ভারতের সাধারণ নির্বাচনে বিজেপি বিপুল ভোটে জয়লাভ করেছে৷ প্রতিবেশী দেশে উগ্র হিন্দুত্ববাদী একটি দলের এই বিজয়ের প্রভাব বাংলাদেশের উপরও পড়বে বলে ধারণা করছেন অনেকে৷ জনপ্রিয় ব্লগ সাইট সামহয়্যার ইন ব্লগে সাবরিন কল্পনা'র লেখার শিরোনাম, ‘‘বাংলাদেশের মানুষের স্পন্দন বুঝতে হবে মোদী৷''
এই ব্লগার লিখেছেন, ‘‘নানা কারণেই কংগ্রেসের ওপর ক্ষুব্ধ বাংলাদেশের মানুষ৷ আমরা এই দশ বছরে কিছুই পাইনি ভারতের কাছ থেকে৷ বরং দিয়ে গেছি একের পর এক নানা সুবিধা৷ জ্যান্ত নদী তিতাস ভরাট করে রাস্তা করে দিয়েছি তাদের ভারী যন্ত্রাংশ যাওয়ার কথা বিবেচনা করে, হুমকির মধ্যে ফেলে দিয়েছি আমাদের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য সুন্দরবন, দিয়েছি বিদ্যুৎ ট্রানজিট ও পোর্ট ব্যবহারের সুযোগ৷''
সাবরিন কল্পনা লিখেছেন, ‘‘বিনিময়ে তিস্তাসহ যৌথ নদীগুলোর ন্যায্য হিস্যা আদায় করতে পারিনি৷ এমন কি সীমান্তে বিএসএফ এর নৃশংসতার কাছেও থেকেছি নতজানু৷''
উগ্র সাম্প্রদায়িক আদর্শ এবং বিভাজনের রাজনীতির কারণে ভারতের বহু মানুষের কাছে তিনি খলনায়ক৷ ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে নিজেকে নতুন মোড়কে সামনে এনে সেই নরেন্দ্র মোদীই শোনাচ্ছেন ভারতকে বদলে দেয়ার মন্ত্র৷
ছবি: dapd১৯৫০ সালে গুজরাটের নিম্নবিত্ত এক ঘাঞ্চি পরিবারে জন্ম নেয়া নরেন্দ্র মোদী কৈশরে বাবাকে সাহায্য করতে রেল ক্যান্টিনে চা বিক্রি করেছেন৷ ঘাঞ্চি সম্প্রদায়ের রীতি অনুযায়ী ১৭ বছর বয়সে যশোদাবেন নামের এক বালিকার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়, যদিও বেশিদিন সংসার করা হয়নি৷ ছাত্র হিসেবে সাদামাটা হলেও মোদী বিতর্কে ছিলেন ওস্তাদ৷ ১৯৭১ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএস-এর প্রচারক হিসাবে রাজনীতির দরজায় পা রাখেন মোদী৷
ছবি: UNI১৯৮৫ সালে আরএসএস থেকে বিজেপিতে যোগ দেয়ার ১০ বছরের মাথায় দলের ন্যাশনাল সেক্রেটারির দায়িত্ব পান ১৯৯৫ সালে গুজরাটের নির্বাচনে চমক দেখানো মোদী৷ ১৯৯৮ সালে নেন দলের জেনারেল সেক্রেটারির দায়িত্ব৷ ২০০১ সালে কেশুভাই প্যাটেলের স্বাস্থ্যের অবনতি হলে দলের মনোনয়নে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে আবির্ভূত হন নরেন্দ্র মোদী, যে দায়িত্ব তিনি এখনো পালন করে চলেছেন৷
ছবি: Reutersমোদীকে নিয়ে আলোচনায় ২০০২ সালের দাঙ্গার প্রসঙ্গ আসে অবধারিতভাবে৷ স্বাধীন ভারতের সবচেয়ে ভয়াবহ সেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় গুজরাটে প্রায় ১২০০ মানুষ নিহত হন৷ মোদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়েও তিনি দাঙ্গায় উসকানি দেন৷ তিনি এ অভিযোগ স্বীকার করেননি, আদালতও তাঁকে রেহাই দিয়েছে৷ তবে দাঙ্গার পক্ষে কার্যত সাফাই গেয়ে, হিন্দুত্ববাদের গান শুনিয়েই তিন দফা নির্বাচনে জয় পান মোদী৷
ছবি: APদাঙ্গার পর নিজের ভাবমূর্তি ফেরানোর উদ্যোগ নেন নরেন্দ্র মোদী৷ একজন বিতর্কিত নেতার বদলে উন্নয়নের কাণ্ডারি হিসাবে তাঁকে প্রতিষ্ঠা দিতে শুরু হয় ‘গুজরাট মডেল’-এর প্রচার৷ ২০০৭ সালের পর নিজেকে একজন সর্বভারতীয় নেতা হিসাবে তুলে ধরতে নতুন প্রচার শুরু করেন এই বিজেপি নেতা, প্রতিষ্ঠা করেন ‘ব্র্যান্ড মোদী’৷গুজরাটের উন্নয়নের চিত্র দেখিয়ে কলঙ্কিত ভাবমূর্তিকে তিনি পরিণত করেন ভারতের ত্রাতার চেহারায়৷
ছবি: UNIভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌঁড়ে নরেন্দ্র মোদী পাড়ি দিয়েছেন তিন লাখ কিলোমিটার পথ৷ সারা ভারতে পাঁচ হাজার ৮২৭টি জনসভায় তিনি অংশ নিয়েছেন, নয় মাসে মুখোমুখি হয়েছেন পাঁচ কোটি মানুষের৷ কট্টর হিন্দুত্ববাদী নেতা হিসাবে শুরু করলেও এবার তিনি হিন্দুত্ব নিয়ে প্রচার এড়িয়ে গেছেন সচেতনভাবে, যদিও বাংলাদেশের মানুষ, ভূখণ্ড এবং ধর্ম নিয়ে নরেন্দ্র মোদী এবং বিজেপি নেতাদের বক্তব্য নতুন সমালোচনার জন্ম দিয়েছে৷
ছবি: APভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটই যে এবার ভারতে সরকারগঠন করতে যাচ্ছে, বুথফেরত জরিপ থেকে তা আগেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল৷ ৬৩ বছর বয়সি মোদীর নেতৃত্বে এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করতে যাচ্ছে হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি৷ ৭ই এপ্রিল থেকে ১২ই মে অনুষ্ঠিত ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এ নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ৮১ কোটি ৪০ লাখ৷ তাঁদের মধ্যে রেকর্ড ৬৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ ভোট দিয়েছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpaনির্বাচনে বিজেপির প্রতিশ্রুতি ছিল – মোদী প্রধানমন্ত্রী হলে দেশের অর্থনীতি নতুন গতি পাবে, গুজরাটের আদলে তিনি ভারতকে বদলে দেবেন৷ অবশ্য সমালোচকরা বলছেন, ‘কলঙ্কিত ভাবমূর্তি’ ঢাকতে এসব মোদীর ফাঁপা বুলি৷ তাঁর স্বৈরাচারী মেজাজ, শিক্ষা ও অর্থনীতির জ্ঞান নিয়েও ঠাট্টা-বিদ্রুপ হয়েছে৷ বলা হচ্ছে, ভোটাররা টানা তৃতীয়বার কংগ্রেসকে চায়নি বলেই বিজেপি জয় পেয়েছে৷ যদিও শেষ হাসি দেখা যাচ্ছে নরেন্দ্র মোদীর মুখেই৷
ছবি: dapd সাবরিন আশা প্রকাশ করে লিখেছেন, ‘‘মোদী বাংলাদেশের মানুষ ও দেশের প্রকৃতির অন্তর অনুধাবনের চেষ্টা করবেন৷ ভারত যেন তার প্রতিবেশী দুই মুসলিম রাষ্ট্র বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সাথে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে পারে৷''
আমারব্লগে একই বিষয়ে মোহাম্মদ আসাদ আলী'র লেখার শিরোনাম, ‘‘ভারতের সাথে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক কাম্য, বৈষম্য নয়৷'' তিনি লিখেছেন, ‘‘শুক্রবারের ফলাফল প্রকাশ হবার পর থেকেই বাংলাদেশের রাজনীতির মাঠে শুরু হয় তুমুল হৈ চৈ৷ অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়েছে যেন এতদিন যাবৎ সবাই মোদীর বিজয়ের জন্য প্রতীক্ষা করে বসে ছিলেন৷ ফল প্রকাশের পরপরই শুরু হয় চিঠি চালাচালি৷''
ব্লগার আলী লিখেছেন, ‘‘তিনি (নরেন্দ্র মোদী) ক্ষমতায় আসার পূর্বেই বাংলাদেশ নিয়ে বেশ কিছু বিতর্কিত মন্তব্য ইতোমধ্যেই করে ফেলেছেন৷ পৃথিবীব্যাপী তিনি একজন সাম্প্রদায়িক ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত৷ সে হিসেবে বিগত কংগ্রেস সরকারের বৈষম্যমূলক বাংলাদেশ নীতির পথ থেকে বিজেপি সরকার সরে আসবে কি না এখনও পরিষ্কার নয়৷
‘‘ভারতের উচিত হবে, বাংলাদেশের ব্যাপারে তারা যে বৈষম্যমূলক পররাষ্ট্রনীতি ধারণ করে এসেছে, তা থেকে অচিরেই বেরিয়ে আসা৷ এই নীতি আধিপত্যকেন্দ্রিক না হয়ে হোক উভয় দেশের শান্তি ও সৌহার্দ্যপ্রেমিক জনগণের ভারসাম্যপূর্ণ স্বার্থকেন্দ্রিক৷''
#মোদী হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে ফেসবুকেও মন্তব্য করেছেন অনেকে৷ রাজু আহমেদ লিখেছেন, ‘‘আরে ভাই মোদী দিনে ঘুমায় নাকি রাতে ঘুমায় এইটা জেনে আমি কি করতাম? আমার তো জানার দরকার সীমান্তে ফেলানীদের সংখ্যা বাড়বে না কমবে এইটা...!''
মোহাম্মদ হাসিব রহমান ওয়ারসি লিখেছেন, ‘‘ভারতে #মোদী সরকার আসুক বা কংগ্রেস সরকার আসুক৷ এই ব্যাপারে আমাদের কোনো মাথাব্যাথা নাই৷ আমরা তাদেরকে অভিনন্দন জানাই৷ কিন্তু নতুন ভারত সরকার যদি বাংলাদেশের উপর কোনো অন্যায় আচারণ করে তাহলে ভারতকে চরমভাবে প্রতিহত করা হবে৷''
সংকলন: আরাফাতুল ইসলাম
সম্পাদনা: জাহিদুল হক