তারপর ২০১৮ সালের ১২ জানুয়ারি বিচারপতি চেলামেশ্বর সেই সাংবাদিক সম্মেলনে যে বোমাটি ফাটালেন, তার জন্য কেউই সম্ভবত তৈরি ছিলেন না।
বিচারপতি মদন লোকুর, বিচারপতি কুরিয়েন জোসেফ, বিচারপতি রঞ্জন গগইকে পাশে বসিয়ে বিচারপতি চেলামেশ্বর সেদিন একেবারে চাঁচাছোলা ভঙ্গিতে যে কথাটা বলেছিলেন, তা হলো, ভারতীয় বিচারব্যবস্থায় বা সর্বোচ্চ আদালতে সবকিছু ঠিকঠাক চলছে না। সুপ্রিম কোর্টে গত কয়েক মাসে এমন ঘটনা ঘটেছে, যা কাঙ্খিত নয়।
বিচারপতি চেলামেশ্বর দৃঢ়ভাবে বলেছিলেন, ''সুপ্রিম কোর্টের মতো সংস্থাকে রক্ষা করতে না পারলে ভারতে গণতন্ত্র বাঁচবে না। ভালো গণতন্ত্রের হলমার্ক হলো স্বাধীন ও পক্ষপাতহীন বিচার ব্যবস্থা।''
বিচারপতি চেলামেশ্বর সেদিন স্বীকার করে নিয়েছিলেন, তারা যা করছেন তা সচরাচর কোনো দেশেই হয় না। তা সত্ত্বেও তারা এই কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন।
কোন কাজটা অস্বাভাবিক বলেছিলেন বিচারপতি চেলামেশ্বর? সেটা হলো, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের এইভাবে সাংবাদিক সম্মেলন করা। মন্ত্রী, আমলা, রাজনীতিক, তারকা, কোনো সংগঠনের পদাধিকারীরা, ক্রীড়াবিদ-সহ অন্যরা হামেশাই সাংবাদিক সম্মেলন করেন। কোনো গুরুত্বপূর্ণ খবর মিডিয়ার মাধ্যমে দেশের বৃহত্তর মানুষের কাছে পৌঁছাতে গেলে অনেকেই সাংবাদিক সম্মেলন করে থাকেন। কিন্তু তাই বলে বিচারপতিরা? না, তারা যা বলার আদালতে বলেন। তার বাইরে সাংবাদিকদের ডেকে পাঠিয়ে কোনো বিষয় বলার পথে তারা কখনোই হাঁটেন না। কিছু বিচারপতি টিভি বা খবরের কাগজে যে সাক্ষাৎকার দেননি এমন নয়, তবে তা সংখ্যায় খুবই কম।
বিচারব্যবস্থার উপর হামলার কিছু উদাহরণ
সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতির বিরুদ্ধে এক বিচারককে ধমক দেয়ার অভিযোগ উঠেছে৷ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিচারব্যবস্থার উপর এমন হামলার তথ্য থাকছে ছবিঘরে৷
ছবি: Reuters/C. Barria
আইসিসির বিচারকদের যুক্তরাষ্ট্রের হুমকি
২০২০ সালের মার্চে আফগানিস্তানে নিয়োজিত মার্কিন বাহিনীসহ সব পক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ তদন্তের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত আইসিসি৷ এর প্রতিক্রিয়ায় মার্কিন প্রশাসন বলেছিল, আইসিসির যে বিচারকরা তদন্তের সঙ্গে যুক্ত হবেন তাদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের ভিসা বাতিল কিংবা প্রত্যাখ্যান করা হবে৷
ছবি: Peter Dejong/AP Photo/picture alliance
ব্রাজিলে সুপ্রিম কোর্টে ভাঙচুর
ব্রাজিলের সাবেক প্রেসিডেন্ট বলসোনারোর সমর্থকরা গত রোববার সুপ্রিম কোর্ট, কংগ্রেস, প্রেসিডেন্ট ভবনে হামলা চালায়৷ তারা সুপ্রিম কোর্টের বিভিন্ন ঘরে ভাঙচুর করেন৷ তারা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বলসোনারোর হার মানতে পারছেন না৷ গতবছরের শুরুতে বলসোনারো সুপ্রিম কোর্টের দুজন বিচারকের নাম উল্লেখ করে তাদের বিরুদ্ধে তার (বলসোনারো) বিরোধিতা করার অভিযোগ এনেছিলেন৷
ছবি: Joedson Alves/AA/picture alliance
যুক্তরাষ্ট্রে বিচারকদের বিরুদ্ধে হুমকি বাড়ছে
২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল বিচারকরা সাড়ে চার হাজারের বেশি হুমকি ও অন্যান্য অগ্রহণযোগ্য যোগাযোগের শিকার হয়েছিলেন৷ হোয়াইট সুপ্রিমেসিস্ট ও সরকারবিরোধী অ্যাক্টিভিস্টদের কাছ থেকে হুমকি বেড়েছে বলে জানিয়েছে ইউএস মার্শালস সার্ভিস৷ একটি ঘটনায় একজন বিচারকের ছেলেকে হত্যা করা হয়৷ ছবিতে যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে অবস্থিত ‘লেডি জাস্টিস’ ভাস্কর্যে এক বিক্ষোভকারীকে দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Reuters/C. Barria
পাকিস্তানে সুপ্রিম কোর্টে শরিফ সমর্থকদের প্রবেশ
১৯৯৭ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগে সুপ্রিম কোর্টে বিচার চলাকালে হাজার হাজার শরিফ সমর্থক কোর্ট ভবনে ঢুকে পড়েছিলেন৷ এই মামলাকে ঘিরে প্রধানমন্ত্রী শরিফ ও প্রধান বিচারপতি সাজ্জাদ আলি শাহের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছিল৷ পরিস্থিতি সামলাতে সেনাবনাহিনীর হস্তক্ষেপ চেয়েছিলেন প্রধান বিচারপতি৷
ছবি: Aamir Qureshi/AFP/Getty Images
কলকাতায় বিচারপতির বিরুদ্ধে পোস্টার
সম্প্রতি কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি রাজাশেখর মান্থার নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তার এজলাস বয়কটের পাশাপাশি অন্য আইনজীবীদের এজলাসে প্রবেশে বাধা দেয়ার অভিযোগ ওঠে তৃণমূল কংগ্রেস সমর্থক বলে পরিচিতি কিছু আইনজীবীর বিরুদ্ধে৷ মান্থা বারবার বিজেপির রাজনীতিবিদ এবং পশ্চিমবঙ্গে বিরোধীদল নেতা শুভেন্দু অধিকারীর ‘পক্ষে’ ও তৃণমূলের অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের শ্যালিকার ‘বিপক্ষে’ রায় দিচ্ছেন বলে মনে করেন তারা৷
ছবি: Jagannath Raul/Dinodia/IMAGO
পদত্যাগে বাধ্য হন বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি
২০১৭ সালে বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দেওয়া রায়ে বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ দিয়েছিলেন৷ তা নিয়ে সেই সময় ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী, দলীয় নেতা ও সরকারপন্থি আইনজীবীরা৷ পরে সিনহা পদত্যাগ করতে বাধ্য হন৷ এর কয়েক মাস পর দুর্নীতি দমন কমিশন তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে৷
ছবি: bdnews24.com
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিচারক অপদস্থ
সম্প্রতি প্রকাশিত এক ভিডিওতে দেখা গেছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি তানভীর ভূঁইয়া দলবল নিয়ে গিয়ে এজলাসে বসা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল ১-এর বিচারক মোহাম্মদ ফারুককে অপদস্থ ও গালাগাল করছেন৷ এই সময় তানভীরকে ধমকের সুরে বিচারক ফারুককে উদ্দেশ্য করে ‘নাম, নাম’ বলতে শোনা যায়৷ যদিও তিনি এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন কথাটি তিনি বিচারককে নয়, যে ভিডিও করছিল, তাকে বলেছেন৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
7 ছবি1 | 7
বিচারপতিদের সাংবাদিক সম্মেলন করে বা মিডিয়ার মাধ্যমে কোনো বিষয় মানুষকে জানানোর কোনো প্রথা কোনো দেশেই নেই। তারা সাধারণত মিডিয়ার ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকেন। একটা সময় পর্যন্ত তারা কোনো অনুষ্ঠানে ভাষণ দিতেন না। এখনো ভারতে বিচারপতিরা প্রকাশ্য ভাষণও খুব বেশি দেন না।
কিন্তু বিচারপতি চেলামেশ্বর-সহ চার বিচারপতি সেই কাজটা করেছিলেন। তাদের মনে হয়েছিল, সুপ্রিম কোর্টকে বাঁচানোটা অত্যন্ত জরুরি। আর তাদের মনে হয়েছিল, পরে কেউ যেন এই অভিযোগ না করতে পারেন, সব জেনেশুনে তারা চুপ করেছিলেন, তাদের আত্মাকে বিকিয়ে দিয়েছিলেন। এ সব যুক্তি চেলামেশ্বরই সেদিন দিয়েছিলেন।
কেন সুপ্রিম কোর্টকে বাঁচানোর কথাটা উঠেছিল? এই সাংবাদিক সম্মেলনের কয়েক মাস আগে চার বিচারপতি একটা চিঠি লিখেছিলেন সেসময়ের প্রধান বিচারপতিকে(দীপক মিশ্র)। সেই চিঠি তারা সাংবাদিকদের দিয়েছিলেন। তাদের সাংবাদিক সম্মেলন ও চিঠি থেকে স্পষ্ট হয়, প্রধান বিচারপতি কিছু গুত্বপূর্ণ স্পর্শকাতর মামলা জুনিয়র বিচারপতিদের বেঞ্চে দিচ্ছিলেন। এইভাবে মামলা দেয়ার মধ্যে কোনো স্বচ্ছ্বতা ছিল না বলে বিচারপতি চেলামেশ্বররা মনে করেন। পরে এই কথাটা তারা প্রধান বিচারপতির কাছে গিয়েও বলেছিলেন। তিনি বুঝতে বা মানতে চাননি। তাই সাংবাদিক সম্মেলন করেছিলেন চার বিচারপতি। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বিচারপতি গগই জানিয়েছিলেন, ওই মামলার মধ্যে সিবিআই বিচারক লোয়ার মৃত্যু সংক্রান্ত মামলাও ছিল।
এই অভিযোগ কোনো মিডিয়া করেনি, কোনো রাজনৈতিক নেতা করেননি, বিরোধী দলের পক্ষ থেকে করা হয়নি, করেছিলেন সুপ্রিম কোর্টের সেসময়ের চার সিনিয়র বিচারপতি। তারপর এ নিয়ে প্রচুর আলোড়ন দেখা দিয়েছিল। তর্ক-বিতর্ক প্রচুর হয়েছে। তবে এর একবছর পর ২০১৯ সালের ১২ জানুয়ারি হিন্দুস্তান টাইমস একটা খবর করে। সেখানে বলা হয়, চার বিচারপতির সাংবাদিক সম্মেলনের এক বছর পর পরিস্থিতিতে সামান্যই বদল হয়েছে। বিচারপতি চেলামেশ্বরের দাবি ছিল, পাঁচজন সবচেয়ে প্রবীণ বিচারপতি পরামর্শ করে কোন মামলা কোন বেঞ্চে যাবে তা ঠিক করুন। এক বছর পর যখন এই রিপোর্ট লেখা হচ্ছে, তখন বিচারপতি রঞ্জন গগই প্রধান বিচারপতি হয়েছেন। তবে তিনিও একাই মামলার রোস্টার তৈরি করতেন। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির পদ থেকে অবসর নেয়ার পর ২০২০ সালে রাষ্ট্রপতি তাকে রাজ্যসভায় মনোনীত সদস্য করেন। তিনি এখনো রাজ্যসভা সাংসদ।
স্বসাসিত সাংবিধানিক সংস্থায় যারা থাকেন, তাদের সংসদে বা বিধানসভায় আসা উচিত কি না, বিচারপতিদের সাংসদ হওয়া উচিত কি না, এনিয়ে ভারতে অনেক বিতর্ক হয়েছে। আমরা সেই বিতর্কে ঢুকব না। আমরা এখানে একটা কথাই বলবো, সুপ্রিম কোর্টের ইতিহাসে এই যে এতবড় বিতর্ক, তা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে, আইনজীবীদের কাছ থেকে, রাজনীতিকদের কাছ থেকে আসেনি, এসেছে বিচারপতিদের মধ্যে থেকে। তাই বলে কি কারো কোনো ক্ষোভ-বিক্ষোভ নেই। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ক্ষোভ-বিক্ষোভতো থাকবেই। কিন্তু তাই বলে বিচারপতিদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে তাদের পদত্যাগ করতে বাধ্য করার মতো ঘটনা ভারতে ঘটে না।
বিচারবিভাগ নিয়েও তো বিতর্ক কম হয়নি। জরুরি অবস্থার সময় সুপ্রিম কোর্টের রায় নিয়ে প্রচুর বিতর্ক হয়েছে। তার আগে পরেও হয়েছে। বিচারবিভাগের রায় নিয়ে ক্ষোভ-বিক্ষোভ থাকাটা কোনো ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়। দিল্লিতে জেসিকা লাল হত্যাকাণ্ডের কথাই ধরা যাক। ১৯৯৯ সালের ঘটনা। দিল্লির একটি বারে অনেকের চোখের সামনে জেসিকা লালকে গুলি করে হত্যা করা হয়। অভিযুক্ত হরিয়ানার প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার ছেলে মনু শর্মা। নিম্ন আদালত তাকে অভিযোগমুক্ত বলে রায় দেয়। প্রবল জনরোষের পর সরকারি তরফে হাইকোর্টে আবেদন জানানো হয়। হাইকোর্ট তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। আরজি কর কাণ্ডের পর সুপ্রিম কোর্ট নিজে থেকে মামলা শুরু করে।
কী হচ্ছে আদালত পাড়ায়?
অন্তর্বর্তী সরকারে সময়ে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের পক্ষে আদালতে দাঁড়াতে গিয়ে হয়রানির শিকার হচ্ছেন আইনজীবীরা৷ ছাত্রদের দাবির মুখে ১২ বিচারপতিকে বিচারকাজ থেকে বিরত রাখার মতো ঘটনাও ঘটেছে৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
‘মারধরের শিকার হয়েছি’
আইনজীবী মোশারফ হোসেন শাহীন বলেন, ‘‘গত আড়াই মাসে যাদের গ্রেপ্তার করে আদালতে নেওয়া হয়েছে, তাদের সবাইকে অপদস্থ করা হয়েছে৷ যারা ডিফেন্স করতে যাচ্ছেন, তাদের উপরও হামলা করা হচ্ছে৷ আক্রমণ করা হচ্ছে৷ এই ধরনের কাজের মাধ্যমে বাইরে খারাপ বার্তা যাচ্ছে৷ আমি নিজেও ডিফেন্স করতে গিয়ে মরধরের শিকার হয়েছি৷ আশা করবো, সবাই যেন সহকর্মীদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকেন৷’’
ছবি: Privat
‘আসামি পক্ষের কোনো আইনজীবীই আদালতে যেতে পারছেন না’
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী সাইদ আহমেদ রাজা বলেন, ‘‘ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে বাদী ও আসামি দুই পক্ষেই আইনজীবী থাকতে হয়৷ কিন্তু বর্তমান সরকারের সময় আসামি পক্ষকে আইনজীবী রাখার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না৷ প্রত্যেক আসামির আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ থাকে৷ সেই সুযোগও পাচ্ছেন না তারা৷ আমি নিজেও কোনো মক্কেলের পক্ষে দাঁড়াতে পারছি না৷ শুধু আমি নই, আসামি পক্ষের কোনো আইনজীবীই আদালতে যেতে পারছেন না৷
ছবি: Privat
‘আসামির পক্ষে আইনজীবীর অধিকার নিশ্চিত করা হচ্ছে না’
সিনিয়র আইনজীবী মনজিল মোরশেদ বলেন, ‘‘আসামির পক্ষে আইনজীবীর দাঁড়াতে পারাটা অধিকার, সেটাই নিশ্চিত করা হচ্ছে না৷ সবাই নাগরিক কিনা সেটাই এখন প্রশ্ন৷ একটা পক্ষ বলতে চাচ্ছে, আরেকপক্ষ এদেশের নাগরিকই না৷ আমরা আগের পথেই চলে গেছি কিনা সেটাও ভাববার বিষয়৷ একটাই পার্থক্য শুধু পুলিশ গুলি করছে না৷ দেশে সরকার দুইটা কিনা সেটাও প্রশ্ন! ছাত্ররাও সিদ্ধান্ত দিচ্ছে, আবার যারা শপথ নিয়েছেন (উপদেষ্টারা) তারাও চালাচ্ছেন৷’’
ছবি: DW
‘এভাবে চললে অভিযুক্তরা ন্যায় বিচার-বঞ্চিত হবেন’
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী আহসানুল করিম বলেন, ‘‘সংবিধানে ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে আইনজীবী নিযুক্ত করার কথা বলা হয়েছে৷ এখন যারা ডিফেন্স করতে যাবেন, তারা তো ভয়ের মধ্যে আছেন৷ প্রধান বিচারপতি বারবার বলছেন, অভিযুক্তকে আইনজীবী প্রাপ্তির সুযোগ দিতে৷ কিন্তু আইনজীবীরা মারধরের শিকার হচ্ছেন৷ অভিযুক্তরা নিজের কথাও বলতে পারছেন না৷ কোর্টও ভয়ের শিকার হন৷ এভাবে চললে অভিযুক্তরা ন্যায় বিচার-বঞ্চিত হবেন৷’’
ছবি: Privat
‘এই বিচারব্যবস্থার জন্য তো তারা জীবন দেননি’
ব্যারিস্টার ওমর ফারুক বলেন, ‘‘আমাদের বিচারব্যবস্থা সামনের দিকে এগোচ্ছে কিনা সেই প্রশ্ন করলে আমি বলবো- ‘না’৷ বিগত সরকারের সময়ে ছাত্রলীগ-যুবলীগ যেটা করেছে, আমরা তো সেটা চাই না৷ আজকের যে বাংলাদেশ, সেটার জন্য কিন্তু যাদের অবদান, তাদের অনেকে কবরে শুয়ে আছে৷ অনেকে অন্ধ হয়ে হাসপাতালের বিছানায়৷ আমার কাছে একজন এসেছেন, যিনি ৪০ বছর ধরে বিচারের জন্য আদালতে ঘুরছেন৷ এই বিচারব্যবস্থার জন্য তো তারা জীবন দেননি৷’’
ছবি: Privat
‘ছাত্ররা আদালতে মিছিল না করে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করলেই ভালো হতো’
আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি তারিক উল হাকিম বলেন, ‘‘ছাত্ররা যেভাবে আদালতের ভেতরে এসে মিছিল করে দাবি জানিয়েছে, সেটা না করে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করলেই ভালো হতো৷ তারপর দাবি পূরণ না হলে আন্দোলন করতে পারতো৷ বিগত সরকারের সময়ের চেয়ে এখন কোনো পার্থক্য দেখা যাচ্ছে কিনা সেটা বুঝতে হলে আমাদের আরেকটু অপেক্ষা করতে হবে৷’’
ছবি: Privat
‘আদালতের তো নিজস্ব কোনো বাহিনী নেই যে, তারা নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবে’
অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ ড. শাহজাহান সাজু বলেন, ‘‘কোন বিচারককে বেঞ্চ দেবেন আর কোন বিচারককে বেঞ্চ দেবেন না সেটা প্রধান বিচারপতির এখতিয়ার৷ ছাত্ররা যেভাবে উচ্চ আদালতের ভেতরে এসে মিছিল করলো, সেখানে পুলিশ তো বাধা দিলো না৷ এখন আদালতেরও তো নিজস্ব কোনো বাহিনী নেই যে, তারা নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবে৷ ফলে তাদের আন্দোলনের কারণেই ভয়ে বা চাপে পড়ে প্রধান বিচারপতি এটা করেছেন সে কথা তো আপনি বলতে পারবেন না৷
ছবি: Privat
‘প্রথম দিকে কিছুটা সমস্যা হলেও এখন আসামী পক্ষের আইনজীবীদের দাঁড়াতে সমস্যা হচ্ছে না’
সুপ্রিম কোর্ট বারের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার এম বদরুদ্দোজা বাদল বলেন, ‘‘ছাত্রদের দাবির মুখে কয়েকজন বিচারককে ছুটিতে পাঠানো হয়েছে, এমন নয়৷ আমরা আইনজীবীরাও তাদের অপসারণের দাবিতে আন্দোলন করেছি৷ আমাদের কাছে তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট প্রমানও আছে৷ সব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে প্রধান বিচারপতি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন৷ প্রথম দিকে কিছুটা সমস্যা হলেও এখন কিন্তু আসামী পক্ষের আইনজীবীদের দাঁড়াতে সমস্যা হচ্ছে না৷
ছবি: Privat
8 ছবি1 | 8
বিলকিস বানো মামলায় বিচারপতি নাগরত্ন ও বিচারপতি ভুয়ান বলেছিলেন, ''জনগণের ক্ষোভ আমাদের বিচারের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে না। আমরা সেই ক্ষোভ অনুসারে কোনো সিদ্ধান্ত নিই না। ধরুন, যদি কোনো গণবিক্ষোভ না থাকে, তাহলে কি আমরা নিম্ন আদালতের সিদ্ধান্ত বহাল রাখব? আর গণবিক্ষোভ হলে কি মনে করতে হবে, নিম্ন আদালতের রায় ভুল ছিল?''
বিচারপতিরা বিচার করেন সংবিধান ও আইন মেনে। তারা তদন্ত করেন না। পুলিশ বা অন্য তদন্তকারী সংস্থা তদন্ত করে। তারপর তার উপর তারা নির্দেশ দেন। দরকার হলে সেই তদন্ত নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। রিপোর্ট চান। সরকারের কাছ থেকে হলফনামা চান। কিন্তু তাদের বিচার হয় সংবিধান ও আইন মেনে। রায় পছন্দ না হলে, নিম্ন আদালতের ক্ষেত্রে উপরের আদালতে, সুপ্রিম কোর্টের ক্ষেত্রে বৃহত্তর বেঞ্চে আবেদন করা যায়। বিচারপতিদের বিরুদ্ধেও আবেদন জানাবার একটি পদ্ধতি আছে। এমনকী বিরল ক্ষেত্রে সংসদও কোনো বিচারপতিকে ইমপিচ করতে পারে। বিচারকদের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্ট ব্যবস্থা নিতে পারে।
যে কোনো গণতন্ত্রে বিচার ব্যবস্থার নিরপেক্ষতা ও স্বাধীনতা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় দুইটি বিষয়। সেখানে ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ, ক্ষোভ-বিক্ষোভের ভূমিকা থাকতে পারে না। আসল কথা হলো, তারা সংবিধান অনুয়ায়ী কাজ করছেন কিনা। আর তাদের সরানোর ক্ষেত্রেও সংবিধান অনুসারে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে কি না। ভারতে এখনো পর্যন্ত এই গণতান্ত্রিক নীতি অনুসরণ করা হয়। তার মধ্যে ব্যতিক্রম থাকতে পারে, মানুষের এমনকী বিচারপতিদেরও ক্ষোভ-বিক্ষোভ থাকতে পারে, কিন্তু নিয়ম অনুসরণ করার বিষয়টিও একই সঙ্গে থাকে।