রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্সের মুক্ত গণমাধ্যমের র্যাঙ্কিংয়ে ভারত বেশ পিছিয়েছে৷ তাহলে কি ভারতে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ক্রমশ হুমকিতে পড়ছে? সাংবাদিক মুহাম্মদ যুবায়েরের গ্রেপ্তারের পর প্রশ্নটি আরো বড় হয়ে উঠেছে৷
বিজ্ঞাপন
তথ্য যাচাই সংক্রান্ত ওয়েবসাইট অল্ট নিউজ-এর প্রতিষ্ঠাতা যুবায়েরকে চার বছর আগের এক টুইটের মাধ্যমে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়৷ ২০১৮ সালে এক টুইটে ‘হানিমুন হোটেল'-এর ছবি শেয়ার করলেও যুবায়ের হোটেলের নাম বদলে দিয়ে লিখেছিলেন, ‘হনুমান হোটেল‘৷ সম্প্রতি এক টুইটার ব্যবহারকারী সেই টুইট রিটুইট করে দাবি করেন, এর মাধ্যমে দায়িত্বশীল সাংবাদিক যুবায়ের হনুমানের প্রতি হিন্দুদের শ্রদ্ধাকে কটাক্ষ করেছেন এবং এর ফলে তার ধর্মীয় অনুভূতি আঘাত পেয়েছে৷
যুবায়ের মূলত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া বিভিন্ন তথ্য যাচাই করতেন, ছড়িয়ে থাকা ভুল তথ্য সম্পর্কে সবাইকে অবগত করতেন এবং ভারতে বিশেষ করে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে যে হেটস্পিচ ক্রমাগত বেড়ে চলেছে, সে বিষয়ে সবাইকে সতর্ক করতেন৷
অল্ট নিউজ-এর প্রতিষ্ঠাতা যুবায়েরকে গ্রেপ্তার করা হয় এমন এক সময়ে যখন ভারতে ক্ষমতাসীন বিজেপি দলের এক নেতার বক্তব্য নিয়ে তোলপাড় চলছে৷ বিজেপির সাবেক মুখপাত্র নূপুর শর্মা এক টেলিভিশন বিতর্কে মুসলমানদের নবি হযরত মুহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে বিতর্কিত মন্তব্য করেন৷ তার মন্তব্যের প্রতিবাদ শুরু হয় ভারত এবং ভারতের বাইরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে৷ নূপুর শর্মাকে বিজেপি থেকে বহিষ্কার করা হলেও পরিস্থিতি দ্রুত শান্ত হয়নি৷
ভারতের অঙ্গীকার
মুহাম্মদ যুবায়ের গ্রেপ্তার হওয়ার সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী জি-৭ সম্মেলনে অংশ নিচ্ছিলেন৷ সম্মেলনে অংশ নেয়া দেশগুলো ‘২০২২ রেজিলিয়েন্ট ডেমোক্র্যাসিজ স্টেটমেন্ট'-এ স্বাক্ষর করে৷ ওই বিবৃতিতে স্বাক্ষর করে বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও সমাজে মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষার অঙ্গীকার করেন৷
মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে আটটি ছবি
তেসরা মে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস৷ মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে বহু সাংবাদিক সংগ্রাম করেছেন৷ তাদেরই কাহিনি নিয়ে তৈরি হয়েছে বিভিন্ন চলচ্চিত্র৷
ছবি: Bild: BR/Wiedemann & Berg Film
রেজর’স এজ
২০১৬ সালে নাগরিক সাংবাদিকতা বিভাগে ডয়চে ভেলের বব্স পুরস্কারে ভূষিত হয় এই তথ্যচিত্র৷ বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষ ব্লগার ও লেখকরা বিশেষভাবে বিপন্ন: ধর্মীয় উগ্রপন্থিদের আক্রমণে শুধুমাত্র গত পাঁচ সপ্তাহে এদের চারজন প্রাণ হারিয়েছেন৷ ‘ক্ষুরধার’ ছবিটি সেই পরিস্থিতির দিকে নজর দিচ্ছে৷
ছবি: Nastiker Dharmakatha
ফ্রেম বাই ফ্রেম
‘এক একটি ছবি’ শীর্ষক দিয়ে চারজন তরুণ আফগান ফটো জার্নালিস্ট বা সংবাদধর্মী আলোকচিত্রশিল্পীর কাহিনি বলা হয়েছে৷ ফটোগ্রাফি বহুদিন সরকারিভাবে নিষিদ্ধ থাকার পর এই সব আফগান ফটোগ্রাফার আবার ছবি দিয়ে কাহিনি সাজাতে শিখছেন৷ কাবুলের মার্কিন দূতাবাসে ছবিটি প্রদর্শিত হওয়ার পর স্থানীয় টিওএলও নিউজ সংস্থার সাতজন সাংবাদিক একটি আত্মঘাতী বোমা আক্রমণে নিহত হন৷
ছবি: Film Fprout
অল দ্য প্রেসিডেন্টস মেন
‘প্রেসিডেন্টের সাঙ্গপাঙ্গ’ নামের ছবিটি ওয়াটারগেট কেলেংকারি নিয়ে৷ ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ পত্রিকার দুই সাংবাদিক বব উডওয়ার্ড ও কার্ল বার্নস্টাইনের খোঁজখবরের ফলে ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি ফাঁস হয় ও প্রেসিডেন্ট নিক্সন শেষমেষ পদত্যাগ করতে বাধ্য হন৷ ছবিটি তৈরি করেন রবার্ট রেডফোর্ড৷
ছবি: Warner Bros./dapd
গুড নাইট অ্যান্ড গুড লাক
‘‘শুভরাত্রি, তোমার মঙ্গল হোক’’ শীর্ষক সাদা-কালো ছবিটিতে বেতার সাংবাদিকতার গোড়ার দিকের পরিবেশ ধরে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে৷ সেনেটর জোসেফ ম্যাককার্থি ১৯৫৩ সালে তাঁর ‘লাল আতঙ্ক’ অভিযানের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার ও সেলিব্রিটি মহলে তথাকথিত কমিউনিস্টদের খুঁজে বার করার চেষ্টা করেন৷ সাংবাদিক এডওয়ার্ড আর. বারোস ম্যাককার্থি আমলের সেই সব কেলেঙ্কারি ফাঁস করে দিয়েছিলেন৷
ছবি: Kinowelt
পিপল ভার্সাস ল্যারি ফ্লিন্ট
যাজক জেরি ফলওয়েল প্রাপ্তবয়স্কদের ম্যাগাজিন ‘হাসলার’-এর বিরুদ্ধে যে মামলা করেছিলেন, তাই নিয়ে তৈরি হয়েছে ১৯৯৬ সালের কথাচিত্র ‘সরকার বনাম ল্যারি ফ্লিন্ট’৷ পর্নোগ্রাফির প্রকাশক ল্যারি ফ্লিন্ট বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও সরকারের কোপে পড়েন৷
ছবি: dpa
ফর্বিডেন ভয়েসেস
জুরিখের চিত্র পরিচালক বার্বারা মিলার-এর ২০১২ সালে নির্মিত তথ্যচিত্র ‘নিষিদ্ধ কণ্ঠ’ কিউবা, চীন ও ইরানের তিন ব্লগারের জীবন তুলে ধরেছে৷ ইওয়ানি সাঞ্চেজ, জেং জিনিয়াং ও ফর্নাজ সঈফি স্বদেশে স্বৈরাচারী শাসন সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে অবহিত করতে চান৷ তাদের কাজ এতটা কৌতূহল সৃষ্টি করে যে, তারা নিজের জীবন বিপন্ন করে এই সব কাহিনি দেশের বাইরে নিয়ে আসার চেষ্টা করেন৷
ছবি: Das Kollektiv
বার্মা ভিজে
বর্মা, অর্থাৎ মিয়ানমারে ২০০৭ সালে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে প্রতিবাদে পথে নামেন৷ সেই নাটকীয় ঘটনাবলী নিয়ে ডেনিশ চিত্রনির্মাতা আন্ডার্স ওস্টারগার্ড-এর ছবি ‘বর্মার ভিডিও জকি’৷ ভিক্ষুদের প্রতিবাদ দেশের সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে রূপান্তরিত হওয়ায় বিদেশি সাংবাদিকদের বর্মা থেকে বহিষ্কার করা হয় ও শুধু গোপনে ছবি তোলার পথই বাকি থাকে৷
ছবি: flickr/Steve Rhodes
দ্য স্পিগেল অ্যাফেয়ার
১৯৬২ সালে জার্মানির ‘ডেয়ার স্পিগেল’ সংবাদ পত্রিকায় পশ্চিম জার্মানির সামরিক বাহিনীর দৈন্যদশা নিয়ে একটি রচনা প্রকাশিত হয়৷ ফলে তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ফ্রানৎস ইওসেফ স্ট্রাউস ‘স্পিগেল’ পত্রিকা অফিসে পুলিশি তল্লাসির নির্দেশ দেন৷ কিছু স্পিগেল সম্পাদকদের গ্রেপ্তারও করা হয়৷ জনসাধারণ এই ঘটনাকে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার উপর আক্রমণ বলে গণ্য করে৷ ‘স্পিগেল কেলেঙ্কারি’ টিভি ছবিটিতে সেই মুড ধরে রাখা হয়েছে৷
ছবি: Bild: BR/Wiedemann & Berg Film
8 ছবি1 | 8
মুহাম্মদ যুবায়েরের আইনজীবী বৃন্দা গ্রোভার মনে করেন, তার মক্কেলের গ্রেপ্তারিও প্রমাণ করে যে, ভারতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা প্রতিনিয়ত খর্ব হচ্ছে৷ তিনি বলেন, তার মক্কেল সাংবাদিক এবং তিনি ক্ষমতাবানদের বিষয়ে সত্যি কথা বলতেন বলেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ আরো অনেকেই সেই ছবি শেয়ার করেছেন, অথচ তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি- এমন দাবি করে ব্রিন্দা বলেন, ‘‘ তাদের সঙ্গে আমার মক্কেলের পার্থক্য বিশ্বাসে, নামে এবং পেশায়৷''
বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা এবং গণমাধ্যম বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংগঠন যুবায়েরকে গ্রেপ্তারের নিন্দা জানিয়ে তার মুক্তি দাবি করেছে৷
ভারতে সঙ্কুচিত মতপ্রকাশের স্বাধীনতা
গত মে মাসে ২০২২ সালের মুক্ত গণমাধ্যম বিষয়ক র্যাঙ্কিং প্রকাশ করে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স (আরএসএফ)৷ সেখানে দেখা যায় ভারত ২০২১ সালের ১৪২তম স্থান থেকে পিছিয়ে ১৫০-এ চলে এসেছে৷ এর আগে গত ফেব্রুয়ারিতে রাইটস অ্যান্ড রিস্ক অ্যানালাইসিস গ্রুপ এক প্রতিবেদনে জানায়, ২০২১ সালে ভারতে সাংবাদিক এবং সংবাদ মাধ্যমের ওপর মোট ১২১টি হামলা হয়েছে৷ এ সময়ে হামলায় অন্তত ছয়জন সাংবাদিক প্রাণ হারিয়েছেন৷ ১২১টি হামলার মধ্যে কমপক্ষে ৩৪টির জন্য দায়ী বিভিন্ন বেসরকারি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান৷ তাদের মধ্যে বেশির ভাগই রাজনৈতিক কর্মী হলেও মাফিয়া, অনলাইন ট্রলাররাও রয়েছেন৷ প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ২০২১ সালে ভারতে আটজন নারী সাংবাদিকও গ্রেপ্তার হয়েছেন বা পুলিশের অভিযোগ অথবা যৌন নিপীড়নের মুখে পড়েছেন৷
কার্যকর গণমাধ্যমের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কি?
গণমাধ্যমের কার্যকারিতা নিয়ে ১৬টি ডিজিটাল মিডিয়া স্টার্টআপের একটি দল কাজ করছে। মানসম্পন্ন সংবাদ প্রকাশ এবং টিকে থাকার ক্ষেত্রে গণমাধ্যম সংস্থাগুলোকে কি ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয় জানালেন বিভিন্ন দেশের এই সাংবাদিকেরা।
ছবি: DW Akademie
ডিজিটাল মিডিয়ার অগ্রদূত যারা
১৬টি ডিজিটাল মিডিয়া স্টার্টআপের একটি দল গণমাধ্যমের কার্যকারিতা নিয়ে কাজ করছে। তারা জবাব দিচ্ছে: তাদের দেশে গণমাধ্যমের কার্যকারিতার ক্ষেত্রে কি কি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়?
ছবি: DW Akademie
লিকা আনতাদজে, জর্জিয়া, চায় খানা
‘’নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ সংবাদ পরিবেশন, একই সাথে দীর্ঘ সময় টিকে থাকা এবং ভালো পাঠক ও দর্শক তৈরি করা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।‘’
ছবি: DW Akademie
তানিয়া এল মন্তালভো, মেক্সিকো, অ্যানিমেল পলিটিকো
‘’মত প্রকাশের স্বাধীনতা, নিরপেক্ষ সংবাদ পরিবেশনা, মানসম্পন্ন সংবাদ পরিবেশন, মাথায় রাখা পাঠকরা কোন বিষয়গুলো জানতে চায়-এগুলোই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।‘’
ছবি: DW Akademie
টিডিয়ানে হামাদৌ, সেনেগাল, ওয়েস্তাফ নিউজ
‘’গণমাধ্যমের উদ্যোগকে স্বাগত জানানোর কোন বাধ্যবাধকতা জনগণের নেই। তবে নিরপেক্ষ সংবাদ মাধ্যম তাদের জন্য কিছু একটা করতে পারে এবং এটার একটা মূল্য আছে, এই বিষয়টা তারা ভালো বোঝে।‘’
ছবি: DW Akademie
পিং জিন থুম, সিঙ্গাপুর, নিউ ন্যারাটিফ
‘’দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মত প্রকাশের স্বাধীনতা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করতে আইন করেছে সরকার। সরকারের সহযোগীদের হাতে বেশিরভাগ গণমাধ্যমের মালিকানা। নিরপেক্ষ গণমাধ্যমকে হয়রানি করা হয়, মামলা দেয়া হয় বা কিনে নেয়া হয়। ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স বা বিশ্ব গণমাধ্যম স্বাধীনতা সূচিতে এশিয়ার দেশগুলোর অবস্থান বেশ নিচে।‘’
ছবি: DW Akademie
লুসিয়া মেনেনডেজ, গুয়াতেমালা, নোমাডা
‘’যে দেশের পাঠকেরা মানসম্পন্ন সাংবাদিকতায় অভ্যস্ত না, তাদের নিরপেক্ষ সংবাদে অন্তর্ভুক্ত করা একটা বড় চ্যালেঞ্জ।‘’
ছবি: DW Akademie
কিরিলো লুকেরেংকো, ইউক্রেন, রোমাদস্কে রেডিও
‘’আইনের অবৈধ ব্যবহার ইউক্রেনের গণমাধ্যমের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।‘’
ছবি: DW Akademie
লুসিয়া মার্টিনেজ, আর্জেন্টিনা, চেকুয়াদো
‘’সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল এমন একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যা দীর্ঘ সময় ধরে মানসম্পন্ন সাংবাদিকতা ধরে রাখবে।‘’
ছবি: DW Akademie
ডেভিড হিলাডগো ভেগা, পেরু, ওজো পাবলিকো
‘’লাতিন অ্যামেরিকায় গণমাধ্যমের কার্যকারিকার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল, জনগণের চাহিদার কথা মাথায় রেখে বিভিন্ন ধরণের খবর পরিবেশন।‘’
ছবি: DW Akademie
রোমান ফিলিপভ, মলদোভা, রাইজ মলদোভা
‘’যে দেশে শাসকগোষ্ঠীর হাতে বেশিরভাগ গণমাধ্যম, সেখানে একটা নিরপেক্ষ গণমাধ্যম হিসেবে গুণগত ও মানসম্পন্ন সাংবাদিকতা ধরে রাখা বড় চ্যালেঞ্জ।‘’