প্রদীপের তলায় বড় বেশি অন্ধকার। ভারতীয় নারী ফুটবল দলের কথা লিখতে বসে প্রথমে এই তুলনাটাই এলো।
বিজ্ঞাপন
এখানে প্রদীপ হচ্ছে অবশ্যই ক্রিকেট। ভারতে খেলাধুলার জগতে যার ছটা বড়ই উজ্জ্বল। অর্থ, গ্ল্যামার, বলিউডের যোগ, অখ্যাত কোনো জায়গার অজানা মানুষের থেকে রাতারাতি চোখ ধাঁধানো প্রচারের আলোয় এসে জাতীয় নায়ক হয়ে ওঠার রূপকথার কাহিনি-এ সবই ভারতীয় ক্রিকেটকে আরো আকর্ষণীয় করে তুলেছে। আর তার নিচের অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে বাকি সব খেলা। নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে হারা ক্রিকেট টেস্টও সরাসরি দেখছিলেন প্রায় ২০ কোটি মানুষ।
অল ইন্ডিয়া ফুটবল ফেডারেশনের ২০২৩-২৪ সালের বাজেটে মেয়েদের সিনিয়র টিমের জন্য রাখা ছিল আট কোটি ৭০ লাখ টাকা। নারীদের ফুটবলের সাপোর্ট স্টাফের জন্য খরচ তিন কোটি থেকে কমিয়ে এক কোটি ৮২ লাখ করা হয়েছিল। অনূর্ধ ২০ ও ১৭ বছরের টিমের বাজেটও কমানো হয়েছিল।
ভারতের ১৭ জন নারী ক্রিকেটার বিসিসিআইয়ের কাছ থেকে শুধু বার্ষিক ভাতা হিসাবে তিন কোটি ৯০ লাখ টাকা পান। তাছাড়াও তারা প্রতিটি টেস্ট খেলার জন্য ১৫ লাখ, প্রতিটি ওয়ান ডে খেলার জন্য তিন লাখ এবং টি২০ খেলার জন্য ছয় লাখ টাকা পান। তার মানে ১৭ জন ভারতীয় নারী ক্রিকেট বোর্ডের কাছ থেকে যে পরিমাণ বার্ষিক ভাতা পান, তা নারী ফুটবলারদের পুরো বছরের বরাদ্দের থেকে বেশি। তাহলে নারীরা কোন খেলার দিকে ঝুঁকবেন, ক্রিকেট না ফুটবল?
অনূর্ধ ২০ এবং অনূর্ধ ১৭ মেয়ে ফুটবলারদের জন্য যদি বরাদ্দ কম হতে থাকে, তাহলে সেখান থেকে ফুটবলার উঠবে কী করে? যদি ভালো কোচের জন্য টাকার বরাদ্দ না থাকে, তাহলে নারী ফুটবলাররা ঠিক প্রশিক্ষণ পাবেন কী করে? জাতীয় দলের সব মেয়ে ফুটবলার লিখিতভাবে জানিয়েছিলেন, টমাস ডেনেরবিকে কোচ হিসাবে রেখে দেয়া হোক। তাঁর অধীনে আহামরি ফল না হলেও খুব খারাপও হয়নি। ২০টি ম্যাচের মধ্যে সাতটিতে ভারতীয় মেয়েরা জিতেছিল।
ভারতে মেয়েদের ঘরোয়া ফুটবলে অন্যতম সফল কোচ অ্যান্থনি স্যামসন অ্যান্ড্রুজকেও কোচ করা হলো না। তাঁর কোচিংয়ে কেরালা গোকুলম তিনবার মেয়েদের ফুটবল লিগ জিতেছে, ৪৬ ম্যাচের মধ্যে মাত্র দুইটিতে হেরেছে। এখন তিনি ইস্টবেঙ্গলে মেয়েদের টিমের কোচ। তাকে না করে কোচ করা হলো সন্তোষ কাশ্যপকে।
মেয়েদের সাফ ফুটবল ‘ডাবল’ : বর্ণে বর্ণে ছবিতে...
আসরের আগে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ পাননি, বেতনও পাননি৷ তাতে কী, পাকিস্তান, ভুটান, ভারত আর নেপালের বাধা পেরিয়ে হিমালয়ের দেশ থেকে সাফ ফুটবলের টানা দ্বিতীয় ট্রফি জিতে এনেছেন বাংলাদেশের মেয়েরা৷ তাদের জয়যাত্রা দেখুন ছবিঘরে ...
ছবি: DW
এভাবেও ফিরে আসা যায়
পাকিস্তানের বিপক্ষে নির্ধারিত ৯০ মিনিটে ১-০ গোলে পিছিয়ে বাংলাদেশ৷ ম্যাচের শেষ বাঁশি বাজার ঠিক আগে শামসুন্নাহার জুনিয়র করলেন দুর্দান্ত এক গোল৷ শেষ মিনিটের ওই গোলেই অক্সিজেন পেলো বাংলাদেশ৷ অথচ ম্যাচের ১০ মিনিটে পাকিস্তানের অধিনায়ক মারিয়া জামিলা খানের সঙ্গে ধাক্কা লেগে চোখের নিচে কেটে যায় শামসুন্নাহারের৷ কপালে ব্যান্ডেজ বেঁধে খেলেন এই ফরোয়ার্ড৷ এভাবেও যে ফিরে আসা যায়, মনে করিয়ে দিলেন শামসুন্নাহার৷
ছবি: DW
সিনিয়র-জুনিয়রের সেতু বন্ধনে ভারতকে হারানো
পাকিস্তানের ড্র করার পরের ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে প্রথম গোল উদযাপনের মধ্যমণি ডিফেন্ডার আফঈদা খন্দকার। এই ছবি দেখে কে বলবে, এক দিন আগেও দলের মধ্যে ঘটে গেছে বিদ্রোহ, যার কেন্দ্রে দলে সিনিয়র-জুনিয়র দেওয়াল। দেওয়াল তুলে দিয়েছেন কোচ পিটার বাটলার। মাসুরা, মারিয়া, তহুরাদের উল্লাসের সঙ্গী আফঈদার স্নিগ্ধ হাসিটাই বলে দিচ্ছিল এই দলটা ভালোবাসার এক সুতোয় বাঁধা।
ফাইনালে আকাশ ভেঙে যেন আওয়াজ ওঠে ‘নেপাল, নেপাল’। ওই আওয়াজ আরো ভয়ঙ্কর হয় নেপালিরা সমতায় ফিরলে। নেপালিরা তখনও জানতো না কে তাদের হৃদয় ভাঙার অপেক্ষায়। ঋতুপর্ণার জোরালো ক্রস নেপালের গোলরক্ষক আনজিলা তুমবাপোর গ্লাভসে চুমু খেয়ে ঢুকে যায় জালে। গ্যালারির সামনে ছুটে এসেছেন ঋতুপর্ণা চাকমা। তার মুখে আঙুল। ইশারায় চুপ করতে বলেন পুরো গ্যালারিকে। সত্যিকার অর্থেই সেদিন পুরো রঙ্গশালাকে চুপ করিয়ে দেন ঋতুপর্ণা।
ছবি: DW
পতাকা নিয়ে উচ্ছ্বাস নেপালি দর্শকের
নেপালের ফুটবল সংস্কৃতি বেশ উন্নত। পুরুষ বা নারী ফুটবল- যা-ই হোক না কেন ফাইনালের মঞ্চে স্বাগতিকরা থাকলে উপচে পড়ে গ্যালারি। ৩০ অক্টোবরও গালে নেপালের পতাকার রঙ এঁকে, গলায় জাতীয় পতাকা ঝুলিয়ে এসেছিলেন হাজারো দর্শক।
ছবি: DW
ঋতুপর্ণাই সেরা
ফাইনাল শেষে সঞ্চালক ঘোষণা দিলেন টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় হয়েছেন ঋতুপর্ণা চাকমা। আনন্দে ঋতুপর্ণার গলা চেপে ধরলেন শামসুন্নাহার জুনিয়র। আরেক হাত ওপরে তুলে ধরলেন শিউলি আজিম।
ছবি: DW
কৃষ্ণার সেলফিতে সেরা মুহূর্ত
পরপর দুবার দক্ষিণ এশিয়ার সেরার মুকুট বাংলাদেশের মেয়েদের মাথায়। এমন স্মৃতিময় মুহূর্ত সেলফিতে ধরে রাখার চেষ্টা কৃষ্ণা রানী সরকারের। আনন্দে শামিল মারিয়া, তহুরা, সানজিদা।
ছবি: DW
দশরথের গ্যালারিতে এক টুকরো বাংলাদেশ
গ্যালারি উপচে পড়া দর্শকের ভীড়ে কাঠমান্ডুতে এই দর্শকেরা যেন এক টুকরো বাংলাদেশের ছবি। যখনই মনিকা, ঋতুপর্ণাদের পায়ে বল পড়েছে ওমনি বাংলাদেশ ‘বাংলাদেশ’ বলে চিৎকার করেছেন এই দর্শকেরা।
ছবি: DW
সাবিনার হাতে স্বপ্নের ট্রফি
যে কীর্তি কখনো গড়তে পারেন বাংলাদেশ পুরুষ ফুটবল দল, কখনো দুবার জেতেনি সাফ। সেই কীর্তি গড়েছে মেয়েরা। টানা দুবার সাফে চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ। ট্রফি হাতে সাবিনাদের আনন্দটা তো এমনই হবে।
ছবি: DW
শিষ্যের ক্যামেরায় গুরুর স্মৃতি
কাঠমান্ডুর ত্রিভূবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ঢাকা ফেরার অপেক্ষায় বাংলাদেশ। চ্যাম্পিয়ন ট্রফি মাঝে রেখে কোচ পিটার বাটলার ও দলের ভিডিও অ্যানালিস্ট মেহেদি হাসান সিদ্দিকীর ছবি তুলছেন তহুরা খাতুন। তাদের সঙ্গে স্মৃতির স্যালুলয়েডে বন্দি হলেন শিউলি আজিম ও শামসুন্নাহার জুনিয়র।
ছবি: DW
বিমানে গর্বের ট্রফি
বাংলাদেশ বিমানে করে নেপাল থেকে ঢাকা ফেরেন সাফজয়ী মেয়েরা। গর্বের সেই ট্রফি ছুঁয়ে দেখার সৌভাগ্য হয় বাংলাদেশ বিমানের ক্যাপ্টেন, ক্রু, বিমানবালাদের। আকাশে হাজার হাজার ফুট উচ্চতায় অপরাজিতাদের সঙ্গে একটা স্মৃতিও রেখে দিলেন সবাই।
ছবি: DW
আকাশ থেকে হিমালয় দেখা
একদিন আগেই হিমালয় কন্যাদের হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশ। বিমানের জানালা দিয়ে এবার হিমালয় দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন সাফজয়ী কন্যারা। সেই স্মৃতি কেউ কেউ মুঠোফোনে বন্দি করেও রাখেন।
ছবি: DW
দেশের মাটিতে সাফজয়ীরা
ট্রফি হাতে বিজয়ীর বেশে ঢাকা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে সবার আগে অধিনায়ক সাবিনা খাতুন। এক পাশে (বাঁয়ে) টানা দুবার সেরা গোলরক্ষকের পুরস্কার পাওয়া রুপনা চাকমা। অন্য পাশে সেরা ফুটবলারের পুরস্কার হাতে ঋতুপর্ণা চাকমা।
ছবি: DW
ছাদখোলা বাসে সংবর্ধনা
দুই বছর আগে এভাবেই দেশে ফেরেন সাবিনারা। সেবারের মতো এবারও ছাদখোলা বাসে সারা শহর ট্রফি নিয়ে প্রদক্ষিণ করেন মেয়েরা। এরপর সন্ধ্যায় পৌঁছান মতিঝিলের বাফুফে ভবনে।
ছবি: DW
নগরবাসীর আগ্রহে সাবিনারা
পেছনে রঙের হোলি উৎসব। সামনে নগরবাসীর আগ্রহ। ছাদখোলা বাসে গর্বিত মেয়েরা। এমন আনন্দ-ক্ষণ ধরে রাখার কমতি ছিল না দেশের গণমাধ্যমের।
ছবি: DW
15 ছবি1 | 15
একসময় তিনি মোহনবাগানের কোচ ছিলেন। প্রত্যাশাপূরণ না করায় তাকে ছাঁটাই করে মোহনবাগান। তারপর কিছু ক্লাবে তিনি দায়িত্ব পেয়েছেন। কিন্তু জাতীয় স্তরে মেয়েদের দলের দায়িত্ব পেয়ে তিনি আবার একের পর এক হার উপহার দিয়েছেন। যেভাবে সাফ কাপে ভারত হেরেছে, তারপর এখানেও তাকে নিয়ে প্রশ্ন উঠে গেছে। ২০২১ সালের পর থেকে পাঁচবার কোচ বদল হলো, কিন্তু ভারতীয় মেয়ে ফুটবল দলের হার থামানো গেলো না।
২০১৯ সালের পর থেকে একবারও ভারতীয় মেয়েদের ফুটবল দল বাংলাদেশ বা নেপালকে হারাতে পারেনি। ২০২২ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত সাফ গেমসে ভারত ১৯টা ম্যাচ খেলে চারটিতে মাত্র জিতেছে। দুবার কিরগিজ রিপাবলিক, একবার এস্তোনিয়া ও একবার হংকংয়ের বিরুদ্ধে। পাঁচজন কোচের অধীনে তারা ৩৪টির মধ্যে ১২টি ম্যাচে জিততে পেরেছে। যারা ২০২১ সালে চাইনিজ তাইপেইয়ের মতো শক্তিশালী দলকে এক গোলে হারাতে পেরেছিল, তারা কেন তালিকায় নিচের দিকে থাকা টিমের কাছে বারবার পরাস্ত হচ্ছে?
একসময় আশা করা হচ্ছিল ভারতের মেয়ে ফুটবল দল প্যারিস অলিম্পিকে খেলতে পারবে। কিন্তু প্রথমে জাপান ও পরে ভিয়েতনামের কাছে হেরে তাদের সেই আশা ধুলিসাৎ হয়। সাফ গেমসেই যারা ম্যাচ জিততে পারছে না, তাদের অলিম্পিক যেতে গেলে যে পরিমাণ পরিকল্পনা ও প্রয়াস দরকার সেটা আছে কি?
অথচ, ভারতের অনেক জায়গায় গরিব মেয়েরা ফুটবলের মাঠে যায় এক টুকরো স্বাধীনতা পাওয়ার জন্য। ফুটবল তাদের কাছে যে কোনো খেলা নয়, তাদের কাছে কিছুক্ষণের জন্য মুক্তি, গ্লানি থেকে মুক্তি, সামাজিক কড়াকড়ি থেকে মুক্তি, নিষেধের বেড়াজাল থেকে মুক্তি। ফুটবল তাদের কাছে একটা আলাদা অর্থ বহন করে। সেই মেয়েদের দক্ষতা, জেদ, লড়াই তো পরিকল্পনামাফিক প্রশিক্ষণের ফলে আরো তীব্র হওয়ার কথা। তা না হলে দায়টা ফুটবল প্রশাসকদেরই নিতে হবে। আর ক্রিকেটের আলোর তলায় অন্ধকারে থাকা খেলার উন্নতির জন্য সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।