কর্মসংস্থানের বাজারের ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান, অর্থনীতি এমন বদলে যাচ্ছে যে বলার নয়৷ এমন সব নতুন নতুন ক্ষেত্রে চাকরির আকাশছোঁয়া চাহিদা হচ্ছে যা, আমরা আগে কখনো ভাবতে পারিনি৷
বিজ্ঞাপন
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভারতের কর্মসংস্থানের বাজারে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে ও হচ্ছে। নতুন নতুন ক্ষেত্রর দরজা খুলে যাচ্ছে। যেমন ধরুন, ভারতে এখন সবচেয়ে বেশি চাহিদা আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স(কৃত্রিম মেধা) ইঞ্জিনিয়ারদের। তারা কত বেতন পায় জানেন? মাসে তিন থেকে ২২ লাখ টাকা। অর্থাৎ, ঢুকেই তিন লাখ টাকা বেতন পেয়ে যাচ্ছে তারা।
যেমন ধরুন ইনফ্লুয়েন্সার। বছর কয়েক আগেও ইনফ্লুয়েন্সারদের সম্পর্কে বিশেষ কেউ কিছু জানতেন না। এখন তাদের চাহিদাও কম নয়। ইনফ্লুয়েন্সার মানে সামাজিক মাধ্যমে যাদের ১০ থেকে ৫০ হাজার ফলোয়ার আছে। তারা একটা পোস্ট করেই প্রায় ১৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা পান। আর তাদের দিয়ে কিছু পোস্ট করালে কম করে পাঁচ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা দিতে হয়। তবে সেই পোস্ট মাত্র ২৪ ঘণ্টা তাদের সামাজিক মাধ্যমে থাকবে। বেশি সময় রাখতে গেলে টাকা আরো বেশি দিতে হবে।
ইউটিউবাররাও তো পিছিয়ে নেই। ইউটিউবে ভিডিও পোস্ট করে তারা দিব্যি কামাচ্ছেন। ২০২৩ সালের হিসাব, ভারতে ২৯ লাখ ইউটিউবার আছেন, যাদের ফলোয়ারের সংখ্যা ১০ হাজার বা তার বেশি। তারা মাসে ১০ থেকে ২২ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করেন। আর এক লাখ ফলোয়ার হলে তো ৭৫ হাজার থেকে প্রায় আড়াই লাখ টাকা মাসে আয় করা যায়। ২০২৩ সালে এক লাখ বা তার বেশি ফলোয়র আছে এমন ইউটিউবারের সংখ্যা ছিল প্রায় চার লাখ। এই সংখ্যাটা বছরে ২২ শতাংশ হারে বাড়ছে। ফলে ২০২৪ সালে তা প্রায় পাঁচ লাখের কাছে চলে যাবে।
তাই বলছিলাম, চাকরির বাজারের চাল-চরিত্র-চেহারা বদলে গেছে। ভারতে ২০২৩ সালে স্টার্ট আপ কোম্পানির সংখ্যা ছিল এক লাখ ১৪ হাজার। সংখ্যার হিসাবে ভারত বিশ্বের তিন নম্বরে। অ্যামেরিকা ও চীনের পরে। ২০২৩ সালে ভারতে ১১১টি স্টার্ট আপ কোম্পানির প্রতিটির মূল্য ছিল একশ কোটি ডলারের বেশি। ভারতের স্টার্ট আপ সংস্থায় ১২ লাখ ভারতীয় কাজ করছে। এই যে দিল্লির কলেজগুলিতে স্নাতক হওয়ার পরই পড়ুয়ারা টপাটপ চাকরি পেয়ে যাচ্ছে, তার পিছনে স্টার্ট আপ কোম্পানিগুলির অবদান কম নয়।
ক্রিকেট খেলে রোজগারের বিষয়টা দেখুন। রঞ্জি ট্রফিতে খেললে প্রতিদিন ৩৫ হাজার টাকা করে পাওয়া যায়। প্রথম ১৬ জন থাকলে ১৭ হাজার ৫০০ টাকা পাওয়া যায়। আর যদি ৪০টি রঞ্জি ম্যাচ খেলে নেয়া যায়, তাহলে প্রতিদিন ৬০ হাজার টাকা পাওয়া যায়। ২১ থেকে ৪০টি খেললে ৫০ হাজার টাকা দিনে। শুধু মুম্বইতেই ক্রিকেট খেলে তিন হাজার মানুষ মাসে অন্তত ২৫ হাজার টাকা রোজগার করে। যত ভালো খেলবে, তত রোজগার। কলকাতার প্রথম ডিভিশন ক্লাবে ক্রিকেট ও ফুটবল খেলে রোজগার করা যুবকদের সংখ্যাটা নেহাত কম নয়।
বাংলাদেশে বেকারত্ব ও ইন্টার্নশিপ
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বিবিএস বলছে, ২০২৩ সাল শেষে বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা ছিল সাড়ে ২৩ লাখ৷ তবে সম্প্রতি স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীদের ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ দিতে ইন্টার্নশিপ নীতিমালা প্রকাশ করেছে সরকার৷
ছবি: Danko Natalya/Zoonar/picture alliance
বেকারত্বের সংজ্ঞা
বেকারত্বের সংজ্ঞাবাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বলছে, সাত দিনে কমপক্ষে এক ঘণ্টাও কোনো কাজ করেনি, কিন্তু কাজের জন্য প্রস্তুত ছিলেন, তাদেরই বেকার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে৷ এমনকি জরিপের আগে ৩০ দিন বেতন বা মজুরি বা মুনাফার বিনিময়ে কাজ খুঁজেছেন, তারাও বেকার হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন৷
ছবি: Danko Natalya/Zoonar/picture alliance
বেকারের সংখ্যা
বিবিএস বলছে, ২০২৩ সাল শেষে বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা ছিল সাড়ে ২৩ লাখ৷ এর মধ্যে পুরুষ ১৫ লাখ ৭০ হাজার আর নারী ৭ লাখ ৮০ হাজার৷
ছবি: PantherMedia/picture alliance
পাঁচ বছরে বেকার স্নাতকের সংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণ
গত অক্টোবরে বিবিএস প্রকাশিত শ্রমশক্তি জরিপ-২০২২ বলছে, স্নাতক ডিগ্রিধারীর হার ২০১৭ অর্থবছরের ১১.২ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২২ সালে ১২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে৷ বিবিএসের পরিসংখ্যান বলছে, পাঁচ বছরে বেকার স্নাতকের সংখ্যা বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে, যা ২০১৭ অর্থবছরে প্রায় ৪ লাখ ছিল৷
ছবি: DW
উচ্চশিক্ষিত বেকার
বিবিএসের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, মাধ্যমিক পাস করেছেন এমন জনগোষ্ঠীর মধ্যে বেকার ২.৮২ শতাংশ, উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছেন এমনদের মধ্যে ৪.৯৪ শতাংশ এবং বিশ্ববিদ্যালয় ও সমপর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ডিগ্রিধারীদের মধ্যে বেকারের হার এখন ১২ শতাংশ৷
ছবি: bdnews24.com
উচ্চশিক্ষার উপযোগিতা নিয়ে প্রশ্ন
অর্থনীতিবিদ ও জেনেভায় ইন্টারন্যাশনাল লেবার অফিসের কর্মসংস্থান বিভাগের সাবেক বিশেষ উপদেষ্টা রিজওয়ানুল ইসলাম বাংলাদেশে ডিডাব্লিউর কন্টেন্ট পার্টনার ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘‘এটি শ্রমবাজারের দৃষ্টিকোণ থেকে উচ্চশিক্ষার উপযোগিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে৷ শিক্ষাব্যবস্থা কেমন গ্র্যাজুয়েট তৈরি করছে, যাদের যোগ্যতা চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো কাজে আসে না?’’
ছবি: Jelena Djukic Pejic/DW
উচ্চশিক্ষার উপযোগিতা নিয়ে প্রশ্ন
অর্থনীতিবিদ ও জেনেভায় ইন্টারন্যাশনাল লেবার অফিসের কর্মসংস্থান বিভাগের সাবেক বিশেষ উপদেষ্টা রিজওয়ানুল ইসলাম বাংলাদেশে ডিডাব্লিউর কন্টেন্ট পার্টনার ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘‘এটি শ্রমবাজারের দৃষ্টিকোণ থেকে উচ্চশিক্ষার উপযোগিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে৷ শিক্ষাব্যবস্থা কেমন গ্র্যাজুয়েট তৈরি করছে, যাদের যোগ্যতা চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো কাজে আসে না?’’
ছবি: Rubel Mahfuz
প্রত্যাশার ঘাটতি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সায়েমা হক বিদিশা ডেইলি স্টারকে বলেন, নিয়োগদাতা ও চাকরিপ্রার্থীদের মধ্যে প্রত্যাশার বিরাট ঘাটতি আছে৷ বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক জ্ঞান ও দক্ষতা দিতে পারে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘‘তাই নিয়োগকারীরা দক্ষ কর্মী পাচ্ছেন না৷ অন্যদিকে প্রত্যাশার সঙ্গে না মেলায় বিপুল সংখ্যক গ্র্যাজুয়েট চাকরির বাজারে প্রবেশ করতে পারেনি৷’’
ছবি: privat
ইন্টার্নশিপ নীতিমালা-২০২৩
স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীদের ব্যবহারিক প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে যুগোপযোগী ও অভিজ্ঞ মানবসম্পদ সৃষ্টি, পাঠ্যপুস্তকের জ্ঞানের সঙ্গে কর্মক্ষেত্রের অভিজ্ঞতার সমন্বয় ঘটানোর সুযোগ রেখে সম্প্রতি ইন্টার্নশিপ নীতিমালা প্রকাশ করেছে সরকার৷ এই নীতিমালা অনুযায়ী সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত কিংবা অন্য কোনো রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ইন্টার্নশিপ প্রদান করতে পারবে৷
ছবি: Oliver Boehmer/Zoonar/picture alliance
আবেদনের যোগ্যতা
ইন্টার্নশিপ নীতিমালা-২০২৩ অনুসারে, ইন্টার্নশিপের আবেদন করার জন্য আগ্রহীকে বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে; প্রার্থীকে কমপক্ষে স্নাতক/সমমানের ডিগ্রিধারী হতে হবে (অবতীর্ণ প্রার্থীসহ); স্নাতক/স্নাতকোত্তর/সমমানের ডিগ্রি অর্জনের দুই বছরের মধ্যে আবেদন করতে হবে এবং একজন প্রার্থী একবার সরকারি অফিসে ইন্টার্নশিপ করতে পারবেন৷
ছবি: DW
মেয়াদ ও ভাতা
ইন্টার্নশিপের মেয়াদ সর্বনিম্ন তিন থেকে ছয় মাস পর্যন্ত হতে পারবে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সময় নির্ধারণ করবে৷ নীতিমালা অনুযায়ী, ইন্টার্ন প্রতি মাসে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত পরিমাণ ভাতা প্রাপ্য হবেন৷ ভাতা ছাড়া ইন্টার্ন অন্য কোনো ভাতা বা সুবিধা প্রাপ্য হবেন না৷
ছবি: Syed Mahamudur Rahman/NurPhoto/IMAGO
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ইন্টার্নশিপ
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সম্প্রতি ৩ মাস মেয়াদে ১০ জনকে ইন্টার্নশিপ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে৷ ইন্টার্নশিপের সময় প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা ভাতা পাবেন শিক্ষার্থীরা৷ ১৫ মার্চের মধ্যে http://erecruitment.bcc.gov.bd ঠিকানায় আবেদন করা যাবে৷ সফলভাবে কোর্স সম্পন্ন করতে পারলে ইন্টার্নরা পাবেন সনদ৷
ছবি: bdnews24.com
11 ছবি1 | 11
সরকারি হিসাব বলছে, ভারতে পরিষেবা ক্ষেত্রে মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩১ শতাংশ মানুষ কাজ করেন। পরিষেবা ক্ষেত্র বলতে, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিনোদন, তথ্যপ্রযুক্তি, বিপিও, আর্থিক সংস্থা, টেলিযোগাযোগ ও ইন্টারনেট, পর্যটন, মিডিয়া, ই কমার্স ইত্যাদি। ভারতে এক লাখ ৮৭ হাজার এনজিও আছে। প্রতিটি এনজিওতে ন্যূনতম সাতজন কর্মী থাকতেই হবে। ফলে সেখানেও প্রচুর মানুষ কাজ করেন। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি জনপ্রিয় কোর্সের নাম সোস্যাল সার্ভিস। এই কোর্স করে কর্মসংস্থান পেতে অসুবিধা হয় না। তাই এর চাহিদাও প্রচুর।
তাই বলছিলাম, চিরাচরিত ধারণা নিয়ে কর্মসংস্থানের বিষয়টি বোঝা যাবে না। যত নতুন প্রযুক্তি আসছে, ততই কাজের, চাকরির চরিত্র বদল হচ্ছে। কনটেন্ট রাইটারের কাজ করে মাসে লক্ষাধিক টাকা আয় করা যায়, তা কে ভেবেছিল? দিল্লির প্রায় প্রতিটি কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন প্লেসমেন্ট সেল রয়েছে। সেখান থেকে প্রচুর ছাত্রছাত্রী চাকরি পেয়ে যাচ্ছেন। বিভিন্ন ধরনের চাকরি। যে কলেজের প্লেসমেন্ট সেল যত ভালো, তার কদর তত বেশি। কলেজে পড়তে পড়তেই একাধিক ইন্টার্নশিপ করে ফেলছে পড়ুয়ারা। এখানেও দিল্লির কলেজগুলি সবচেয়ে আগে আছে।
আমাদের ছেলেবেলায় ব্যবসা করার ক্ষেত্রে যেরকম অনীহা দেখেছি, এখন তার সম্পূর্ণ বদল হয়েছে। প্রচুর মানুষ ব্যবসা করছেন। দিল্লিতে তো জমি, বাড়ি ভাড়া ও কেনাবেচার দালালি করে বেশ কয়েক হাজার মানুষ বেঁচেবর্তে আছেন।
সরকারি সংস্থা ন্যাশনাল স্যাম্পেল সার্ভে অর্গানাইজেশন(এনএসএসও) জানাচ্ছে, ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে ভারতে বেকারত্বের হার ছয় দশমিক আট শতাংশ। এটাও আগামী মাসগুলিতে কমে যেতে পারে। কারণ বলা হয়েছে, এবার ভালো বৃষ্টি হয়েছে। ফসলের উৎপাদন বেশি হবে। সেক্ষেত্রে কৃষি শ্রমিকদের চাহিদা বাড়বে। এর পাশাপাশি উজ্জ্বল দিক হলো, মুদ্রা যোজনায় ঋণ নিয়ে ছোট ব্যবসা করার মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। স্টার্ট আপ কোম্পানির সংখ্যা সমানে বাড়ছে। স্বনিযুক্ত মানুষের সংখ্যা এক বছরে দেড় শতাংশ বেড়ে গেছে।
ছেলেবেলায় দেখেছি, পাড়ার মোড়ে মোড়ে বেকার যুবকরা সারাদিন আড্ডা মারছে। কলকাতার সেই বিখ্য়াত রকের আড্ডা প্রায় ইতিহাস হয়ে গেছে। ছোট-বড় কাজের সংখ্যা ও সুয়োগ দুইই অনেক বেড়েছে। বিশ্বের পঞ্চম অর্থনীতির দেশ ভারতে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও বিপুল বদল হয়েছে।