স্বামী স্ত্রী-কে ধর্ষণ করলে ভারতের আইন তাকে আজও শাস্তি দিতে পারে না। বিয়ের 'পবিত্র বন্ধনের' আড়ালে মাটিতে মিশে যায় সম্মতির চেতনা। বাড়তে থাকে পৌরুষের আস্ফালন।
নারী নির্যাতন বন্ধের দাবিতে প্রায়ই আন্দোলন করেন ভারতের বিভিন্ন সংগঠন ছবি: Saikat Paul/Pacific Press/picture alliance
বিজ্ঞাপন
২০১৭-র ডিসেম্বরে ছত্তিসগড়ের বাস্তারে ছিন্ন ভিন্ন শরীরে হাসপাতালে ভর্তি হন বছর ৩০-এর এক নারী। শারীরিক আঘাতের অভিঘাত সহ্য না করতে পেরে কিছুদিনের মধ্যেই মৃত্যু হয় তার। মৃত্যুকালীন জবানবন্দিতে তিনি বলেন, তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে স্বামী নৃশংসভাবে ধর্ষণ করেছেন তাকে। অস্বাভাবিক যৌনক্রিয়ায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে তার যৌনাঙ্গ এবং পায়ুদ্বার। পুলিশের দ্বারস্থ হন মৃতার বাবা। স্বামীর বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা (অস্বাভাবিক যৌনক্রিয়া), ৩৭৬ (ধর্ষণ) এবং ৩০৪ (অনিচ্ছাকৃত খুন) ধারা মামলা হয়। নিম্ন আদালত তাকে ১০ বছরের কারাদণ্ডের সাজা দেয়।
২০২৫-এর ফেব্রুয়ারিতে ছত্তিসগড় হাইকোর্টের বিচারপতি নরেন্দ্র কুমার ব্যাস বেকসুর মুক্তি দেন স্বামীকে। রায়ে বলা হয়, ভারতীয় আইনে স্ত্রীয়ের বয়স ১৫-র বেশি হলে তার সঙ্গে যৌন সম্পর্ককে ধর্ষণ বলা যায় না। এদেশে অস্বাভাবিক যৌন সম্পর্ক বা সম্মতির কোনো আইনি স্বীকৃতি নেই, এ কথাও বলা হয়।
স্বামীর দ্বারা ধর্ষণ ফৌজদারি অপরাধ নয়
ভারতবর্ষে বৈবাহিক ধর্ষনের কারণে স্বামীর সাজা না পাওয়া কোনো বিক্ষিপ্ত ঘটনা নয়। স্বাধীনতার ৭৭ বছর পরেও এদেশে স্বামী স্ত্রীকে ধর্ষণ করলে তাকে ফৌজদারি অপরাধ বলে গণ্য করা হয় না। সম্প্রতি, সুপ্রিম কোর্টে বৈবাহিক ধর্ষণকে ফৌজদারি অপরাধ বলে গণ্য করার পক্ষে একটি আবেদনের বিরোধিতা করেছে দেশের সরকার। ২০২৪-এর অক্টোবরে আদালতকে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয় একে ফৌজদারি অপরাধের পরিধিতে আনলে তা 'অত্যন্ত কঠোর' হয়ে যাবে যা দাম্পত্যে প্রভাব ফেলতে পারে। সরকারের পক্ষ থেকে আরো বলা হয়, এর ফলে 'পবিত্র বৈবাহিক বন্ধন' ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এমনকি, এর ভুল ব্যবহারও হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। স্বামী স্ত্রীকে বলপূর্বক ধর্ষণ করলে কেন সেই একই 'পবিত্র বন্ধন' ক্ষতিগ্রস্ত হবে না তার কোনো সদুত্তর অবশ্য কোনো সরকারই দেয় না।
যে কাজ অন্য যে কেউ করলে তাকে অপরাধী শনাক্ত করে শাস্তি দেয় দেশের আইন, সেই একই অপরাধ স্বামী করলে তার শাস্তি হবে না কেন? ভারতবর্ষে স্ত্রীর উপর স্বামীর শারীরিক অত্যাচারের ঘটনা অহরহ ঘটে চলেছে। সরকারের সাম্প্রতিক এক পরিসংখ্যানে, স্বামীর দ্বারা নিগৃহীত হন প্রায় ২৬ দশমিক নয় শতাংশ মহিলা। এই অবস্থায় বৈবাহিক ধর্ষণকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে কেন স্বীকৃতি দেওয়া যাবে না, তার ব্যাখ্যা স্বাভাবিকভাবেই লুকিয়ে আছে দেশের মজ্জাগত পুরুষতন্ত্রের ছায়ায়। একটু ব্যাখ্যা করা যাক।
বিয়ের পবিত্রতা এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজ
ভারতীয় সংস্কৃতিতে 'বিবাহ বন্ধনের' পবিত্রতার মধ্যে সুস্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে পুরুষতান্ত্রিকতার ছায়া। পণ বিনিময় আইনত দণ্ডনীয় হলেও বাস্তবে এখনো বিরাজমান। কন্যাদান, কনকাঞ্জলি, ইত্যাদি আচারে নারীকে সম্পত্তি সমতুল্য করে রাখা হয়েছে। কন্যাদান কার্যত একটি হস্তান্তর আচার যার মাধ্যমে নারী বাবার হাত থেকে স্বামী হেফাজতে যায়। এহেন পরিমণ্ডলে ধরেই নেওয়া হয় স্ত্রী স্বামীরই সম্পত্তি। তার শরীরের উপর তার থেকেও বেশি অধিকারী তার স্বামী। সেক্ষেত্রে, স্ত্রী-এর সম্মতির প্রশ্নটি সম্পূর্ণভাবে অপ্রয়োজনীয় বলে মনে করা সমাজ।
এমনিতেই সম্মতি, ব্যক্তিগত পরিসরের মতো ধারণাগুলি উপমহাদেশের প্রেক্ষিতে এখনো অচল। বড় শহরের বিশ্বদর্শনে খানিকটা চর্চায় এলেও ভারতের বিশাল পরিধিতে তা প্রায় নেই বললেই চলে। যে শিশু ছোটবেলা থেকেই সাধারণভাবে ব্যক্তিগত পরিসরের ধারণা ছাড়াই বড় হয়, বিয়ের পর তার নিজের শরীরের উপর অধিকার জন্মাবে কেমন করে? অন্যদিকে, যে শিশু ছোটবেলা থেকেই জেনে এসেছে নারী মাত্রেই তার অধীন, সে স্বামী হয়ে তার অন্যরকম ভাবা প্র্যাকটিস করবেই বা কেন? বরং সে নারীর উপর শক্তি প্রয়োগ করে নিজের অধীনে রাখার মধ্যে একটা একটা 'পাওয়ার ট্রিপ' নিতে শিখবে। এক্ষেত্রে সম্মতি কেন, সম্মানের সিকিভাগও খরচ করবে না এদেশের পৌরুষ।
তাছাড়া, এদেশে বিয়ের বন্ধনকে পবিত্র বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। দাম্পত্য জীবনে সামাজিক আচার প্রবেশ করলেও, আইন সচরাচর প্রবেশাধিকার পায় না। ন্যাশানাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে পাঁচের রিপোর্ট অনুযায়ী, ১৮ থেকে ৪৯ বছরের বিবাহিত মহিলাদের ৩২ শতাংশ নারী স্বামীর হাতে নিগৃহীত হন। কেবলমাত্র মারধর নয়, এর মধ্যে আছে যৌন অত্যাচার, ধর্ষণের অভিযোগও। তদন্ত, বিচার প্রক্রিয়া তো অনেক পরের ব্যাপার, এদের মধ্যে মাত্র ২৯ শতাংশ নারী পুলিশের কাছে যান। বাড়ির অন্তরমহলে চাপা পরে থাকে প্রায় তিন চতুর্থাংশেরও বেশি অভিযোগ। আবার ধর্ষণের অভিযোগ দাখিলযোগ্য না হওয়ায় অনেকক্ষেত্রেই তা গার্হস্থ হিংসার নামে পুলিশের কাছে অভিযোগ জানানো হয়।
শরীরের অধিকার
বিয়ে দুটি জীবনকে, এমনকি দুটি পরিবারকেও সামাজিকভাবে কাছাকাছি এনে দেয়। এই পারস্পরিকতায় ব্যক্তিগত পরিসর, পরিধি বা সম্মতির মতো স্বাভাবিক দৈনন্দিন জীবনের বোঝাপড়াগুলির পরিবর্তন হওয়ার কথা নয়। আমার শরীর আমারই। তার ভালো থাকা, খারাপ থাকা, ইচ্ছে-অনিচ্ছেগুলি নিজের মতো করে আমারই থাকে। তার উপর জোর করা যায় না। নারী হোক বা পুরুষ, অসম্মতিতে শরীরের উপর অধিকার হস্তান্তরিত হয় কী করে?
অ্যামেরিকা, ইউরোপসহ পৃথিবীর বহু দেশেই বৈবাহিক ধর্ষণকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। বিশ্বের এগিয়ে থাকা দেশগুলি বাদ দিলেও, সাম্প্রতিককালে একে অপরাধ বলে মেনে নিয়েছে জিম্বাবোয়ে, তুরস্ক, ঘানা, নেপালের মতো অর্থনৈতিক ভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলিও। বিয়ের পবিত্রতা এই দেশগুলিতে অপরাধীকে আড়াল করতে বর্ম হিসেবে ব্যবহার হয়না। নারীর শরীরের উপর অধিকার একেবারেই তার -- এটা মেনে নিতে পৌরুষে আটকায় না এই দেশগুলির সমাজের।
সারা বিশ্বে দক্ষিণপন্থি রাজনীতির উত্থানের সঙ্গে নারী বিদ্বেষের বাড়বাড়ন্ত অস্বাভাবিক নয়। বিভিন্ন দেশে নারীবাদী, সমানাধিকার কর্মীদের উপর আক্রমণ বেড়েছে বহুগুণ। ভারতের ক্ষেত্রে প্রাচীন সনাতনী মূল্যবোধের সঙ্গে এই নব্য নারীবিদ্বেষ মিশে তৈরি হয়েছে এক অভূতপূর্ব ককটেল। সেই কারণে বিয়ের পরে ধর্ষণের মতো ঘটনা শহরাঞ্চলের শিক্ষিত উচ্চমধ্যবিত্ত পরিসরেও কিছু কম নয়। গ্রাম থেকে শহর, উচ্চবিত্ত থেকে সাধারণ খেতে খাওয়া মানুষ -- জাতি ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি নির্বিশেষে নারীর প্রতি ন্যূনতম সম্মান, তার সম্মতিকে সম্মান না জানানো আমাদের সমাজে দস্তুর হয়ে গেছে। বৈবাহিক ধর্ষণকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করতে চেয়ে বারবার আইন আদালতের দরজায় ধাক্কা দিয়েছেন সমাজকর্মীরা। এখনো সদুত্তর মেলেনি। এতদিনেও, একবিংশ শতাব্দীতেও মেলেনি। জিডিপিতে ভারত জাপানকে টপকে চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি হল কি না, সেই আলোচনার মধ্যে আমরা এই মানবাধিকারের ব্যর্থতার ইতিহাসগুলো যেন ভুলে না যাই।
’বৈবাহিক ধর্ষণ’ : বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নারী, পুরুষ যা ভাবছেন
‘ম্যারিটাল রেপ’ অর্থাৎ ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’ নিয়ে বিভিন্ন শ্রেণি, পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছে ডয়চে ভেলে৷ ছবিঘরে বিস্তারিত...
ছবি: Maya Alleruzzo/AP Photo/picture alliance
পক্ষে-বিপক্ষে কথা হলে আইন তৈরি ও সংজ্ঞায়িত করা সহজ হবে: কামরুন নাহার, সদস্য, নারীপক্ষ
‘‘বিবাহের পর যৌন সম্পর্ক স্থাপনে জোরজবরদস্তির মতো ‘অপরাধটি’ যেন বেড়ে না যায় এবং নারী-পুরুষ সকলেই আইনের সহায়তা পায় সেই কারণেই সংস্কার কমিশনের সুপারিশে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পক্ষে-বিপক্ষে তো কথা হবেই এবং হওয়া উচিত বলেও মনে করি।এতে আইন তৈরি করা এবং সম্মতি ও ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’কে সংজ্ঞায়িত করা সহজ হবে। কোন প্রেক্ষিতে এটিকে অপরাধ ধরা হবে তার ব্যাখ্যায় বয়স নির্ধারণ করা আছে।’’
‘‘সংবিধানের ২৭ নম্বর ধারায় বলা আছে সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। ৩২ নম্বর ধারায় ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষার কথা বলা হয়েছে। বিবাহ মানেই তো সম্মতির অধিকার কেড়ে নেওয়া নয়। বিয়ের আগে একজন নাগরিকের যেসব অধিকার থাকে, বিয়ের পরও ঠিক তাই থাকে। এই অধিকার রক্ষা করতে না পারলে তা সংবিধানের সঙ্গেও অসঙ্গতিপূর্ণ।আধুনিক যুগে দেশের 'বৈবাহিক ধর্ষণ' নিয়ে সরাসরি আইন না থাকা হতাশার।’’
ছবি: Privat
বৈবাহিক ধর্ষণ ও সম্মতির গুরত্ব নতুন প্রজন্ম কিছুটা বুঝতে পারছে : জাওয়াদ বিন মিজান, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জাওয়াদ বিন মিজান বলেন, ‘‘বন্ধু ও সমসাময়িক পরিচিতজনদের মধ্যে এই বিষয়গুলো নিয়ে কিছুটা কথা হয়। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখি তরুণ প্রজন্মের অনেকেই আলোচনা করেন। সম্পর্কে থাকলেই সব কিছু স্বাভাবিকভাবে অনুমতিপ্রাপ্ত- এই ধারণায় কিছুটা বদল এসেছে বলে মনে হচ্ছে। ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’ বিষয়টি খুবই সংবেদনশীল। তাই নারী ও পুরুষ উভয়রই এ বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করা উচিত।’’
ছবি: Privat
'ম্যারিটাল রেপ' পরিভাষাটি বলা বাদ দিয়ে বরং নারীর অধিকার রক্ষার আলাপ করা উচিত: মীর হুযাইফা, গবেষক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসা থেকে শিক্ষাজীবন শেষ করা এবং বর্তমানে গবেষক হিসেবে কর্মরত মীর হুযাইফা বলেন, ‘‘হাদিসের আলোকেই বিবাহ পরবর্তী প্রতিবার মেলামেশায় দুজনেরই সম্মতির প্রয়োজন আছে। দেশে বিবাহ পরবর্তী সহিংসতার হার বেশি। নারীরা এ বিষয়ে কথা বলতে ভয় পান। তাই সামাজিক আলাপ ওঠা উচিত। তবে ‘ম্যারিটাল রেপ’ বা ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’ পরিভাষাটির পরিবর্তে নারীর অধিকার রক্ষা- এভাবে আলোচনা জরুরি।’’
ছবি: Privat
‘বৈবাহিক ধর্ষণ’ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা বড় একটি জনগোষ্ঠীর কাছে ট্যাবু : জুবায়দুল হক রনি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী জুবায়দুল হক রনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘দেশে ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’-এর ফলে নারী মৃত্যুর মতো ঘটনাও ঘটছে। কিন্তু তবুও ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা বড় একটি জনগোষ্ঠীর কাছে ট্যাবু। বিষয়টিকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে আইন করা হলে সে আইন শুধু নারীর জন্য নয়, পুরুষের জন্যও হবে। কোনো পুরুষ যদি ‘বৈবাহিক ধর্ষণের’ শিকার হন, তাহলে তিনিও আইনের সহায়তা নিতে পারবেন। ’’
ছবি: privat
সেই ক্ষত ও ট্রমা দীর্ঘ বছরেও ভুলতে পারিনি : ভুক্তভোগী নারী
বৈবাহিক ধর্ষণের শিকার এক ভুক্তভোগী নারী বলেন, ‘‘নিজের পছন্দে বিয়ে করলেও বিয়ের রাতেই স্বামীর জোরজবরদস্তির শিকার হয়েছি। এটিকে যে ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’ বলে সেটাও জানতাম না। কিন্তু বহুবার একই ধরনের ঘটনা ঘটার পরে বুঝতে পারলাম,পরিবারকে জানালেও সবাই সংসার চালিয়ে যাওয়ার জন্য চাপ দেন। অনেক সহ্য করার পর সে সম্পর্ক থেকে তালাক দিয়ে বেরিয়ে আসি। কিন্তু সেই ক্ষত ও ট্রমা দীর্ঘ বছরেও ভুলতে পারিনি।’’
ছবি: Colourbox
অনেক নারী ও পুরুষের কাছেই ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’-এর অস্তিত্ব নেই : নওশিন নাবিলা, চাকরিজীবী
চাকরিজীবী নওশিন নাবিলা বলেন, ‘‘পরিবার থেকেই নারীদের শিখানো হয় স্বামীকে খুশি রাখতে হবে। এই প্রথাগত ধারণা থেকে এ সময়ে এসেও নারীরা বের হতে পারেননি। আর বেশির ভাগ পুরুষও এর বাইরে ভাবতে চান না। তাই ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’-এর অস্তিত্ব অনেক নারী ও পুরুষের কাছেই নেই। কোনো নারী তার অধিকার নিয়ে কথা বললেই সে খুব নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ‘নারীবাদী’ বলে বিবেচিত হন।’’
ছবি: Rifat Parveen Anny/DW
পুরুষ তার চাহিদাই শুধু বোঝে : মাসুদা, সুপারশপের কর্মী
একটি সুপারশপের কর্মী মাসুদা বলেন, ‘‘পুরুষরা শুধু নিজের চাহিদা বোঝে। স্ত্রীর শরীর খারাপ, ব্যথা বা পিরিয়ড কোনো কিছুই তারা বুঝতে চায় না। স্বামীর সঙ্গে প্রায়ই এ নিয়ে ঝগড়া হয়। আমি যে ছোট বাড়িতে ভাড়া থাকি, সেখানে প্রায় সব মেয়েই একই কষ্টের কথা বলে। আইন হলে নারীদের সাহায্য নেওয়া উচিত, কিন্তু পরিবার, সমাজ কী বলবে। টাকা না থাকলে সে নারী কী খাবে, সন্তানদের নিয়ে কোথায় যাবে।’’
ছবি: Rifat Parveen Anny/DW
বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে অনেক কিছুই মানতে হয়েছে : সুলতানা, গৃহকর্মী
সুলতানা পেশায় গৃহকর্মী৷ তিনি জানান, ‘‘বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে অনেক কিছুই মানতে হয়েছে। এখন আর স্বামী কোনো কিছু নিয়া জোরাজুরি করে না। আমার অমতে শারীরিক সম্পর্ক করে না। বয়স কম থাকতে তো বুঝতে চায় না। সারা দিন পরিশ্রম করলে মন না-ই চাইতে পারে। বিয়ের পর নিজের মায়ের কাছেও কিছু বলা যায় না। স্বামীর সম্পর্কে কিছু বলাও তো ভালো না।’’
ছবি: Rifat Parveen Anny/DW
কোনো আলোচনা ছাড়া কণ্ঠরোধ সমর্থন করি না : কামরুল হাসান, উদ্যোক্তা ও চলচ্চিত্রকার
উদ্যোক্তা ও চলচ্চিত্রকার কামরুল হাসান বলেন, ‘‘বৈবাহিক সম্পর্কে অধিকার আছে, কিন্তু ধর্ষণ বলে কিছুই নেই- এমন ধারণা অনেক নারী ও পুরুষের। তাই এই বিষয়ে আলোচনা হলে, আইন হলে নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই ভালো, যদিও আইনের ভুল ব্যবহার যেন না হয় সে ব্যবস্থা নিতে হবে। তা নিয়ে আলাপ হওয়াও জরুরি। কিন্তু কোনো আলোচনা ছাড়া কণ্ঠরোধ সমর্থন করি না। বিশ্বের অনেক দেশেই বৈবাহিক ধর্ষণকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে আইন হয়েছে।’’
ছবি: Rifat Parveen Anny/DW
পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’ ও সম্মতি শিক্ষা নিয়ে আলোচনার সুযোগ নেই :
নিফাত সুলতানা, শিক্ষার্থী
শিক্ষার্থী নিফাত সুলতানা মনে করেন, ‘‘পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বৈবাহিক ধর্ষণ ও সম্মতি শিক্ষা নিয়ে আলোচনার সুযোগ নেই।’’ ডয়চে ভেলেকে তিনি আরো বলেন, ‘‘বেশির ভাগ ছেলে বন্ধু এ বিষয়ে কথা বলতে লজ্জা বোধ করেন। তবে কিছু বন্ধু স্বাভাবিকভাবেই আলোচনা করেন। তাই মেয়ে বন্ধুরা নিজের মধ্যে আলাপ করি, বিবাহিত বান্ধবীদের থেকে জানার চেষ্টা করি।’’
ছবি: privat
বৈবাহিক ধর্ষণ ও সম্মতির বিষয়ে বিবাহিত ও অবিবাহিত সবারই কথা বলা উচিত : তাসফিয়া ফাইরোজ আনান, শিক্ষার্থী
শিক্ষার্থী তাসফিয়া ফাইরোজ মনে করেন বিবাহিত নারীদের অনেকেই চুপ থাকাতে বৈবাহিক ধর্ষণের মতো বিষয়টি আলোচনায় আসছে না৷ তিনি বলেন, ‘‘সম্মতির বিষয়টি প্রতিটি সম্পর্কেই জরুরি, সে সম্পর্ক বৈবাহিক হোক বা না হোক। একজন মানুষ হিসেবে নিজের শরীর ও সম্মতির অধিকার সবারই থাকা উচিত। এই বিষয়ে কেবল ভুক্তভোগী না, বরং আমাদের সবার, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের খোলাখুলি কথা বলা উচিত, যাতে সচেতনতা বাড়ে এবং সমাজে পরিবর্তন আসে।’’
ছবি: Tasfia Fairoz Anan
স্বামীর ডাকে স্ত্রীকে সাড়া দিতে হবে: মাওলানা কারী রওশন আরা নূরী, প্রিন্সিপাল, ইসলামী মিশন মহিলা কামিল মাদ্রাসা
তিনি বলেন, ‘‘কোরআনের আয়াতে বলা হয়েছে, ‘স্বামী-স্ত্রী একে অপরের লেবাস (পোশাক) স্বরূপ৷ আরেকটি আয়াতে বলা হয়েছে, যখন তোমার স্বামী ডাকবে, তখন তুমি তার ডাকে সাড়া দেবে৷ এটা হলো ফরজ৷ স্বামী ডাকলে সাড়া দিতে হবে৷ কিন্তু স্ত্রীর কোনো শারীরিক বা মানসিক অসুস্থতা থাকলে সে অনিচ্ছা প্রকাশ করলে স্বামীকে সেটা বিবেচনা করতে হবে৷ প্রয়োজনে একসাথে বসে আলোচনা করে নেবে। কিন্তু স্বামীর ডাকে স্ত্রীকে সাড়া দিতে হবে।''