ভারতবর্ষের বেশিরভাগ প্রাথমিক স্কুল কর্তৃপক্ষ সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বাচ্চাদের প্রতি নানান ধরণের বৈষম্যমূলক আচরণ করে থাকেন, যেটা তাদের শিক্ষার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করার নামান্তর৷ জানাচ্ছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ৷
বিজ্ঞাপন
মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে সমীক্ষা চালিয়ে যে রিপোর্ট তৈরি করেছে, সম্প্রতি নতুন দিল্লির এক আলোচনাচক্রে তার ওপর বক্তব্য রাখেন বিভিন্ন বক্তা৷
রিপোর্টের মূলকথা: ভারতের প্রাথমিক স্কুলগুলিতে প্রান্তিক জনসমাজের বাচ্চাদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করা হচ্ছে, যার ফলে তারা বঞ্চিত হচ্ছে শিক্ষার অধিকার থেকে৷ কেন্দ্রীয় সরকার ২০০৯ সালে ৬ থেকে ১৪ বছর বয়সের বাচ্চাদের জন্য বাধ্যতামূলক অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা আইন চালু করার পর দেখা যায় প্রায় অর্ধেক, অর্থাৎ ৮ কোটিরও বেশি বাচ্চা স্কুল ছেড়ে দিচ্ছে অষ্টম শ্রেণির গণ্ডি বা প্রাথমিক শিক্ষা শেষ হবার আগেই৷ অথচ রাজ্য, জেলা ও পঞ্চায়েত স্তরের শিক্ষা কর্মকর্তারা কখনোই এ বৈষম্যের কথা স্বীকার করেন না, সমস্যার সমাধান তো দূর অস্ত৷
ভারতের চারটি রাজ্য অন্ধ্র প্রদেশ, উত্তর প্রদেশ, বিহার এবং দিল্লির সরকারি প্রাথমিক স্কুলগুলিতে সমীক্ষা চালিয়ে এবং সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে কথা বলে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ সংস্থার গবেষকরা প্রান্তিক শ্রেণির বাচ্চাদের প্রতি কী ধরণের বৈষম্য করা হয়, কারা করেন, কেন করেন এবং তা নিবারণের জন্য কী করণীয় – সে বিষয়ে প্রকাশিত রিপোর্ট নিয়ে সেই আলোচনাচক্রে বক্তব্য রাখেন৷
আলোচনার সূত্রপাত করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর দক্ষিণ এশিয়ার ডায়রেক্টর মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনকে ঘিরে ভারতে এখন তুমুল উত্তেজনা৷ শিক্ষা, কর্মসংস্থান, প্রবৃদ্ধি নিয়ে চলছে ভাষণবাজি, বাকযুদ্ধ ও বিতর্ক৷ কিন্তু আইন থাকা সত্ত্বেও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বাচ্চারা শিক্ষার মৌলিক অধিকার থেকে কেন বঞ্চিত? কেন তারা বৈষম্যের শিকার? কারা দায়ী এ জন্য? সরকার, রাজনৈতিক দল বা দলের নেতারা কেন এই বিষয়ে উদাসীন? কী ধরণের বৈষম্য করা হয়, কারা করে এবং এর জন্য কারা দায়ী?
এ প্রশ্নগুলির উত্তরে মীনাক্ষী গাঙ্গুলি প্রথমেই দায়ী করেন স্কুল শিক্ষক এবং কর্তৃপক্ষকে৷ ডয়চে ভেলেকে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, বৈষম্যটা ওদের স্তর থেকেই শুরু হয় প্রথমে৷ ওদের প্রথম নিশানা দলিত, উপজাতি এবং গরিব মুসলিম পড়ুয়ারা৷
কী ধরণের বৈষম্য? যেমন উত্তর প্রদেশের আট বছরের এক উপজাতি বাচ্চা ছেলে পঙ্কজ (নাম পরিবর্তিত) বা ওর মতো আরো অনেক পড়ুয়াদের কথায়, ‘‘ক্লাসে অন্য সহপাঠিদের সঙ্গে বসতে গেলে দিদিমনি উঁচুজাতের ছেলে-মেয়েদের পাশে বসতে দেন না, আলাদা বসতে বলেন৷ কারণ নীচুজাতের ছেলে-মেয়েরা, মানে আমরা নাকি খুব নোংরা৷ তাই দিদিমনি আমাদের বসতে বলেন একেবারে শেষের বেঞ্চিতে বা অন্য রুমে৷ শুধু তাই নয়, কথায় কথায় গালাগালি দেন আমাদের৷ স্কুলের প্রার্থনা সভায় বা অন্য কোনো বড় অনুষ্ঠানে আমাদের যোগ দিতে বারণ করা হয়৷ মিড-ডে মিলে সবার শেষে আমাদের খেতে দেয়া হয়৷ এমনকি শিক্ষকদের টয়লেট পর্যন্ত সাফ করতে বলা হয়, বলা হয় শিক্ষকদের পা টিপে দিতে৷ নইলে মার খেতে হয় আমাদের৷ যেটা তথাকথিত উচ্চবর্গের সুবিধাভোগী পরিবারের পড়ুয়াদের বলার সাহস হয় না শিক্ষক-শিক্ষিকাদের৷''
সব দেশেই শিক্ষার ধরণ আলাদা
বিশ্বের প্রায় সব দেশেই শিক্ষকরা চক দিয়ে ব্ল্যাকবোর্ডে লেখেন – এ দৃশ্য তাই সবারই জানা৷ কিন্তু তারপরও দেশ ভেদে এর পার্থক্য রয়েছে, বিশেষকরে আজকের এই তথ্য প্রযুক্তির যুগে৷
ছবি: Getty Images
সব স্কুল কি এক রকম?
সারা বিশ্বের ছাত্ররা একইভাবে পড়ালেখা শেখে? না, তবে প্রায় সব দেশেই শিক্ষকরা চক দিয়ে ব্ল্যাকবোর্ডে লেখেন – এ দৃশ্য তাই সবারই জানা৷ কিন্তু তারপরও দেশ ভেদে এর পার্থক্য রয়েছে৷ কোনো দেশে ছাত্র-ছাত্রীরা খোলা আকাশের নীচে মাটিতে পা মুড়ে বসে লেখাপড়া করে, কোথাও আবার স্কুল বেঞ্চে বসে৷ আবার কোনো কোনো দেশের ছাত্রদের রয়েছে নিজস্ব ল্যাপটপ৷
ছবি: AP
ডিজিটাল স্কুলের বই
দক্ষিণ কোরিয়ার শিক্ষাব্যবস্থা পুরোপুরি ডিজিটাল সিস্টেমে চলে৷ প্রতিটি ক্লাস রুমেই রয়েছে কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট৷ সরকারের ইচ্ছে সব স্কুল বই পুরোপুরিই ই-বুকে রূপান্তরিত করার৷ ডিজিটাল সিস্টেমে লেখাপড়া করতে কোনো ছেলে-মেয়ের যেন অসুবিধা না হয় এবং ডিজিটাল বইয়ের অভাবে যেন কারো লেখাপড়া বন্ধ না হয়, সেজন্য সরকার বিনা মূল্যে তাদের ট্যাবলেট এবং কম্পিউটার দিয়ে থাকে৷
ছবি: AP
গ্রামের স্কুলে যাওয়ার অসুবিধা
অন্যভাবেও পড়াশোনা চলতে পারে৷ কোনোরকমে ঝুলানো একটি ব্ল্যাকবোর্ড এবং কয়েকটি কাঠের বেঞ্চই আফ্রিকার ঘানার এই স্কুলটির জন্য যথেষ্ট৷ এই স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত বিনা বেতনে লেখা পড়া করা যায়, যদিও কাগজে কলমে রয়েছে ক্লাস নাইন পর্যন্ত লেখপড়া বাধ্যতামূলক৷ পড়াশোনার মাধ্যম ইংরেজি হওয়ায় গ্রামের ছাত্রদের অনেকেরই লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া বেশ কঠিন হয়৷
ছবি: Fotolia/Living Legend
টাচপ্যাডের মাধ্যমে লেখা শেখা
তবে জার্মানির এই স্কুলটি ব্যতিক্রম৷ কাগজ, পেন্সিল ছাড়া ছাত্ররা পুরোপুরি স্মার্টবোর্ড এবং নেটবুকের মাধ্যমে লেখা শেখে৷ ডিজিটাল নেটওয়ার্কিং-এর ছাত্রদের যোগাযোগের কাজে সাহায্য করে এবং কর্মদক্ষতা বাড়ায়৷ জার্মানিতে এখনো দুই মিলিয়ন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ লিখতে পড়তে পারেন না, যদিও পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে জার্মানির সবাই লেখাপড়া জানেন৷
ছবি: AP
শিল্পোন্নত দেশগুলোতে ছোটবেলা থেকেই সুবিধা
শিল্পোন্নত দেশ মানেই সে দেশের ছাত্র-ছাত্রীদের অন্যদেশের চেয়ে লেখাপড়ায় অনেক বেশি এগিয়ে থাকা৷ এমনকি ছোট বাচ্চাদেরও সেভাবেই তৈরি করা হয়, যেমন অ্যামেরিকার এই স্কুলটিতে৷ শিল্পোন্নত দেশগুলোতে ছোটবেলার শিক্ষাকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় এবং ৭০ শতাংশ বাচ্চাই প্রাইমারি স্কুলে যাওয়ার আগে অনেককিছু শিখে ফেলে৷ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ১০ জনের মধ্যে হয়ত তিনজন কিন্ডারগার্টেনে যাওয়ার সুযোগ পায়৷
ছবি: AP
যেখানে শিক্ষা অর্থের জন্য বাঁধাগ্রস্থ
কেনিয়াতে সব ছাত্রই অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বিনা বেতনে পড়তে পারে৷ তারপরও অনেকে তার আগেই স্কুল ছেড়ে দেয়৷ স্কুল ড্রেস, বই, খাতা, জুতো ইত্যাদি জোগাড় করা অনেক বাবা মায়ের জন্য কষ্টকর হয় দাঁড়ায়৷ সেখানে ছাত্রের সংখ্যা অনেক বেশি এবং পড়াশোনার মানও নিম্ন৷ যাঁদের সামর্থ রয়েছে সে রকম অনেক বাবা-মা তাঁদের বাচ্চাদের প্রাইভেট স্কুলে পাঠান৷
ছবি: DW/J.Bruck
স্কুল ড্রেস পরে লেখাপড়া
ইংল্যান্ডে স্কুল ড্রেস ছাড়া কেউ স্কুলে যায় না৷ ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য স্কুল ড্রেস পরা বাধ্যতামূলক৷ কারণ স্কুল ড্রেস যার যার স্কুলের পরিচয় বহন করে এবং পড়াশোনার প্রতি উৎসাহী করে৷ দরিদ্র পরিবাররের ছেলে-মেয়েরা স্কুল ড্রেসের জন্য স্কুল থেকে টাকা পেয়ে থাকে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/dpaweb
খোলা আকাশের নীচে ক্লাসরুম
একটি পাবলিক পার্কে ক্লাস নেওয়া হচ্ছে পাকিস্তানের একটি স্কুলে৷ গরিব বাবা-মায়েরা পয়সার অভাবে এমন স্কুলেই তাঁদের সন্তানদের পাঠিয়ে থাকেন৷ পাকিস্তানে শিক্ষা খাতে ব্যয় কমানো হয়েছে, কারণ সরকার শিক্ষার চেয়ে সামরিক খাতে বেশি খরচ করে৷ যা ছাত্ররাও বুঝতে পারছে৷
ছবি: AP
কমপক্ষে মৌলিক শিক্ষা থাকতে হবে
আফগানিস্তানে গৃহযুদ্ধ ও নানা সমস্যার কারণে ছাত্র-ছাত্রীরা শিক্ষার সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত৷ বিশেষকরে মেয়েদের ক্ষেত্রে একথাটি বেশি প্রযোজ্য৷ প্রতি দশজনের একজন লিখতে পড়তে পারে সেখানে৷ তবে এ হার পুরুষদের ক্ষেত্রে শতকরা ৪০ জন৷ তাছাড়া স্কুলগুলোতে প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট স্কুলও নেই, অভাব রয়েছে শিক্ষক এবং শিক্ষার সরঞ্জামেরও৷
ছবি: picture-alliance/dpa
মেয়েরা শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত
আফগানিস্তানের মতো প্রায় একই অবস্থা দক্ষিণ সুদানেও৷ এদেশেও মেয়েদের প্রতি পাঁচজনের একজন লিখতে ও পড়তে পারে৷ সেজন্যই বিদেশি সাহায্য সংস্থাগুলো সুদানের মেয়েদের শিক্ষার দিকে বিশেষ নজর দিয়ে থাকে৷ বহু বছরের গৃহযুদ্ধ সে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় ঘুণ ধরিয়ে দিয়েছে৷ অনেক স্কুলেই বই-খাতা এবং টেবিল-বেঞ্চও ঠিকমতো নেই৷
ছবি: dapd
কো-এডুকেশন পছন্দ নয়
কো-এডুকেশন? না, ইরানে সেটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়৷ ছেলে এবং মেয়ে আলাদাভাবে পড়াশোনা করে ইরানে৷ এমন কি এই ইহুদি স্কুলেও ইসলামিক স্কুল ড্রেস পরা বাধ্যতামূলক৷ এখানে মেয়েরা যে ধর্মেরই হোক না কেন সবাইকেই চুল ঢেকে রাখতে হবে, অর্থাৎ হিজাব পরতে হবে৷
ছবি: AP
ধনী-গরিবের পার্থক্য
ব্রাজিলের গ্রামাঞ্চলের ছাত্রদের জন্য লেখাপড়া করা বেশ কঠিন৷ কারণ সেখানকার স্কুলগুলোতে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নেই৷ যেমন মন্টে আলেগ্রের এই স্কুলটির মতো ৷ যদিও ব্রাজিল শিল্পোন্নত দেশগুলোর একটি, তারপরও এদেশে গরিব এবং ধনীদের মধ্যে অনেক পার্থক্য৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বাংলাদেশের অবস্থা অনেকটা একই রকম
বাংলাদেশের গ্রামের স্কুল এবং রাজধানী ঢাকা শহরের স্কুলের মধ্যে বিশাল পার্থক্য৷ বড় শহরগুলোতে ছাত্ররা কম্পিউটার বা ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে৷ আর গ্রামের স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের কম্পিউটার ব্যবহার করার ইচ্ছা – এখনো স্বপ্ন!
ছবি: Getty Images
13 ছবি1 | 13
এইভাবে দিনের পর দিন অপমান ও অমানবিক আচরণে স্কুলের প্রতি এই সব প্রান্তিক ছেলে-মেয়েদের আকর্ষণ আর থাকে না৷ গরিব অভিভাবকরাও বাচ্চাদের স্কুলে পাঠানোর চেয়ে শিশু শ্রমিক হবার দিকেই ঠেলে দেন৷ এতে দুটো পয়সা তো অন্তত আসবে!
তাহলে এর প্রতিবিধানের জন্য করণীয় কী? উত্তরে আলোচনা চক্রের অন্যান্য বক্তাদের সুপারিশ: প্রান্তিক বাচ্চাদের প্রতি বৈষম্য করা হচ্ছে কিনা সেটা দেখার জন্য একটা ‘মনিটরিং মেকানিজম' থাকা জরুরি৷ যদি কেউ ধরা পড়ে তাহলে উপযুক্ত শাস্তির বিধান থাকা দরকার৷ দ্বিতীয়ত, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মানসিকতায় আনতে হবে পরিবর্তন৷ আর সেজন্য বিশেষ ট্রেনিং কোর্স থাকতে হবে৷ তৃতীয়ত, কোনো পড়ুয়া দীর্ঘদিন স্কুল কামাই করলে কেন কামাই করছে সে বিষয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষকে খোঁজ নিতে হবে এবং সেটা করতে হবে বাধ্যতামূলকভাবে৷
শিশু অধিকার রক্ষার আন্তর্জাতিক চুক্তিতে ভারত সামিল হওয়া সত্ত্বেও এ দেশে জাতপাত, ধর্ম ও লিঙ্গভেদে সেটাই হয়ে চলেছে, বলেন আলোচনাচক্রের অন্যতম বক্তা জয়শ্রী বাজোরিয়া এবং বিমলা রামচন্দ্রন৷