বাঘসুমারির ফলপ্রকাশ করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ভারতে এখন বাঘের সংখ্যা তিন হাজার ১৬৭।
বিজ্ঞাপন
ভারতে প্রজেক্ট টাইগার শুরু হয়েছিল ১৯৭৩ সালে। মাত্র নয়টি টাইগার রিজার্ভ ফরেস্ট নিয়ে শুরু হয় এই প্রকল্প। ৫০ বছর পর এখন টাইগার রিজার্ভের সংখ্যা হলো ৫৩।
উনিশ শতকের শেষে ভারতে ৪০ হাজারের মতো বাঘ ছিল। কিন্তু শিকার ও নির্বিচারে বাঘ মারার ফলে তা ভয়ংকরভাবে কমে য়ায়। ১৯৭২ সালে প্রথম বাঘগণনায় দেখা যায়, দেশে এক হাজার ৪১১টি বাঘ আছে।
প্রজেক্ট টাইগারের ফলে একসময়ে ভারতে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার মুখে থাকা বাঘের সংখ্যা এখন দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ১৬৭। সন্দেহ নেই, প্রজেক্ট টাইগারের সাফল্য এটা। বিখ্যাত প্রাণিসংরক্ষণবিদ ওয়াই ভি ঝালা ইন্ডিয়া টুডে-কে বলেছেন, প্রজেক্ট টাইগার নেয়া না হলে ভারতে বাঘথাকত না।
উনিশ শতকের শেষে ভারতে যখন ৪০ হাজার বাঘ ছিল, তখন দেশে বনের পরিমাণ ছিল অনেক বেশি। ক্রমশ, জনসংখ্যা বেড়েছে। বনের পরিমাণ কমেছে। বন্যজন্তুরাও বিপাকে পড়েছে।
প্রজেক্ট টাইগারের প্রধান এস পি যাদব বলেছেন, করবেট, কানহা, পেন্চ, বান্ধবগড়, রনথম্ভোর, পান্নার মতো অনেক টাইগার রিজার্ভ আছে, যেখানে বাঘের সংখ্যা আর বাড়া সম্ভব নয়। কারণ, একটা বাঘের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ বিচরণভূমি দরকার হয়। তাই এখন বাঘের সংখ্যা বাড়াতে গেলে বিশেষ কৌশল নিতে হবে।
জলবায়ু পরিবর্তন আর বাঘের শিকার যে জীবন
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কৃষিভিত্তিক জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে পড়ছে৷ সুন্দরবন অঞ্চলের উপকূলীয় এলাকার মানুষ তাই বাধ্য হচ্ছেন জীবিকার সন্ধানে বনের গভীরে যেতে৷ কিন্তু সেখানে আছে বাঘের ভয়৷
ছবি: Anushree Fadnavis/REUTERS
প্রাকৃতিক দুর্যোগ
এনভায়রনমেন্ট, ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি জার্নালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, সুন্দরবনের ভারতীয় অংশে ক্রান্তীয় ঝড়ের সংখ্যা ২৬ শতাংশ বেড়েছে৷ গত বছরের মে মাসে সাইক্লোন আমপান ঘণ্টায় ১৩৩ কিলোমিটার বেগের বাতাস নিয়ে সুন্দরবনে আছড়ে পড়ে৷ প্রাণ হারান বহু মানুষ৷ কয়েক হাজার বাড়িঘর ও বাঁধ ধ্বংস হয়ে যায়৷ এমন একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হচ্ছেন এ অঞ্চলের মানুষ৷
ছবি: Anushree Fadnavis/REUTERS
পানির নিচে ধানক্ষেত
অক্টোবরে নোনা পানিতে প্লাবিত হয়ে গেছে কুমিরমারি দ্বীপের বাসিন্দা নাগিন মুন্ডার আধা একরের ধানক্ষেত৷ ‘‘আমার পুকুরে কোনো মাছ নেই, বাগানে কোনো সবজি নেই; আর আমার ধানের ফসল অর্ধেকটাই নষ্ট হয়ে গেছে,’’ বলেন ৫০ বছর বয়সি এ কৃষক৷
ছবি: Anushree Fadnavis/REUTERS
১৫ শতাংশ জমি
গত বছর কুমিরমারির প্রায় আড়াইশ একর কৃষিজমি প্লাবিত হয়েছে৷ এতে দেড় হাজারের বেশি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন সেখানকার স্থানীয় কর্মকর্তা দেবাশীষ মন্ডল৷ তার দেয়া তথ্য অনুযায়ী, সাম্প্রতিক দশকগুলোতে কুমিরমারির আনুমানিক এক হাজার একর জমি মুছে গেছে, যা দ্বীপটির মোট ভূখণ্ডের ১৫ শতাংশেরও বেশি৷ এর ফলে কৃষি জমি আরও সংকুচিত হয়ে পড়েছে৷
ছবি: Anushree Fadnavis/REUTERS
বাঘের খাদ্য
চার বছর আগে সুন্দরবনের গভীরে মাছ ধরতে গিয়ে আর ফিরে আসেননি পারুল হালদারের স্বামী৷ মাছ ধরতে গিয়ে বাঘের শিকার হয়েছেন তিনি৷ চার সন্তানের ভরণপোষণের ভার পুরোটাই এখন পারুলের কাঁধে৷
ছবি: Anushree Fadnavis/REUTERS
বাড়ছে মৃত্যু
৭৮ বছরের সুভদ্রা হালদারের স্বামীও মারা গেছেন বাঘের হামলায়৷ সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভের পরিচালক তাপস দাস বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে জানান, সুন্দররনের ভারত অংশে গত বছরের এপ্রিল থেকে বাঘের হামলায় অন্তত পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে৷ স্থানীয় গণমাধ্যমের হিসাবে, গত বছর বাঘের আক্রমণে মৃত্যু হয়েছে মোট ২১ জনের৷ আগের দুই বছর এই সংখ্যা ছিল ১৩৷ প্রকৃত সংখ্যাটা হয়ত তার চেয়েও বেশি৷
ছবি: Anushree Fadnavis/REUTERS
পারুলের সংগ্রাম
স্বামীর পরিণতির কথা জেনেও জীবিকার সন্ধানে নিয়মিত সুন্দরবনের গভীরে যেতে হয় ৩৯ বছরের পারুলকে৷ মাসে দুইবার তিনি ছয় ঘণ্টা নৌকা চালিয়ে যান সুন্দরবনের গভীরে৷ মৃত্যুর শঙ্কা নিয়েও কয়েকদিন তাকে থাকতে হয় বনের ভিতরে৷ মাছ আর কাঁকড়া ধরে মাসে দুই হাজার রূপি আয় হয় তার৷ ‘‘যদি আমি জঙ্গলে না যাই, তাহলে খাবারও জুটবে না,’’ বলেন পারুল৷
ছবি: Anushree Fadnavis/REUTERS
মেয়ের জন্য
১১ বছর বয়সি পাপড়ির জন্যই কাজের খোঁজে অন্য কোথাও যেতে চান না পারুল৷ কারণ তিনি না থাকলে সন্তানের যত্ন নেবে এমন কেউ পরিবারে কেউ নেই৷ ‘‘যত কষ্টই হোক না কেন, আমি ওকে পড়াবোই’’, বলেন তিনি৷
ছবি: Anushree Fadnavis/REUTERS
করোনা ও হরিপদের নির্মম ভাগ্য
সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে সুন্দরবনে গিয়ে আর ফেরেননি ৩১ বছরের হরিপদ মণ্ডল৷ কুমিরমারির বাসিন্দারা একটি গাছের নিচে তার একজোড়া মোজা দেখতে পান৷ পরে তার দেহাবশেষ খুঁজে পান তারা৷ ‘‘তিনি (হরিপদ) বলেছিলেন কাছাকাছি কোথাও মাছ ধরে ৫০-১০০ রুপি পেলে তা দিয়ে ঘরের খরচ মেটাবেন৷ যদি লকডাউন বা করোনা ভাইরাস না থাকতো, তিনি হয়তো কাজেই থাকতেন,’’ বলেন ২৯ বছর বয়সি অষ্টমী৷
ছবি: Anushree Fadnavis/REUTERS
8 ছবি1 | 8
কিন্তু পাশাপাশি এটাও ঘটনা, অনেক বনে বাঘ নেই। এখন তিন লাখ বর্গ কিলোমিটার বনভূমির মধ্য়ে ৯০ হাজারে বাঘ আছে। ঝালা জানিয়েছেন, ঝাড়খণ্ড, ছত্তিশগড়, ওড়িশা, উত্তরপূর্বের রাজ্গুলিতে আরো প্রায় হাজার দেড়েকের মতো বাঘ থাকা সম্ভব।
তিনি জানিয়েছেন, ভারতে টাইগার রিজার্ভগুলির আয়তন গড়ে ২৩০ বর্গকিলোমিটার। মাপে এগুলি ছোট। সেরেঙ্গেটি, ইয়েলোস্টোনের মতো বিশাল রিজার্ভ নেই. তার জন্য অসুবিধাও হচ্ছে।
সংখ্যা কত বাড়ল?
চারবছর আগে বাঘসুমারির পর বলা হয়েছিল, ভারতে দুই হাজার ৯৬৭টি বাঘ আছে। এবার বাঘসুমারির হিসাব দিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদী জানিয়েছেন, বাঘের সংখ্যা বেড়েছে। এটা শুধু ভারতের নয়, গোটা বিস্বের কাছে সাফল্যের কাহিনি।
মোদীর দাবি, ভারত তার সংস্কৃতি অনুযায়ী প্রাণিদের সংরক্ষণ করছে। সেজন্যই সাফল্য পাওয়া যাচ্ছে।
তবে বিশেষজ্ঞরা ভারতের ওই সংরক্ষণ পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বেঙ্গালুরুর অশোক ট্রাস্ট ফর রিসার্চ ইন ইকলজি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের শরৎচন্দ্র লেলে সংবাদসংস্থা এপি-কে বলেছেন, ভারতীয় সংরক্ষণ পদ্ধতি মান্ধাতার আমলের।
ভারতে মানুষের সঙ্গে বাঘ-সহ অন্য প্রামির সংঘাত লেগেই রয়েছে।