গত কয়েক বছরে পশ্চিমবঙ্গের দুর্নীতির নানা কেলেঙ্কারি ও কীর্তি সামনে এসেছেছবি: Payel Samanta/DW
ছেলেবেলায় টাকার মাহাত্ম্য বোঝাতে বলা হতো, টাকা ফেললে বাঘের দুধও পাওয়া যায়। স্থলে, জলে, অন্তরীক্ষে ব্যাপ্ত এই দুর্নীতির রাজত্বে মনে হয়, এই যে টাকা মোক্ষ ভেবে যেভাবেই হোক তা রোজগার করার চেষ্টা চলছে। আর আমাদের প্রাপ্য পরিষেবা পেতে গিয়ে কিঞ্চিত খরচ তো করতেই হয়- এই সব আপ্তবাক্যের আড়ালে লাখ লাখ কোটি টাকার দুর্নীতির খেলা চলছে, চলেই যাচ্ছে। আগে দুর্নীতি করে যারা অর্থ উপার্জন করতেন, তারা তা গোপন করার চেষ্টা করতেন। এখন সব খুল্লাম খুল্লা চলে। দুর্নীতিও।
একটা ছোট উদাহরণ দিই। আমার এক বন্ধুর ছেলে একটি নামী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গেছিল। সেখানে অধ্যাপক এথিক্সের ক্লাস নিচ্ছিলেন। কথা হচ্ছিল দুর্নীতি নিয়ে। সেখানে এক সরকারি অফিসারের ছেলে বলেছিল, ‘‘দুর্নীতি তো করতেই হবে। আমার বাবা যদি দুর্নীতি না করতো৷ নাহলে কি আমি এই দামী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারতাম? নাকি আমার হাতে আইফোনের শেষতম মডেল থাকতো?'' মোক্ষম যুক্তি। কিন্তু তার থেকে মোক্ষম হলো, একটা গোটা ক্লাসের সামনে জোরগলায় বলা. তার বাবা ঘুস খায়, সেই দুর্নীতির টাকায় সে পড়তে এসেছে।
গত ১১ ফেব্রুয়ারি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল যে তালিকা প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, দুর্নীতির ইনডেক্সে ভারত আছে ১৮০টি দেশের মধ্যে ৯৬ নম্বরে। ২০২৩ সালে ছিল ৯৩ নম্বরে। প্রতিবেশী বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার অবস্থা আরো অনেকটাই খারাপ। তবে সেটা তো শ্লাঘার বিষয় হতে পারে না। কিছুদিন আগে চীন এই তালিকায় একশ নম্বরে ছিল। তারা এখন ৭৬ নম্বরে। ডেনমার্কে দুর্নীতি সবচেয়ে কম। তারপরে আছে ফিনল্যান্ড ও সিঙ্গাপুর। তারা পারলে আমরা কেন দুর্নীতি কমাতে পারি না?
২০২১ সালে লোকসভায় পার্সোনেল মন্ত্রী জিতেন্দ্র সিং জানিয়েছিলেন, সরকার দুর্নীতি নিয়ে ‘জিরো টলারেন্স' নীতি নিয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে, দুর্নীতি কমাতে স্বচ্ছ্ব নাগরিক-বান্ধব পরিষেবা দেয়া, যেমন নাগরিকদের জন্য যাবতীয় কল্যাণমূলক ব্যবস্থা সরাসরি তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে দেয়া, ই-টেন্ডারিং করা, ই-গভর্ননেন্স মডেল নেয়া, খাদ্যশস্য কেনার ক্ষেত্রে ই -মার্কেটপ্লেসের ব্যবহার, যেসব সরকারি কর্মী জনস্বার্থে কাজ করেন না বা যারা ঠিকভাবে কাজ করেন না, তাদের অবসরের ব্যবস্থা করা। যেখানেই দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে, সেখানেই ভিজিলেন্স কমিশন তদন্ত করে। সেন্ট্রাল ভিজিলেন্স কমিশন বা সিভিসি দুর্নীতি দমনে নানা ধরনের ব্যবস্থা নিতে পারেন। এছাড়া লোকপাল রয়েছে। তাদের কাছে অভিযোগ গেলে তারা সঙ্গে সঙ্গে তার তদন্ত করে। অর্থাৎ, সরকার সম্ভাব্য সব ব্যবস্থা নিচ্ছে, যার ফলে দুর্নীতি নির্মূল হলো বলে। সম্ভবত ১৯৫২ সালে প্রথম লোকসভা ও রাজ্যসভা গঠনের পর থেকেই দুর্নীতি নিয়ে সরকারের কাছে অসংখ্য প্রশ্ন রেখে আসছেন সাংসদরা। তার উত্তর কম-বেশি একই রকমের। যেভাবে প্রতিটি সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে রণসাজে সজ্জিত হয়ে অভিযানে ব্যস্ত থাকে, তাতে এতদিনে দুর্নীতি দমনে ভারতের এক নম্বর দেশ হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে কী হয়েছে?
২০২১ সালের উত্তরকে ভিত্তি করে একবার বাস্তব অবস্থার দিকে তাকানো যাক। কোনো সন্দেহ নেই সরকার ডাইরেক্ট বেনিফিট ট্রান্সফার বা সরাসরি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠায়। আদর্শ ব্যবস্থা হলে এখানে দুর্নীতি করার জায়গা থাকে না। মনমোহন সিং এবং নরেন্দ্র মোদী বারবার দাবি করেছেন, এর ফলে টাকা পাবেন তিনিই, যার পাওয়ার কথা। মাঝখান থেকে দালালরা এসে বাগ বসাতে পারবে না। কিন্তু বাস্তবে কি তাই হয়? এককথায় জবাব, হয় না। হয় না, কারণ, দুর্নীতিও তো তার রূপ বদল করেছে। আমার এক সাংবাদিক বন্ধু অবসর নেয়ার পর পূর্ব ভারতে তার গ্রামে ফিরে গিয়ে পঞ্চাযেত নির্বাচনে দাঁড়িয়ে জিতে যায়। তার কাছ থেকেই শুনেছি, সব ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ কাটের একটা গল্প আছে। তা যাদের কাছে সরকারি প্রকল্পের টাকা পোঁছচ্ছে তাদেরও ক্ষেত্রেও যেমন প্রযোজ্য, তেমনই প্রযোজ্য রাস্তা তৈরি, আলোর ব্যবস্থা, বাড়ি তৈরি করে দেওয়ার মতো বিষয়গুলির ক্ষেত্রেও। কাট না দিলে? তালিকায় নামও আর থাকবে না। আর এই কাটে উঁচু থেকে নিচু সকলেরই নাকি অধিকার আছে। পুরো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। দিবে আর নিবে, মেলাবে মিলিবে আর কী। না দিলে মিলবে না।
চাকরি দুর্নীতি : যোগ্যদের পাশাপাশি অযোগ্যদেরও পাশে থাকতে চেয়ে তোপের মুখে মমতা
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, যোগ্যদের চাকরির বিষয়টির ফয়সালা করে অযোগ্যদের বিষয়টিও দেখবেন। কিন্তু ‘স্বেচ্ছাশ্রম’ মানতে নারাজ যোগ্যরা৷ অযোগ্যদের পাশে থাকার বার্তা দিয়েও তোপের মুখে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী...
ছবি: Satyajit Shaw/DW
সময় চাইলো এসএসসি
সুপ্রিম কোর্ট রায়ে বলেছিল, যেহেতু যোগ্য ও অযোগ্যর মধ্যে পার্থক্য করা যাচ্ছে না, তাই প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষকের চাকরি বাতিল হবে। এসএসসি সুপ্রিম কোর্টে করা আবেদনে বলেছে, চলতি শিক্ষাবর্ষের শেষপর্যন্ত যোগ্যদের চাকরি করতে দেয়া হোক। এর জন্য সুপ্রিম কোর্ট প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিক।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
মমতা যা বললেন
নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে চাকরিহারাদের একাংশকে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ''কারো চাকরি যাবে না। আগে রাজ্য সরকার সুপ্রিম কোর্টের ব্যাখ্য়া চাইবে। সুপ্রিম কোর্টের নেতিবাচক উত্তর হলে সরকার যোগ্যদের নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিকল্প ব্যবস্থা করে দেবে। দুই মাসের মধ্যে বিকল্প ব্যবস্থা করে দেবো।''
ছবি: Satyajit Shaw/DW
স্বেচ্ছাশ্রমের প্রস্তাব
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ‘‘আপনারা কি এখনো বরখাস্তের নোটিস পেয়েছেন? (না পেয়ে থাকলে) চাকরি করুন না! স্বেচ্ছায় তো সকলেই কাজ করতে পারেন।’’ তিনি আরো বলেন, ''আপনাদের সরকার বরখাস্ত করেনি। আপনারা স্কুলে যান। কাজ করুন।'' কিন্তু স্বেচ্ছায় কাজ করলে বেতন পাওয়া যাবে কিনা, স্বেচ্ছায় কাজ করলে চুক্তিবদ্ধ শিক্ষকদের মতো অল্প বেতন দেয়া হবে কিনা, সে বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রী কিছু বলেননি।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
প্রতিবাদ
মুখ্যমন্ত্রীর স্বেচ্ছাশ্রমের বিষয়টি উপস্থিত চাকরিহারা শিক্ষকরা মেনে নিতে পারেননি। তাদের অনেকেই বলতে থাকেন, এভাবে হয় না, স্বেচ্ছাশ্রম বিষয়টির ব্যাখ্যা চাই। তবে তারা স্কুলে ফিরতে চান। তারা বলেন, বেতনসহ চাকরি রাখা হলে তারা স্কুলে ফিরবেন। তবে তারা চুক্তিভিত্তিক চাকরি করতে চান না।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
অযোগ্যদের চাকরির প্রসঙ্গে মমতা
এ বিষয়ে মমতা বলেন, ''অযোগ্যদের বিরুদ্ধে তথ্য-প্রমাণ পরীক্ষা করবো। অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হলে আমার কিছু বলার থাকবে না। কিন্তু অযোগ্য কাকে বলেছে, কেন বলেছে, কোন এজেন্সি বলেছে- সে সব দেখবো। নিশ্চিন্তে থাকুন। যোগ্য এবং অযোগ্যদের মধ্যে গন্ডগোল বাঁধাবেন না। মানুষকে শিক্ষা দিন। শিক্ষিত করুন। কারা যোগ্য, কারা অযোগ্য তা আদালত বলেনি। ২০২২ থেকে খেলা শুরু করেছে। আমি জেনে-শুনে কারো চাকরি খাইনি।''
ছবি: Satyajit Shaw/DW
অযোগ্যদের নিয়ে বক্তব্যের প্রতিবাদ
অযোগ্যদের নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর এই কথার প্রতিবাদ করেন সভায় উপস্থিত চাকরি হারানো শিক্ষকরা। তারা বলেন, অযোগ্যদের চাকরি দেয়া যাবে না। তাদের প্রশ্ন- যোগ্যদের তালিকা তিনি কি সুপ্রিম কোর্টে দেবেন? সুপ্রিম কোর্ট তো তালিকা দেবে না। দেবে এসএসসি। সিবিআই রিপোর্ট মানলে যোগ্য ও অযোগ্যদের তো আগেই আলাদা করা যেতো।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
চাকরিহারাদের দাবি
চাকরিহারা শিক্ষকদের অনেকেই বলেছেন, রাজ্য সরকার ও এসএসসির জন্য এখন তাদের এই অবস্থা। তারা যোগ্য ও অযোগ্য আলাদা করেনি। চাকরি হারানো যোগ্য শিক্ষকরা মনে করেন, মুখ্যমন্ত্রী সব গোলমাল পাকিয়েছেন।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
বিকাশ ভট্টাচার্য বনাম মমতা
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ''সিপিএমের কাছে প্রশ্ন করছি, কেন বিকাশ ভট্টাচার্য সব চাকরি বাতিল করালেন? তাকে আইসোলেট করুন।'' এর জবাবে বিকাশ ভট্টাচার্য বলেছেন, ''তিনি দুর্নীতি করেছেন। সকলে পেটাবে। মারের হাত থেকে বাঁচতে এসব বলছেন। তিনি বারবার যোগ্য অযোগ্য বলছেন। হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্টে তো বললেন না। রায়ের পর লম্ফঝম্প করছেন।''
ছবি: Srijit Roy
বিরোধী নেতার বক্তব্য
রাজ্যের বিরোধী দলীয় নেতা শুভেন্দু অধিকারী বলেছেন, ''সরকারের কাছে সুযোগ আছে চাকরি দেয়ার। সরকার রিভিশন পিটিশন করেছে। সরকার যোগ্যদের তালিকাটা ফেলে দিন। তাহলে দুধ ও জল আলাদা হবে। কোনো বিতর্ক থাকবে না। সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, সরকার ও এসএসসির অসহযোগিতার জন্য যোগ্য ও অযোগ্য বাছতে পারলাম না। তিনি (মমতা) যদি বলেন, সবাইকে চাকরি দিলাম ১০ হাজার টাকা করে দেবো. সেটা মানবো না।''
ছবি: Satyajit Shaw/DW
নবান্নর কাছে বিক্ষোভ
চাকরি না পাওয়া শিক্ষকদের একাংশ নবান্নর কাছে গিয়ে বিক্ষোভ দেখান। তাদের দাবি, যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও তারা কেন চাকরি পাবেন না তাদের বিক্ষোভ ছত্রভঙ্গ করে দেয় পুলিশ৷
ছবি: Satyajit Shaw/DW
সারা রাত চাকরিহারা শিক্ষকদের অপেক্ষা
নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে মুখ্যমন্ত্রীর সভায় যাবেন বলে কলকাতার বাইরে থেকে আসা শিক্ষকরা সারা রাত শহিদ মিনারের পাশে মাঠে ছিলেন। ‘যোগ্য’ লেখা কার্ড সংগ্রহ করে সকালে নেতাজি ইন্ডোরে যান তারা।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
ঢোকার সময় ঝামেলা
‘যোগ্য’ কার্ড না পাওয়ায় অনেক শিক্ষকই ইন্ডোর স্টেডিয়ামে ঢুকতে পারেননি। জোর করে ঢুকতে চাওয়ায় পুলিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তিও হয় তাদের।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
12 ছবি1 | 12
পশ্চিমবঙ্গের উদাহরণ ধরুন। গত কয়েক বছরের মধ্যে কত কেলেঙ্কারি, কীর্তি সামনে এলো। কী হলো? নারদ মামলা, যেখানে টিভিতে ঘুষ নিতে দেখা যাচ্ছে, সেখানেও প্রমাণ হাতড়ে বেড়াতে হচ্ছে ইডি, সিবিআইকে। সারদা, কয়লা কেলেঙ্কারি, গরুপাচার কোন তদন্ত শেষ হয়েছে? এখানে দুর্নীতি তো একা নয়, সঙ্গে জুড়ে গেছে রাজনীতি, তার সুবিধা-অসুবিধা, তার দায়দায়িত্ব। ফলে দুর্নীতি থেকে যাচ্ছে পিছনের সারিতে, আসল হচ্ছে, কী করলে ভোটে জেতা যায়, সেই কাহিনি।
আবার দেখুন, আয়কর বিভাগে যে সংস্কার চালু হয়েছে, তার ফলে দুর্নীতি অনেকটাই কমে গেছে। এখন মানুষ আয়কর রিটার্ন দেয়ার পর কিছুদিনের মধ্যে প্রাপ্য টাকা ফেরত পাচ্ছেন। সোজা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে তা চলে যাচ্ছে। আয়কর নিয়ে আগের অভিযোগ এখন আর নেই।
দিল্লির রাজনীতিকদের মধ্যে একটা চালু কথা আছে, দুর্নীতি নিয়ে মানুষ মাথা ঘামায় না। দুর্নীতি কাউকে হারাতে বা জেতাতে পারে না। সত্যি কি তাই? তাহলে বফর্সকাণ্ডের পর রাজীব গান্ধীর চূড়ান্ত পতন হলো কেন, কেনই বা দ্বিতীয় ইউপিএ-র পতন নিশ্চিত করলো একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগ, যার জেরে শীলা দীক্ষিতকেও গোহারা হারিয়ে দিল্লির কুর্সি দখল করলেন কেজরিওয়াল, আবার মদের লাইসেন্স কেলেঙ্কারির জেরে তাকেও যেতে হলো। আবার এর উল্টো উদাহরণও আছে। দুর্নীতির অসংখ্য অভিযোগ, সিন্ডিকেটরাজ, শিক্ষকের চাকরি টাকার বিনিময়ে বিক্রি করার এতবড় কেলেঙ্কারির পরেও তো তৃণমূল বারবার ক্ষমতায় আসতে পারে। সারদা-নারদও তাকে টলাতে পারে না। তাহলে কি প্যাকেজিং কেমন করা হচ্ছে সেটাই বড় কথা? আন্না হাজারে যখন লোকপাল আন্দোলন করেছিলেন, তখন তিনি বলতেন, লোকপাল হলেই দেশ থেকে সব দুর্নীতি দূর হয়ে যাবে। সেই আন্দোলনের জেরে ইউপিএ হারলো, একসময় লোকপালও হলো। কিন্তু দুর্নীতি দূর হওয়া দূরস্থান, বরং তা দিব্যি জাঁকিয়ে বসেছে।
কেজরিওয়াল প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পরই বললেন, ঘুষ চাইলেই ফোনে রেকর্ড করুন, আমার কাছে পাঠান। শাস্তি দেবই। কিছুদিন পুলিশ, পুরসভা, প্রশাসনের মানুষজন একটু থমকেছিলেন। কিন্তু কিছুদিন পরে যে কে সেই। এ তো গেলো ছোট ছোট দুর্নীতি। বড় বড় চুক্তিতে কাট কি বন্ধ হয়েছে? অন্তত অভিযোগ তো বন্ধ হয়নি। আর দুর্নীতির সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হলো, এর অঙ্ক কিছুতেই মেলে না। বফর্স মেলেনি, ইউপিএ আমলে একটা দুর্নাীতিরও ফয়সালা হয়নি, এনডিএ আমলে আনা সব অভিযোগ খারিজ হয়ে গেছে। তাহলে কি আপাতত শান্তিকল্যাণ? দুর্নীতির ইনডেক্স তো তা বলছে না। প্রতিদিনের অভিজ্ঞতাও তো তা বলছে না। কালো টাকার হদিশ পেতে ডিমনিটাইজেশন বা নোটবন্দি করা হলো। তারপর কী হলো? কালো টাকা কমেছে, এমন দাবিও তো করছেন না কেউ।
আসলে রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তি না থাকলে দুর্নীতি বন্ধ করা যায় না। মনমোহন সিং-এর কথাই ধরুন। তার মতো আনখশির সৎ প্রধানমন্ত্রী ভারতের ইতিহাসে খুব কমই হয়েছেন, তারপরেও তার সরকারের একের পর এক মন্ত্রীর বিরুদ্ধে গুরুতর দুর্নীতির অভিযোগ এসেছে। সেই দুর্নীতির মূলোচ্ছেদ করার ইচ্ছা থাকলেও হয়ত শক্তি তার ছিল না। তাই তাকে এভাবে বিদায় নিতে হয়েছে। আমরা এখন প্রায়ই শুনি, ইডি, সিবিআইয়ের সক্রিয়তার কথা। তারপরই অভিযোগ ওঠে, বেছে বেছে বিরোধী নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। দুর্নীতি তো তখনই যাবে, যখন আঘাতটা দল না দেখে, প্রভাবের কথা না ভেবে শুধু দুর্নীতিগ্রস্তদের উপরে করা হবে।
শেষে শুধু এই আশাটুকু থাক, একদিন ভারত থেকেও দুর্নীতি বিদায় নেবে। কীভাবে হবে জানি না, তবে আশাতেই তো চাষারা বাঁচে।
দুর্নীতি ও দমনের উপায় নিয়ে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের ভাবনা
বাংলাদেশে দুর্নীতি কি কমেছে? দেশ থেকে দুর্নীতি নির্মূলে কী করা উচিত? বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের ভাবনা থাকছে ছবিঘরে৷
ছবি: DW
ডা. আব্দুন নূর তুষার, গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব
বাংলাদেশে দুর্নীতির মূল কারণ আমার বিবেচনায় দুইটি৷ একটি স্বজনপ্রীতি, আরেকটি অর্থলোভ৷ দুর্নীতি পৃথিবীর কোথাও একেবারে বন্ধ হয় না৷ কিন্তু দুর্নীতিকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় যদি ক্ষমতা এবং দায়িত্বের সাথে সংশ্লিষ্ট লোকেরা অর্থলোভ ও স্বজনপ্রীতি- এই দুইটিকে পরিত্যাগ করে৷ দুর্ভাগ্যক্রমে বাংলাদেশে এটা আগে দেখিনি, এখনো দেখছি না৷ প্রকৃতপক্ষে দুর্নীতি চেহারা বদলায়নি, দুর্নীতিকারীর চেহারাগুলো বদল হয়েছে৷
ছবি: DW
মোহাম্মদ সাইফুল আলম চৌধুরী, শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
দুর্নীতির প্রবণতা আগের মতোই আছে৷ কোনো কোনো ক্ষেত্রে বরং বেড়েছে৷ স্বার্থের দ্বন্দ্ব দুর্নীতির বড় অনুঘটক৷ সেটি তো এখন সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে প্রকাশ্যে দৃশ্যমান৷ বাংলাদেশে দুর্নীতিতে প্রতিকারের কথা ভাবা হয়, প্রতিরোধ নয়৷ শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মতো মৌলিক চাহিদাগুলো রাষ্ট্র পূরণ না করে শুধু দুদক দিয়ে দুর্নীতি দমন করা যাবে না৷ কর পরিশোধের পরও যখন রাষ্ট্র মৌলিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয়, তখন দুর্নীতি হবেই৷
ছবি: DW
মোঃ রেজাউল করিম, অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার
সৎ ও যোগ্য অফিসারদের মূল্যায়ন করে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসালে দুর্নীতি কমে আসবে৷ দুর্নীতিতে যুক্ত অফিসারদের চিহ্নিত করে গুরুত্বহীন পদে বসাতে হবে, বিশেষ করে সেবামূলক কোনো পদে তাদের কিছুতেই বসানো যাবে না৷ তবেই দুর্নীতি কমবে৷ আর সিবিএ (সেন্ট্রাল বার্গেইনিং এজেন্ট) বন্ধ করা গেলে এ ক্ষেত্রে বড় সুফল পাওয়া যেতে পারে৷ দলীয় লেবেলে এদের সীমাহীন দৌরাত্ম্যে অফিস-আদালতের স্বাভাবিক কাজ পরিচালনা করা দূরূহ হয়ে পড়ে৷
ছবি: DW
ইশরাত হাসান, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী
দুর্নীতির মূল কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে জবাবদিহিতার অভাব, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ প্রশাসনিক দুর্বলতা ও আইন প্রয়োগে পক্ষপাত৷ দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ অনুসারে দুদককে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে, যাতে তারা তদন্ত ও বিচারপ্রক্রিয়া নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করতে পারে৷ একইসাথে তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯ সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করলে সরকারি সেবায় স্বচ্ছতা বাড়বে৷
ছবি: DW
আব্দুল হক, রিকশাচালক
আওয়ামী লীগ সরকারের সময় দুর্নীতি ছিল৷ বিএনপি সরকার বলছে তারা আসলে দুর্নীতি করবে না৷ প্রকৃতপক্ষে সবাই দুর্নীতি করে৷ তবে বর্তমানে দুর্নীতি আগের চেয়ে বেশি, কারণ এখন কোনো সরকার নেই৷ আমার কাছে মনে হয় নতুন সরকার আসলে দুর্নীতি কিছুটা কমবে৷
ছবি: DW
মোঃ দেলোয়ার হোসেন, খুচরা বিক্রেতা
বর্তমানে দুর্নীতি সব দিকে হচ্ছে৷ আগেও ছিল, এখনো আছে৷ দুর্নীতি কমাতে হলে মানুষের মূল্যবোধ তৈরি করতে হবে, মানুষকে সচেতন করতে হবে৷ সামাজিকভাবে দুর্নীতিবাজদেরকে বয়কট করতে হবে৷ টাকার বান্ডেল এক ধরনের নেশা, এ নেশায় পড়ে তাই অনেকে দুর্নীতিতে জড়িয়ে যায়৷ আগেও ছিল, এখনো আছেন তবে কিছুটা কম বলে মনে হয়৷
ছবি: DW
জয় শাহরিয়ার, সংগীতশিল্পী
এখন তো একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আছে দায়িত্বে৷ তাদের মূল দায়িত্ব কিছু সংস্কার আর একটা ভালো নির্বাচন দিয়ে যাওয়া৷ তাই দুর্নীতির অবস্থা মূলত নিরুপণ করা যাবে রাজনৈতিক সরকার এলে৷ কারণ আমাদের রাজনৈতিক সরকারের নৈতিক অবস্থান ও সুশাসনের ওপর নির্ভর করবে দেশের দুর্নীতির অবস্থা৷
ছবি: DW
আনিকা আফরোজা দিশা, বেসরকারি চাকরিজীবী
দুর্নীতির হাত বদল হয়েছে কেবল, মানুষের অসৎ পথের আয়ের আগ্রহ কমেনি৷ যতই অভ্যুত্থান হোক না কেন ব্যক্তি পর্যায় থেকে চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া প্রয়োজন৷ সাথে আইনের কঠোর প্রয়োগ ও সুষ্ঠ ব্যবহার প্রয়োজন৷
ছবি: DW
আনিলা তাবাস্সুম হৃদি, মডেল ও উদ্যোক্তা
বর্তমানে দুর্নীতির অবস্থা গত ১৫ বছরের ফ্যাসিস্ট সরকারের তুলনায় অনেক কম৷ আগে পুলিশের কাছে গেলে টাকা দিয়ে কাজ করাতে হতো৷ এখন একটা সাধারণ জিডি করতে গেলেও কোনো টাকা খরচ হয় না৷ দুর্নীতি কমাতে হলে সবার প্রথমে যে রাষ্ট্রের কর্তা তাকে অনেক বেশি স্বচ্ছ হতে হবে৷ রাষ্ট্রের প্রধান যখন আইন মেনে চলার বিষয়ে কঠোর হবেন, তখন দুর্নীতি অনেকটা কমানো সম্ভবত হবে৷