ভারতে কেন বারবার ট্রেন দুর্ঘটনা হচ্ছে?
৩০ জুলাই ২০২৪মাস দুয়েক আগে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসে ভয়াবহ দুর্ঘটনার স্মৃতি এখনো তাজা। অনেকটা সেই ধাঁচেই ফের দুর্ঘটনায় যাত্রিবাহী ট্রেন।
কাকভোরে দুর্ঘটনা
মঙ্গলবার ভোর তিনটে ৩৫ নাগাদ দুর্ঘটনায় পড়ে হাওড়া মুম্বই সিএসএমটি এক্সপ্রেস। হাওড়া থেকে ছেড়ে মুম্বইয়ের ছত্রপতি শিবাজী টার্মিনাসের উদ্দেশে রওনা দিয়েছিল ট্রেনটি। সোমবার সন্ধ্যা সাতটা ৩৫ মিনিটে হাওড়া থেকে রওনা দেয় এই এক্সপ্রেস। ঝাড়খণ্ডের চক্রধরপুরের কাছে দূরপাল্লার ট্রেনটি লাইনচ্যুত হয়। চক্রধরপুর বিভাগের বাদাবাম্বো ও রাজখরসাওয়ান স্টেশনের মধ্যে এই দুর্ঘটনাটি ঘটেছে।
হাওড়া-মুম্বই এক্সপ্রেস ওই পথে যাওয়ার আগে দুর্ঘটনাগ্রস্ত হয় একটি পণ্যবাহী ট্রেন। ডাউন লাইনে যাওয়া মালগাড়ির একাধিক কামরা বেলাইন হয়ে যায়। একটি কামরা এসে পড়ে আপ লাইনে। সেই লাইন দিয়েই ঘন্টায় ১২০ কিলোমিটার গতিতে ছুটে আসছিল হাওড়া-মুম্বই এক্সপ্রেস।
দূরপাল্লার ট্রেনের চালক লাইনের উপর গাড়ি দেখতে পেয়ে ব্রেক কষলেও শেষরক্ষা হয়নি। মেলের ১৮টি কামরা লাইনচ্যুত হয়। এক একটি কামরা এক একদিকে ছিটকে যায়।
দুর্ঘটনার জেরে রেল চলাচল ব্যাহত হয়েছে। বাতিল হয়েছে একাধিক ট্রেন। হাওড়া-বারবিল জনশতাব্দি এক্সপ্রেস, হাওড়া-কাটাভাজি ইস্পাত এক্সপ্রেস, ধানবাদ এক্সপ্রেস বাতিল হয়েছে। হাওড়া-মুম্বই দুরন্ত এক্সপ্রেস, হাওড়া-পুনে এক্সপ্রেস ঘুরপথে চলছে। যাত্রা শুরুর সময় পিছিয়েছে ফলকনামা এক্সপ্রেসের।
দক্ষিণ পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক ওমপ্রকাশ চরণ বলেন, "ভোরে দুর্ঘটনায় পড়ে হাওড়া-মুম্বই এক্সপ্রেস। ত্রাণ ও উদ্ধারের কাজ শেষ হয়েছে। ৮০ শতাংশ যাত্রীকে বাসে করে চক্রধরপুর নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বাকি যাত্রীদের ট্রেনে করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। চক্রধরপুর থেকে ছেড়েছে মুম্বইগামী বিশেষ ট্রেন।"
ঘটনার পর কয়েকজন কামরা থেকে বেরিয়ে আসেন। কেউ কেউ সেখানে আটকা পড়েছিলেন। তাদের উদ্ধার করে বাহিনী। এক্সপ্রেসের ট্রেন ম্যানেজার এম জে রেহান বলেন, "চারপাশে একেবারে অন্ধকার ছিল। আমারও অল্প চোট লেগেছে। বেশি লেগেছে চালক, সহকারী চালকের। যাত্রীরা বুঝতে পারছিলেন না কী হয়েছে? আগেই মালগাড়ি লাইনে পড়েছিল। আমরা সেটা জানতাম না।"
রাজনৈতিক চাপানউতোর
ফের একটি রেল দুর্ঘটনা নিয়ে রাজনৈতিক তরজা শুরু হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ও সাবেক রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এদিন সকালে সমাজ মাধ্যমে পোস্ট করেন। তিনি লেখেন, "আরো এক ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা। কেন্দ্রীয় সরকারের এই উদাসীনতা কোনোদিন কি শেষ হবে? আমার প্রশ্ন, এটাই কি সরকার চালানোর নমুনা? প্রায় প্রতি সপ্তাহেই দুঃস্বপ্নের ধারাবাহিকতা চলছে।"
মঙ্গলবার লোকসভায় এই বিষয়টির উল্লেখ করে কেন্দ্রের সমালোচনা করেন তৃণমূলের দলনেতা সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, "রেলওয়ে সুরক্ষার কাজে নিযুক্ত কর্মীদের অসংখ্য শূন্যপদ বছরের পর বছর পূরণ করা হচ্ছে না। গ্যাংম্যানের অজস্র পদ খালি। তাই রেল সফর সুরক্ষিত হচ্ছে না।"
বিজেপি সাংসদ শমীক ভট্টাচার্য এই দুর্ঘটনাকে দুর্ভাগ্যজনক আখ্যা দিয়ে আক্রমণ করেছেন তৃণমূলকে। তিনি বলেন, "মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন রেলমন্ত্রী ছিলেন, তখন রেলকে আইসিইউতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। এটা আমার কথা নয়, তার দলেরই নেতার কথা। তৃণমূলের ঘোষণা সর্বস্ব রেল পরিচালনার খেসারত দিতে হচ্ছে আজ। ভারতীয় রেল পরিষেবাকে উন্নত করার কাজ চলছে। দুর্ঘটনা ঘটলে সরকার যাত্রীদের পাশে থাকে।"
সুরক্ষা কোথায়?
সম্প্রতি বাজেট পরবর্তী সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দাবি করেন, ইউপিএ সরকারের তুলনায় এনডিএ আমলে রেলে বরাদ্দ বেড়েছে আট গুণ। কিন্তু তা সত্ত্বেও কেন রেল দুর্ঘটনা রোখা যাচ্ছে না?
জুন এবং জুলাই মাসে তিনটি বড় দুর্ঘটনায় ১৭ জনের মৃত্যু এবং একশ জনেরও বেশি আহত হয়েছেন। গত ১৭ জুন কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের দুটি কামরা লাইনচ্যুত হয়। ১১ জনের মৃত্যু হয় ও ৬০-এর বেশি যাত্রী আহত হন। ১৮ জুলাই উত্তরপ্রদেশের গোন্ডা স্টেশনের কাছে একটি ট্রেনের আটটি কামরা বেলাইন হয়। সেই ঘটনায় চারজনের মৃত্যু হয়। ৩৫ জনের বেশি আহত হয়েছিলেন।
এদিনের দুর্ঘটনায় প্রশ্ন উঠছে, মালগাড়ি বেলাইন হওয়া সত্ত্বেও কেন মুম্বই এক্সপ্রেসকে থামিয়ে দেয়া হলো না? স্টেশন ম্যানেজার কী করছিলেন? রেলমন্ত্রীর বিবৃতি দাবি করেছে বিরোধীরা।
কয়েক বছর ধরেই রেল পরিষেবায় সংঘর্ষরোধক যন্ত্র বা সুরক্ষা কবচের প্রয়োগের কথা শোনা যাচ্ছে। কিন্তু তাতে দুর্ঘটনায় লাগাম টানা যাচ্ছে না। বরং ছোটখাট ভ্রান্তি থেকেও বড় ঘটনা ঘটে যাচ্ছে।
পরিবহন বিশেষজ্ঞ, অধ্যাপক পার্থপ্রতিম বিশ্বাস বলেন, "রেলের ট্র্যাক কিংবা সিগনালিং ও ইন্টারলকিং ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। এর ঠিকঠাক রক্ষণাবেক্ষণ হয় না। এ কারণেই বারবার রেল দুর্ঘটনা ঘটছে। রেল মন্ত্রক জেগে ঘুমাচ্ছে। তাদের ঘুম না ভাঙলে দেশের সোয়া কোটি মানুষ, যারা নিয়মিত রেল ব্যবহার করেন, তাদের যাত্রা কখনো সুরক্ষিত হবে না।"