ভারতের রাজধানী দিল্লিতে একটি পোশাক কারখানায় আগুন লেগে অন্তত ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে, গুরুতর দগ্ধ হয়েছেন আরও আটজন৷ শুক্রবার ভোরে দিল্লির গাজিয়াবাদ জেলার শহিদাবাদ এলাকায় এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে৷
বিজ্ঞাপন
পোশাক কারখানাটিতে রাতে ঘুমিয়ে ছিল শ্রমিকরা৷ এর মধ্যেই লাগে আগুন৷ তাই তাদের বাঁচার উপায় ছিল না৷ পোশাক কারখানার নীচ তলায় নকল চামড়ার জ্যাকেট কারখানায় ভোর চারটায় আগুনের সূত্রপাত৷ প্রথম তলায় বেশিরভাগ শ্রমিক ঘুমিয়ে ছিল৷ জ্যাকেটে আগুন লেগে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে৷ প্রত্যক্ষদর্শী শাহাবুদ্দীন আলী বলেন, প্রথম তলার শ্রমিকদের চিৎকার শুনে অন্য তলার শ্রমিকদের ঘুম ভাঙে এবং তারা পালাতে সক্ষম হয়৷ আগুন লাগার দু'ঘণ্টার মধ্যে দমকল কর্মীরা সেখানে উপস্থিত হয়৷ পুলিশ ১৩ জনের মৃত্যুর খবরটি নিশ্চিত করে জানিয়েছে, শর্ট সার্কিট বা সিগারেট থেকে আগুন লেগে থাকতে পারে৷
পুলিশ কর্মকর্তা সালমান তাজ জানিয়েছেন, নিহতদের মধ্যে তিনজন আগুনে পুড়ে মারা গেছে৷ বাকিদের শ্বাসনালী পুড়ে যাওয়ায় মৃত্যূ হয়েছে৷ দু'জন শ্রমিক ভবনের বারান্দা থেকে লাফ দিয়ে রক্ষা পেয়েছে৷ এছাড়া কারাখানার এক শ্রমিক সংবাদ সংস্থা এএফপিকে জানান, ভবনটির সিড়ি এত সরু যে সেখান থেকে বেরিয়ে আসাটাও ভীষণ কঠিন৷ এছাড়া কারাখানাটি অবৈধ বলেও ধারণা তাঁর৷ পুলিশ কর্মকর্তা জানান, কারাখানার মালিকের কাছে তারা কাগজপত্র চাইবেন৷ তারপরই বোঝা যাবে এটি অবৈধ কিনা৷ পাশাপাশি দু'টি কারখানার মালিককে আটক করা হয়েছে বলে জানালেন তাজ৷
এই ঘটনার পর ভারতের মত বড় দেশে কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে আবারো প্রশ্ন উঠেছে৷ এলাকাটির অধিবাসীরা জানালেন, পুরো এলাকাটির বিভিন্ন গলিতে এমন অবৈধ কারখানা রয়েছে৷ এখানে এমন অনেক শ্রমিক কাজ করেন, যাঁরা অভিবাসী৷ তাঁরা নামমাত্র বেতনে সেখানে কাজ করেন৷ এছাড়া এমন কিছু ভবন আছে যেটার নীচ তলায় কারখানা এবং উপরতলায় মালিকের পরিবার থাকে৷
অভিবাসী শ্রমিক নওয়াজ আলম জানালেন, তিনি একটি জিন্স তৈরির কারখানায় কাজ করেন৷ উপায় না থাকায় অবৈধ কারখানায় কাজ করতে বাধ্য হন তিনি৷ তাঁর কথায়, তাঁদের খুবই কম বেতন দেয়া হয় এবং ঘর ভাড়া বাঁচাতে কারখানার দূষিত পরিবেশে থাকতে বাধ্য হন তাঁরা৷ গত মাসেই তামিলনাড়ুর এক কারখানায় আতশবাজির কারখানায় বিস্ফোরণে আট শ্রমিকের মৃত্যু হয়৷ ২০১৪ সালের মে মাসে মধ্যপ্রদেশে আরেক আতশবাজির কারখানায় আগুন লেগে নিহত হন ১৫ জন৷
দক্ষিণ এশিয়ার বেশিরভাগ দেশেই এমন অমানবিক পরিবেশে কাজ করেন পোশাক শ্রমিকরা৷ সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিল বাংলাদেশ৷ ২০১৩ সালের এপ্রিলে রানা প্লাজায় ভবন ধসে ১,১৩৮ মানুষের মৃত্যু হয়৷ এছাড়া এ বছরও সেপ্টেম্বরে ঢাকায় একটি কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণে ২৫ শ্রমিকের মৃত্যু হয়৷ ২০১২ সালে ১১১ জন শ্রমিক প্রাণ হারান ঢাকার একটি পোশাক কারখানায় আগুন লেগে৷
পোশাক শিল্পে শ্রমশোষণ: ব্রিটেন থেকে বাংলাদেশ
দু মুঠো অন্নের সংস্থান করতে রানা প্লাজায় গিয়ে লাশ হয়ে ফিরেছিলেন এগোরো শ-রও বেশি মানুষ৷ যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁদের অনেকেরই বাকি জীবন কাটবে দুর্বিষহ কষ্টে৷ পোশাক শ্রমিকদের জীবনের এই নির্মমতার ইতিহাস কিন্তু অনেক দীর্ঘ৷
ছবি: DW/M. Mohseni
বৈশ্বিক শিল্প
প্রতিটি পোশাকে মিশে থাকে শ্রমিকের শ্রম-রক্ত-ঘাম৷ ১৯৭০-এর দশক থেকে ইউরোপ আর যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ব্র্যান্ডগুলো এশিয়া আর ল্যাটিন অ্যামেরিকার কিছু দেশ থেকে পোশাক কিনতে শুরু করে৷ খুব কম মজুরিতে শ্রমিক পাওয়া যায় বলে দাম পড়ে কম, লাভ হয় বেশি৷ এমন সুযোগ ছাড়ে তারা! কম টাকায় পণ্য কিনবেন, ছবির মতো পোশক তৈরি হবে মিষ্টির দোকানে – তারপর আবার শ্রমিকের অধিকাররক্ষা, পরিবেশ দূষণ রোধ করবেন – তাও কি হয়!
ছবি: picture-alliance/dpa
সবার জন্য পোশাক
বড় আঙ্গিকে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পোশাক তৈরি প্রথম শুরু হয়েছিল ব্রিটেনে, অষ্টাদশ শতাব্দীর সেই শিল্পবিপ্লবের সময়টাতে৷ এখন বিশ্বাস করতে অনেকের হয়ত কষ্ট হবে, তবে ইতিহাস বলছে, শিল্পবিপ্লবের ওই প্রহরে ব্রিটেনের লন্ডন আর ম্যানচেস্টারও শ্রমিকদের জন্য ছিল আজকের ঢাকার মতো৷ শতাধিক কারখানা ছিল দুটি শহরে৷ শিশুশ্রম, অনির্ধারিত কর্মঘণ্টার সুবিধাভোগ, অল্প মজুরি, কারখানার অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ – সবই ছিল সেখানে৷
ছবি: gemeinfrei
সেই যুক্তরাষ্ট্র এখন কর্তৃত্বে
যুক্তরাষ্ট্রেও পোশাকশ্রমিকরা স্বর্গসুখে ছিলেন না সব সময়৷ সেখানেও এক সময় কারখানায় আগুন লাগলে মালিকপক্ষ শ্রমিকদের ভেতরে রেখেই সদর দরজায় তালা লাগাতো৷ ১৯১১ সালে তাই নিউ ইয়র্কের ট্রায়াঙ্গেল শার্টওয়েস্ট ফ্যাক্টরিতে পুড়ে মরেছিল ১৪৬ জন শ্রমিক৷ মৃতদের অধিকাংশই ছিলেন নারী৷ মজুরি, কর্মঘণ্টা, কর্মপরিবেশ, নিরাপত্তা – কোনো কিছুই এশিয়ার এখনকার কারখানাগুলোর চেয়ে ভালো ছিল না৷
ছবি: picture-alliance/dpa
পোশাক শিল্পে চীন বিপ্লব
পোশাক রপ্তানিকারী দেশগুলোর মধ্যে চলছে সবচেয়ে কম খরচে পোশাক তৈরির প্রতিযোগিতা৷ রপ্তানিকারী দেশগুলোর মধ্যে চীনের অবস্থা সবচেয়ে ভালো৷ রপ্তানি সবচেয়ে বেশি, শ্রমিকদের মজুরিও খুব ভালো৷ চীনে একজন পোশাক শ্রমিক এখন মাস শেষে ৩৭০ ইউরো, অর্থাৎ, বাংলাদেশি মুদ্রায় ৩৭ হাজার টাকার মতো পেয়ে থাকেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শ্রমশোষণ কাকে বলে...
ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য তামিলনাড়ুর সুমাংগলি৷ তামিল শব্দ ‘সুমাংগলি’-র অর্থ, ‘যে নববধু সম্পদ বয়ে আনে’৷ এলাকায় পোশাক এবং সুতা তৈরির প্রশিক্ষণের নামে খাটানো হয় প্রায় ১ লক্ষ ২০ হাজার মেয়েকে৷ দিনে ১২ ঘণ্টা কাজ করে তাঁরা হাতে পান ৬০ ইউরো সেন্ট, অর্থাৎ বাংলাদেশের মুদ্রায় ৬০ টাকা৷ সে হিসেবে মাস শেষে পান ১৮০০ টাকা৷ টাকাটা তাঁদের খুব দরকার৷ বিয়ের সময় বাবাকে তো যৌতুক দিতে হবে!
ছবি: picture-alliance/Godong
অধিকার আদায়ের করুণ সংগ্রাম
কম্বোডিয়াতেও অবস্থা খুব খারাপ৷ ৩ লক্ষের মতো পোশাক শ্রমিক আছে সে দেশে৷ কাজের পরিবেশ আর অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা কেমন? মাসিক বেতন মাত্র ৫০ ইউরো, অর্থাৎ বাংলাদেশের মুদ্রায় বড় জোর ৫ হাজার টাকা৷ মালিকের কাছে শ্রমিকদের মানুষের মর্যাদা প্রাপ্তি সৌভাগ্যের ব্যাপার৷ মজুরি বাড়ানোর দাবিতে মিছিলে নেমে শ্রমিকরা মালিকপক্ষের গুলিতে মরেছেন – এমন দৃষ্টান্তও আছে সেখানে৷
ছবি: Reuters
ট্র্যাজেডি
গত ২৪শে এপ্রিল বাংলাদেশের রানা প্লাজা ধসে পড়ায় মারা যান ১১শ-রও বেশি তৈরি পোশাককর্মী৷ দেয়ালে ফাটল ধরার পরও সেখানে কাজ চালিয়ে যাওয়ায় এতগুলো জীবন শেষ হওয়াকে বিশ্বের কোনো দেশই ভালো চোখে দেখেনি৷ ঘটনার পর জার্মানির এইচঅ্যান্ডএম, কেআইকে এবং মেট্রোসহ বিশ্বের ৮০টির মতো পোশাক কোম্পানি শ্রমিকের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য পোশাক রপ্তানিকারী কারখানাগুলোর সঙ্গে নতুন চুক্তি স্বাক্ষর করেছে৷
ছবি: Reuters
আলোয় ঢাকা আঁধার
অভিজাত বিপণিবিতান কিংবা দোকানের পরিপাটি পরিবেশে ঝলমলে আলোয় ঝিকমিক করে থরে থরে সাজানো বাহারি সব পোশাক৷ দেখে চোখ ধাঁধিয়ে যায়৷ ক্রেতাদের ক’জনের মনে পড়ে রানা প্লাজা কিংবা অতীতের ব্রিটেন বা যুক্তরাষ্ট্রের ভাগ্যাহতদের কথা?