ভারতে পাসপোর্ট পেতে গেলে পুলিশ ভেরিফিকেশন বাধ্যতামূলক। পুলিশ তথ্য যাচাই না করে দিলে পাসপোর্ট পাওয়া য়ায় না।
বিজ্ঞাপন
ভারতে পুলিশ রেকর্ড পরীক্ষা করে জানায় আবেদনকারীর বিরুদ্ধে কোনোরকম অভিয়োগ আছে কিনা, মামলা হয়েছে কিনা, পুলিশি খাতায় তার নাম আছে কিনা। তাছাড়া তারা আবেদনকারীর বাড়ি গিয়ে তার সঙ্গে কথা বলেন। দুই জন প্রতিবেশীর সঙ্গে কথা বলেন এবং রিপোর্ট দেনছবি: picture-alliance/Dinodia Photo Library
তবে তৎকাল পাসপোর্টের ক্ষেত্রে পুলিশ ভেরিফিকেশন পাসপোর্ট দেওয়ার পরে হয়। কিন্তু তৎকাল পাসপোর্টের ক্ষেত্রে উচ্চপদস্থ গেজেটেড অফিসারের সার্টিফিকেট দরকার হয়। সেই অফিসার ব্যক্তিগতভাবে না চিনলে সার্টিফিকেট পাওয়া কঠিন। কারণ, সেই গেজেটেড অফিসারের পরিচয়পত্রের ফটোকপিও তার সার্টিফিকেটের সঙ্গে জমা করতে হয়। ফলে কোনো গড়বড় হলে ওই অফিসারের ঘাড়েও দোষ পড়ে। এক্ষেত্রেও পাসপোর্ট দিয়ে দেয়ার পর পুলিশ ভেরিফিকেশন হয়। আসলে তৎকাল পাসপোর্ট খুব জরুরি দরকার হলে দেয়া হয়। তাই এই ব্যবস্থা।
না হলে সাধারণভাবে পাসপোর্ট দেয়ার ক্ষেত্রে পুলিশ ভেরিফিকেশন জরুরি। এখন ভারতে পাসপোর্ট পাওয়ার পদ্ধতি খুবই আধুনিক ও ঝামেলাহীন করে দেয়া হয়েছে। অনলাইনে পাসপোর্টের আবেদন করতে হয়। তারপর নির্দিষ্ট দিনে পাসপোর্ট অফিসে সব নথিপত্র নিয়ে যেতে হয়। তারা আধার কার্ড-সহ সব নথিপত্র পরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় পদ্ধতিগত কাজ শেষ করেন। তারপর আবেদনপত্র পাঠিয়ে দেয়া হয় পুলিশের কাছে।
আবেদনকারী যে এলাকায় থাকেন, সেই থানায় বা সেই এলাকার পুলিশ অফিসে বিষয়টি যায়। তারপর পুলিশ দুইটি কাজ করে। প্রথমত, রেকর্ড পরীক্ষা করে জানায় আবেদনকারীর বিরুদ্ধে কোনোরকম অভিয়োগ আছে কিনা, মামলা হয়েছে কিনা, পুলিশি খাতায় তার নাম আছে কিনা। তাছাড়া তারা আবেদনকারীর বাড়ি গিয়ে তার সঙ্গে কথা বলেন। দুই জন প্রতিবেশীর সঙ্গে কথা বলেন এবং রিপোর্ট দেন।
সাধারণত সাত থেকে ২১ দিনের মধ্যে পুলিশের রিপোর্ট দেয়ার কথা। তবে সচরাচর সাতদিনের মধ্যেই রিপোর্ট চলে যায়। তার কয়েকদিনের মধ্যে পাসপোর্ট দিয়ে দেয়া হয়।
কেন পুলিশ ভেরিফিকেশন জরুরি?
ভারতে পাসপোর্ট সেবার ওয়েবসাইটে এই প্রশ্নের জবাব দেয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, পাসপোর্ট খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং দামি একটা নথি। এটা যাতে ভুল মানুষের হাতে না পড়ে, তার জন্য পুলিশ ভেরিফিকেশন জরুরি। আবেদনকারী যে তথ্য দিয়েছে, তা ঠিক কিনা তা যাচাই করে নেয়া প্রয়োজন।
এই যুক্তি নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই। বর্তমানে দুনিয়াজুড়ে জালিয়াতির যুগে নাগরিকত্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি দলিল এবং বিদেশে বৈধভাবে যাওয়ার ক্ষেত্রে তার সবচেয়ে বড় পরিচয়পত্র এবং ট্রাভেল ডকুমেন্ট নিয়ে সাবধানী হতেই হয়। ফলে পাসপোর্ট নিয়ে হালকা মনোভাব দেখানোর কোনো প্রশ্নই ওঠে না।
ভারতের পাসপোর্ট আইনে বলা হয়েছে, কেউ যদি তথ্য গোপন করে পাসপোর্ট নিতে চায়, তাহলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হবে এবং এর জন্য কারাদণ্ড হতে পারে। বিশেষ করে কোনো মামলায় শাস্তি হয়েছে কি না, কোন ধরনের মামলা সেই সব বিষয় উল্লেখ করতে হয়।
এখন পুলিশ ভেরিফিকেশন না হলে, কী করে বোঝা যাবে আবেদনকারী সত্য গোপন করেছে কিনা? কারো হাতে বিদেশে যাওয়ার প্রধান নথি তুলে দেয়ার আগে তার সম্পর্কে ন্যূনতম খোঁজখবর নেয়ার দায়িত্বও তো সরকারের থাকে।
দুর্নীতির প্রসঙ্গ
পুলিশের বিরুদ্ধে একটা সাধারণভাবে দুর্নীতি নিয়ে একটা অভিয়োগ আছে। তাই এই পুলিশ ভেরিফিকেশনের ঝামেলা তুলে দেয়া উচিত বলে একটা যুক্তি শোনা য়ায়। প্রথমেই বলে নেয়া ভালো, আমার বা আমার পরিবারের কারো কাছে ভেরিফিকেশনের জন্য কোনো পুলিশ কর্মী কোনোদিন পয়সা চাননি।
তর্কের খাতিয়ে ধরে নেয়া গেল, কারো কাছ থেকে তারা চাইতে পারেন। তার প্রতিকারের পদ্ধতি আছে। তার জন্য তথ্য যাচাইয়ের পদ্ধতি তুলে দেয়ার কথা যারা বলেন, তারা নেহাতই কুযুক্তি দেন। কোনো সন্দেহ নেই, দুর্নীতি বন্ধ হওয়া দরকার। তার জন্য সরকারের উপযুক্ত পদক্ষেপ নেয়া দরকার। প্রশ্ন হলো, আজকের সমাজে, সরকারি অফিসে কোথায় দুর্নীতি নেই? তাহলে তো সবই তুলে দিতে হয়। সেক্ষেত্রে মাৎস্যন্যায় ছাড়া তো আর কিছু হবে না।
ভিসা দেয়ার ক্ষেত্রে
এমনিতেই ভিসা দেয়ার ক্ষেত্রে দেখে নেয়া হয়, আবেদনকারীর কোনো অপরাধের রেকর্ড আছে কিনা। এই পরিস্থিতিতে কোনো দেশ যদি পুলিশ ভেরিফিকেশন ছাড়া পাসপোর্ট দেয়, তখন তাদের ভিসা দেয়ার ক্ষেত্রেও কড়াকড়ি হবে। সবদিক আরো ভালো করে খতিয়ে দেখেই ভিসা দেয়া হবে। ভিসা নিয়ে এই কড়াকড়ি কি তখন সাধারণ মানুষের ভালো লাগবে?
পাসপোর্টে পুলিশ ভেরিফিকেশন বন্ধে লাভ-ক্ষতি
পাসপোর্টের ক্ষেত্রে পুলিশ ভেরিফিকেশন উঠিয়ে দেওয়ায় আপাতত হয়রানি কমেছে বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু এ নিয়ে নানা দুশ্চিন্তার কারণ রয়েছে বলেও মনে করছেন কেউ কেউ। সংশ্লিষ্টদের প্রতিক্রিয়া জানুন ছবিঘরে।
ছবি: DW
‘পুলিশের দুর্নাম তো অনেকদিনের’
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক ও সাবেক সংসদ সদস্য নূর মোহাম্মদ মনে করেন, ‘‘দেশে তো আইনের অভাব নেই, কিন্তু বাস্তবায়নে সমস্যা। পাসপোর্টে ভেরিফিকেশনে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ তো অনেকদিনের। পুলিশ ওই দুর্নাম থেকে বের হতে পারেনি। ফলে সরকার যে সিদ্ধান্তটা নিয়েছে, সেটা তো অবশ্যই চিন্তা করে নিয়েছে। কাজটা শুরু হোক, তারপর বোঝা যাবে ঠিক হলো না ভুল হলো। কোথাও কোনো সমস্যা হলে পরে সংশোধন করা যাবে।’’
ছবি: privat
‘পর্যটন ভিসা কমতে পারে’
লেক্সাস ট্যুর অ্যান্ড ট্র্যাভেলস-এর সত্বাধিকারী অজিত কুমার সাহা বলেন, ‘‘পাসপোর্টের ক্ষেত্রে পুলিশ ভেরিফিশেন বাদ দেওয়ার কারণে পর্যটকদের ভিসা পেতে সমস্যা হতে পারে। যারা সত্যিকারের পর্যটক, এখন তারা অনেক ক্ষেত্রেই ভিসা না-ও পেতে পারেন। কারণ, দেশে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা রয়েছে। ফলে পর্যটকদের যেসব দেশ ভিসা দেয়, তারা এখন আগের থেকে বেশি সতর্ক হবে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভিসা কমিয়েও দিতে পারে।’’
ছবি: privat
‘বিশেষ ক্ষেত্রে ভেরিফিকেশন হতে পারে’
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান বলেন, ‘‘ঢালাওভাবে যারা পাসপোর্টের আবেদন করবেন, তাদের সবার যদি ভেরিফিকেশন করতে হয়, এটা সময়সাপেক্ষ কাজ। বরং যেটা হয়েছে, সেটা আমার মনে হয় ভালো কাজ। কিন্তু পাসপোর্ট অধিদপ্তরের যদি কারো আবেদন নিয়ে সন্দেহ হয়, সেক্ষেত্রে পুলিশ ভেরিফিকেশনের বিষয়টা থাকা উচিত। আবেদন করলেই পাসপোর্ট দিতে হবে, এমনটি না করে সন্দেহ হলে ভেরিফিকেশন থাকাটা ভালো।’’
ছবি: privat
‘মধ্যপ্রাচ্যের কোনো কোনো দেশ পুলিশ ভেরিফিকেশন রিপোর্ট চায়’
অভিবাসন বিশেষজ্ঞ হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরন বলেন, ‘‘আমাদের অনেক অভিবাসী কর্মীকে পাসপোর্টের জন্য খুব ভোগান্তির শিকার হতে হয়। এখন অন্তত সেই ভোগান্তিটা আর থাকবে না। তবে শঙ্কার জায়গাটা হলো, এখন মধ্যপ্রাচ্যের কোনো কোনো দেশ ভিসার সময় পুলিশ ভেরিফিকেশন রিপোর্ট চায়। এই সংখ্যা ভবিষ্যতে বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। সেক্ষেত্রে আমাদের মিশনগুলোকে আরো বেশি সক্রিয় হতে হবে।’’
ছবি: privat
‘সন্ত্রাসীদের নিয়ে শঙ্কা আছে’
দীর্ঘদিন মালয়েশিয়ায় কাজ করে দেশে ফিরে অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করছেন আল আমিন নয়ন৷ তিনি মনে করেন, ‘‘শুরুতে পাসপোর্ট পাওয়াটাই বড় চ্যালেঞ্জ। এর জন্য একজন কর্মীকে শুরুতেই বেশ কিছু টাকা খরচ করতে হয়। এখন সেই খরচটা লাগবে না। সমস্যা হলো, দেশে অপরাধে যুক্ত কেউ যদি ভেরিফিকেশন ছাড়া বিদেশে চলে যান, সেখানে তিনি অপরাধে যুক্ত হতে পারেন। এতে বাংলাদেশিদের দুর্নাম হবে এবং কাজের ক্ষেত্র সংকুচিত হতে পারে।’’
ছবি: privat
‘এনআইডি নিয়েও ঝামেলা আছে’
সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘‘এখন যেটা বলা হচ্ছে, এনআইডি বা বার্থ সার্টিফিকেট দিয়ে পাসপোর্ট করা হবে। কিন্তু এনআইডি নিয়েও তো অনেক ঝামেলা আছে। আমি মনে করি, সরকার চিন্তা করেই সিদ্ধান্তটা নিয়েছে। তবে এর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে সবার এনআইডি, যদি ডিজিটাল হয় তাহলেও পরিচয় জটিলতা যেটা আছে সেটা কিছুটা কমবে। এনআইডির গুরুত্বটা আরো বাড়লো।’’
ছবি: Samir Kumar Dey
‘ক্যানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর নামেও জন্ম নিবন্ধন হয়েছিল’
ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, ‘‘কাউকে পাসপোর্ট দেওয়ার আগে তিনি বাংলাদেশের নাগরিক কিনা সেটি নিশ্চিত হওয়া জরুরি। ১৮ বছরের উপরে হলে জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে নাগরিকত্ব যাচাই যতটা সহজ, ১৮ বছরের নীচে হলে জন্মনিবন্ধন দিয়ে সেটা ততটা সহজ নয়। বাংলাদেশের জনসংখ্যার চেয়ে জন্মনিবন্ধনের সংখ্যা বেশি হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এমনকি ক্যানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর নামেও জন্ম নিবন্ধন হয়েছিল।