1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান
দুর্নীতিভারত

ভারতে দুর্নীতি ঠেকানোর উদ্যোগের সঙ্গে বদলায় দুর্নীতির রূপও

ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি গৌতম হোড়৷
গৌতম হোড়
১৩ জুন ২০২৫

পুরসভায় দুর্নীতি, পুলিশে দুর্নীতি, সরকারে দুর্নীতি, শিক্ষায় দুর্নীতি, হাসপাতালে দুর্নীতি, চাকরি পাওয়ার জন্য দুর্নীতি, আদালতে দুর্নীতি৷ টাকা ফেললেই আধার কার্ড, টাকা ফেললেই ড্রাইভিং লাইসেন্স, বাড়ির প্ল্যান পাস৷

গত কয়েক বছরে পশ্চিমবঙ্গের দুর্নীতির নানা কেলেঙ্কারি ও কীর্তি সামনে এসেছেছবি: Payel Samanta/DW

ছেলেবেলায় টাকার মাহাত্ম্য বোঝাতে বলা হতো, টাকা ফেললে বাঘের দুধও পাওয়া যায়। স্থলে, জলে, অন্তরীক্ষে ব্যাপ্ত এই দুর্নীতির রাজত্বে মনে হয়, এই যে টাকা মোক্ষ ভেবে যেভাবেই হোক তা রোজগার করার চেষ্টা চলছে। আর আমাদের প্রাপ্য পরিষেবা পেতে গিয়ে কিঞ্চিত খরচ তো করতেই হয়- এই সব আপ্তবাক্যের আড়ালে লাখ লাখ কোটি টাকার দুর্নীতির খেলা চলছে, চলেই যাচ্ছে। আগে দুর্নীতি করে যারা অর্থ উপার্জন করতেন, তারা তা গোপন করার চেষ্টা করতেন। এখন সব খুল্লাম খুল্লা চলে। দুর্নীতিও।

একটা ছোট উদাহরণ দিই। আমার এক বন্ধুর ছেলে একটি নামী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গেছিল। সেখানে অধ্যাপক এথিক্সের ক্লাস নিচ্ছিলেন। কথা হচ্ছিল দুর্নীতি নিয়ে। সেখানে এক সরকারি অফিসারের ছেলে বলেছিল, ‘‘দুর্নীতি তো করতেই হবে। আমার বাবা যদি দুর্নীতি না করতো৷ নাহলে কি আমি এই দামী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারতাম? নাকি আমার হাতে আইফোনের শেষতম মডেল থাকতো?'' মোক্ষম যুক্তি।  কিন্তু তার থেকে মোক্ষম হলো, একটা গোটা ক্লাসের সামনে জোরগলায় বলা. তার বাবা ঘুস খায়, সেই দুর্নীতির টাকায় সে পড়তে এসেছে। 

গত ১১ ফেব্রুয়ারি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল যে তালিকা প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, দুর্নীতির ইনডেক্সে ভারত আছে ১৮০টি দেশের মধ্যে ৯৬ নম্বরে। ২০২৩ সালে ছিল ৯৩ নম্বরে। প্রতিবেশী বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার অবস্থা আরো অনেকটাই খারাপ। তবে সেটা তো শ্লাঘার বিষয় হতে পারে না। কিছুদিন আগে চীন এই তালিকায় একশ নম্বরে ছিল। তারা এখন ৭৬ নম্বরে। ডেনমার্কে দুর্নীতি সবচেয়ে কম। তারপরে আছে ফিনল্যান্ড ও সিঙ্গাপুর। তারা পারলে আমরা কেন দুর্নীতি কমাতে পারি না?

২০২১ সালে লোকসভায় পার্সোনেল মন্ত্রী জিতেন্দ্র সিং জানিয়েছিলেন, সরকার দুর্নীতি নিয়ে ‘জিরো টলারেন্স' নীতি নিয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে, দুর্নীতি কমাতে স্বচ্ছ্ব নাগরিক-বান্ধব পরিষেবা দেয়া, যেমন নাগরিকদের জন্য যাবতীয় কল্যাণমূলক ব্যবস্থা সরাসরি তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে দেয়া, ই-টেন্ডারিং করা, ই-গভর্ননেন্স মডেল নেয়া,  খাদ্যশস্য কেনার ক্ষেত্রে ই -মার্কেটপ্লেসের ব্যবহার, যেসব সরকারি কর্মী জনস্বার্থে কাজ করেন না বা যারা ঠিকভাবে কাজ করেন না, তাদের অবসরের ব্যবস্থা করা। যেখানেই দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে, সেখানেই ভিজিলেন্স কমিশন তদন্ত করে। সেন্ট্রাল ভিজিলেন্স কমিশন বা সিভিসি দুর্নীতি দমনে নানা ধরনের ব্যবস্থা নিতে পারেন। এছাড়া লোকপাল রয়েছে। তাদের কাছে অভিযোগ গেলে তারা সঙ্গে সঙ্গে তার তদন্ত করে। অর্থাৎ, সরকার সম্ভাব্য সব ব্যবস্থা নিচ্ছে, যার ফলে দুর্নীতি নির্মূল হলো বলে। সম্ভবত ১৯৫২ সালে প্রথম লোকসভা ও রাজ্যসভা গঠনের পর থেকেই দুর্নীতি নিয়ে সরকারের কাছে অসংখ্য প্রশ্ন রেখে আসছেন সাংসদরা। তার উত্তর কম-বেশি একই রকমের। যেভাবে প্রতিটি সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে রণসাজে সজ্জিত হয়ে অভিযানে ব্যস্ত থাকে, তাতে এতদিনে দুর্নীতি দমনে ভারতের এক নম্বর দেশ হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে কী হয়েছে?

২০২১ সালের উত্তরকে ভিত্তি করে একবার বাস্তব অবস্থার দিকে তাকানো যাক। কোনো সন্দেহ নেই সরকার ডাইরেক্ট বেনিফিট ট্রান্সফার বা সরাসরি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠায়। আদর্শ ব্যবস্থা হলে এখানে দুর্নীতি করার জায়গা থাকে না। মনমোহন সিং এবং নরেন্দ্র মোদী বারবার দাবি করেছেন, এর ফলে টাকা পাবেন তিনিই, যার পাওয়ার কথা। মাঝখান থেকে দালালরা এসে বাগ বসাতে পারবে না। কিন্তু বাস্তবে কি তাই হয়? এককথায় জবাব, হয় না। হয় না, কারণ, দুর্নীতিও তো তার রূপ বদল করেছে। আমার এক সাংবাদিক বন্ধু অবসর নেয়ার পর পূর্ব ভারতে তার গ্রামে ফিরে গিয়ে পঞ্চাযেত নির্বাচনে দাঁড়িয়ে জিতে যায়। তার কাছ থেকেই শুনেছি, সব ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ কাটের একটা গল্প আছে। তা যাদের কাছে সরকারি প্রকল্পের টাকা পোঁছচ্ছে তাদেরও ক্ষেত্রেও যেমন প্রযোজ্য, তেমনই প্রযোজ্য রাস্তা তৈরি, আলোর ব্যবস্থা, বাড়ি তৈরি করে দেওয়ার মতো বিষয়গুলির ক্ষেত্রেও। কাট না দিলে? তালিকায় নামও আর থাকবে না। আর এই কাটে উঁচু থেকে নিচু সকলেরই নাকি অধিকার আছে। পুরো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। দিবে আর নিবে, মেলাবে মিলিবে আর কী। না দিলে মিলবে না।

পশ্চিমবঙ্গের উদাহরণ ধরুন। গত কয়েক বছরের মধ্যে কত কেলেঙ্কারি, কীর্তি সামনে এলো। কী হলো? নারদ মামলা, যেখানে টিভিতে ঘুষ নিতে দেখা যাচ্ছে, সেখানেও প্রমাণ হাতড়ে বেড়াতে হচ্ছে ইডি, সিবিআইকে। সারদা, কয়লা কেলেঙ্কারি, গরুপাচার কোন তদন্ত শেষ হয়েছে? এখানে দুর্নীতি তো একা নয়, সঙ্গে জুড়ে গেছে রাজনীতি, তার সুবিধা-অসুবিধা, তার দায়দায়িত্ব। ফলে দুর্নীতি থেকে যাচ্ছে পিছনের সারিতে, আসল হচ্ছে, কী করলে ভোটে জেতা যায়, সেই কাহিনি।

আবার দেখুন, আয়কর বিভাগে যে সংস্কার চালু হয়েছে, তার ফলে দুর্নীতি অনেকটাই কমে গেছে। এখন মানুষ আয়কর রিটার্ন দেয়ার পর কিছুদিনের মধ্যে প্রাপ্য টাকা ফেরত পাচ্ছেন। সোজা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে তা চলে যাচ্ছে। আয়কর নিয়ে আগের অভিযোগ এখন আর নেই।

দিল্লির রাজনীতিকদের মধ্যে একটা চালু কথা আছে, দুর্নীতি নিয়ে মানুষ মাথা ঘামায় না। দুর্নীতি কাউকে হারাতে বা জেতাতে পারে না। সত্যি কি তাই? তাহলে বফর্সকাণ্ডের পর রাজীব গান্ধীর চূড়ান্ত পতন হলো কেন, কেনই বা দ্বিতীয় ইউপিএ-র পতন নিশ্চিত করলো একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগ, যার জেরে শীলা দীক্ষিতকেও গোহারা হারিয়ে দিল্লির কুর্সি দখল করলেন কেজরিওয়াল, আবার মদের লাইসেন্স কেলেঙ্কারির জেরে তাকেও যেতে হলো। আবার এর উল্টো উদাহরণও আছে। দুর্নীতির অসংখ্য অভিযোগ, সিন্ডিকেটরাজ, শিক্ষকের চাকরি টাকার বিনিময়ে বিক্রি করার এতবড় কেলেঙ্কারির পরেও তো তৃণমূল বারবার ক্ষমতায় আসতে পারে। সারদা-নারদও তাকে টলাতে পারে না। তাহলে কি প্যাকেজিং কেমন করা হচ্ছে সেটাই বড় কথা? আন্না হাজারে যখন লোকপাল আন্দোলন করেছিলেন, তখন তিনি বলতেন, লোকপাল হলেই দেশ থেকে সব দুর্নীতি দূর হয়ে যাবে।  সেই আন্দোলনের জেরে ইউপিএ হারলো, একসময় লোকপালও হলো। কিন্তু দুর্নীতি দূর হওয়া দূরস্থান, বরং তা দিব্যি জাঁকিয়ে বসেছে।

কেজরিওয়াল প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পরই বললেন, ঘুষ চাইলেই ফোনে রেকর্ড করুন, আমার কাছে পাঠান। শাস্তি দেবই। কিছুদিন পুলিশ, পুরসভা, প্রশাসনের মানুষজন একটু থমকেছিলেন। কিন্তু কিছুদিন পরে যে কে সেই।  এ তো গেলো ছোট ছোট দুর্নীতি। বড় বড় চুক্তিতে কাট কি বন্ধ হয়েছে? অন্তত অভিযোগ তো বন্ধ হয়নি। আর দুর্নীতির সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হলো, এর অঙ্ক কিছুতেই মেলে না। বফর্স মেলেনি, ইউপিএ আমলে একটা দুর্নাীতিরও ফয়সালা হয়নি, এনডিএ আমলে আনা সব অভিযোগ খারিজ হয়ে গেছে।  তাহলে কি আপাতত শান্তিকল্যাণ? দুর্নীতির ইনডেক্স তো তা বলছে না। প্রতিদিনের অভিজ্ঞতাও তো তা বলছে না। কালো টাকার হদিশ পেতে ডিমনিটাইজেশন বা নোটবন্দি করা হলো। তারপর কী হলো? কালো টাকা কমেছে, এমন দাবিও তো করছেন না কেউ।

আসলে রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তি না থাকলে দুর্নীতি বন্ধ করা যায় না। মনমোহন সিং-এর কথাই ধরুন। তার মতো আনখশির সৎ প্রধানমন্ত্রী ভারতের ইতিহাসে খুব কমই হয়েছেন, তারপরেও তার সরকারের একের পর এক মন্ত্রীর বিরুদ্ধে গুরুতর দুর্নীতির অভিযোগ এসেছে। সেই দুর্নীতির মূলোচ্ছেদ করার ইচ্ছা থাকলেও হয়ত শক্তি তার ছিল না। তাই তাকে এভাবে বিদায় নিতে হয়েছে।  আমরা এখন প্রায়ই শুনি, ইডি, সিবিআইয়ের সক্রিয়তার কথা। তারপরই অভিযোগ ওঠে, বেছে বেছে বিরোধী নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। দুর্নীতি তো তখনই যাবে, যখন আঘাতটা দল না দেখে, প্রভাবের কথা না ভেবে শুধু দুর্নীতিগ্রস্তদের উপরে করা হবে। 

শেষে শুধু এই আশাটুকু থাক, একদিন ভারত থেকেও দুর্নীতি বিদায় নেবে। কীভাবে হবে জানি না, তবে আশাতেই তো চাষারা বাঁচে। 

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ