ভারতে কনডম ব্যবহার করেন মাত্র পাঁচ শতাংশ মানুষ। সমীক্ষায় এমনই তথ্য উঠে এসেছে। আন্দোলন প্রয়োজন, বলছেন বিশিষ্টজনেরা।
বিজ্ঞাপন
দোকানে গিয়ে কনডম চাইতে আড়ষ্ট বোধ করা। লজ্জায় দোকানদারের কাছে কনডম চেয়েই উঠতে না পারা। এ সব নতুন ছবি নয়। রাস্তাঘাটে প্রতিদিনই এমন ঘটনা লক্ষ্য করা যায়। কনডম নিয়ে ভারতীয়দের মধ্যে এখনো যে যথেষ্ট ট্যাবু এবং আরষ্টতা রয়েছে, এবার তা প্রমাণ হয়ে গেল। একুশ শতকে পৌঁছে এই প্রথম ভারতে কনডমের ব্যবহার নিয়ে একটি সমীক্ষা হলো। এবং সেখানে যে তথ্য উঠে এসেছে, তা হতাশ হওয়ার জন্য যথেষ্ট।
একাধিক সংস্থা একত্রে এই সমীক্ষাটি করেছে। সাহায্য নেওয়া হয়েছে স্বাস্থ্য এবং পরিবার মন্ত্রণালয়ের তথ্য। দেখা গেছে, ১৩০ কোটির ভারতে মাত্র ৫ শতাংশের কিছু বেশি মানুষ কনডম ব্যবহার করেন। ২০ থেকে ২৪ বছরের তরুণ ভারতের ৮০ শতাংশই শেষবার যৌনমিলনের সময় কনডম ব্যবহার করেনি।
যৌন লালসার বিকৃত রূপ
পাঁচ-ছয় বছরের শিশু থেকে শত বছরের বৃদ্ধা, কেউ বাদ যাননি ধর্ষণের শিকার হওয়া থেকে৷ ঘর, গণপরিবহন আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান- সব জায়গাতেই ঘটেছে এসব ঘটনা৷ ছবিঘরে দেখে নিন যৌন লালসার এমন বিকৃত রূপের চিত্র৷
ছবি: bdnews24.com/A. Mannan
লালসার শিকার ছয় বছরের সায়মা
রাজধানীর ওয়ারীতে প্রতিবেশীর ফ্ল্যাটে খেলতে গিয়ে ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হয়েছে ছয় বছরের শিশু আফরিন সায়মা৷ সম্প্রতি এই ঘটনা ব্যাপক আলোচনা ও উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে৷ ধর্ষককে গ্রেপ্তারের পর তার বাবার আবেগধর্মী বক্তব্যে আলোড়িত হয়েছেন সবাই৷
এমন ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে, নিজের প্রতিবেশও কতোটা অনিরাপদ নারী ও শিশুর জন্য৷
ছবি: bdnews24.com
১২ ছাত্রীর ধর্ষক মাদ্রাসা অধ্যক্ষ
নারায়ণগঞ্জে ১২ ছাত্রীকে ধর্ষণ, ধর্ষণের চেষ্টা ও যৌন হয়রানির অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছেন একটি মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা আল আমিন৷ গ্রেপ্তার আল আমিন ১২ ছাত্রীকে ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি অভিযোগ স্বীকার করেছেন বলে র্যাব৷
ছবি: bdnews24.com
শত বছরের বৃদ্ধাকে ধর্ষণ!
মে মাসে টাঙ্গাইলে শত বছর বয়সি অন্ধ বৃদ্ধাকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠে ১৫ বছর বয়সি এক কিশোরের বিরুদ্ধে৷ ওই কিশোর বৃদ্ধার ঘরে ঢুকে মুখ বেঁধে তাঁকে ধর্ষণ করেছে বলে জানায় পুলিশ৷ গ্রেফতার কিশোর সোহেল ধর্ষণের অভিযোগ স্বীকার করেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ৷
আগুনে পুড়ল নুসরাত
ফেনীতে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করার জেরে আগুনে পুড়তে হলো নুসরাত জাহান রাফিকে৷ অধ্যক্ষের পক্ষ নিয়ে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীসহ কয়েকজন ওই কাণ্ড ঘটায়৷ নুসরাতকে হত্যার আগে নিপীড়ক অধ্যক্ষ সিরাজের পক্ষে মানববন্ধনও হতে দেখা গেছে৷ নারায়ণগঞ্জ আর ফেনীর ঘটনা প্রকাশ করছে, ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও অনিরাপদ নারীরা৷
ছবি: picture-alliance/M. Rashid
রাজনীতির বিরোধে ধর্ষণ!
নোয়াখালীর সুবর্ণচরে ভোটের রাতে ধর্ষণের ঘটনা ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়৷ এরপর নোয়াখালীতেই আরেকটি ভোট কেন্দ্র করে ছয় সন্তানের জননীকে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে৷ ধর্ষণে রাজনীতির সংযোগ নারীর জন্য সমাজকে ঝুঁকিপূর্ণই করছে৷ এর আগে ২০০১ সালের নির্বাচনের পরও দেশের বিভিন্ন এলাকায় ধর্ষণের ঘটনায় ব্যাপক প্রতিবাদের জন্ম দিয়েছিল৷
ছবি: bdnews24.com
ছয় মাসে ভিকটিম ৩৯৯ শিশু
মানবাধিকার সংগঠন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের হিসাব বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত সারা দেশে ৩৯৯ শিশু ধর্ষণ ও ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হয়েছে৷ এর মধ্যে আটজন ছেলে শিশু রয়েছে৷ ধর্ষণের পর ১৫জন মেয়ে শিশু ও এক ছেলে শিশু হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে৷ অন্যদিকে, ছয় মাসে ৬৩০ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে বলে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর তথ্য৷
ছবি: Bilderbox
পাঁচ মাসে ৩০০ মামলা
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে সারা দেশে শিশু ধর্ষণের মামলা হয়েছে ৩০০-এর কিছু বেশি৷ আর গত পাঁচ বছরে মোট শিশু ধর্ষণ মামলার সংখ্যা ছিল ৩ হাজারের কিছু বেশি৷
ছবি: picture-alliance/Pacific Press/E. McGregor
কিনারা হয়নি তনু হত্যার
কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী ও নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান তনুকে ধর্ষণ ও হত্যা মামলার তদন্ত তিন বছরেও শেষ হয়নি৷ তনুর পরিবারের অভিযোগ, স্থবির হয়ে আছে তদন্তকাজ৷ ২০১৬ সালের ২০ মার্চ রাতে কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাস এলাকার থেকে তনুর লাশ উদ্ধার করা হয়৷ ঘটনার সঙ্গে সেনাসদস্যরা জড়িত বলে অভিযোগ তনুর পরিবারের৷
ছবি: Twitter
আলোচিত রূপা হত্যা
২০১৭ সালের আগস্টে টাঙ্গাইলে চলন্ত বাসে কলেজছাত্রী জাকিয়া সুলতানা রূপাকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়৷ ওই মামলায় চারজনকে ফাঁসি ও একজনকে সাত বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত৷
ছবি: picture-alliance/Photoshot
ক্রসফায়ার কি সমাধান?
ধর্ষককে কথিত বন্দুকযুদ্ধে হত্যার ঘটনা ঘটেছে বিভিন্ন সময়ে৷ ধর্ষককে ক্রসফায়ারে পক্ষে রাস্তায় দাঁড়াতেও দেখা গেছে৷ এমনকি জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে একাধিকবার ধর্ষককে বিচার বহির্ভূতভাবে হত্যার কথা বলেছিলেন জাতীয় পার্টির সংসদ কাজী ফিরোজ রশীদ৷ আইনের শাসনের প্রতি আস্থাহীনতার প্রমাণ হিসাবে দেখা দিয়েছে এসব ঘটনা৷
ছবি: Getty Images/N. Seelam
10 ছবি1 | 10
মন-সমাজবিদ মোহিত রণদীপ ভারতের যৌনপ্রশিক্ষণ নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছেন। ডয়চে ভেলেকে তিনি জানিয়েছেন, এই সমীক্ষা দেখে তিনি এতটুকু বিস্মিত নন। ''এটাই তো হওয়ার কথা ছিল। আমাদের সমাজে যৌনতাকে এখনো নিষিদ্ধ বস্তু হিসেবে দেখা হয়। যৌনতাকে কেবলমাত্র সন্তান উৎপাদনের বিষয় হিসেবে দেখা হয়। ফলে সেখানে কনডমের ব্যবহারে অনীহা থাকবে, সেই তো স্বাভাবিক।''
মোহিতের মতে, এতবছর লেগে গেল কনডমের ব্যবহার নিয়ে একটি সমীক্ষা করতে। বহু বছর আগেই এই সমীক্ষা হওয়া দরকার ছিল। যে তথ্য হাতে পাওয়া গেছে, তা নিয়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে ওঠা প্রয়োজন। সরকারকেও কনডম ব্যবহার নিয়ে সামাজিক প্রকল্প গড়ে তুলতে হবে। সামাজিক ট্যাবু ভেঙে জনগণের হাতে কনডম তুলে দিতে হবে।
আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের কথা বলেছেন মোহিত। তার মতে, যৌনতা নিয়ে সামাজিক ট্যাবু থাকলেও যৌন চাহিদা স্বাভাবিক ভাবেই মানুষের মধ্যে থাকে। ফলে তার প্রভাব পড়ে জনসংখ্যার উপর। অন্যদিকে কম বয়সীদের মধ্যে ধর্ষকাম, বিকৃত যৌনতার মানসিকতা তৈরি হয়। কনডমের সমীক্ষায় যে তথ্য উঠে এসেছে, তাতে সেই বিষয়গুলিও স্পষ্ট হয়েছে।
ভ্যাজাইনা বা যোনি সম্পর্কে আপনার যা জানা উচিত
05:54
স্যাফো ফর ইকুয়ালিটির সদস্য চিত্র পরিচালক সুস্মিতা সিনহা। ডয়চে ভেলেকে তিনি জানিয়েছেন, ''অত্যন্ত জরুরি একটি সমীক্ষা হয়েছে। আমরা যারা যৌনতা নিয়ে কাজ করি, যৌন চাহিদা, যৌন স্বাধীনতার বিষয়গুলি নিয়ে কথা বলি, তারাও অনেকে জানতামই না যে, মেয়েদের জন্যও আলাদা কনডম হয়। এটাই হলো সামাজিক শিক্ষার অভাব।'' মোহিতের মতো সুস্মিতারও বক্তব্য, সামাজিক সংগঠনগুলির পাশাপাশি সরকারকেও এ বিষয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
পরিবার প্রকল্প নিয়ে ভারত সরকার বহুদিন ধরেই চিন্তিত। সেই ইন্দিরা গান্ধীর আমলে 'হাম দো হামারা দো' স্লোগান সামনে এসেছিল। গ্রামে গঞ্জে সেই স্লোগান পৌঁছে গিয়েছিল। তাতে যে কোনোই লাভ হয়নি, এমনটা বলা যায় না। কিন্তু জনসংখ্যার বৃদ্ধি যে এখনো নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি, সে তথ্যও বিভিন্ন সমীক্ষায় একাধিকবার উঠে এসেছে। মোহিতের মতে, যে ভাবে হাম দো হামারা দো স্লোগান গ্রামে গ্রামে গ্রামে পৌঁছেছিল, ঠিক সেভাবেই কনডমের ব্যবহার, ডনডমের বিজ্ঞাপন গ্রামে গ্রামে পৌঁছানো দরকার।
কনডম নিয়ে এই সমীক্ষাটির নাম দেওয়া হয়েছে কনডমোলজি। কনজিউমার, কনডম এবং সাইকোলজি-- এই তিনটি শব্দকে জুড়ে কনডমোলজি নামটি তৈরি করা হয়েছে। যে সংস্থাগুলি এই সমীক্ষা চালিয়েছে, তারা রিপোর্টে বলেছে, ভবিষ্যতে এ বিষয়ে আরো কাজ করবে তারা। মানুষকে সচেতন করার জন্য আরো বেশ কিছু প্রয়াস নেওয়া হবে। তবে সমীক্ষাটি নিয়ে সরকারের তরফে এখনো পর্যন্ত কোনো মন্তব্য করা হয়নি।