1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ভারতে শিল্পীর মত প্রকাশের স্বাধীন পরিসর ক্রমেই ছোট হচ্ছে

শময়িতা চক্রবর্তী কলকাতা
৯ মে ২০২৫

শিল্পীর মত প্রকাশের স্বাধীনতার সাম্প্রতিকতম মূল্য দিয়েছেন কুণাল কামরা এবং মুম্বইয়ের একটি কমেডি ক্লাব।

কুণাল কামরা
কুনাল কামরা শিবসেনার নেতা একনাথ শিন্ডেকে নিয়ে গান বেধে বিপত্তিতে পরেনছবি: Kunal Kamra/YouTube

ভারতের এই স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ান একটি অনুষ্ঠানে মহারাষ্ট্রের মন্ত্রী, তথা শিবসেনার নেতা একনাথ শিন্ডেকে নিয়ে গান বাঁধলেন। শাহরুখ খানের ৯০ দশকের জনপ্রিয় গানের প্যারোডি। নাম না করেই এই মন্ত্রী মহাশয়কে তিনি 'গদ্দার' বা 'বিশ্বাসঘাতক' বলে বিঁধলেন। ভিডিও প্রকাশ্যে আসার দুদিনের মধ্যেই শিন্ডে, তাঁর দলের নেতা-সমর্থকরা, এমনকি বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী পর্যন্ত এই কমেডিয়ানের বিরুদ্ধে সুর চড়ালেন।

তবে ঘটনাটি এখানে থামেনি। সোশাল মিডিয়ায় ক্রমাগত হুমকির সুনামি পেরিয়ে যেই কমেডি ক্লাবে এই অনুষ্ঠানটি হয়েছিল, সেটিকে ভাঙচুর করে এলেন শিন্ডে সমর্থকেরা। কুণালের নামে পুলিশ কেস, মামলা করা হলো। শেষ পর্যন্ত আদালতের রায় আপাতত খানিকটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছেন তিনি।

মুক্তচিন্তার দেশ 

মুক্ত চিন্তার স্বাধীনতা শহুরে প্রগতিশীল সমাজে শুনতে যতটা ভালো লাগে, ব্যবহারিক জীবনে প্রয়োগ করার ক্ষেত্রটা ততটা সরল নয়। গণতান্ত্রিক, এমনকি পাশ্চাত্যের তথাকথিত এগিয়ে থাকা দেশগুলিতেও ফাঁক ফোকর দিয়ে কণ্ঠরোধের কঙ্কাল বেরিয়ে পড়ে। শিল্প হোক বা রাজনীতি, ভারতবর্ষে (এমনকি অন্যান্য দেশেও) মত প্রকাশের স্বাধীনতা আসে বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণের সঙ্গে। "নিজের মত নিজ দায়িত্বে প্রকাশ্য করবেন। রাষ্ট্রদ্রোহিতার কেস খেতে পারেন।" ভারতের সংবিধানের ১৯(১)(এ) প্রতিটি দেশবাসীকে মত প্রকাশের স্বাধীনতা দিয়েছে। তবে তার সঙ্গেই থাকে একটা ফুটনোট। সংবিধানের ১৯(২)তে বলা আছে মত প্রকাশের এই স্বাধীনতার উপর সরকার নিষেধাজ্ঞা লাগাতে পারে, যদি আপনার মতকে তাদের দেশের সার্বভৌমত্ব বা জনহিতের পরিপন্থী, শালীনতা বা নৈতিক বোধের বিপ্রতীপে বলে মনে হয়।

কুণাল কামরার উপর আক্রমণ কোনো বিক্ষিপ্ত ঘটনা নয়। শিল্পী সাহিত্যিকদের উপর আক্রমণের ঘটনা এর আগেও আমরা দেখেছি। ডমিনিক ল্যাপিয়ের কলকাতায় সিটি অফ জয়-এর শুটিং করতে এসে বাম ছাত্র যুব দলের থেকে বাধা পেয়েছিলেন। পরে অবশ্য পুলিশের সাহায্য নিয়ে শুটিং শেষ করেন। সলমন রাশদির উপন্যাস স্যাটানিক ভার্সেস ১৯৮৮-তে নিষিদ্ধ করে রাজীব গান্ধী সরকার। মৌলবাদের হুমকিতে রুশদি দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। ( ২০২২-এ যুক্তরাষ্ট্রের শাটাকুয়া ইন্সটিটিউশনে একটি অনুষ্ঠানে সাংঘাতিক আক্রমণ চালায় এক ব্যক্তি। ঘটনার অভিঘাতে একটি চোখ নষ্ট হয় বিশ্ববরেণ্য এই লেখকের। নিয়তির কী পরিহাস, ২০২৪-এ স্যাটানিক ভার্সেসের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠে যায় ভারতে!)

তসলিমা নাসরিন তার দেশের মৌলবাদীদের থেকে নিষ্কৃতি পেতে কলকাতায় এসে আশ্রয় নিলেও ২০০৩-এ প্রকাশিত ‘দ্বিখণ্ডিত' নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি করে। একাধিক সাহিত্যিক এবং ক্যালকাটা খিলাফত কমিটি তদানীন্তন সরকারকে বইটি নিষিদ্ধ করার পরামর্শ দেয়। বইটি শেষ পর্যন্ত নিষিদ্ধ হয়। এর পর ২০০৭-এ তার বই ‘শোধ' ঘিরে ফের শুরু হয় বিতর্ক। তার নামে আবারও একাধিক ফতোয়া জারি হয়। এবার মৌলবাদীদের আক্রমণে তিনি কলকাতা ছাড়তে বাধ্য হন। সম্প্রতি তাকে কলকাতায় ফেরাতে রাজ্যসভায় তদবির করেছেন বিজেপি সাংসদ শমীক ভট্টাচার্য। এক্ষেত্রে, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তৃণমূল কংগ্রেস এবং বামেদের সমালোচনা করতেও ছাড়েননি তিনি।     

কেবলমাত্র ধর্মীয় গোঁড়ামি বা সামাজিক বাধা নয়, রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতারও বলি হয়েছেন একাধিক শিল্পী। অনেক ক্ষেত্রেই শিল্পীরা তাদের শিল্পের মাধ্যমে রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট করে দেন। কুণাল কামরা দৃশ্যত বিজেপি-বিরোধী কমেডি স্কিট লেখেন এবং পরিবেশন করেন। ৮০র দশকে নাট্যব্যক্তিত্ব সফদর হাশমি তার বামপন্থি অবস্থান সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করতেন। ১৯৮৯-তে গাজিয়াবাদ পুরসভা নির্বাচনের আগে তার পথনাটক 'হাল্লা বোল' প্রদর্শনের সময় দুষ্কৃতিরা এসে তাকে পিটিয়ে খুন করে। অভিযোগ, তারা কংগ্রেসের গুন্ডাবাহিনী।

পশ্চিমবঙ্গে ২০০৬ থেকে মঞ্চস্থ হতো পঞ্চম বৈদিকের ‘পশুখামার'। জর্জ অরওয়েলের অ্যানিমাল ফার্ম অবলম্বনে এই নাটকটি তদানীন্তন বাম শাসনের ‘সমালোচনা করে। স্বভাবতই কিছু বাম নেতা কর্মীর বিরাগভাজন হয়। ২০১১-তে এই নাটকটিকে নিষিদ্ধ করার রব ওঠে। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য অবশ্য নিষেধাজ্ঞা প্রস্তাবের নিন্দা করেন। ব্রাত্য বসুর রাজনৈতিক স্যাটায়ার ‘উইঙ্কল টুইঙ্কল'-এর কয়েকটি শো ঘিরেও উত্তেজনা ছড়ায়। সুমন মুখোপাধ্যায় পরিচালিত হারবার্ট সিনেমাটি নন্দন প্রেক্ষাগৃহে পরিবেশনে বাধা পেয়েছিল। 

পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান সরকারের আমলেও ছাড় পাননি শিল্পীরা। ২০১১তে নতুন সরকার আসার পর পরেই মিনার্ভার মঞ্চ থেকে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অভিনীত ‘রাজা লিয়র' নাটকটি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। রাজনৈতিক মহলের বক্তব্য ছিল সৌমিত্র পূর্বতন বাম সরকারের ঘনিষ্ঠ হওয়ার কারণেই এই কোপ। পরিচালক অনীক দত্ত বাম ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। ২০১৯-এ তার ছবি ভবিষ্যতের ভূতের প্রদর্শনী কার্যত বন্ধ করে দেওয়া হয়। এক্ষেত্রেও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অভিযোগ ওঠে। এই ঘটনার ঠিক আগেই ২০১৮-র কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে একটি সভায় মুখ্যমন্ত্রীর কড়া সমালোচনা করেছিলেন তিনি। এরকম একাধিক উদাহরণ আছে।

এ যুগের নীতিপুলিশরা 

ধর্মীয় বা রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা ছাড়াও আছেন আরো এক প্রকার 'কালচার কাকু' বা নীতি পুলিশরা। এরা নিজেদের তৈরি নৈতিক এবং সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের বাইরে বাকি শিল্প কর্মকে বিনা প্রশ্নে বন্ধ করে দিতে পারেন। এরা পরিচালক দীপা মেহতাকে বেনারসে ‘ওয়াটার'-এর শুটিং করতে দেননি। 'ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত করেছে' এই অভিযোগে বাতিল করেছেন এমএফ হুসেনের দুর্মূল্য ছবির প্রদর্শনী। এদের দাপটেই পরিচালক সঞ্জয় লীলা ভনশালি দু-দুবার একই ছবির নাম পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছেন।

কিছুদিন আগে সোশাল মিডিয়া পরিচালিত এই নীতিপুলিশদের আক্রমণের মুখে পড়তে হয় ইউটিউবার সময় রায়নার জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ইন্ডিয়া'স গট লেটেন্টকে। এই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত এক অতিথি রনবীর এলাহাবাদিয়ার একটি বিতর্কিত মশকরা প্রকাণ্ড আকার ধারণ করে। আদালতের নোটিস, পুলিশে এফআইআর থেকে ট্রোলিং -- এই অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত সবাইকে কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হয়।

সোশাল মিডিয়ার যুগে এই নীতিপুলিশরা আরো সংঘবদ্ধ। বিশ্ব জুড়ে বেড়ে চলা দক্ষিণপন্থি রাজনীতি ক্রমাগত এদের ইন্ধন দিয়ে চলেছে। যেকোনো প্রকার বহুত্ববাদের বিপরীতে তারা। সমাজ মাধ্যম অনেক ক্ষেত্রেই বিদ্বেষের আঁতুড়ঘর। অতীতে শিল্পীর কণ্ঠরোধ করতে প্রশাসনিক হস্তক্ষেপের প্রয়োজন পড়তো। এখন এজলাস বসে সোশাল মিডিয়ায়। দোষ ধরা থেকে বিচার এবং শাস্তি -- প্রতিটি শুনানি এখন হাতের মুঠোয়। মুক্তমনা শিল্পীচেতনাকে জেলে বন্দি করতে প্রয়োজন মাত্র একটি আঙুলের চাপ। এই আক্রমণের বীভৎসতায় জেলবন্দি হতে সময় নেন না শিল্পীরাও। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রকাশ্যে 'দোষ' স্বীকার করে, ক্ষমা চেয়ে, মনের জানলা দরজায় চাবি দিয়ে গৃহবন্দি হন। হাতে গোণা অল্প কয়েকজন ব্যতিক্রমের মধ্যে একজন কুণাল কামরা। মার্চে আক্রমণ এবং তার পরে সোশাল মিডিয়ার খাপ পঞ্চায়েত পেরিয়ে তিনি সরবে ঘোষণা করেছেন, তিনি ক্ষমা চাইবেন না। প্রশাসনের সঙ্গে সহযোগিতা করবেন। তবে তিনি অন্য কোথাও যাবেন না। এই দেশেতেই থাকবেন। মুক্ত চিন্তার স্বাধীনতার লড়াইয়ে এই কারণেই তার জন্য একটা চ্যাপ্টার লেখা যায়।  

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ