অ্যাসিড সন্ত্রাস আজও এক কঠিন বাস্তব৷ ক্রোধ, ঘৃণা বা প্রতিশোধের কারণ দেখিয়ে অ্যাসিড ছুড়ে কারও মুখচ্ছবি নষ্ট করে দেওয়ার মতো ঘৃণ্য, জঘণ্য অপরাধ রুখতে ভারতে আরও কড়া আইন পাশ করা হয়েছে৷
বিজ্ঞাপন
রেশমা কুরেশির বয়স এখন ১৮৷ এক পারিবারিক বিবাদের জের ধরে এক আত্মীয় ও তার বন্ধুরা তাঁর মুখে অ্যাসিড নিক্ষেপ করে৷ হামলার পর চিকিৎসার জন্য আত্মীয়-স্বজনদের অনেক ঋণ নিতে হয়েছে৷ ডাক্তাররা বলেছেন, আরও ১০টি অপারেশন করতে হবে৷ আদালত রেশমার জন্য এক লক্ষ ভারতীয় টাকার ক্ষতিপূরণের রায় দেয়৷ রাষ্ট্রকেই সেই ক্ষতিপূরণ দিতে হবে৷ কিন্তু এর পর প্রায় পাঁচ মাস পেরিয়ে গেছে৷ রেশমা একটি পয়সাও হাতে পাননি৷ অ্যাসিড হামলার ফলে তাঁর একটি চোখ নষ্ট হয়ে গেছে৷ বদলে গেছে জীবনযাত্রা৷ বিকৃত মুখ নিয়ে রেশমা বাড়ির বাইরে যেতে চান না৷ অথচ হামলার আগে পর্যন্ত বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে হইচই করতে ভালোবাসতেন এই তরুণী৷
অ্যাসিড সন্ত্রাস!
একটা সময় বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে প্রায়ই আসতো নারীর ওপর অ্যাসিড নিক্ষেপের খবর৷ এমন বর্বরোচিত হামলা এখনও হয় কিছু দেশে৷ কয়েকটি দেশ ঘুরে জার্মান ফটোগ্রাফার অ্যান-ক্রিস্টিন ভোর্ল-এর তোলা ছবি নিয়ে আজকের ছবিঘর৷
ছবি: DW/M. Griebeler
বাংলাদেশের ফরিদা
ফরিদার স্বামী ছিলেন ড্রাগ এবং জুয়ায় আসক্ত৷ ঋণের দায়ে একসময় বাড়িটাও বিক্রি করে দেয় নেশাগ্রস্ত লোকটি৷ রেগেমেগে ফরিদা বলেছিলেন, এমন স্বামীর সঙ্গে আর ঘর করবেন না৷ সেই রাতেই হলো সর্বনাশ৷ ঘুমন্ত ফরিদার ওপর অ্যাসিড ঢেলে দরজা বন্ধ করে দিল পাষণ্ড স্বামী৷ যন্ত্রণায় চিৎকার করছিলেন ফরিদা৷ প্রতিবেশীরা এসে দরজা ভেঙে উদ্ধার করে তাঁকে৷
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
মায়ের স্নেহে, বোনের আদরে...
অ্যাসিডে ঝলসে যাওয়ার সময় ফরিদা ছিলেন ২৪ বছরের তরুণী৷ ১৭টি অস্ত্রোপচারের পর এখন কিছুটা সুস্থ৷ তবে সারা গায়ে রয়েছে দগদগে ঘায়ের চিহ্ন৷ পুড়ে যাওয়া জায়গাগুলোর ত্বক মসৃণ রাখতে প্রতিদিন মালিশ করে দেন মা৷ নিজের কোনো বাড়ি নেই বলে মায়ের সাথেই বোনের বাড়িতে থাকেন ফরিদা৷
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
উগান্ডার ফ্লাভিয়া
ফ্লাভিয়ার ওপর এক আগন্তুক অ্যাসিড ছুড়ে মেরেছিল ৫ বছর আগে৷ আজও ফ্লাভিয়া জানেন না, কে, কেন তাঁর ওপর হামলা চালালো৷ বিকৃত চেহারা নিয়ে অনেকদিন ঘরেই ছিলেন৷ বাইরে যেতেন না৷ এক সময় ফ্লাভিয়ার মনে হলো, ‘‘এভাবে ঘরের কোণে পড়ে থাকার মানে হয় না৷ জীবন এগিয়ে চলে৷ আমাকেও বেরোতে হবে৷’’
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
আনন্দময় নতুন জীবন
এখন প্রতি সপ্তাহে একবার সালসা নাচতে যায় ফ্লাভিয়া৷ আগের সেই রূপ নেই, তাতে কী, বন্ধুদের কাছে তো রূপের চেয়ে গুণের কদর বেশি! ফ্লাভিয়া খুব ভালো নাচ জানেন৷ তাই একবার শুরু করলে বিশ্রামের সুযোগই পান না৷ এভাবে পরিবার আর বন্ধুদের সহায়তায় আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছেন ফ্লাভিয়া৷
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
ভারতের নীহারি
নীহারির বয়স তখন ১৯৷ একরাতে আত্মহত্যা করার জন্য আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন নিজের শরীরে৷ স্বামীর মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন থেকে মুক্তি পাওয়া জরুরি মনে হয়েছিল তখন৷
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
নতুন রূপ
যে ঘরটিতে বসে নীহারি তাঁর চুল ঠিক করছেন এটা ছিল বাবা-মায়ের শোবার ঘর৷ এখানেই নিজেকে শেষ করে দিতে চেয়েছিলেন৷ দেয়াশলাইয়ের বাক্সে একটা কাঠিই ছিল৷ তা দিয়েই আগুন জ্বালিয়েছিলেন শরীরে৷ তবে এখন আর দুর্বল মনের মেয়েটি নেই নীহারি৷ নিজেকে সামলে নিয়ে একটা সংস্থা গড়েছেন৷ সংস্থাটির নাম, ‘পোড়া মেয়েদের রূপ’৷
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
পাকিস্তানের নুসরাত
দু-দুবার অ্যাসিড ছোড়া হয়েছে নুসরাতের ওপর৷ প্রথমে স্বামী আর তারপর দেবর৷ ভাগ্যগুণে বেঁচে আছেন নুসরাত৷ ভালোই আছেন এখন৷
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
আশার আলো
দু-দুবার অ্যাসিড হামলার শিকার হওয়ায় মাথার অনেকটা চুলও হারিয়েছেন নুসরাত৷ ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে মাথার ক্ষতস্থান পুরোপুরি সারিয়ে চুল এবং আগের হেয়ারস্টাইল ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করছেন তিনি৷
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
বন্ধুদের মাঝে...
নিজের ভাবনা, যন্ত্রণার অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করতে কিংবা গল্প করতে প্রায়ই অ্যাসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশন (এএসএফ)-এ যান নুসরাত৷ সেখানে এমন অনেকেই আসেন যাঁদের জীবনও অ্যাসিডে ঝলসে যেতে বসেছিল৷ এখন সকলেই জানেন, তাঁরা আর একা নন৷
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
9 ছবি1 | 9
আদালত ও সরকারের পক্ষ থেকে নানা পদক্ষেপ সত্ত্বেও যারা অ্যাসিড সন্ত্রাসের শিকার, তাদের জীবনযাত্রায় কোনো উন্নতি আসেনি বলে দাবি করছে অনেক সংগঠন৷ নতুন দিল্লি ভিত্তিক ‘স্টপ অ্যাসিড অ্যাটাক্স ক্যাম্পেন গ্রুপ'-এর কর্মী অলোক দিক্ষীত সংবাদ সংস্থা এএফপি-কে বলেছেন, এ বিষয়ে এখনো যথেষ্ট সচেতনতার অভাব রয়েছে৷ কর্তৃপক্ষও সময় নষ্ট করছে৷ ভারতের সর্বোচ্চ আদালত – সুপ্রিম কোর্ট গত বছরের জুলাই মাসে অ্যাসিড বিক্রির উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার নির্দেশ দিয়েছিল৷ অথচ আজও সহজেই অ্যাসিড কেনা যায়৷ যারা অ্যাসিড সন্ত্রাসের শিকার, তাদের জন্য আদালত ৩ লক্ষ ভারতীয় টাকা ক্ষতিপূরণেরও নির্দেশ দিয়েছিল৷ হামলার ১৫ দিনের মধ্যেই তার এক-তৃতীয়াংশ হস্তান্তর করার কথা৷ অলোক দিক্ষীত বলেন, তাঁর কাছে যে খবর এসেছে, সেই অনুযায়ী ১০০ জনের মধ্যে মাত্র দু'জন ক্ষতিপূরণের পুরো অঙ্ক হাতে পেয়েছে৷ সেই প্রক্রিয়ায়ও অনেক বিলম্ব ঘটেছে৷
অ্যাসিড হামলার ক্ষেত্রে ভারতে পুলিস ও প্রশাসনের মনোভাবের কড়া সমালোচনা শোনা যায়৷ অপরাধীদের বিরুদ্ধে তদন্ত ও তাদের শাস্তি দেওয়ার বিষয়ে পুলিশ গড়িমসি করে৷ আদালতে মামলাও সহজে শেষ হতে চায় না৷ এই অবস্থায় অ্যাক্টিভিস্টরা সরকার ও প্রশাসনের উপর নির্ভর না করে ‘ক্রাউডফান্ডিং' বা জনগণের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করার পথে এগোচ্ছেন৷ যেমন ‘মেক লাভ নট স্কার্স' নামের এক অভিযানের আওতায় রেশমার জন্য প্রায় ২,২০০ ডলার সংগ্রহ করার চেষ্টা চলছে৷ তবে হাসপাতালের খরচ আরও বেড়ে যাবে বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে৷