ভারতে শুরু ভ্যাকসিন-বিতর্ক। প্রশ্ন উঠেছে, তৃতীয় পর্যায়ের পরীক্ষা শেষ হয়নি, তাও ভারত বায়োটেকের ভ্যাকসিন কেন অনুমোদন পেল?
বিজ্ঞাপন
অনুমোদনের পরেই ভারতেভ্যাকসিন-বিতর্ক তুঙ্গে। যথারীতি এর মধ্যে ঢুকে গিয়েছে রাজনৈতিক অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ। দেশাত্মবোধের জিগির এবং দেশের স্বার্থরক্ষার কথা এবং সেই সঙ্গে ভ্যাকসিন কতটা নিরাপদ সেই বিতর্ক।
ভারতে দুইটি ভ্যাকসিন অনুমোদন পেয়েছে। অক্সফোর্ড ও অ্যাস্ট্রোজেনেকার ভ্যাকসিন কোভিশিল্ড, যা তৈরি করছে পুণের সেরাম ইনস্টিটিউট। দ্বিতীয়টি হলো ভারত বায়োটেক এবং ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ সায়েন্টিফিক রিসার্চের তৈরি করা কোভ্যাকসিন। বিশেষজ্ঞ কমিটি প্রথমে অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনকে ছাড়পত্র দেয়। পরের দিন ভারত বায়োটেকের ভ্যাকসিনকেও। তারপর ড্রাগ কন্ট্রোলার অফ ইন্ডিয়া দুইটি ভ্যাকসিনকেও ছাড়পত্র দিয়েছেন।
বিতর্ক শুরু হয়েছে তারপর থেকেই। ভারত বায়োটেকের ভ্যাকসিন নিয়ে প্রধান আপত্তি হলো, কোভ্যাকসিনের তৃতীয় পর্যায়ের পরীক্ষা চলছে। এখনো শেষ হয়নি। সেই পরীক্ষার ফলাফল পুরোপুরি সামনে আসেনি। তার আগেই কি করে এই ভ্যাকসিনের অনুমোদন দেয়া হলো?
কংগ্রেসের একাধিক নেতা দাবি করেছেন, তৃতীয় পর্যায়ের পরীক্ষা শেষ হওয়ার আগে যেন কোভ্যাকসিন দেয়া না হয়। কংগ্রেস সাংসদ শশী থারুর টুইট করে বলেছেন, ''ভারত বায়োটেকের ভ্যাকসিনের অনুমোদন সময়ের আগেই দিয়ে দেয়া হয়েছে। এর ফল মারাত্মক হতে পারে। যতক্ষণ পর্যন্ত পরীক্ষা শেষ না হচ্ছে, ততক্ষণ এই ভ্যাকসিন যেন দেয়া না হয়।'' একই ধরনের আপত্তি জানিয়েছেন কংগ্রেস সাংসদ জয়রাম রমেশ, সমাজবাদী পার্টির সভাপতি অখিলেশ যাদব। তিনি তো আরো একধাপ এগিয়ে বলেছেন, বিজেপি-র ভ্যাকসিন তিনি অন্তত নেবেন না।
করোনা ভ্যাকসিন: কোন দেশের কী কৌশল
এক বছরেরও কম সময়ে করোনার কার্যকরী একাধিক ভ্যাকসিন আবিস্কার করেছে বিভিন্ন কোম্পানি৷ সেগুলো অনুমোদনও পেতে শুরু করেছে৷ আগেভাগে সংগ্রহে দেশগুলোর মধ্যে তোড়জোড় যেমন চলছে; তেমনি নাগরিকদের টিকা প্রদানে নেয়া হয়েছে বিভিন্ন কৌশল৷
ছবি: Allan Carvalho/NurPhoto/picture-alliance
পথ দেখালো যুক্তরাজ্য
আট ডিসেম্বর বায়োনটেক ও ফাইজারের টিকার প্রথম ডোজ নেন ৯০ বছরের মার্গারেট৷ যুক্তরাজ্যে প্রথম আট লাখ টিকা পাবেন তার মতো প্রবীণ, সামনের সারির স্বাস্থ্যকর্মীসহ বাকি বয়স্ক নাগরিকরা৷ ফাইজারের কাছে মোট চার কোটি ডোজ টিকার অর্ডার দিয়েছে দেশটি; যার মাধ্যমে দুই ডোজ করে দুই কোটি মানুষের ভ্যাকসিনের নিশ্চয়তা মিলছে৷ পাঁচ কোটি ত্রিশ লাখ নাগরিকের সবাইকে টিকা দিতে যুক্তরাজ্যকে নির্ভর করতে হবে অন্য কোম্পানিগুলোর উপরে৷
ছবি: Jacob King/AP Photo/picture alliance
প্রস্তুত যুক্তরাষ্ট্র
বায়োনটেক-ফাইজারের টিকার প্রয়োগ শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্রও৷ দেশব্যাপী ছড়ানো বিতরণ কেন্দ্রগুলোতে ২৯ লাখ ডোজ টিকার প্রথম চালান পৌঁছেছে৷ ফাইজার থেকে আরো ২০ লাখ আর মডার্নার ৫৯ লাখ ডোজের চালান ছাড় হতে পারে আসছে সপ্তাহে৷ এই দুই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেই ৩০ কোটি ডোজ ভ্যাকসিনের চুক্তি যুক্তরাষ্ট্রের৷ প্রথম ধাপে স্বাস্থ্যকর্মী, নার্সিং হোমে বসবাসরত, জরুরি সেবায় নিয়োজিত এবং দীর্ঘস্থায়ী ব্যধিতে আক্রান্তরা টিকা পাবেন৷
ছবি: Bran Woolston/REUTERS
ক্যানাডার তোড়জোড়
মডার্নার কাছ থেকে এক লাখ ৬৮ হাজার ডোজ ভ্যাকসিন পেতে সম্প্রতি চুক্তি করেছে ক্যানাডা৷ শর্ত অনুযায়ী অনুমোদন পাওয়ার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে এই চালান ছাড় শুরু করবে কোম্পানিটি৷ তবে তার আগেই ফাইজারের টিকা পৌঁছে গেছে দেশটিতে৷ ১৬ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়েছে প্রয়োগও৷
ছবি: Adrian Wyld/REUTERS
দেরি করেনি সৌদি
আরব নিউজের সংবাদ অনুযায়ী, ১৬ ডিসেম্বর সৌদি আরবে বায়োনটেক-ফাইজারের টিকার প্রথম চালান পৌঁছায়৷ পরের দিন থেকেই শুরু হয়েছে প্রয়োগ৷ টিকা পেতে একদিনে মোট দেড় লাখ মানুষ অনলাইনে নিবন্ধন করেছেন৷ সবাইকে বিনামূল্যে দেয়ার কথা থাকলেও অগ্রাধিকারভিত্তিতে পাবেন ৬৫ বছরের বেশি বয়সি, বিভিন্ন ব্যাধিতে আক্রান্ত রোগী আর স্বাস্থ্যকর্মীরা৷
ছবি: Ahmed Yosri/REUTERS
শুরু হচ্ছে ইসরায়েলে
ইসরায়েলের গণমাধ্যম হারিৎস-এর তথ্য অনুযায়ী ১৯ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু প্রথম টিকা নেবেন দেশটিতে৷ এরপর প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে পাবেন বাকি জ্যেষ্ঠ নেতৃবৃন্দ ও স্বাস্থ্যকর্মীরা৷ সাধারণ নাগরিকদের টিকা প্রদান শুরু হবে আসছে সপ্তাহে৷ শুরুতে অগ্রাধিকার পাবেন বয়স্করা৷ প্রাথমিক পর্যায়ে ফাইজারের কাছ থেকে কয়েক লাখ ভ্যাকসিন নিচ্ছে দেশটি৷ দ্বিতীয় ধাপের ট্রায়ালে রয়েছে নিজেদের উদ্ভাবিত একটি ভ্যাকসিনও৷
ছবি: Abir Sultan/REUTERS
অপেক্ষায় জার্মানি
নভেম্বরের শুরুতেই টিকা কর্মসূচির কৌশল নির্ধারণ করেছে জার্মানির সরকার৷ ইইউর মাধ্যমে ৩০ কোটি টিকার অর্ডার দিয়েছে দেশটি৷ টিকা পাওয়া মাত্র দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ৬০ টি বিতরণ কেন্দ্রে সেগুলো পৌঁছে দেবে সরকার৷ তবে সাধারণ মানুষকে এর আওতায় আসতে বেশ কয়েক মাস অপেক্ষায় থাকতে হবে৷ কেননা, শুরুতে প্রাধান্য পাবেন বয়স্ক ও স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে থাকা নাগরিকরা৷ এই তালিকায় আছেন স্বাস্থ্যকর্মী ও করোনা চিকিৎসায় নিয়োজিতরাও৷
ছবি: Ralph Orlowski/REUTERS
জাপানে মহাযজ্ঞ
নিজেদের ১২ কোটি জনগোষ্ঠীর সবার জন্য আগামী জুনের মধ্যে করোনার টিকা নিশ্চিত করতে চায় জাপান সরকার৷ এজন্য ফাইজার, আস্ট্রাজেনেকা, মডার্নার কাছ থেকে ২৯ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন কেনার চুক্তি হয়েছে৷ জনগণকে বিনা খরচেই এই টিকা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেশটির সরকার গত অক্টোবরেই৷ ভ্যাকসিন সংরক্ষণে এরই মধ্যে সাড়ে দশ হাজার ডিপ ফ্রিজার কেনাসহ মহাযজ্ঞ হাতে নেয়া হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/Kyodo/MAXPPP
শেষ ধাপে চীন
পরীক্ষার শেষ ধাপে রয়েছে চীনের বিভিন্ন কোম্পানির বেশ কয়েকটি টিকা৷ সেগুলো চূড়ান্ত অনুমোদন না পেলেও জরুরি ভিত্তিতে এরই মধ্যে ১০ লাখ স্বাস্থ্যকর্মী ও ঝুঁকিতে থাকা নাগরিককে পরীক্ষামূলক টিকা দেয়া হয়েছে৷ বিভিন্ন প্রদেশের সরকার আগেভাগেই কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে জনসংখ্যার হিসাবে টিকার অগ্রিম অর্ডার দিয়ে রেখেছে৷ কারা আগে ভ্যাকসিন পাবেন তার অগ্রাধিকার তালিকাও তৈরি করছে প্রশাসন৷
ছবি: Wang Zhao/AFP/Getty Images
একাধিক টিকার অপেক্ষায় ভারত
আগামী ছয় থেকে আট মাসের মধ্যে ৩০ কোটি নাগরিককে টিকা দেয়ার পরিকল্পনা মোদী সরকারের৷ প্রথম ধাপের এই টিকা কর্মসূচীর আওতায় আসবেন স্বাস্থ্যকর্মী ও পঞ্চাশোর্ধ্বরা৷ এতে খরচ হবে ১৪০ থেকে ১৮০ কোটি ডলার৷ পুরো প্রক্রিয়ায় জড়িত থাকবে ২৩টি মন্ত্রণালয়৷ যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ও আস্ট্রাজেনেকা, রাশিয়ার স্পুটনিক এবং ভারতীয় জাইডাস কেডিলা ও ভারতী বায়োটেকের টিকা আছে সম্ভাব্য প্রাপ্তির তালিকায়৷
ছবি: Dado Ruvic/REUTERS
চীনে চোখ পাকিস্তানের
চীনের একটি টিকার তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল চলছে পাকিস্তানে৷ ভ্যাকসিন কেনার জন্য ইমরান খান সরকারের এখন পর্যন্ত ঘোষিত বাজেট ২৫ কোটি ডলার৷ এই অর্থ দিয়ে একাধিক টিকা কোম্পানির সঙ্গে চুক্তির পরিকল্পনা তাদের৷ প্রথম পর্যায়ে অগ্রাধিকার পাবেন কোভিড চিকিৎসায় নিয়োজিত স্বাস্থকর্মী এবং ৬৫ বছরের বেশি বয়সীরা৷ পরবর্তী ধাপে গুরুত্ব দেয়া হবে বাকি স্বাস্থ্যকর্মী এবং ষাটোর্ধ্বদের৷
ছবি: Aamir Qureshi/AFP/Getty Images
অক্সফোর্ডের ভরসায় বাংলাদেশ
অক্সফোর্ড-আস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন পেতে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে চুক্তি করেছে বাংলাদেশের বেক্সিমকো৷ যার মাধ্যমে পাওয়া যাবে তিন কোটি টিকা৷ এতে দেড় কোটি মানুষকে টিকার আওতায় আনা যাবে৷ টিকা প্রদানে অগ্রাধিকারের জন্য ১০ ধরনের জনগোষ্ঠীর তালিকা করেছে সরকার৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/J. Cairns
11 ছবি1 | 11
তাঁরা যে প্রশ্ন তুলেছেন, তা বিশেষজ্ঞদের মনেও আছে। এর আগে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট যখন তাঁদের ভ্যাকসিন স্পুটনিক ৫ চালু করার কথা ঘোষণা করেন, তখন প্রশ্ন ওঠে, পুরো পরীক্ষা না করে ভ্যাকসিন চালু করা বিপজ্জনক এবং অনুচিত। ভারত বায়োটেকের ভ্যাকসিন নিয়ে আপত্তি এখানেই।
কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষবর্ধন এই সব অভিযোগ সরাসরি খারিজ করে দিয়ে বলেছেন, ''এর পিছনে আছে নিখাদ রাজনীতি। শশী থারুররা এই সব কথা বলে নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছেন। সব বৈজ্ঞানিক প্রটোকল অনুসরণ করেই কোভ্যাকসিনের অনুমোদন দেয়া হয়েছে।'' ড্রাগ কন্ট্রোলার জানিয়েছেন, দুইটি ভ্যাকসিনই ১১০ শতাংশ নিরাপদ।
বিজেপি সভাপতি জে পি নাড্ডার দাবি, ''কংগ্রেস ও বিরোধীরা ভারতের সাফল্য দেখতে পারে না। তাদের এটুকু বোঝা উচিত, তারা যে মিথ্যা কথাগুলো বলছে, তাতে স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীগুলি সুবিধা পাবে।'' থারুরের জবাব, ''ভারতের ভ্যাকসিন সফল হলে আমিও গর্ববোধ করব। কিন্তু সেটা তৃতীয় পর্যায়ের পরীক্ষায় ভ্যাকসিন নিরাপদ ও কার্যকর প্রমাণিত হওয়ার পরেই।''
এটা ঘটনা, ভারত বায়োটেকের তৃতীয় পর্যায়ের পরীক্ষা চলছে। ২৯ ডিসেম্বর তাঁরা জানিয়েছিলেন, ১২ হাজার মানুষের শরীরে ভ্যাকসিনের তৃতীয় পর্যায়ের পরীক্ষা হয়েছে। তাঁদের ভ্যাকসিন সম্পূর্ণ নিরাপদ।
প্রশ্ন হলো, পরীক্ষাপর্ব কবে শেষ হবে, কোভ্যাকসিনের উৎপাদন কবে শুরু হবে, প্রতি মাসে কত তৈরি হবে? অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন যেমন এখনই পাঁচ কোটি তৈরি আছে। আর মাস দুয়েকের মধ্যে আট কোটি ভ্যাকসিন তৈরি হয়ে যাবে। তারা সরকারকে ভ্যাকসিন ২০০ টাকায় দেবে। আর সরকার অনুমতি দিলে বাইরে এক হাজার টাকায় বিক্রি করতে চায়। স্বাস্থ্য মন্ত্রক সূত্র জানাচ্ছে, এমন সম্ভাবনাও আছে, অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনই প্রথমে দেয়া হবে। কোভ্যাকসিনকে প্রথমে রাখা হবে ব্যাক আপ হিসাবে।
দীর্ঘদিন ধরে স্বাস্থ্য মন্ত্রক কভার করছেন প্রবীণ সাংবাদিক অবন্তিকা ঘোষ। ডয়চে ভেলেকে তিনি জানিয়েছেন, ''সরকারের দাবি, এই ভ্যাকসিন ভালোভাবে কাজ করবে। তবে ভারত যদি বিশ্বে ভ্যাকসিন সরবরাহ করতে চায়, তা হলে এই ধরনের সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একটা প্রভাব ফেলতে পারে।''