ভারতের মেওয়ায় রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির প্রতিমাসেই নতুন নতুন অবৈধ রোহিঙ্গারা আসছেন৷ বাংলাদেশের শরণার্থী শিবির থেকে তাদের ভারতে বিক্রি করে দিচ্ছে দালালরা৷
বিজ্ঞাপন
তাদেরই একজন আবদুল রহমান৷ রাখাইনে সবুজ ক্ষেতের হাতছানি তাঁর কাছে এখন কেবলই স্মৃতি৷ সেই স্মৃতি বুকে নিয়ে ঝাপসা চোখে তিনি ভারতের মথুরায় ন্যাকড়া কুড়াতেন৷
রাখাইন থেকে প্রথমে বাংলাদেশ৷ এরপর দশ হাজার টাকায় দালাল তাঁকে ভারতে পাচার করে দেয়৷ উত্তরাঞ্চলের মথুরায় মনিব তাঁকে ন্যাকড়া কুড়ানোর কাজ দেন৷ থাকতেন পলিথিনের তৈরি ভাড়া বাড়িতে৷ সেখান থেকেই তাঁকে উদ্ধার করে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ৷
শুধু রহমানই নন, তার সঙ্গে আরো সাতটি পরিবারকে বাংলাদেশের শরণার্থী শিবির থেতে পাচার করে দেয়া হয় ভারতে৷
রোহিঙ্গা শিশুদের খোঁজ নিচ্ছে না কেউ
01:26
‘‘মনিব আমাকে মাথা গোঁজার ঠাই দেন৷ পেটে দু‘টো দানাপানি পড়ে৷'' রয়টার্সকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলছিলেন ৪৫ বছর বয়সি চার সন্তানের এই জনক৷
‘‘দালাল আমাকে বলেছিল যে, ভারতে এলে ভালো থাকা যাবে৷''
বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরগুলোতে মানবপাচারকারীদের উৎপাত সম্পর্কে আগেই সতর্ক করেছিল জাতিসংঘ৷ ভারতে এই চুক্তিভুক্ত শ্রমিকদের উদ্ধার করার পর দাস হিসেবে এদের চালান করে দেয়ার বিষয়টি সামনে এলো৷
দাসপ্রথার অনুরূপ এমন চুক্তিভুক্ত শ্রম ১৯৭৬ সালেই নিষিদ্ধ করেছে ভারত৷ কিন্তু এখনো লাখো শ্রমিক ক্ষেত খামার, ইটভাটা, পতিতালয়, অথবা গৃহে কাজ করছেন৷
তবে কর্তৃপক্ষ উদ্ধার করলে অনেকে নগদ টাকা, জমি বা ঘর ক্ষতিপূরণ পান, তবে কেবল ভারতীয় হলেই৷ রোহিঙ্গারা যেহেতু অবৈধ অনুপ্রবেশ করেছেন, তাই তাদের ক্ষেত্রে কী হবে তা অনিশ্চিত৷
কেউ কেউ মনে করছেন, তাদের বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে৷
এ পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রায় দশ লাখ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছেন, যার মধ্যে গেল বছরের ২৫ আগষ্টের পর থেকেই গিয়েছেন প্রায় সাড়ে ছয় লাখ৷ অন্যদিকে গেল এক দশকে ভারতে প্রবেশ করেছেন প্রায় ৪০ হাজার রোহিঙ্গা৷
রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে বিয়ে
শরণার্থী শিবির, তাতে কী? সেখানে তো কোনো আনন্দ আয়োজনে বাধা নেই! শফিকা আর সাদ্দাম তাই নিজেদের নতুন জীবন শুরু করলেন আশ্রয় শিবিরেই৷ মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা এই দু’জন রোহিঙ্গা শরণার্থী গত মাসের শেষে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন৷
ছবি: Reuters/D. Sagolj
আনন্দের সেই দিন
শফিকার বয়স ১৮ বছর৷ বিয়ের ঠিক আগে ফটোগ্রাফারকে বিয়ের আংটি আর হাতের মেহেদি দেখাচ্ছেন তিনি৷ অনেকেরই বিশ্বাস, মেহেদির রং নব-দম্পতির জীবনকে রঙিন করে এবং জীবনে খুশির বার্তা নিয়ে আসে৷
ছবি: Reuters/D. Sagolj
শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি
বর সাদ্দামের বয়স ২৩ বছর৷ তিনি বিয়ের আসরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন৷ শফিকার সাথে তাঁর বাল্যকালের প্রেম৷ তাঁরা মিয়ানমারের গ্রাম ফয়রা বাজারে থাকতেন৷ কিন্তু মিয়ানমার সেনাবাহিনী তাঁদের গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়৷ তবে সেখান থেকে পালিয়ে আসার আগেই তাঁদের বিয়ের সবকিছু ঠিক ছিল৷
ছবি: Reuters/D. Sagolj
বিদায়ের অশ্রু
এখন বিয়েটা হচ্ছে, তবে নিজের দেশে নয়৷ আত্মীয়-পরিজনরা ঘিরে রেখেছে নবপরিণীতাকে৷ বাপের বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার মতোই, শফিকা এখন এই তাঁবু ছেড়ে বরের তাঁবুতে গিয়ে উঠবেন৷
ছবি: Reuters/D. Sagolj
অতিথিদের আগমন
বিয়ে উপলক্ষ্যে অন্যান্য শরণার্থী শিবির থেকে অতিথিরা বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসেছেন৷ শফিকা এবং সাদ্দাম মাত্র তিন মাস আগে বাংলাদেশে আসেন৷ সে সময় কুতুপালং আশ্রয়কেন্দ্রে জরুরি শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছিলেন তাঁরা৷
ছবি: Reuters/D. Sagolj
আল্লাহর নামে শপথ
অন্যান্য ইসলামি বিয়ের মতোই এই বিয়ের রীতি-নীতি একই ছিল৷ একজন ইমাম তাঁদের বিয়ে পড়ান৷ পরে শফিকা এবং সাদ্দাম আল্লাহ’র উদ্দেশে শুকরিয়া আদায় করে প্রার্থনা করেন৷
ছবি: Reuters/D. Sagolj
বিয়ের অনুষ্ঠান
ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষে তরুণরা নেচে গেয়ে অতিথিদের আনন্দ দেন৷ নাচ-গানের মধ্য দিয়ে যেন তাঁরা তাঁদের কষ্টের কথা কিছু সময়ের জন্য হলেও ভুলে যান৷
ছবি: Reuters/D. Sagolj
স্বাভাবিক জীবনে প্রত্যাবর্তন
বিয়ের পাঁচদিন পর শরণার্থী শিবিরে নতুন জীবন শুরু করেছেন নব-দম্পতি৷ সাদ্দাম রাস্তার পাশে ওষুধ বিক্রি করেন আর শফিকা বাড়ির কাজে ব্যস্ত থাকেন৷
ছবি: Reuters/M. Djurica
আশার আলো
আরো অনেক শরণার্থীদের মতোই এই নব-দম্পতির আশা একসময় তাঁরা নিজেদের বাড়িতে নিরাপদে ফিরে যেতে পারবেন৷
ছবি: Reuters/M. Djurica
8 ছবি1 | 8
দিল্লি থেকে ১০০ কিলোমিটার দক্ষিণে মেওয়াতে ভারতের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির৷ সেখানেই উঠেছেন রহমান৷ সেখানে প্রতি মাস-দু'মাসে নতুন নতুন রোহিঙ্গা শরণার্থীরা যুক্ত হচ্ছেন৷
গেল মাসেও ১৩ জনকে উদ্ধার করে আনা হয়েছে৷
রহমান অবশ্য ভারতে গিয়েছেন আরো বছর চারেক আগে, ২০১৩ সালে৷ চার বছর পর যখন উদ্ধার হলেন, তখন তার হাতে ফুটো কড়িও নেই৷ কারণ, মনিব যে পয়সায় তাঁকে কিনেছেন, তা তাঁর বেতন থেকে কেটে রাখা হতো৷
একই অবস্থা তার সঙ্গে উদ্ধার হওয়া বাকিদেরও৷ ২২ বছর বয়সি সাদিক হোসেন বলেন, ‘‘মনিবের কাছে আমার এখনো আরো ৫ হাজার রূপী ঋণ আছে৷''
তাই স্থানীয়রা শরণার্থীদের জন্য জায়গা দিলেও ঘর বানানোর পয়সা নেই তাদের কাছে৷
রোহিঙ্গারা মুসলিম বলে ভারতে তাদের কাজ পাওয়া খুব কঠিন৷ পাকিস্তানের জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ থাকতে পারে এমন যুক্তিতে নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে তাদের ফেরত পাঠানোর বা ভারত থেকে তাড়িয়ে দেয়ার আইনি উপায় খুঁজছে কর্তৃপক্ষ৷
সম্প্রতি দিল মোহাম্মদ নামের এক রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানো হয়েছে৷ তিনি জম্মুতে ১১ হাজার রুপী বেতনে চাকরি করতেন৷
বাদামি ছাতা ও এক রোহিঙ্গা পরিবারের সংগ্রাম
মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নির্যাতন থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে গেছে নূর হাফেস ও তাঁর পরিবার৷ ১২ বছরের হাফেস এখন তার পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি৷
ছবি: Reuters/A. Abidi
আগতদের ছায়া দেয়া
বাদামি ছাতা হাতে ছেলেটির নাম নূর হাফেস৷ বয়স মাত্র ১২৷ দুই মাসেরও বেশি সময় আগে ছোট সাত ভাই-বোন ও মায়ের সঙ্গে বাংলাদেশে পালিয়ে যায় সে৷ এই বাদামি ছাতার সঙ্গে আগতদের আশ্রয় দিয়ে কিছু অর্থ উপার্জন করে নূর হাফেস৷
ছবি: Reuters/A. Abidi
পরিবারকে সহায়তা
বাদামি ছাতার তলে একজনকে আশ্রয় দিয়ে তাঁর কাছ থেকে পাওয়া ৫০ টাকা দেখাচ্ছে নূর হাফেস৷ এর বাইরে ইমামদের কাছ থেকেও মাঝেমধ্যে টাকা পায় সে৷ রোহিঙ্গাদের জন্য বিভিন্ন মসজিদে মুসল্লিদের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করে সেগুলো রোহিঙ্গাদের মাঝে বিতরণ করেন ইমামরা৷ বাবা না থাকায় ১২ বছরের নূর হাফেসই এখন তার পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি৷
ছবি: Reuters/A. Abidi
বাবার খবর নেই
হাফেসদের বাড়ি ছিল মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংদুর থারায় কোন ইয়ো ডান গ্রামে৷ সেনাবাহিনীর উপস্থিতি টের পেয়ে কিছু বুঝে উঠতে না পেরে নূর হাফেসের বাবা কোথাও চলে যায়৷ এরপর থেকে বাবার আর খবর নেই৷
ছবি: Reuters/A. Abidi
স্বামী ছাড়াই বাংলাদেশে পাড়ি
স্বামীর খোঁজ না পেয়ে জীবন বাঁচাতে হাফেস সহ আট সন্তানকে নিয়ে নৌকা করে বাংলাদেশে পালিয়ে যান রাবিয়া খাতুন৷ বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে তিনি মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নৃশংসতার কথা শুনিয়েছেন৷ এখন তারা আছে কক্সবাজারের পালং খালি শরণার্থী শিবিরে৷
ছবি: Reuters/A. Abidi
ঘরবাড়ি পোড়ানো
রাবিয়া খাতুন বলেন, ‘‘ঘরের ভেতর মানুষ রেখে বাইরে থেকে সেখানে আগুন ধরিয়ে দেয় মিয়ানমার সেনাবাহিনী৷’’ তিনি বলেন, অনেক মানুষকে তিনি গুলিবিদ্ধ অবস্থায় দেখেছেন৷ আর ঘর জ্বলতে দেখে মানুষের চিৎকার শুনেছেন৷ ছবিতে বড় ছেলে নূর হাফেসের মাথা আঁচড়িয়ে দিচ্ছেন রাবিয়া খাতুন৷
ছবি: Reuters/A. Abidi
বাবার বাড়ি পালানো
নিজের গ্রামে সেনাবাহিনীর তাণ্ডব দেখে কিছু জরুরি জিনিস সঙ্গে নিয়ে বাবার বাড়ি পালিয়ে গিয়েছিলেন রাবিয়া খাতুন৷ কিন্তু পরের দিনই সেখানে আবার সেনাবাহিনীর উপস্থিতি দেখতে পান৷ তখন আর কোনো উপায় না দেখে বাংলাদেশে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন তিনি৷ ছবিতে আট মাসের শিশুকন্যা ফাতেমা রাজিয়াকে গোসল করাতে দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Reuters/A. Abidi
বাবাকে সহায়তা করত হাফেস
মিয়ানমারে থাকার সময় পাইকারি বাজার থেকে বাবার কিনে আনা পণ্য স্থানীয় গ্রামে বিক্রি করত নূর হাফেস৷ বাংলাদেশে গিয়েও সেরকম কিছু করতে চায় সে৷ কারণ বাবা না থাকায় ছোট ভাই-বোনের কথা ভাবতে হচ্ছে তাকে৷ আট ভাই-বোনের মধ্যে ছ’জনের বয়সই দশের নীচে৷ ছবিতে হাফেসকে মাছ বিক্রি করতে দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Reuters/A. Abidi
শিশুর মতো আচরণ নয়
হাফেসের মা বলছেন, তিনি জানেন তাঁর ছেলে এখনও ছোট৷ কিন্তু এখনই সে তার দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন বলে জানায় রাবিয়া খাতুন৷ ‘‘এখন সে শিশুর মতো আচরণ করে না’’, বলেন তিনি৷
ছবি: Reuters/A. Abidi
স্কুল আর ফুটবল
ভাগ্যের ফেরে ১২ বছর বয়সেই জীবন সংগ্রামে নামতে বাধ্য হয়েছে নূর হাফেস৷ ছবিতে সাদা শার্ট পরিহিত হাফেসকে ত্রাণের জন্য অপেক্ষা করতে দেখা যাচ্ছে৷ অবশ্য এখনও বন্ধুদের সঙ্গে স্কুলে যাওয়া আর ফুটবল খেলার স্বপ্ন দেখে সে৷ রয়টার্সের প্রতিবেদককে অন্তত সেই কথাই জানিয়েছে নূর হাফেস৷