ভারতের ১২টি রাজ্যে বসবাস করছেন রোহিঙ্গারা। তাঁরা সকলেই বেআইনিভাবে এসেছেন। সংসদে জানালেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিত্যানন্দ রাই।
বিজ্ঞাপন
পশ্চিমবঙ্গ সহ ভারতের মোট বারোটি রাজ্যে আছেন রোহিঙ্গারা। রাজ্যসভায় এক প্রশ্নের জবাবে জানালেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিত্যানন্দ রাই। সাংসদ অনিল দেশাইয়ের এক প্রশ্নের লিখিত জবাবে তিনি বলেছেন, জম্মু ও কাশ্মীর, তেলেঙ্গানা, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ, দিল্লি, রাজস্থান, তামিলনাড়ু, আসাম, কর্ণাটক, কেরালা ও পশ্চিমবঙ্গে রোহিঙ্গারা আছেন। তাঁরা বেআইনিভাবে ভারতে ঢুকেছেন। তাঁদের কাছে কোনো বৈধ কাগজপত্র নেই। তবে মন্ত্রী জানিয়েছেন, কতজন রোহিঙ্গা এই সব রাজ্যে বসবাস করছেন, তার কোনো তথ্য তাঁদের কাছে নেই।
নিত্যানন্দ রাইয়ের জবাব থেকে বোঝা যাচ্ছে, রোহিঙ্গারা উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্ব ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্যে বসবাস করছেন। এর মধ্যে বিজেপি-শাসিত হরিয়ানা, কর্ণাটক, আসাম ও উত্তর প্রদেশ আছে। জম্মু ও কাশ্মীরে লেফটন্যান্ট গভর্নরের শাসন চলছে এবং তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি। এছাড়া বিরোধী-শাসিত পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা, তেলেঙ্গানা, পাঞ্জাব, তামিলনাড়ু, দিল্লি আছে। ফলে এটা বলা যাবে না, রোহিঙ্গারা বিজেপি-শাসিত রাজ্যে নেই। সব চেয়ে বড় কথা, কতজন রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে এসেছে, মোদী সরকারের কাছে তার কোনো তথ্য নেই। তার মানে কোন রাজ্যে কত রোহিঙ্গা আছে, তার কোনো পাকা হিসাবও নেই।
দিল্লিতে রোহিঙ্গারা আছেন মদনপুর-খাদাড় এলাকায়। কিছুদিন আগে হায়দরাবাদে পুরসভা নির্বাচনের সময় দেখা যাচ্ছিল, রোহিঙ্গাদের বিষয়টি প্রচার হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে এখন প্রতিদিনই বিজেপি নেতারা রোহিঙ্গাদের নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। অর্থাৎ, রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে রোহিঙ্গাদের বিষয়টি।
ভাসানচরে স্থানান্তর: কী বলছেন রোহিঙ্গারা
শুক্রবার রোহিঙ্গাদের প্রথম ব্যাচ ভাসানচরে পৌঁছেছে৷ তাদের অনেকে সেখানকার সুযোগ-সুবিধা দেখে ভালো লাগার কথা জানিয়েছেন৷ তবে জোর বা নির্যাতন করে রোহিঙ্গাদের সেখানে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগও আছে৷
ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS
ভাসানচর প্রকল্প
প্রায় তিন হাজার একশ কোটি টাকা খরচ করে ভাসানচরে আশ্রয়ন প্রকল্প তৈরি করেছে বাংলাদেশ সরকার৷ সেখানে এক লাখ রোহিঙ্গা নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে৷ স্থানীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, ভাসানচরে যাওয়া প্রত্যেক রোহিঙ্গা পরিবার আলাদা ঘর পাচ্ছে, আছে রান্নার ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ, পানি আর পয়ঃনিষ্কাশন সুবিধা৷ সেই সঙ্গে আছে খেলার মাঠ, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র ও জীবিকা নির্বাহের সুযোগ৷
ছবি: DW/A. Islam
প্রথম ব্যাচ পৌঁছেছে
বাসে ও জাহাজে করে প্রথম ধাপে এক হাজার ৬৪২ জন রোহিঙ্গা শুক্রবার ভাসানচরে পৌঁছেছেন৷ পরে তাদের অনেককে মোবাইল ফোনে কক্সবাজারে থাকা সঙ্গীদের ভাসানচরের খবর দিতে দেখা গেছে৷ কেউ কেউ ভিডিও কলও করেছেন৷
ছবি: bdnews24.com
বাবা-মাকে আনতে চান হোসেন
কক্সবাজারের বালুখালী ক্যাম্প থেকে স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে ভাসনচরে গেছেন মোহাম্মদ হোসেন৷ তিনি বলেন, ‘‘এখানে অনেক ভালো লাগছে৷ আমি এখানে ঘুরেফিরে আবার কক্সবাজার যাবো৷ ওখানে গিয়ে তাদের (বাবা-মা ও ভাইয়ের পরিবার) নিয়ে আসবো৷ তারা যদি না আসে, তাহলে আমি আবার এখানে ফিরে আসবো৷’’
ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS
‘আল্লাহ মিলায়ে দিছে’
কক্সবাজারের কুতুপালং ক্যাম্প থেকে ভাসানচরে গেছেন মোহাম্মদ জোবায়ের৷ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, ‘‘এত ভালো পরিবেশের কথা আমরা ভাবতেই পারছি না৷ জীবনে আমরা এত ভালো বাসায় থাকতে পারিনি, থাকতে পারব এটাও আশা করিনি৷ আল্লাহ আমাদের মিলায়ে দিছে৷’’
ছবি: bdnews24.com
নিরাপত্তাবোধ
বালুখালীর ক্যাম্প থেকে ভাসানচরে যাওয়া আবদুর রহমান এখন নিজেকে কিছুটা নিরাপদ ভাবছেন৷ ‘‘ওখানে (বালুখালী ক্যাম্পে) ঘরের বেড়া কেটে চুরি করে নিয়ে যেতো৷ ঘুমিয়ে থাকলে ছুরিও মারতো৷ এখানে তা পারবে না৷ যে ঘরটা পেলাম, সেটা খুবই নিরাপদ৷ কেউ চাইলেই চুরি করতে বা ঘরে ঢুকতে পারবে না৷’’
ছবি: DW/A. Islam
‘লেখাপড়ার জন্য স্কুল, মাদ্রাসা আছে’
বালুখালীর ক্যাম্প থেকে স্ত্রী, সন্তান ও বাবা-মাকে সঙ্গে নিয়ে ভাসানচরে যাওয়া আব্দুস সামাদ বলেন, ‘‘এখানে এসে খুব ভালো লাগছে৷ ঘরবাড়ি অনেক৷ অনেক বড় বড় রুম৷ এখানে লেখাপড়ার জন্য স্কুল, মাদ্রাসা আছে৷ বড় খেলার মাঠ আছে৷’’ তিনি বলেন, ‘‘কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোতে জায়গা কম৷ মানুষ অনেক৷ একজন বের হলে আরেকজন বের হওয়ার জায়গা থাকে না৷’’
ছবি: DW/N. Conrad
পার্থক্য
ভাসানচর আর কক্সবাজারের পরিবেশের পার্থক্য সম্পর্কে জমিনা আক্তার বলেন, ‘‘এখানে বেশি ভালো লাগছে৷ ভালো ঘর, থাকার জায়গা ভালো৷’’
ছবি: bdnews24.com
নির্যাতনের অভিযোগ
রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নিতে বৃহস্পতিবার কক্সবাজারের উখিয়ায় একটি ট্রানজিট ক্যাম্পে নেয়া হয়েছিল৷ সেখানে উপস্থিত ৬০ বছর বয়সি শরণার্থী সুফিয়া খাতুন এএফপিকে জানান, ‘‘আমার ছেলে যেন ঐ দ্বীপে যেতে রাজি হয় সেজন্য তারা আমার ছেলেকে নির্দয়ভাবে পিটিয়েছে, তার দাঁত ভেঙে ফেলেছে৷ আমি এখানে তাকে ও তার পরিবারকে হয়ত শেষবারের মতো দেখতে এসেছি৷’’
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
‘নিজের ইচ্ছায় যাচ্ছে না’
ট্রানজিট ক্যাম্পে উপস্থিত আরেক শরণার্থী হাফেজ আহমেদ এএফপিকে বলেন, ‘‘গত দুইদিন ধরে আমার ভাই নিখোঁজ ছিল৷ আমরা জানতে পেরেছি, সে এখানে আছে৷ এখান থেকে তাকে দ্বীপে নিয়ে যাওয়া হবে৷ সে সেখানে নিজের ইচ্ছায় যাচ্ছে না৷’’
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
জাতিসংঘের আশঙ্কা, অভিযোগ
জাতিসংঘের আশঙ্কা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে ভাসানচরে পানি উঠে গিয়ে রোহিঙ্গাদের জীবন বিপদাপন্ন হয়ে উঠতে পারে৷ এছাড়া রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘকে যুক্ত করা হয়নি বলে অভিযোগ তাদের৷ ভাসানচরে স্থানান্তর প্রসঙ্গে রোহিঙ্গারা যেন ‘স্বাধীন ও তথ্যসমৃদ্ধ’ সিদ্ধান্ত নিতে পারে তা নিশ্চিত করারও আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ৷
ছবি: DW/A. Islam
‘ভুল ব্যাখ্যা’ না দেয়ার অনুরোধ
রোহিঙ্গারা ‘স্বেচ্ছায়’ ভাসানচরে গেছে জানিয়ে এক বিবৃতিতে বাংলাদেশ বলেছে, ‘‘জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য একমাত্র বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ হওয়া উচিত প্রত্যাবাসন শুরুর জন্য মিয়ানমারের সঙ্গে দায়িত্ব নিয়ে ও কার্যকরভাবে সম্পৃক্ত হওয়া, সেটাই একমাত্র স্থায়ী সমাধান৷ একইসঙ্গে বাংলাদেশের আন্তরিক চেষ্টাকে খাটো করা ও ভুল ব্যাখ্যা না করার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্ক হতে সবার প্রতি আমরা আহ্বান জানাচ্ছি৷’’
ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS
বিএনপির বক্তব্য
রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নেয়ায় তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো কঠিন হয়ে যাবে বলে মনে করছে বিএনপি৷ জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে উপেক্ষা করে এই স্থানান্তর প্রক্রিয়াকে ‘আত্মহনন’ বলেও আখ্যায়িত করেছে দলটি৷
ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS
12 ছবি1 | 12
প্রবীণ সাংবাদিক শুভাশিস মৈত্রের মতে, এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক বিষয়। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেছেন, রোহিঙ্গাদের সমস্যা মানবিক। কিছু মানুষের খারাপ কাজের জন্য লাখ লাখ মানুষ পালাতে বাধ্য হয়েছেন। তাঁদের কোনো দেশ নেই। কেন্দ্রীয় সরকারের উচিত, বিষয়টি নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে কথা বলা। তাদের পরিচয়পত্র দেয়া। তাঁদের ফেরত পাঠানোর পথ প্রশস্থ করা। শুভাশিস মনে করেন, রোহিঙ্গাদের নিয়ে রাজনীতি একেবারেই কাম্য নয়।
অসমিয়া প্রতিদিনের দিল্লির ব্যুরো চিফ আশিস গুপ্ত মনে করেন, রোহিঙ্গাদের উদ্বাস্তুদের মর্যাদা দেয়া উচিত। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেছেন, রোহিঙ্গারা কম-বেশি অনেক রাজ্যেই আছে। কিন্তু তাঁদের উদ্বাস্তু মর্যাদা দেয়া হয়নি। বিশ্ব এখন বুঝে গেছে, রোহিঙ্গা মানবিক সমস্যা। অনেক দেশই তাঁদের সাহায্য করছে। বাংলাদেশ তো খুব ভালো কাজ করেছে। রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করছে। আর ভারতে তাঁদের নিয়ে রাজনীতি হচ্ছে।
অনিল দেশাইয়ের প্রশ্ন ছিল, রোহিঙ্গাদের কবে ফেরত পাঠানো হবে? মন্ত্রী অবশ্য তার কোনো জবাব দেননি।