২০০৬ সালের বনভূমি অধিকার রক্ষা আইনে বলা হয়েছে, জঙ্গল বা তার ধারে কাছে বসবাসকারী পরিবারগুলিকে জমির মালিক হিসেবেই গণ্য করা হবে৷ কিন্তু সরকারি নিষ্ক্রিয়তায় সেই সংক্রান্ত নথিপত্র দেখাতে পারেননি বনবাসীরা৷
অন্তত ১৭টি রাজ্য থেকে ১০ লাখেরও বেশি বনবাসী উপজাতি ও অন্যান্য জনজাতি পরিবারগুলিকে উচ্ছেদের নির্দেশ দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট৷ ২০০৬ সালের অরণ্য অধিকার আইনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে কিছু অরণ্যপ্রেমী সংগঠনের দায়ের করা জনস্বার্থ মামলার প্রেক্ষিতে এই নির্দেশ৷
আইনে কী ছিল?
আইনে বলা হয়েছে, যে-সব উপজাতি পরিবার বংশপরম্পরায় অরণ্যভূমিতে বসবাস করছে, চাষাবাদ করছে এবং সেখান থেকেই তাঁদের জীবিকা নির্বাহ করছে সেখানে তাঁদের থাকার অধিকার আছে৷ আইন প্রণয়নের দিন পর্যন্ত বনবাসীরা যে যেখানে বাস করছেন, তিনি বা তাঁরা জমির মালিক বলে গণ্য হবেন৷
কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার এবং বিভিন্ন রাজ্য সরকার নানা অজুহাতে জমির মালিকানাপত্র, যাকে পাট্টা বলে, তা দিতে গড়িমসি করে৷
ফলে নিরক্ষর বনবাসী পরিবারগুলির পক্ষে ঐ সংক্রান্ত নথিপত্র জোগাড় করা সম্ভব না হওয়ায় তাঁদের জমির মালিকানাসত্ত্ব খারিজ হয়ে যায়৷
এর জেরে ১৭টি রাজ্যের এই রকম ১০ লাখেরও বেশি জনজাতি পরিবার, যারা জমির পাট্টা জোগাড় করতে পারেনি, কিংবা পাট্টার আবেদন খারিজ হয়ে যাওয়া পরিবারগুলিকে ২৭ জুলাইয়ের মধ্যে উত্খাত করার নির্দেশ দেন সর্বোচ্চ আদালত৷
জাতিসংঘের হিসেবে বিশ্বে প্রায় ৩৭ কোটি আদিবাসী রয়েছে৷ অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার প্রায় পাঁচ শতাংশই এই গোষ্ঠীর অন্তর্গত৷ ছবিঘরে থাকছে কয়েকটি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর কথা৷
ছবি: picture-alliance/Sandra Gätkeব্রাজিলের কায়াপো গোষ্ঠীর এই সদস্যকে দেখলে মনে হতে পারে তাঁরা বোধ হয় অনেক আধুনিক৷ কিন্তু না৷ আসলে তাঁদের অবস্থান বিশ্বের অন্যতম অরক্ষিত ও সুবিধাবঞ্চিতদের দলে৷
ছবি: APছবিতে গ্রিনল্যান্ডের ইনুইট-দের একজনকে দেখা যাচ্ছে৷ মেক্সিকো ও মধ্য অ্যামেরিকার মায়া গোষ্ঠী থেকে শুরু করে আফ্রিকা কিংবা উপমহাদেশ, প্রায় সব জায়গায় আদিবাসীদের বাস৷ জানা গেছে, ৯০টি দেশে প্রায় পাঁচ হাজার আদিবাসী গোষ্ঠী রয়েছে৷
ছবি: Getty Imagesমরক্কোর ব্যারব্যার বা বর্বর গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত এঁরা৷ উত্তর আফ্রিকার প্রায় নয়টি দেশে এই আদিবাসীদের বাস৷ তাঁদের অনেকেই ‘তামাঝিঘট’ ভাষায় কথা বলেন যেটা আফ্রো-এশিয়ান ভাষা পরিবারের অন্তর্গত এবং প্রাচীন মিশরীয় ও ইথিওপীয় ভাষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট৷ আরবি সংস্কৃতির আগ্রাসন থেকে নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে বাঁচাতে ব্যারব্যারদের অনেক লড়তে হয়েছে৷
ছবি: Getty Imagesইকুয়েডরের অ্যামাজন রেনফরেস্ট এলাকায় ওয়াওরানিদের বসবাস৷ সাম্প্রতিক সময়ে তাঁদের একটা অংশ ‘ইয়াসুনি ন্যাশনাল পার্ক’-এ নির্মিত ঘরবাড়িতে বসবাস শুরু করেছে৷ তবে আরেকটা অংশ এখনও বহির্বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে আগ্রহী নয়৷ এর চেয়ে বানর আর পাখি শিকার করে জীবন কাটাতেই পছন্দ করছেন তাঁরা৷
ছবি: APভারতের ওড়িশার এই আদিবাসীরা সম্প্রতি ব্রিটিশ এক কোম্পানির প্রস্তাবিত খননকাজের প্রকল্প বাস্তবায়ন রুখে দিয়েছে৷ এই খননকাজে নিজেদের পবিত্র পাহাড় কাটা পড়ার বাস্তবতা তাঁরা মেনে নেননি৷ তবে বিশ্বের অন্য সব আদিবাসীদের পক্ষে যে এভাবে উন্নয়নের নামে এমন সব প্রকল্পের কাজ বন্ধ করে দেয়া সম্ভব হয়েছে তা নয়৷ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বরং উল্টোটাই হয়েছে৷
ছবি: Survival Internationalআদিবাসী নারী ও মেয়েরা অনেকসময় গুণগত শিক্ষা পায় না৷ তবে পেরুর কুসকো অঞ্চলের আদিবাসীদের শিক্ষা দিতে ‘প্ল্যান’ নামের একটি বেসরকারি সংস্থা উদ্যোগ নিয়েছে৷ সংস্থাটি আদিবাসীদের শিক্ষা কার্যক্রমে তাদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতির মিশ্রণ ঘটানোর চেষ্টা করছে৷
ছবি: picture-alliance/Sandra Gätke উচ্ছেদের বিষয়ে সরকার কী পদক্ষেপ নিয়েছে, তা জানাতে সরকারকে আদালত নোটিশ দিয়েছে৷
প্রতিক্রিয়া
বিভিন্ন আদিবাসী অধিকার রক্ষা গোষ্ঠীগুলির অভিযোগ, চূড়ান্ত শুনানির দিনে তাঁদের পক্ষ হয়ে কথা বলার জন্য সরকারের তরফে কোনো আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন না৷ তাঁদের সমস্যার বিহিত করতে গোড়া থেকেই সরকার উদাসীন৷ ফলে ২০০৬ সালের জনজাতি গোষ্ঠীগুলির অরণ্যের অধিকার আইনের মূল উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়ে যায়৷ তাঁদের বংশানুক্রমিক আবাসভূমি থেকে আজ তাঁরা উচ্ছেদের সন্মুখীন৷
বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি মোদী সরকারের ঘাড়ে দোষ চাপাতে চায়৷ কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী মনে করেন, এই বিষয়ে মোদী সরকার আগাগোড়া নীরব দর্শক হয়ে থাকেন৷ এতে বোঝা যায়, আদিবাসী ও জনজাতিদের প্রতি সরকার কতটা নির্বিকার৷ লক্ষ লক্ষ গরিব আদিবাসী কৃষিজীবী পরিবার তাদের চিরাচরিত বাসভূমি থেকে উত্খাত হলে মোদী সরকারের কিছু যায় আসে না৷ ফেসবুকে তিনি লিখেছেন, জল, জঙ্গল ও জমি আদিবাসীদের জীবনধারণের এক অঙ্গ৷ কংগ্রেস-শাসিত রাজ্যগুলিকে এই মর্মে চিঠিও দিয়েছেন রাহুল গান্ধী৷
এদিকে, কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া (মার্ক্সিস্ট) বা সিপিআই-এম তরফে বলা হয়েছে, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের প্রেক্ষিতে মোদী সরকারের উচিত অবিলম্বে অর্ডিন্যান্স জারি করে আদিবাসীদের চিরাচরিত অরণ্য বাসভূমি থেকে উচ্ছেদ আটকানো৷ আদালতের নির্দেশে তাঁরা বিনাদোষে শাস্তি পাবে৷ এজন্য কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলি সমান দায়ী৷ মোদী সরকার আগেই বনভূমির অধিকার রক্ষা আইন শিথিল করেছিল৷
উল্লেখ্য, ভারতে প্রায় চার কোটি হেক্টর বনভূমিতে বসবাস করে প্রায় ১০ কোটি আদিবাসী ও অন্যান্য জনজাতি৷ এদের উচ্ছেদ করার পেছনে আপাত কারণ হলো, খনি ও কলকারখানার জন্য আরো জমি চাই৷ জীববৈচিত্র্যকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে শিল্পোদ্যোগীদের হাতে জমি তুলে দেওয়া চাই৷ ঝাড়খন্ডে কয়েক হাজার বনভূমি এলাকা দখল করে নিয়েছে আদানি কোম্পানি৷ তাদের হয়ে প্রমাণ ও পুলিশ দুই-ই জুগিয়েছে সরকার৷ এই রকমভাবে আদিবাসীদের বনভূমি আবাস কেড়ে নিয়ে খনি হয়েছে, বাঁধ হয়েছে, কারখানা হয়েছে৷ তাঁরা পেয়েছে শুধু অবিচার আর বঞ্চনা৷
পহেলা বৈশাখে অনেক আদিবাসী গোষ্ঠীও বর্ষবরণ করে থাকেন৷ এছাড়া আছে অন্যান্য উৎসবও৷ ছবিঘরে আদিবাসীদের কয়েকটি উৎসবের কথা থাকছে৷
ছবি: hello.bdnews24.comত্রিপুরা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের ‘বৈসুক’, মারমাদের ‘সাংগ্রাই’ আর চাকমাদের ‘বিজু’ – এই তিন উৎসবের নামের প্রথম অক্ষর থেকে ‘বৈসাবি’ উৎসবের নাম এসেছে৷ তিনটিই বর্ষবরণের অনুষ্ঠান৷ ফলে পার্বত্য এলাকার আদিবাসীরা সবাই মিলে বৈসাবি উৎসবে অংশ নেয়ার মাধ্যমে নতুন বছরকে স্বাগত জানায়৷ উপরের ছবিটি সাংগ্রাই উৎসবের৷
ছবি: bdnews24.comবাংলা বছরের শেষ দু’দিন ও নতুন বছরের প্রথম দিন এই উৎসব হয়৷ অনুষ্ঠানের প্রথম দিন ‘ফুল বিজু’ নামে পরিচিত৷ এই দিন ভোরে পানিতে ফুল ভাসানো হয়৷ তরুণ-তরুণীরা পাড়ার বৃদ্ধদের গোসল করিয়ে দেয়৷ তবে বিজু উৎসবের মূল দিন নববর্ষের প্রথম দিন৷ চাকমা ভাষায় এই দিনটির নাম গজ্জ্যেপজ্জ্যে, অর্থাৎ গড়াগড়ি খাওয়ার দিন৷ এই দিন ভালো খাবার রান্না করা হয়৷ কারণ মনে করা হয়, বছরের প্রথম দিন ভালো রান্না করলে বছরজুড়ে অভাব থাকবে না৷
ছবি: Sanchay Chakmaপার্বত্য চট্টগ্রামের দ্বিতীয় বৃহত্তম আদিবাসী গোষ্ঠী মারমারা পহেলা বৈশাখে নববর্ষ উদযাপন করলেও বাংলা পঞ্জিকা অনুসরণ করে না৷ তারা বর্মীপঞ্জি, অর্থাৎ বার্মা মিয়ানমারের ক্যালেন্ডার মেনে চলে৷ সাংগ্রাই উৎসবের মূল আকর্ষণ ‘রিলং পোয়েহ্’৷ এটি পানি ছো়ড়াছুড়ির খেলা৷ মারমা তরুণ-তরুণীরা একে অপরকে পানি ছিটিয়ে ভিজিয়ে দেয়৷ তাঁদের বিশ্বাস, এর মাধ্যমে অতীতের সকল দুঃখ-গ্লানি ও পাপ ধুয়ে-মুছে যায়৷
ছবি: bdnews24.comচাকমাদের বিজুর মতো এই উৎসবও তিনদিনের৷ নববর্ষের প্রথম দিন বয়স্করা ছোটদের আশীর্বাদ করেন৷ আর কিশোরীরা কলসি কাঁখে নিয়ে বয়স্কদের খুঁজে খুঁজে গোসল করায়৷ তরুণ-তরুণীরা রং খেলায় মেতে ওঠে৷ একজন আরেকজনকে রং ছিটিয়ে রঙিন করে দিয়ে গোসল করে আবারো আনন্দে মেতে ওঠে৷
ছবি: Sanchay Chakmaতঞ্চঙ্গ্যাদের বর্ষবরণ অনেকটা চাকমাদের মতোই৷ উৎসবের প্রথম দিন মেয়েরা ফুল সংগ্রহ করে ঘর সাজায়৷ পরদিন সবাই গোসল করে নতুন জামা-কাপড় পরে আনন্দ-ফূর্তি করে৷ ঘরে ঘরে ঐতিহ্যবাহী খাবার আর পিঠার আয়োজন করা হয়৷ রাতে ‘ঘিলা’ নামের এক খেলায় মেতে ওঠে সবাই৷ আর নববর্ষের দিন তরুণ-তরুণীরা বয়স্কদের গোসল করায়৷
ছবি: Sanchay Chakmaমূল উৎসবের দিন মুরংরা বাঁশি বাজিয়ে ‘পুষ্প নৃত্য’ করতে করতে মন্দির প্রদক্ষিণ করে৷ ম্রো সমাজে লাঠি খেলা খুবই জনপ্রিয়৷ তাই চাংক্রানের মূল দিনে তারা এই খেলা খেলে থাকে৷
ছবি: bdnews24.comসমতলের আদিবাসীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠান ‘কারাম উৎসব’ বা ‘ডাল পূজা’৷ ওঁরাও, সাঁওতাল, মালো, মুন্ডা, মাহাতো, ভুইমালি, মাহলীসহ বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ একসঙ্গে এই উৎসবে অংশ নিয়ে থাকে৷ এই আদিবাসীরা ‘কারাম’ নামক একটি গাছের ডালকে পূজা করেন বলে এই উৎসবের আরেক নাম ‘ডাল পূজা’৷
ছবি: bdnews24.comআদিবাসী সাঁওতালদের কাছে গৃহপালিত গরু, মহিষের গুরুত্ব অনেক৷ সহরায় উৎসবে এসব প্রাণীর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়৷ উৎসবকে ঘিরে বিবাহিত মেয়েরা তাদের বাবার বাড়ি যাওয়ার সুযোগ পান৷ কারণ উৎসবে তাদের আমন্ত্রণ জানানো একটি রেওয়াজ৷ এই পরবের নির্দিষ্ট কোনো দিনক্ষণ নেই৷ গ্রামের মোড়লদের নিয়ে সভা করে উৎসবের দিন ঠিক করা হয়৷
ছবি: hello.bdnews24.com নির্বাচনের কয়েক মাস আগে সুপ্রিম কোর্ট এই আদেশ দিলেন৷ এর আগে কয়েকটি রাজ্যের ভোটের ফলাফলে বিজেপির বিরুদ্ধে আদিবাসীদের ক্ষোভ প্রতিফলিত হয়েছিল৷ কারণ আদিবাসী ও অন্যান্য জনজাতিরা ভোটের একটা বড় অংশ৷ আগামী সাধারণ নির্বাচনে তার অভিঘাত পড়বে না, কে বলতে পারে? সম্ভবত ভোটের দিকে তাকিয়ে বিজেপি এবং কংগ্রেস সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশ পুনর্বিবেচনা করার আর্জি জানাবে এমনটাই বলা হচ্ছে৷