ভারত সরকারের সঙ্গে সংঘাত চলছিলই। এবার টুইটারের বিরুদ্ধে উত্তর প্রদেশে মামলা হলো। আইনি ব্যবস্থা নিচ্ছে কেন্দ্রও।
বিজ্ঞাপন
টুইটারের বিরুদ্ধে এ বার সাম্প্রদায়িক অশান্তি ছড়ানোর অভিযোগ আনা হলো। উত্তরপ্রদেশ সরকার এ বিষয়ে টুইটারের বিরুদ্ধে একটি মামলাও দায়ের করেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছে, এবার টুইটারের বিরুদ্ধে আরো বড় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তাদের রক্ষাকবচ সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এর ফলে যে কোনো বিষয়েই তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে।
রক্ষাকবচ কী
টুইটার, ইউটিউব, ফেসবুকের মতো সংস্থাগুলিকে আইনি ভাষায় মধ্যস্থতাকারী সংস্থা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। অর্থাৎ, এই প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে সাধারণ মানুষ তাদের নিজেদের বক্তব্য প্রকাশ করতে পারে। মধ্যস্থতাকারী সংস্থাগুলিকে এক ধরনের আইনি রক্ষাকবচ দেওয়া হয়। যার ফলে যে কেউ যে কোনো সময় তাদের বিরুদ্ধে যে কোনো ধারায় মামলায় করতে পারে না। টুইটারের ক্ষেত্রে সেই আইনি রক্ষাকবচ তুলে নেওয়া হয়েছে।
বিরোধের সূত্রপাত
দিনকয়েক আগে উত্তরপ্রদেশে এক ব্যক্তিকে মারধরের ঘটনা সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়। দৃশ্যত মুসলিম ওই ভদ্রলোককে প্রথমে কয়েকজন ঘিরে ধরে প্রবল মারধর করে। পরে তার দাড়ি কেটে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ। টুইটারে সেই ভিডিও ভাইরাল হয়। বিষয়টিকে সাম্প্রদায়িক বলে মন্তব্য করেন বেশ কিছু ব্যক্তি। উত্তর প্রদেশ সরকারের বক্তব্য, ওই ঘটনার সঙ্গে সাম্প্রদায়িক বিষয় জড়িত নয়। টুইটারকে ওই মন্তব্যগুলি সরিয়ে দিতে বলা হয়। কিন্তু টুইটার তা করেনি। তারপরেই এই পদক্ষেপ বলে মনে করা হচ্ছে।
ফেসবুক যখন সহিংসতার উৎস
বাংলাদেশে মাঝেমাঝেই ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে সহিংসতা এবং প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে৷ কখনো কখনো রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কুৎসা রটাতেও পরিকল্পিতভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে এই মাধ্যম৷ ছবিঘরে থাকছে সেরকম কয়েকটি ঘটনার কথা৷
ছবি: bdnews24.com
ফেসবুক বার্তার জেরে তাণ্ডব
ফেসবুকে ইসলাম ধর্ম এবং মহানবীকে নিয়ে কথিত কটূক্তির জের ধরে বাংলাদেশে একাধিকবার সহিংস পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে৷ ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলায় এক হিন্দু যুবকের ফেসবুক ম্যাসেজের জের ধরে ২০১৯ সালের ২০ অক্টোবর সৃষ্ট তাণ্ডবে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত চারজন৷ সেই যুবক আগেই থানায় তার ফেসবুক একাউন্ট হ্যাক হওয়ার কথা জানিয়ে থানায় জিডি করেছিলেন৷ পুলিশও জানিয়েছে, সেই যুবকের একাউন্টটি হ্যাকড হয়েছিল৷
ছবি: bdnews24
ফেসবুকে সমালোচনা, পিটিয়ে হত্যা
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের কিছু চুক্তির সমালোচনা করে ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছিলেন বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ৷ আর তাতেই ছাত্রলীগের বুয়েট শাখার কয়েক সদস্য ২০১৯ সালের সাত অক্টোবর তাকে পিটিয়ে হত্যা করে৷ আবরার হত্যাকাণ্ডের পর উত্তপ্ত হয়ে ওঠে বুয়েট৷ ইতোমধ্যে অবশ্য আসামীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং সেখানে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে৷
ছবি: Reuters/M. Ponir Hossain
পদ্মা ‘সেতুর জন্য মাথার’ গুজব
২০১৯ সালের জুন-জুলাই মাসের দিকে ‘পদ্মা সেতুতে মানুষের মাথা লাগবে’ বলে এক গুজব ফেসবুকের মাধ্যমে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে৷ সেসময় ছেলেধরা সন্দেহে কয়েকজনকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটেছে৷
ছবি: bdnews24.com
খালেদাকে নিয়ে গুজব, নিষিদ্ধ ফেসবুক একাউন্ট
বাংলাদেশের সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনের আগে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে নিয়ে একাধিক ভুয়া খবর ফেসবুকের মাধ্যমে ব্যাপক আকারে ছড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছিল৷ নিজস্ব তদন্তের ভিত্তিতে ফেসবুক সেসব খবরের প্রচার রোধে একাধিক একাউন্ট এবং পাতা নিষিদ্ধ করে৷ বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েকজন এসব গুজব ছড়াচ্ছিল বলেও জানায় প্রতিষ্ঠানটি৷
ছবি: Bdnews24.com
শিক্ষার্থী ধর্ষণের গুজবে সংঘর্ষ
২০১৮ সালের আগস্ট মাসে নিরাপদ সড়কের দাবিতে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের একপর্যায়ে ঢাকার জিগাতলায় ছাত্রলীগের সঙ্গে শিক্ষার্থীরা সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে৷ সেসময় সেখানে শিক্ষার্থী নিহত এবং ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে বলে গুজব ছড়িয়ে পড়লে পরিস্থিতি আরো উত্তপ্ত হয়ে ওঠে৷ পরবর্তীতে অবশ্য প্রাণহানি বা গুজবের কোন সত্যতা মেলেনি৷
ছবি: Reuters/M. Ponir Hossain
রংপুরে দাঙ্গা
ইসলামের মহানবীকে নিয়ে ফেসবুকে এক হিন্দু যুবকের পোস্টকে কেন্দ্র করে রংপুরের গঙ্গাচড়ায় হিন্দু পাড়ায় হামলার ঘটনা ঘটে৷ ২০১৭ সালের দশ নভেম্বরের সেই ঘটনায় এক ব্যক্তির মৃত্যুও হয়৷
ছবি: bdnews24.com
ফেসবুকে ছবি, তাণ্ডব
এক হিন্দু যুবক ফেসবুকে উস্কানিমূলক ছবি পোস্ট করার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ২০১৬ সালের ত্রিশ অক্টোবর ব্রাক্ষণবাড়িয়ার নাসিরনগরে তাণ্ডব চালায় একদল বিক্ষুব্ধ মুসলমান৷ সেসময় সেখানে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর ও মন্দির ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে৷
ছবি: Khukon Singha
ফেসবুকে গুজব, বৌদ্ধ পল্লিতে হামলা
২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের রামুতে ১৯টি বৌদ্ধ মন্দির ভাঙচুর করে উত্তেজিত মুসলমানরা৷ উত্তম কুমার নামের এক তরুণ ফেসবুকে ইসলাম ধর্ম অবমাননাকর পোস্ট দিয়েছেন এমন গুজবের ভিত্তিতে সেই হামলা চালানো হয়েছিল৷ তবে, পরবর্তীতে সেই তরুণের খোঁজ আর পাওয়া যায়নি৷
ছবি: AFP/Getty Images
8 ছবি1 | 8
সরকারের দাবি
উত্তরপ্রদেশ সরকারের দাবি, সাম্প্রদায়িক কারণে ওই ব্যক্তিকে মারধর করা হয়নি। ওই ব্যক্তি তাবিজ-কবচ বিক্রি করতেন। তা নিয়েই স্থানীয় মানুষের সঙ্গে তার বচসা হয়। যারা মারধর করেছে, তাদের মধ্যে হিন্দু-মুসলিম সকলেই আছে।
বিরোধীদের অভিযোগ
বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি এবং নেটিজেনদের একাংশের অভিযোগ, যাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার, তাদের গায়ে হাত না দিয়ে টুইটারকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হচ্ছে। শুধু তাই নয়, এই কাজের মাধ্যমে উত্তর প্রদেশ সরকার নিজেদের সাম্প্রদায়িক চরিত্র স্পষ্ট করছে। এর আগেও উত্তর প্রদেশে একের পর এক মারধরের ঘটনা ঘটেছে। অন্যদিকে দিল্লির কেন্দ্রীয় সরকার টুইটারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করেছে।
পুরনো বিতর্ক
টুইটার সহ একাধিক সামাজিক মাধ্যম সংস্থার সঙ্গে বেশ কিছুদিন ধরেই কেন্দ্রীয় সরকারের বিতর্ক চলছে। দিল্লি পুলিশ, যা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে, কিছুদিন আগে গুরুগ্রামে টুইটারের অফিসে রেডও করেছিল। কেন্দ্রের বক্তব্য, সোশ্যাল নেটওয়ার্কের ডেটা প্রয়োজনে সরকারকে দিতে হবে। কিন্তু টুইটার স্পষ্ট জানিয়েছিল, এ কাজ বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ। তারা সে কাজ করতে পারবে না। প্রতিটি সংস্থাকে বলা হয়েছিল, ভারতে তাদের একজন কর্মকর্তাকে নিয়োগ করতে হবে, কেন্দ্র যার কাছে জবাবদিহি চাইতে পারবে। বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই দিল্লির সঙ্গে টুইটারের সংঘাত চলছে। বিজেপি সরকারের বক্তব্য, অন্য সংস্থাগুলি তাদের সঙ্গে সহযোগিতা করলেও টুইটার করছে না। সাম্প্রতিক ঘটনা সেই সংঘাতকে আরো অনেকটা বাড়িয়ে দিল বলেই মনে করা হচ্ছে।