বিশ্বকাপজয়ী দৃষ্টিহীন নারী ক্রিকেটারদের ম্যাচ ফি তিন হাজার
২৬ নভেম্বর ২০২৫
গত রোববার কলম্বোয় দৃষ্টিহীন নারীদের প্রথম বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ভারত। নারীদের ক্রিকেটে বিশ্বজয়ের কিছুদিনের মধ্যেই আরো এক সাফল্য।
বিশ্বসেরার মুকুট
দৃষ্টিহীন নারীদের বিশ্বকাপে অংশ নেয় ছয়টি দল। প্রতিযোগিতায় ফাইনালে ভারত হেলায় হারায় নেপালকে। ২০ ওভারের ম্যাচে নেপাল প্রথমে ব্যাট করে ১১৪ রান করে। ভারত মাত্র ১২ ওভার এক বলে জয়ের লক্ষ্যে পৌঁছে যায়। ফুলা সারেন ২৭ বলে ৪৪ রানে অপরাজিত থেকে যান। করুণা কে ৪২ রান করেন ২৭ বলে। মাত্র তিন উইকেট হারিয়ে ফাইনালে জয় পায় ভারত।
দীপিকা টিসির অধিনায়কত্বে গোটা প্রতিযোগিতায় অপ্রতিরোধ্য ছিলেন ভারতের মেয়েরা। শ্রীলঙ্কা, অস্ট্রেলিয়া, নেপাল, অ্যামেরিকা, পাকিস্তানকে হারিয়ে সেমিফাইনালে ওঠে ভারত। সেমিফাইনালে নয় উইকেটে হারায় অস্ট্রেলিয়াকে।
অসামান্য এই সাফল্যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী শুভেচ্ছা জানিয়েছেন দৃষ্টিহীন নারী ক্রিকেটারদের। কিন্তু, দীর্ঘদিন ধরে এই ক্রিকেটারদের সঙ্গে হয়ে আসা বঞ্চনার এবার ইতি ঘটবে কি?
কীভাবে খেলা হয়
সাধারণ ক্রিকেট খেলার সঙ্গে দৃষ্টিহীনদের প্রতিযোগিতার নিয়মকানুনে পার্থক্য বিশেষ নেই। ক্রিকেটের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও অন্য কয়েকটি ক্ষেত্রে ফারাক আছে।
দৃষ্টিহীনদের খেলায় যে উইকেট ব্যবহার করা হয় তা তৈরি ধাতু দিয়ে। সাধারণ ক্ষেত্রে তিনটি উইকেটের মধ্যে নির্দিষ্ট ব্যবধান থাকে। এক্ষেত্রে কোনো ফাঁক থাকে না। অর্থাৎ তিনটি উইকেট একটির সঙ্গে অন্যটি সংযুক্ত।
এই খেলায় সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব তার বলে। সাউন্ড বল দিয়ে দৃষ্টিহীন ক্রিকেটাররা খেলেন। সাধারণ ক্রিকেটে যেটা ডিউজ বল, এখানে সেটা তৈরি প্লাস্টিক দিয়ে। ভিতরে থাকে লোহার বল বিয়ারিং।
এই বল মাটিতে পড়লেই ভিতরের বল বিয়ারিং-এর সঙ্গে সংঘর্ষে শব্দ তৈরি হয়। এই শব্দই হচ্ছে দৃষ্টিহীনদের ক্রিকেট খেলার মূল যোগসূত্র। এই বলের শব্দ অনুসরণ করে ব্যাটাররা ব্যাট চালান। ফিল্ডাররা ফিল্ডিং করেন, ক্যাচ ধরেন।
দৃষ্টিহীনদের ক্রিকেট দলে তিন শ্রেণীর ক্রিকেটার থাকেন। সম্পূর্ণ দৃষ্টিহীন, আংশিক দৃষ্টিহীন ও আংশিক দৃষ্টিমান। প্রতিটি দলে ১১ জনের মধ্যে কমপক্ষে চারজন সম্পূর্ণ দৃষ্টিহীন ক্রিকেটার রাখতে হয়। আংশিক দৃষ্টিহীন থাকবেন নূন্যতম তিনজন ও চারজন আংশিক দৃষ্টিমান। খেলার মাঠে এই তিন শ্রেণীর ক্রিকেটারদের হাতে আলাদা আলাদা রঙের রিস্ট ব্যান্ড থাকে, যাতে তাদের চিহ্নিত করা যায়।
আংশিক দৃষ্টিমান মানে যাদের দৃষ্টিহীনতার পরিমাণ ৭৫ শতাংশ এবং আংশিক দৃষ্টিহীন মানে যাদের দৃষ্টিহীনতার পরিমাণ ৮০ শতাংশ।
প্রতিযোগী দুই দলের ক্রিকেটাররা খেলা চলার সময়ে নিজেদের মধ্যে সাংকেতিক ভাষায় কথা বলেন। বোলার বল শুরুর করার আগে বলেন 'রেডি', ব্যাটার বলবেন 'ইয়েস'। বোলার লোয়ার আর্ম বল করেন অর্থাৎ হাত নীচ থেকে উপরের দিকে ওঠে বল হাত থেকে ছাড়ার সময়ে। বল ছোড়ার আগে বোলার ব্যাটারের উদ্দেশে বলেন 'প্লে'। ড্রপ খেয়ে আসা বলের শব্দ শুনে ব্যাট চালান ব্যাটার। বাকি নিয়মের ক্ষেত্রে কোনো ফারাক নেই।
দৃষ্টিহীনদের ক্রিকেটের ক্ষেত্রে মাঠের পরিধি থাকে একটু কম। ৭০ গজের বদলে মাঠ হয় ৫৫ গজের। এছাড়া পিচের মাঝখানে একটি সরলরেখা টানা থাকে আড়াআড়ি। যার মাধ্যমে পিচটিকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। ব্যাটারের শ্রেণী অনুযায়ী বোলারকে বল পিচের আগের বা পরের অংশে ড্রপ খাওয়াতে হয়।
খেলার এই ধরন বুঝিয়ে দেয়, না দেখে স্রেফ শব্দের ভিত্তিতে ব্যাটে-বলে সংযোগ ঘটিয়ে রান তোলা কত কঠিন। বাংলা দলের প্রাক্তন ক্রিকেটার তথা কোচ শিবশঙ্কর পাল ডিডাব্লিউকে বলেন, বলেন, "ওদের কুর্নিশ জানাই। ওরা যেভাবে নিরন্তর অভ্যাস করে খেলাটা আয়ত্তে এনেছেন, সেটা অনেকের কাছে শেখার বিষয়। আত্মবিশ্বাস ওদের এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে। জয়ের কৃতিত্ব পুরোই ওই টিমের। ওদের পাশে থাকা উচিত দেশের মানুষের।"
পারিশ্রমিকের বৈষম্য
ভারতীয় পুরুষ ও মহিলা ক্রিকেট দলের পরিচালনায় থাকে বিসিসিআই। দৃষ্টিহীনদের ক্রিকেট পরিচালনা করে ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন ফর ব্লাইন্ড ইন ইন্ডিয়া (ক্যাবি)। এরাই দৃষ্টিহীন ক্রিকেটারদের ম্যাচ-প্রতি পারিশ্রমিক দেয়। প্রতিযোগিতার সময়ে ক্রিকেটারদের যাতায়াত ও থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত করে।
প্রায় কোনো স্পনসর ছাড়াই দৃষ্টিহীন নারী ক্রিকেট দল চালাতে হয়। এর ফলে একেবারেই কম পারিশ্রমিকে খেলতে হয় ক্রিকেটারদের। এর সঙ্গে জাতীয় মহিলা ক্রিকেট দলের কোনো তুলনাই চলে না। পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের উপার্জন অনেক কম হলেও ম্যাচ ফি-র ক্ষেত্রে সমতা রয়েছে। হরমনপ্রীত কৌর, স্মৃতি মান্ধানা, রিচা ঘোষরা টেস্ট ম্যাচের জন্য ১৫ লক্ষ, এক দিনের ম্যাচের জন্য ছয় লক্ষ এবং টি-টোয়েন্টির জন্য তিন লক্ষ টাকা করে পান।
দৃষ্টিহীন নারী ক্রিকেটারদের ক্ষেত্রে এই টাকা খুবই কম। জাতীয় স্তরের খেলায় প্রত্যেক ম্যাচে একজন ক্রিকেটার মাত্র ৭০০ টাকা পান। আন্তর্জাতিক স্তরের খেলায় এই অঙ্ক তিন হাজার টাকা।
ক্যাবির ভাইস প্রেসিডেন্ট চিন্ময় মণ্ডল ডিডাব্লিউকে বলেন, "আমরা সেভাবে কোনো সাহায্য পাই না। বিভিন্ন কর্পোরেট সংস্থা তাদের সিএসআর (কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটি) খাতে যে খরচ করে, সেটাও যদি দৃষ্টিহীনদের ক্রিকেটে কিছুটা পাওয়া যেত, তাহলে দরিদ্র পরিবারের মেয়েরা উপকৃত হত।"
এদের দৃষ্টিহীনতার প্রধান কারণ হচ্ছে অপুষ্টি। চিন্ময় বলেন, "দরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়েরা অপুষ্টির শিকার হয়। তারাই এই ক্রিকেট খেলতে আসে। এমন কত প্রতিভা আমাদের সমাজে আছে, যারা দারিদ্রের সঙ্গে দৈনন্দিন লড়াই করতে করতে হারিয়ে যাচ্ছে। তাদের আমরা তুলে আনতে পারছি না।"
তিনি বলেন, "ক্রিকেটাররা বড় জোর ২০ বছর খেলতে পারেন। বাকি জীবনটা তাদের কীভাবে কাটবে, সেটাও আমাদের ভাবতে হচ্ছে। তাই আমাদের লক্ষ্য তাদের জন্য চাকরির ব্যবস্থা করা। যেভাবে রাজ্য সরকার রিচা ঘোষকে চাকরি দিল, সেভাবেই নীতি নির্ধারণের মাধ্যমে বিভিন্ন সরকার দৃষ্টিহীন নারী ক্রিকেটারদের পাশে দাঁড়াক, এটাই আমাদের দাবি।"
স্পনসর কোথায়
ভারতের পুরুষ ও মহিলা ক্রিকেট দলের পিছনে যখন রয়েছে দেশের প্রথম সারির কর্পোরেট সংস্থা, তখন দৃষ্টিহীন নারী ক্রিকেটারদের সবচেয়ে বড় আর্থিক সাহায্যদাতা একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সমর্থনম ট্রাস্ট।
দক্ষিণ ভারতের এই সংগঠনের মিডিয়া ম্যানেজার নিরঞ্জন সুরেশ ডিডাব্লিউকে বলেন, "স্পনসর জোগাড় করা খুবই কঠিন কাজ। যে কোনো বিজ্ঞাপনদাতা এটা বুঝে নিতে চান, তারা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে কত সংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছতে পারবেন। দৃষ্টিহীনদের ক্রিকেট যেহেতু এখনো ততটা প্রচারিত নয়, তাই স্পনসর টেনে আনা সহজ নয়। গরিব ঘরের নারীরা এই ক্রিকেট খেলেন। কিছুটা আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যের পথ দেখাতে না পারলে তাদের উৎসাহিত করা আমাদের পক্ষে কঠিন।"
দৃষ্টিহীন প্রতিভাদের তুলে আনাও বেশ চ্যালেঞ্জের। সুরেশ বলেন, "এই মেয়েদের খেলার মাঠে নিয়ে আসা মানে বড় বাধা পার করা। তাদের বোঝানো, অনুপ্রাণিত করে বাড়ির বাইরে নিয়ে আসা সহজ নয়। বাবা-মাকে বোঝাতে হয়। তারা ভাবেন, দৃষ্টিহীন মেয়ে ঘরের বাইরে গেলে তাদের সুরক্ষা কে নিশ্চিত করবে। যারা ঘরের বাইরে বেরোয় না, তারা কী ভাবে বিদেশে গিয়ে খেলবে।"
জাতীয় দলের প্রাক্তন ক্রিকেটার লক্ষ্মীরতন শুক্লার ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে প্রশিক্ষক তথা জাতীয় দলের কোচ চরণজিৎ সিং ডিডাব্লিউকে বলেন, "দৃষ্টিহীন নারীদের ক্রিকেট দল যেভাবে বিশ্বকাপ জয় করেছে, সেটা ঐতিহাসিক। এতদিন ক্রিকেট পুরুষরাই নিয়ন্ত্রণ করতেন। আস্তে আস্তে নারীরা এগিয়ে আসছেন। আশা করা যায় ভবিষ্যতে দৃষ্টিহীনদের ক্রিকেটও এগিয়ে যাবে। বৈষম্য কমে যাবে। আমাদের কাছে একটা অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছেন দৃষ্টিহীন নারী ক্রিকেটাররা।"
চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করে যারা ভারতকে বিশ্বজয়ী করেছেন, তাদের নিয়ে তেমন উচ্ছ্বাস নেই, মিডিয়াতেও প্রচার কম। চরণজিৎ বলেন, "যেভাবে পুরুষদের ক্রিকেটকে মিডিয়া, রাষ্ট্র বা অন্যরা সম্মান দিয়েছে এদেরও সেই সম্মান পাওয়া উচিত। রাষ্ট্রের উচিত এদের জন্য কিছু করা। এই জয়ের প্রচার অনেক বেশি জরুরি ছিল। মিডিয়া সেভাবে গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করেনি। এর থেকে বড় জয় আর হয় না।"
শিবশঙ্করের বক্তব্য, "আমরা খুব আনন্দিত, গর্বিত যে ভারত তিন সপ্তাহের মধ্যে আর একটা বিশ্বকাপ পেল। মিডিয়ারই উচিত দৃষ্টিহীন মহিলা ক্রিকেটারদের কথা আরো বেশি করে তুলে আনা।"
চিন্ময় বলেন, "আগে খেলার পাতায় এক কোণে একটা ছোট্ট ছবি দিয়ে খবর প্রকাশিত হত, যখন দৃষ্টিহীন নারী ক্রিকেটাররা সাফল্য পেতেন। এবার বিশ্বকাপ জয়ের খবর প্রথম পাতায় প্রকাশিত হয়েছে। সুতরাং কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে, আমাদের আশা ভবিষ্যতেও হবে।"