ভারতে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা বেড়েছে৷ দেশটির অপরাধের চিত্র সেই তথ্যই দিচ্ছে৷ তবে সার্বিক অপরাধের সংখ্যা আগের চেয়ে কিছুটা কমেছে৷ বেড়েছে শাস্তির হারও৷
বিজ্ঞাপন
২০১৭ সালের তুলনায় ২০১৮ সালে ভারতে কিছু অপরাধের হার কমেছে ২০১৮-তে৷ তবে নারী নির্যাতন ও শ্লীলতাহানির সংখ্যা ছয় দশমিক চার শতাংশ বেড়েছে৷ শিশুদের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের ঘটনাও এক দশমিক ছয় শতাংশ বেড়েছে৷
পরিসংখ্যান অনুযায়ী ভারতে হত্যা, হত্যাচেষ্টা, ডাকাতি, পণ বা যৌতুকের জন্য হত্যা, সরকারি সম্পত্তি নষ্ট করার ঘটনা কমেছে৷ দণ্ডবিধি অনুসারে স্বীকৃত অপরাধ সবমিলিয়ে কমেছে দশমিক এক শতাংশ৷ তা সত্ত্বেও ভারতে প্রতিদিন গড়ে ৮০টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা এবং ৯১ টি ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে৷
নারীদের বিরুদ্ধে অপরাধে শীর্ষে রয়েছে দিল্লি৷ অন্য মহানগরের তুলনায় দিল্লিতে সব ধরনের অপরাধের সংখ্যা চারগুণ বেশি৷ ফলে দিল্লি এখনও দেশের অপরাধ-রাজধানী৷ তবে নারীদের বিরুদ্ধে অ্যাসিড হামলার ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটেছে পশ্চিমবঙ্গে৷ এরপরই রয়েছে উত্তর প্রদেশ। ২০১৮ সালে পশ্চিমবঙ্গে ৩৬টি ও উত্তর প্রদেশে ৩২টি অ্যাসিড হামলা হয়েছে৷ তবে সবমিলিয়ে মহানগরগুলির মধ্যে কলকাতাই সবথেকে নিরাপদ৷
নারী ও শিশুদের বিরুদ্ধে অপরাধ বাড়ার দায়টা সাধারণত পুলিশ ও প্রশাসনের ওপরে গিয়ে পড়ে৷ তবে পশ্চিমবঙ্গে নারী কমিশনের প্রধান লীনা গঙ্গোপাধ্যায়ের ব্যাখ্যা, ''নারীদের ক্ষেত্রে সচেতনতা বেড়েছে৷ তাঁরা পুলিশের কাছে গিয়ে অভিযোগ জানাচ্ছেন৷'' ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেছেন, ''এ জন্যই স্বাভাবিকভাবে অপরাধের হার বেশি দেখাচ্ছে৷ তবে গত কয়েক বছরে নৃশংসতা যে বেড়েছে তা অস্বীকার করা যায় না৷ খুন করে পুড়িয়ে দেওয়া যায়, তা এখন দেখতে পাচ্ছি৷ এটা আগে হত কিনা বলতে পারব না, সেরকম অভিযোগ সামনে আসেনি৷ এখন আসছে৷ ফলে নারীদের বিরুদ্ধে অপরাধের ধরন ও নৃশংসতা দুইই বেড়েছে৷''
পশ্চিমবঙ্গের শিশুরক্ষাকমিশনের চেয়ারপার্সন অনন্যা চট্টোপাধ্যায়ও মনে করেন, শিশু নিগ্রহের ঘটনা আগের তুলনায় অনেক বেশি করে সামনে আসছে৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেছেন, ''পুলিশ এখন শিশুদের বিরুদ্ধে অপরাধ বন্ধ করার জন্য অনেক বেশি সক্রিয়৷ তারা ভালো কাজ করছে৷ নির্যাতন আগেও হত৷ কিন্তু পুলিশের কাছে কম অভিযোগ জানানো হত৷ এখন আগের থেকে অনেক বেশি অভিযোগ দায়ের করা হচ্ছে, বলে সংখ্যাটা বেশি মনে হচ্ছে৷''
যৌন হয়রানির হাত থেকে কীভাবে বাঁচাবেন শিশুকে
শিশুরা বিকৃতকাম মানুষের সহজ শিকার৷ সারল্যের সুযোগ নিয়ে সহজে ভোলানো যায় তাদের৷ অনেক সময় শিশুরা বুঝতে পারে না, চিনতে পারে না পিশাচের থাবা৷ আর বুঝলেও করতে পারে না প্রতিবাদ, প্রতিরোধ৷ শুধু একটা অস্বস্তি থেকে যায় সারাটা জীবন৷
ছবি: picture alliance/abaca
ভয়াবহ অবস্থা ভারতে
ভারতের জাতীয় ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের অর্ধেকেরও বেশি বাচ্চা যৌন নিগ্রহের শিকার৷ তবে সবচেয়ে ভয়ংকর সত্য হলো, নাবালিকা বা শিশুর ওপর যৌন হেনস্থার ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটছে পরিবারের মধ্যে, পরিবারেরই কোনো মানসিক বিকারগ্রস্ত সদস্যের হাতে৷ তাই সে সব ঘটনা পুলিশের কাছে পৌঁছাচ্ছে না, হচ্ছে না কোনো ডাইরি অথবা মামলা৷
ছবি: Fotolia/Gina Sanders
হারিয়ে যাচ্ছে শৈশব
এভাবে প্রতিদিন বিকৃত যৌন নির্যাতনে হারিয়ে যাচ্ছে অগুন্তি শৈশব৷ অনেকক্ষেত্রেই শিশুরা বুঝে উঠতে পারছে না, বলে উঠতে পারছে না তাদের অমানবিক সেই সব অভিজ্ঞতার কথা৷ তাই শিশুদের প্রতি যৌনাসক্ত, বিকৃত মানুষগুলো থেকে যাচ্ছে লোকচক্ষুর আড়ালে৷ সমাজবিদরা বলছেন, এ জন্য আগাম সতর্কতার দায়িত্ব নিতে হবে অভিভাবক এবং স্কুলের৷ শিশুকে দিতে হবে তার প্রাপ্য শৈশব৷
ছবি: Fotolia/Kitty
যেভাবে বোঝাবেন বাচ্চাদের
সহজ ভাষায় খেলা বা গল্পচ্ছলে শিশুদের এ বিষয়ে একটা ধারণা গড়ে তোলা যেত পারে৷ বাচ্চাদের বলতে হবে যে, তাদের শরীরটা শুধুমাত্র তাদের৷ অর্থাৎ কেউ যেন তাদের ‘গোপন’ জায়গায় হাত না দেয়৷ তাই কোনো আত্মীয় বা পরিচিত ব্যক্তির আচরণ অস্বস্তিকর ঠেকলে, কেউ তাদের জোর ঘরে কোনো ঘরে নিয়ে গেলে, খেলার ছলে চুমু দিলে বা শরীরের কোথাও হাত দিলে – তা যেন মা-বাবাকে জানায় তারা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
চিনিয়ে দিন যৌনাঙ্গ
অনেক বাবা-মা নিজ সন্তানের সঙ্গে যৌনাঙ্গ নিয়ে কথা বলতে কুণ্ঠা বোধ করেন৷ কিন্তু এই লজ্জা কাটিয়ে উঠতে হবে এবং খুব ছোটবেলাতেই ছবি এঁকে অথবা গল্পে-গানে বাচ্চাকে তার শরীরের অন্য সব অঙ্গের মতো যৌনাঙ্গ, লিঙ্গ ইত্যাদি চিনিয়ে দিতে হবে৷ এমনটা করলে কেউ যদি তাদের সঙ্গে পিশাচের মতো ব্যবহার করে, তাহলে শিশুরা সহজেই বলতে পারবে কে, কখন, কোথায় হাত দিয়েছিল৷
ছবি: DW/S.Rahman
শিশুর কথা শুনুন, তার পক্ষ নিন
শিশু যাতে আপনাকে বিশ্বাস করতে পারে, বন্ধুর মতো সবকিছু খুলে বলতে পারে – সেটা নিশ্চিত করুন৷ আপনার বাচ্চা যদি পরিবারের কাউকে বা আপনার কোনো বন্ধুকে হঠাৎ করে এড়িয়ে যেতে শুরু করে অথবা আপনাকে খুলে বলে বিকৃত সেই মানুষের কৃতকর্মের কথা, তবে সময় নষ্ট না করে শিশুটির পক্ষ নিন আর তিরস্কার করে বাড়ি থেকে বার করে দিন ঐ ‘অসুস্থ’ লোকটাকে৷
ছবি: Fotolia/pegbes
স্কুলেরও দায়িত্ব আছে
বাচ্চারা দিনের অনেকটা সময় স্কুলে কাটায়৷ তাই যৌন শিক্ষার ক্ষেত্রে স্কুলের একটা বড় দায়িত্ব থেকে যায়৷ তবে স্কুলের মধ্যে, বিদ্যালয় চত্বরেও ঘটতে পারে শিশু নির্যাতনের ঘটনা৷ তাই স্কুল থেকে ফেরার পর বাচ্চা যদি অতিরিক্ত চুপচাপ থাকে, একা একা সময় কাটায় বা পড়াশোনা করতে না চায়, তাহলে ওর সঙ্গে কথা বলুন৷ জানতে চান কী হয়েছে, প্রয়োজনে স্কুল কর্তৃপক্ষকেও জানান৷
ছবি: picture-alliance/blickwinkel
ছেলে-মেয়ে সমান!
আমাদের সমাজে ছোট থেকেই মেয়েদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়৷ মেয়ে হলেই হাতে একটা পুতুল আর ছেলে হলে ধরিয়ে দেয়া হয় বল বা খেলনার পিস্তল৷ ছেলের পাতে যখন তুলে দেয়া হয় মাছের বড় টুকরোটা, তখন মেয়েটির হয়ত এক গ্লাস দুধও জোটে না৷ এ বৈষম্য বন্ধ করুন৷ বাবা-মায়ের চোখে ছেলে-মেয়ে সমান – সেভাবেই বড় করুন তাদের৷ তা না হলে নারীর ক্ষমতায়ন হবে কীভাবে? কীভাবে কমবে শিশু নির্যাতন?
ছবি: picture alliance/abaca
7 ছবি1 | 7
ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর হিসাব থেকে আরেকটি উল্লেখযোগ্য তথ্য বেরিয়ে এসেছে৷ বেড়েছে দেশদ্রোহের ঘটনা৷ শিল্পক্ষেত্রে (ইন্ডাস্ট্রিয়াল) দাঙ্গার পরিমাণ বেড়েছে৷ ২০১৭ সালে যেখানে ৫১টি দেশদ্রোহের ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছিল, সেখানে পরের বছর সংখ্যাটা বেড়ে হয়েছে ৭০৷ শিল্প-দাঙ্গার সংখ্যা বেড়েছে ১৭৮টি৷ জল নিয়ে দাঙ্গার সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৩৮টি৷ কিন্তু কমেছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, কৃষি সংক্রান্ত দাঙ্গার সংখ্যা৷ বেড়েছে অন্য ধরনের দাঙ্গাহাঙ্গামার সংখ্যা৷ কমেছে কৃষক আত্মহত্যার সংখ্যাও৷
রিপোর্ট বলছে, বেআইনি অনুপ্রবেশকারীদের গ্রেফতার ও নথিভুক্তিকরণ নিয়ে মামলার সংখ্যা কমেছে৷ ২০১৮ সালে এই সংখ্যাটা ছিল ৯৯৯ টি৷ আগের বছর ছিল এক হাজার ২৮৫৷ তবে সরকারের খুশি হওয়ার একটাই জায়গা আছে, তা হল, বিভিন্ন অপরাধে শাস্তির পরিমাণ ৫০ শতাংশ বেড়েছে৷ ১৯৮৮ সালের পর এই প্রথম আবার তা এই জায়গায় পোঁছল৷ কিন্তু ধর্ষণ, ধর্ষণের চেষ্টা ও হত্যার ক্ষেত্রে শাস্তির হার কম৷ ফলে চিত্রটা যথেষ্ট উদ্বেগজনক৷