করোনার ভ্যাকসিন দেয়ার প্রস্তুতি শুরু করে দিলো ভারত। চারটি রাজ্যে শুরু হয়েছে টিকা দেয়ার ড্রাই রান। দেখে নেয়া হচ্ছে পরিকাঠামো।
বিজ্ঞাপন
এখনো পর্যন্ত সরকারের ইঙ্গিত, জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ থেকে করোনা ভ্যাকসিন দেয়া শুরু হয়ে যাবে। কাদের কখন দেয়া হবে, সেই তালিকাও তৈরি। অক্সফোর্ডের টিকাও তৈরি। ভারত বায়োটেক ও ফাইজারও অনুমতি চেয়েছে। এখন শুধু চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষা। তার আগে সোমবার অন্ধ্র প্রদেশ, গুজরাট, আসাম ও পাঞ্জাবে ভ্য়াকসিনের ড্রাই রান হচ্ছে।
ড্রাই রান মানে শুধু টিকাটা দেয়া হচ্ছে না। বাকি সব কিছু দেখা হচ্ছে। টিকা যাঁরা দেবেন, তাঁরা কতটা প্রস্তুত, যে কোল্ড স্টোরেজে টিকা রাখা হবে তার অবস্থা কেমন, সেখান থেকে টিকা দেয়ার কেন্দ্রে কীভাবে ভ্যাকসিন যাবে তার ব্যবস্থা, কীভাবে দেয়া হবে, কাদের দেয়া হবে, সব দেখে নেয়া হচ্ছে। অর্থাৎ, প্রস্তুতির মধ্যে কোনো ফাঁক আছে কি না, সেটা খতিয়ে দেখাই ড্রাই রানের উদ্দেশ্য। যাতে ভ্যাকসিন দেয়া যখন শুরু হবে, তখন যেন কোনো গোলমাল না হয়, সমালোচনার জায়গা না থাকে। দিল্লি এই ড্রাই রানের তালিকায় না থাকলেও এখানে বাড়ি বাড়ি গিয়ে সিনিয়ার সিটিজেনদের তালিকা মিলিয়ে দেখে নেয়া হচ্ছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রক জানিয়েছে, এখনো পর্যন্ত দুই হাজার ৩৬০টি প্রশিক্ষণ শিবির হয়েছে, সাত হাজার পেশাদারকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। তাঁরা বাকিদের শেখাচ্ছেন। সোমবার যে ড্রাই রান হচ্ছে, সেখানে ভ্যাকসিন কেন্দ্রে পাঁচটি করে সেশন হবে। প্রতিটি সেশনে ২৫ জন করে স্বাস্থ্যকর্মীকে ডাকা হয়েছে। প্রতিটি জায়গায় অ্যাডভার্স এফেক্ট ফলোয়িং ইমিউনাইজেশন(এইএফআই) গঠন করা হয়েছে। যাতে ভ্যাকসিন নেয়ার পর কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া হলে তা সঙ্গে সঙ্গে সামাল দেয়া যায়।
করোনা ভ্যাকসিন: কোন দেশের কী কৌশল
এক বছরেরও কম সময়ে করোনার কার্যকরী একাধিক ভ্যাকসিন আবিস্কার করেছে বিভিন্ন কোম্পানি৷ সেগুলো অনুমোদনও পেতে শুরু করেছে৷ আগেভাগে সংগ্রহে দেশগুলোর মধ্যে তোড়জোড় যেমন চলছে; তেমনি নাগরিকদের টিকা প্রদানে নেয়া হয়েছে বিভিন্ন কৌশল৷
ছবি: Allan Carvalho/NurPhoto/picture-alliance
পথ দেখালো যুক্তরাজ্য
আট ডিসেম্বর বায়োনটেক ও ফাইজারের টিকার প্রথম ডোজ নেন ৯০ বছরের মার্গারেট৷ যুক্তরাজ্যে প্রথম আট লাখ টিকা পাবেন তার মতো প্রবীণ, সামনের সারির স্বাস্থ্যকর্মীসহ বাকি বয়স্ক নাগরিকরা৷ ফাইজারের কাছে মোট চার কোটি ডোজ টিকার অর্ডার দিয়েছে দেশটি; যার মাধ্যমে দুই ডোজ করে দুই কোটি মানুষের ভ্যাকসিনের নিশ্চয়তা মিলছে৷ পাঁচ কোটি ত্রিশ লাখ নাগরিকের সবাইকে টিকা দিতে যুক্তরাজ্যকে নির্ভর করতে হবে অন্য কোম্পানিগুলোর উপরে৷
ছবি: Jacob King/AP Photo/picture alliance
প্রস্তুত যুক্তরাষ্ট্র
বায়োনটেক-ফাইজারের টিকার প্রয়োগ শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্রও৷ দেশব্যাপী ছড়ানো বিতরণ কেন্দ্রগুলোতে ২৯ লাখ ডোজ টিকার প্রথম চালান পৌঁছেছে৷ ফাইজার থেকে আরো ২০ লাখ আর মডার্নার ৫৯ লাখ ডোজের চালান ছাড় হতে পারে আসছে সপ্তাহে৷ এই দুই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেই ৩০ কোটি ডোজ ভ্যাকসিনের চুক্তি যুক্তরাষ্ট্রের৷ প্রথম ধাপে স্বাস্থ্যকর্মী, নার্সিং হোমে বসবাসরত, জরুরি সেবায় নিয়োজিত এবং দীর্ঘস্থায়ী ব্যধিতে আক্রান্তরা টিকা পাবেন৷
ছবি: Bran Woolston/REUTERS
ক্যানাডার তোড়জোড়
মডার্নার কাছ থেকে এক লাখ ৬৮ হাজার ডোজ ভ্যাকসিন পেতে সম্প্রতি চুক্তি করেছে ক্যানাডা৷ শর্ত অনুযায়ী অনুমোদন পাওয়ার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে এই চালান ছাড় শুরু করবে কোম্পানিটি৷ তবে তার আগেই ফাইজারের টিকা পৌঁছে গেছে দেশটিতে৷ ১৬ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়েছে প্রয়োগও৷
ছবি: Adrian Wyld/REUTERS
দেরি করেনি সৌদি
আরব নিউজের সংবাদ অনুযায়ী, ১৬ ডিসেম্বর সৌদি আরবে বায়োনটেক-ফাইজারের টিকার প্রথম চালান পৌঁছায়৷ পরের দিন থেকেই শুরু হয়েছে প্রয়োগ৷ টিকা পেতে একদিনে মোট দেড় লাখ মানুষ অনলাইনে নিবন্ধন করেছেন৷ সবাইকে বিনামূল্যে দেয়ার কথা থাকলেও অগ্রাধিকারভিত্তিতে পাবেন ৬৫ বছরের বেশি বয়সি, বিভিন্ন ব্যাধিতে আক্রান্ত রোগী আর স্বাস্থ্যকর্মীরা৷
ছবি: Ahmed Yosri/REUTERS
শুরু হচ্ছে ইসরায়েলে
ইসরায়েলের গণমাধ্যম হারিৎস-এর তথ্য অনুযায়ী ১৯ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু প্রথম টিকা নেবেন দেশটিতে৷ এরপর প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে পাবেন বাকি জ্যেষ্ঠ নেতৃবৃন্দ ও স্বাস্থ্যকর্মীরা৷ সাধারণ নাগরিকদের টিকা প্রদান শুরু হবে আসছে সপ্তাহে৷ শুরুতে অগ্রাধিকার পাবেন বয়স্করা৷ প্রাথমিক পর্যায়ে ফাইজারের কাছ থেকে কয়েক লাখ ভ্যাকসিন নিচ্ছে দেশটি৷ দ্বিতীয় ধাপের ট্রায়ালে রয়েছে নিজেদের উদ্ভাবিত একটি ভ্যাকসিনও৷
ছবি: Abir Sultan/REUTERS
অপেক্ষায় জার্মানি
নভেম্বরের শুরুতেই টিকা কর্মসূচির কৌশল নির্ধারণ করেছে জার্মানির সরকার৷ ইইউর মাধ্যমে ৩০ কোটি টিকার অর্ডার দিয়েছে দেশটি৷ টিকা পাওয়া মাত্র দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ৬০ টি বিতরণ কেন্দ্রে সেগুলো পৌঁছে দেবে সরকার৷ তবে সাধারণ মানুষকে এর আওতায় আসতে বেশ কয়েক মাস অপেক্ষায় থাকতে হবে৷ কেননা, শুরুতে প্রাধান্য পাবেন বয়স্ক ও স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে থাকা নাগরিকরা৷ এই তালিকায় আছেন স্বাস্থ্যকর্মী ও করোনা চিকিৎসায় নিয়োজিতরাও৷
ছবি: Ralph Orlowski/REUTERS
জাপানে মহাযজ্ঞ
নিজেদের ১২ কোটি জনগোষ্ঠীর সবার জন্য আগামী জুনের মধ্যে করোনার টিকা নিশ্চিত করতে চায় জাপান সরকার৷ এজন্য ফাইজার, আস্ট্রাজেনেকা, মডার্নার কাছ থেকে ২৯ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন কেনার চুক্তি হয়েছে৷ জনগণকে বিনা খরচেই এই টিকা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেশটির সরকার গত অক্টোবরেই৷ ভ্যাকসিন সংরক্ষণে এরই মধ্যে সাড়ে দশ হাজার ডিপ ফ্রিজার কেনাসহ মহাযজ্ঞ হাতে নেয়া হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/Kyodo/MAXPPP
শেষ ধাপে চীন
পরীক্ষার শেষ ধাপে রয়েছে চীনের বিভিন্ন কোম্পানির বেশ কয়েকটি টিকা৷ সেগুলো চূড়ান্ত অনুমোদন না পেলেও জরুরি ভিত্তিতে এরই মধ্যে ১০ লাখ স্বাস্থ্যকর্মী ও ঝুঁকিতে থাকা নাগরিককে পরীক্ষামূলক টিকা দেয়া হয়েছে৷ বিভিন্ন প্রদেশের সরকার আগেভাগেই কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে জনসংখ্যার হিসাবে টিকার অগ্রিম অর্ডার দিয়ে রেখেছে৷ কারা আগে ভ্যাকসিন পাবেন তার অগ্রাধিকার তালিকাও তৈরি করছে প্রশাসন৷
ছবি: Wang Zhao/AFP/Getty Images
একাধিক টিকার অপেক্ষায় ভারত
আগামী ছয় থেকে আট মাসের মধ্যে ৩০ কোটি নাগরিককে টিকা দেয়ার পরিকল্পনা মোদী সরকারের৷ প্রথম ধাপের এই টিকা কর্মসূচীর আওতায় আসবেন স্বাস্থ্যকর্মী ও পঞ্চাশোর্ধ্বরা৷ এতে খরচ হবে ১৪০ থেকে ১৮০ কোটি ডলার৷ পুরো প্রক্রিয়ায় জড়িত থাকবে ২৩টি মন্ত্রণালয়৷ যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ও আস্ট্রাজেনেকা, রাশিয়ার স্পুটনিক এবং ভারতীয় জাইডাস কেডিলা ও ভারতী বায়োটেকের টিকা আছে সম্ভাব্য প্রাপ্তির তালিকায়৷
ছবি: Dado Ruvic/REUTERS
চীনে চোখ পাকিস্তানের
চীনের একটি টিকার তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল চলছে পাকিস্তানে৷ ভ্যাকসিন কেনার জন্য ইমরান খান সরকারের এখন পর্যন্ত ঘোষিত বাজেট ২৫ কোটি ডলার৷ এই অর্থ দিয়ে একাধিক টিকা কোম্পানির সঙ্গে চুক্তির পরিকল্পনা তাদের৷ প্রথম পর্যায়ে অগ্রাধিকার পাবেন কোভিড চিকিৎসায় নিয়োজিত স্বাস্থকর্মী এবং ৬৫ বছরের বেশি বয়সীরা৷ পরবর্তী ধাপে গুরুত্ব দেয়া হবে বাকি স্বাস্থ্যকর্মী এবং ষাটোর্ধ্বদের৷
ছবি: Aamir Qureshi/AFP/Getty Images
অক্সফোর্ডের ভরসায় বাংলাদেশ
অক্সফোর্ড-আস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন পেতে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে চুক্তি করেছে বাংলাদেশের বেক্সিমকো৷ যার মাধ্যমে পাওয়া যাবে তিন কোটি টিকা৷ এতে দেড় কোটি মানুষকে টিকার আওতায় আনা যাবে৷ টিকা প্রদানে অগ্রাধিকারের জন্য ১০ ধরনের জনগোষ্ঠীর তালিকা করেছে সরকার৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/J. Cairns
11 ছবি1 | 11
কোন ভ্যাকসিন দেয়া হবে?
ভারতে এটাই এখন সব চেয়ে আলোচিত প্রশ্ন। মোট তিনটি ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক জরুরি ভিত্তিতে দেয়ার জন্য আবেদন জানিয়েছে। অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন তৈরি করছে সেরাম ইনস্টিটিউট। তারা যাবতীয় কাগজপত্র জমা দিয়েছে বলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানাচ্ছে। কিন্তু বায়োনটেক-ফাইজারের ক্ষেত্রে তা বলা যাচ্ছে না। ভারতের নিজস্ব উদ্যোগ ভারত বায়োটেকের ভ্যাকসিনের চূড়াস্ত পর্যায়ের পরীক্ষা চলছে। সে দিক থেকে দেখতে গেলে অক্সফোর্ডের টিকার অনুমোদনের সম্ভাবনা বেশি। তবে পুরোটাই কর্তৃপক্ষের হাতে। তারা চাইলে বা দ্রুত সব তথ্য পেলে যে কোনো সময় তিনটি বা দুইটি ভ্যাকসিনের অনুমোদন তারা দিতে পারে।
প্রবীণ সাংবাদিক অবন্তিকা ঘোষ ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ''সেরামের কাছে চার কোটি ডোজ টিকা আছে। তারা ভ্যাকসিন উৎপাদনের গতি অনেকটাই বাড়াচ্ছে। ফেব্রুয়ারি থেকে তারা মাসে ১০ কোটি ভ্যাকসিন তৈরি করবে।''
তবে এর সবটাই ভারত পাবে না। বাংলাদেশ সহ অন্য দেশেও পাঠানো হবে। সেরাম আগেই জানিয়েছিল, তাদের ভ্যাকসিনের দুইটি ডোজের জন্য এক হাজার টাকার মতো লাগবে।
দেরি কেন?
যুক্তরাজ্যে ভ্যাকসিন দেয়া শুরু হয়েছে। শুরু করে দিয়েছে অ্যামেরিকা এবং ইইউ-র দেশগুলি। আরো কিছু দেশেও ভ্যাকসিন চালু হয়ে গেছে। সেখানে ভারতে সব কিছু হাতের কাছে থাকলেও ভ্যাকসিন চালুর ক্ষেত্রে দেরি হচ্ছে কেন?
স্বাস্থ্য মন্ত্রকের সূত্র জানাচ্ছে, তাড়াহুড়ো করা হচ্ছে না। সব কিছু নিশ্চিত করেই কাজে নামা হচ্ছে। ভারতে ইউনিভার্সাল ইমিউনাইজেশন প্রকল্প সাফল্যের সঙ্গে চলে। জাতীয় নির্বাচনের মতো বিশাল কর্মযজ্ঞও সাফল্যের সঙ্গে সামলানো হয়। কিন্তু করোনার ভ্যাকসিন সকলকে দেয়া তার চেয়ে অনেক বড় ও সময়সাপেক্ষ কাজ। সে জন্যই সব দিক ভালো করে দেখে নিয়ে ভ্যাকসিন চালু করা হচ্ছে।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তার মতে, ভারত বায়োটেকের টিকাও যাতে একসঙ্গে চালু করা যায়, সেই বিষয়টি না কি মথায় রাখা হচ্ছে। যদিও এই ধরনের কথা ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিচ্ছে স্বাস্থ্য মন্ত্রকের অন্য সূত্র।
নতুন বছরের গোড়াতেই করোনার ভ্যাকসিন পাওয়া যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।