোক না মাত্র এক কোটি ১৪ লাখ মানুষের দেশ, করোনাকে এভাবে বোতলবন্দি করলো কিভাবে তা-ই এখন কৌতুহলের কেন্দ্রে৷ গার্ডিয়ান বলছে, শুরু থেকে সপ্তাহের সাতদিন ঘরে ঘরে করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থা করে তা সম্ভব করেছে কিউবা৷
ছবি: pictrure-alliance/AP Photo/I. Francisco
বিশেষজ্ঞরা স্বেচ্ছাচারিতার কবলে পড়লে যা হয়
লকডাউন প্রশ্নে ট্রাম্পের বিরোধিতা করে কোণঠাসা হয়েছেন জাতীয় অ্যালার্জি ও সংক্রামক রোগ ইনস্টিটিউটের প্রধান ডা, অ্যান্থনি ফাউচি, একই বিষয়ে প্রেসিডেন্ট বলসোনারোর বিরোধিতা করে দায়িত্ব হারিয়েছেন ব্রাজিলের দুই স্বাস্থ্যমন্ত্রী৷ সামাজিক দূরত্ব মানার সরাসরি বিরোধিতা করা বলসোনারোর দেশও এখন ধুঁকছে৷ গার্ডিয়ানের বিশ্লেষণে করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে কিউবার চেয়ে সত্তর গুন পিছিয়ে আছে ব্রাজিল৷
ছবি: Getty Images/AFP/S. Lima
ভিয়েতনাম হলে যা হয়
ভিয়েতনামও করোনার বিরুদ্ধে দারুণ সফল৷ দেশ ছোট আর অর্থনীতি দুর্বল হলেও বড় যুদ্ধে ভিয়েতনাম কখনো হারেনি৷ ৩৫ বছর আগে সামরিক যুদ্ধে ব্যর্থ হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র, এখন ব্যর্থ হচ্ছে করোনা ভাইরাস৷ দ্রুত সীমান্ত বন্ধ করা, অল্প সময়ে বেশি পরীক্ষা করানো, সামাজিক দূরত্ব, লকডাউন- সব নিয়ম কঠোরভাবে মেনে সফল হয়েছে ভিয়েতনাম৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/Hau Dinh
সরকার এবং সরকারপ্রধান অপরিনামদর্শী না হলে যা হয়
জনমনে অসন্তোষ দেখে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট বন্ধ করেছিল ব্রাজিল সরকার৷ সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তা আবার চালু হয়েছে৷ ফুটবলে তাদের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে আর্জেন্টিনা ২৬ হাজারের মতো সংক্রমণ আর মাত্র ৭৮৭ জন করোনায় মৃত্যু নিয়ে এখনো অনেক ভালো অবস্থায়৷ আর্জেন্টিনার জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে চার কোটি, বিপরীতে ব্রাজিলের জনসংখ্যা ২১ কোটির কাছাকাছি হলেও ব্যবধানটা কিন্তু সেই তুলনায় অনেক বড়!
ছবি: Getty Images
করোনাকে বেশি সময় দিলে যা হয়
করোনা যখন হানা দিলো, তখন পরীক্ষার প্রস্তুতি, ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামের জোগান- সব কিছুরই ঘাটতি ছিল ইউরোপের দেশটিতে৷ লকডাউন, সামাজিক দূরত্ব মানতে চাননি অনেকে৷ ফলে বিপদ বেড়েছে দ্রুত৷ এখন পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক৷ এ পর্যন্ত ইটালিতে ৩৪ হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে৷ ডাক্তার মারা গেছেন একশ’রও বেশি৷ বেশির ভাগ ডাক্তারই মারা গেছেন পিপিই ছাড়া চিকিৎসা সেবা দিতে গিয়ে৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/E. Mattia Del Punta
ছোট দেশও ‘গাইডলাইন’ মানলে যা হয়
প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আর্ডার্ন জানিয়েছেন, নিউজিল্যান্ডে আর করোনায় সংক্রমিত রোগী নেই৷ বিশ্লেষকরা বলছেন মূলত গাইডলাইন মেনে চলার কারণেই এমন সাফল্য এসেছে৷ ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের স্কুল অব ফার্মাসির শিক্ষক ওকসানা পাইসিক বলেন, ‘‘ প্রথমে খুঁজে বের করা, তারপর টেস্ট করা, আইসোলেট করা, প্রত্যেক রোগীকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা, সংক্রমণ ধরা পড়লে কোয়ারান্টিনে পাঠানো- এসব মেনেই নিউজিল্যান্ড সফল হয়েছে৷’’
ছবি: picture-alliance/AP Photo/M. Baker
7 ছবি1 | 7
যে সময়ের মধ্য দিয়ে আমরা যাচ্ছি, তা স্বাভাবিক সময় নয়৷ করোনার কারণে হাসপাতালগুলির উপর চাপ কয়েক গুণ বেড়ে গিয়েছে৷ কিন্তু একই সঙ্গে এ কথাও ঠিক, করোনা দেশের সরকারি হাসপাতালগুলির আসল চেহারা বাইরে নিয়ে এসেছে৷ শুধুমাত্র করোনার চিকিৎসায় ভেন্টিলেটর লাগে না৷ এই যন্ত্রটি এখন প্রায় অপরিহার্য হয়ে উঠেছে৷ ২০২০ সালে দাঁড়িয়ে ভারত যখন বিশ্বের কাছে নিজেকে সুপার পাওয়ার হিসেবে প্রমাণ করতে চাইছে, তখন সামান্য ভেন্টিলেটর থাকবে না কেন হাসপাতালগুলিতে? কেন পিপিই কিট ছাড়াই চিকিৎসা করতে হবে ডাক্তারবাবুদের? পিপিই কিট তো চিকিৎসার একেবারে গোড়ার সরঞ্জাম৷ কেন তা যথেষ্ট পরিমাণে মজুত থাকবে না? কেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্যানডেমিক ছড়িয়ে পড়ার দৃশ্য দেখেও আগে থেকে সতর্ক হওয়া গেল না? কেন সামান্য পিপিই কিট কিনতে নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা রাজ্য এবং কেন্দ্র সরকারের? প্রশ্নগুলো সহজ, উত্তর জানা নেই৷
এ তো গেল সরকারি হাসপাতালের কথা৷ করোনার সময়ে দেশের বহু বেসরকারি হাসপাতাল কার্যত ঝাঁপ ফেলে বসে আছে৷ পাছে করোনা রোগী হাসপাতালে ঢুকে পড়ে! পাছে হাসপাতাল থেকে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে! মাত্র একমাস আগে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছিল দিল্লিতে৷ ৬৫ বছরের এক বৃদ্ধের হার্ট অ্যাটাক হয়৷ অ্যাম্বুলেন্সে তুলে ওই রোগীর মেয়ে বাবাকে অন্তত তিনটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যান৷ একটি হাসপাতালও রোগীকে অ্যাম্বুলেন্স থেকেই নামাতে দেয়নি৷ ইমার্জেন্সিতে পর্যন্ত নিতে দেওয়া হয়নি৷ চিকিৎসা না পেয়ে পথেই মৃত্যু হয় ওই রোগীর৷ এমন একাধিক ঘটনা ঘটেছে কলকাতায়৷ পুলিশ পর্যন্ত রোগীকে ভর্তি করতে পারেনি৷ কারণ, বেসরকারি হাসাপাতালগুলি রোগী ভর্তি করছে না৷ যুক্তি দেখাচ্ছে, তাদের করোনা সামলানোর পরিকাঠামো নেই৷ বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, সম্পূর্ণ ব্যবসায়িক মানসিকতা থেকেই এই কাজটি করছে বেসরকারি হাসপাতালগুলি৷ করোনার চিকিৎসার সাধারণ পরিকাঠামো তৈরি করে তারা খরচ বাড়াতে চাইছে না৷ ফলে ঝাঁপ ফেলে রাখছে৷ অথচ তাদের কাছে কিন্তু ভেন্টিলেটর আছে৷ আইসিইউ, আইটিইউ পর্যন্ত আছে৷
কোনো কোনো বেসরকারি হাসপাতাল আবার নিজেদের কোভিড হাসপাতাল বলে ঘোষণা করেছে৷ সেখানে ভর্তি হলে প্রতিদিন এক লাখ টাকা করে খরচ৷ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে রোগের কোনও চিকিৎসাই নেই, সেই রোগে দিনে এক লাখ টাকা খরচ কীভাবে হবে, সেটাই বোঝা যাচ্ছে না৷
চিকিৎসক সাত্যকি হালদার ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ‘‘আসলে এ দেশে গোটা চিকিৎসা ব্যবস্থাটাই পাতলা সুতোর উপর ঝুলে আছে৷ একটু নাড়া লাগলেই সবটা ভেঙে পড়বে৷ এতদিন ওই দোলাটা লাগেনি৷ করোনা এসে দোলা লাগিয়ে দিয়েছে৷ পুরো ব্যবস্থাটাই ভেঙে পড়েছে৷’’
একই মত চিকিৎসক সমরজিৎ জানার৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি জানিয়েছেন, ‘‘চিকিৎসা তো অনেক পরের বিষয়৷ সাধারণ টেস্টের ব্যবস্থাই তো এখনও পর্যন্ত ঠিক করে করা গেল না৷’’ বস্তুত, সমরজিৎবাবুর বক্তব্য, সাধারণ রোগীরাও ঠিক মতো চিকিৎসা পাচ্ছেন না৷ স্বাস্থ্য নিয়ে ব্যবসা কোন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে, তা এখন সকলের কাছে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে৷
এ তো গেল শহরের কথা৷ গ্রামের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ৷ আবার তাকানো যাক পশ্চিমবঙ্গের দিকে৷ দক্ষিণ ২৪ পরগনা একটি বড় জেলা৷ সেই গোটা জেলার মধ্যে একমাত্র মাল্টি স্পেশালিটি সরকারি হাসপাতাল এমআর বাঙুর, যা কি না কলকাতায়৷ এই একটা উদাহরণেই স্পষ্ট জেলাগুলিতে চিকিৎসার অবস্থা ঠিক কী? সুন্দরবনের প্রত্যন্ত গ্রাম নয়, গোসাবায় কোনো নারীর প্রসবযন্ত্রণা হলে অন্তত দেড় ঘণ্টা লাগে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে৷ গ্রামের মানুষ অভিযোগ করেন, এলাকার স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে রোগীদের ভর্তিই করা যায় না৷ নিয়ে গেলেই রেফার করে দেওয়া হয় কলকাতার হাসপাতালে৷ বস্তুত, এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলির এ ছাড়া আর কোনো উপায়ও নেই৷ ন্যূনতম চিকিৎসার পরিকাঠামোটুকু পর্যন্ত সেখানে থাকে না৷ ফলে চিকিৎসকরা বাধ্য হয়েই কলকাতায় পাঠিয়ে দেন রোগীদের৷ রাস্তাতেই মৃত্যু হয় বহু রোগীর৷
হাসপাতাল ভর্তি নেয় না৷ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পরিকাঠামো নেই৷ হাসপাতালগুলির সংস্কার হয়নি৷ এ সব কথা বোঝার জন্য করোনার প্রয়োজন হয় না৷ ভারতের অধিকাংশ মানুষ এমনিতেই এগুলি জানতেন৷ এও জানতেন যে, বেসরকারি হাসপাতালগুলি ব্যবসা ছাড়া আর কিছু বোঝে না৷ মৃতপ্রায় রোগীকে ভেন্টিলেটরে ফেলে রেখে বিল বাড়ানো হয়েছে, এই অভিযোগ প্রায় প্রতিদিনের৷ অথচ প্রয়োজনের সময় সেই ভেন্টিলেটরই পাওয়া যাচ্ছে না৷ আর তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অনিয়ম৷ গুজরাটের সরকারি হাসপাতাল কয়েক কোটি টাকা দিয়ে একটি সরকার ঘনিষ্ঠ সংস্থার কাছ থেকে ভেন্টিলেটর কিনেছে৷ অভিযোগ, সেই ভেন্টিলেটরগুলি আসলে কাজই করে না৷ পিএম কেয়ার ফান্ড থেকে টাকা নিয়ে সেই ভেন্টিলেটর কেনা হয়েছে৷ এ অনিয়মও নতুন কিছু নয়৷ সারা বছরই স্বাস্থ্যখাতে এমন নানা অনিয়মের কথা শোনা যায়৷ করোনার সময় সেই সব কিছুকেই একেবারে সামনে নিয়ে এসেছে৷ কিছুই আর লুকনো নেই৷
ভালোমন্দের স্বাস্থ্যছবি
করোনা মহামারির কারণে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবার একটি করুন চিত্র সামনে এসেছে৷ তবে স্বাধীনতার পর স্বাস্থ্যসেবায় বাংলাদেশ কিছু বিষয়ে সাফল্যও দেখিয়েছে৷
ছবি: DW/H. Ur Radhid
জনবল ও অবকাঠামো সংকট
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে, একটি দেশের জনসংখ্যার অনুপাতে যতজন ডাক্তার, নার্স, মেডিকেল টেকনলজিস্ট, অ্যানেস্থেটিস্ট থাকা আদর্শ সেটি বাংলাদেশে নেই৷ করোনার কারণে সেই সংকট প্রবলভাবে দেখা গেছে৷ বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী বলছেন, একজন ডাক্তারের বিপরীতে নার্স থাকতে হয় তিন জন৷ কিন্তু বাংলাদেশে আছে আধা জন৷ এছাড়া স্বাস্থ্যসেবা দিতে প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর অভাবতো আছেই৷
ছবি: bdnews24.com
দুর্নীতি
দুর্নীতি দমন কমিশনের তৈরি এক প্রতিবেদনে স্বাস্থ্য খাতে কেনাকাটা, নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি, পদায়ন, চিকিৎসাসেবা, চিকিৎসাসেবায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ব্যবহার, ওষুধ সরবরাহসহ দুর্নীতির ১১টি খাত চিহ্নিত করা হয়৷ বলা হয়, দুর্নীতি করার জন্য অনেক অপ্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কেনা হয়, যা পরিচালনার লোক নেই৷ ওইসব যন্ত্রপাতি কখনোই ব্যবহার করা হয় না৷ প্রতিবেদনটি গতবছর জানুয়ারিতে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাছে তুলে দেয়া হয়েছিল৷
ছবি: DW
বাজেট বরাদ্দ ও বাস্তবায়নে অক্ষমতা
করোনার কারণে সম্প্রতি পেশ করা বাজেটে গতবছরের চেয়ে এবার স্বাস্থ্যখাতে বেশি বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে৷ এবার প্রস্তাবিত ৪১ হাজার ২৭ কোটি টাকা জিডিপির ১.৩ ভাগ৷ গতবছর তা ছিল মাত্র ০.৮৯ ভাগ৷ তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, বরাদ্দ যেমন প্রয়োজনের তুলনায় কম তেমনি অতীতে দেখা গেছে, বরাদ্দ বাস্তবায়নের হারও কম৷ ফলে স্বাস্থ্যসেবা পেতে মানুষের ভোগান্তি কমছে না৷
ছবি: bdnews24.com/ M. Zaman Ovi
টিকাদানে সাফল্য
ছয়টি রোগের বিরুদ্ধে লড়তে ১৯৭৯ সালে ‘সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি’ কার্যক্রম শুরু হয়৷ বর্তমানে এটি ১০টি রোগের ক্ষেত্রে সম্প্রসারিত হয়েছে৷ সারা দেশে বিনামূল্যে এসব টিকা দেয়া হয়৷ ২০১৮ সালে সব টিকাপ্রাপ্তির হার ছিল ৯৭.৬ শতাংশ৷ টিকাদান কর্মসূচিতে সফলতার জন্য গতবছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ পুরস্কার দিয়েছে ‘গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনেশন এবং ইমিউনাইজেশন’৷
ছবি: Reuters/M. Ponir Hossain
শিশুমৃত্যুর হার কমেছে
জনস্বাস্থ্যবিষয়ক দেশের সবচেয়ে বড় জরিপ ‘বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ’ বা বিডিএইচএস৷ সবশেষ জরিপটি হয়েছে ২০১৭-১৮ সালে৷ এতে বলা হয়, পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুদের মৃত্যুহার সেই সময় ছিল প্রতি হাজারে ৪৫ জন৷ এই সংখ্যা ১৯৭৯ সালে ২০২ জন এবং ২০০৬ সালে ৬৫ জন ছিল বলে জনস্বাস্থ্য বিষয়ক বিশ্বখ্যাত সাময়িকী ‘দ্য ল্যানসেট’-এর এক প্রবন্ধে বলা হয়েছে৷
ছবি: Imago Images/Zuma/M. Hasan
গড় আয়ু বেড়েছে
গতবছর জুনে প্রকাশিত এক জরিপে ‘বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো’ বা বিবিএস জানায়, বাংলাদেশের মানুষের মোট গড় আয়ু এখন ৭২ বছর ৩ মাস৷ ১৯৬০ সালে গড় আয়ু ৪৬ বছর ছিল বলে ২০১৮ সালে বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
জন্মনিয়ন্ত্রণে সাফল্য
বিশ্ব ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে নারীদের সন্তান জন্মদানের হার ১৯৭১ সালে ছয় দশমিক নয় থেকে ২০১৭ সালে দুই দশমিক শূন্য ছয়ে নেমে এসেছে৷ এই হার প্রায় ইউরোপের সমান উল্লেখ করে জন্মনিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ আফ্রিকার জন্য রোল মডেল হতে পারে বলে গতবছর মন্তব্য করেছিলেন জার্মান উন্নয়নমন্ত্রী গ্যার্ড ম্যুলার৷
ছবি: picture-alliance/AP
খরচ বাড়ছে
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বাংলাদেশে স্বাস্থ্যের পেছনে ১০০ টাকা খরচ হলে সরকারি সহায়তা পাওয়া যায় ২৮ টাকা এবং বাকি ৭২ টাকা রোগীকে বহন করতে হয়৷ ২০১২ সালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ২০১২-২০৩২ সাল মেয়াদি একটি কৌশলপত্র তৈরি করেছিল৷ সেখানে ব্যক্তিগত খরচ ৩২ টাকায় (তখন ছিল ৬৪ টাকা) নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়৷ অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে ৬৪ থেকে ৩২-এ নামার লক্ষ্য থাকলেও উলটো সেটি বেড়ে ৭২ টাকা হয়েছে৷
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman
সবার জন্য স্বাস্থ্যবিমা এখনও নেই
সরকার স্বাস্থ্য বিমা চালুর পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে বলে গতবছর ১৯ জুন সংসদকে জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা৷ এর অংশ হিসেবে টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর, ঘাটাইল ও কালিহাতি উপজেলায় পরীক্ষামূলকভাবে স্বাস্থ্য বিমা কার্যক্রম চলছে বলেও জানিয়েছিলেন তিনি৷
ছবি: DW
বেশিরভাগ রোগী এমবিবিএস ডাক্তারের কাছে যান না
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ২০১৬ সালের খানা আয় ও ব্যয় জরিপের চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে ২০১৯ সালের জুনে৷ এতে দেখা গেছে, ৫৮ শতাংশ রোগী ওষুধের দোকানদার, হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক, হাকিম-কবিরাজ, ওঝা, পীর, বৈদ্যসহ অন্যদের কাছ থেকে চিকিৎসা নেন৷ ১৬ শতাংশ যান সরকারের কমিউনিটি ক্লিনিক, উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের হাসপাতালে৷ বাকি ২৬ শতাংশ বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারে গিয়ে চিকিৎসা নেন৷