ভারতীয় সেনাবাহিনীতে লিঙ্গ বৈষম্য দূর করতে ঐতিহাসিক রায় দিল সুপ্রিম কোর্ট৷ এ বার থেকে ছেলেদের মতো মেয়েরাও বাহিনীকে কমান্ড দিতে পারবে।
বিজ্ঞাপন
কেন্দ্রীয় সরকার চায়নি৷ তাদের রায় ছিল, মূলত পুরুষদের বাহিনীতে কমান্ড দেওয়ার ক্ষমতা মেয়েদের দেওয়া উচিত হবে না৷ বিশেষ করে বাহিনীর সদস্যরা যেখানে মূলত গ্রাম থেকে আসেন এবং বিশেষ সামাজিক ধ্যান-ধারণা নিয়ে আসেন, সেখানে মহিলা অফিসারের হাতে কমান্ড থাকা ঠিক হবে না। কেন্দ্রীয় সরকার জানিয়েছিল, মেয়েদের শারীরিক সক্ষমতাও পুরুষদের থেকে কম৷ কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের এই যুক্তি উড়িয়ে দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, এরকম বস্তাপচা ধ্যান-ধারণার কোনও অর্থ হয় না৷ সংবিধান ছেলে ও মেয়েদের সমানাধিকার দিয়েছে৷ কোনওরকম লিঙ্গ বৈষম্য করা যাবে না৷ বিচারপতি চন্দ্রচূড় ও বিচারপতি অজয় রাস্তোগিরের রায়, ''সেনাতে মহিলারাও পুরুষদের মতো কমান্ড করতে পারবেন৷ তাঁদের প্রতি কোনওরকম বিভেদ করা যাবে না৷ তিন মাসের মধ্যে এই রায় কার্যকর করতে হবে৷''
সহজ কথায়, কোনও মহিলা অফিসার কর্নেল বা তার ওপরের পদে যেতে পারবেন। তিনি ৮৫০ জন জওয়ানদের ব্যাটেলিয়ানকে কমান্ড করতে পারবেন বা নেতৃত্ব দিতে পারবেন৷ সেই ব্যাটেলিয়ানে তাঁর নির্দেশে চলবে৷ মহিলাদের এই অধিকার পাওয়ার ক্ষেত্রে বড় বাধা ছিল, তাদের স্থায়ীভাবে নিয়োগ করা হয় না৷ তাদের জন্য শর্ট সার্ভিস কমিশন আছে। তারা খুব বেশি হলে ১৪ বছর কাজ করতে পারতেন, সেটাও নির্দিষ্ট দশটি বিভাগে৷ সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিয়েছে, মহিলাদের জন্য স্থায়ী কমিশন গঠন করতে হবে। আর যাঁরা ১৪ বছর শর্ট সার্ভিস কমিশনে কাজ করেছেন, তাঁরা যদি সাফল্যের সঙ্গে কাজ করে থাকেন, তা হলে তাঁদেরও পদোন্নতি হতে পারে৷
তবে সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ের পরেও মহিলারা যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে বাহিনীকে কমান্ড করতে পারবেন কি? অবসরপ্রাপ্ত লেফটানান্ট কমান্ডার উৎপল ভট্টাচার্য ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ''জওযানদের মধ্যে এখনও মেযেরা আসেননি৷ তারা শুধু অফিসার পর্যায়ে আছেন৷ সেনার ফাইটিং ব্রাঞ্চ আছে পাঁচটি৷ পদাতিক, গোলন্দাজ, সাঁজোয়া, ইঞ্জিনিয়ারিং ও সিগন্যাল৷ পদাতিক, গোলন্দাজ, সাঁজোয়া তো বটেই ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে যাঁরা ওয়ারজোনে কাজ করেন, সেখানে মেয়েদের নেওয়া হয় না৷ আমি জানি ইসরায়েলি বাহিনীতে মেয়েরা এই সব জায়গায় আছেন। আমাদের দেশেও হবে৷ তবে সময় লাগবে৷ দেশকে সেভাবে এগোতে হবে৷ হয়তো তিরিশ বছর লাগবে৷ সব কিছুতেই আমরা কিছুটা পিছিয়ে। এই অবস্থায় মেয়েরা যুদ্ধক্ষেত্রে কমান্ড করছে, এটা মিসম্যাচ হয়ে যেতে পারে। আর্মি সার্ভিস কোর, অর্ডনান্স কোর, মিলিটারি পুলিশ, এডুকেশন কোর, যাকে বলে সেনার সার্ভিস সেক্টর সেখানে মেয়েরা কমান্ড করতেই পারেন৷''
লিঙ্গবৈষম্য দূর করায় এশিয়ার সেরা ১০ দেশ
লিঙ্গবৈষম্য দূর করায় কোন দেশ কতটা এগিয়ে আর কারা কত পিছিয়ে তা প্রতিবছরই জানিয়ে আসছে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম৷ সংস্থাটির সর্বশেষ ইনডেক্সে এশিয়ার সেরা দশটি দেশের তালিকা প্রকাশ করেছে৷ সেখানে একেবারে ওপরের দিকে আছে বাংলাদেশ৷
ছবি: picture-alliance/dpa
১০. কম্বোডিয়া
২০০৬ সাল থেকে ‘গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ ইনডেক্স’ প্রকাশ করে আসছে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম৷ সম্প্রতি প্রকাশিত তাদের সর্বশেষ ইনডেক্সে এশিয়ার সেরা দশটি দেশের মধ্যে দশম স্থানে রয়েছে কম্বোডিয়া৷ নারীর ক্ষমতায়নে দেশটির সাম্প্রতিক অগ্রগতির প্রশংসা করেছে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম৷ বলা হয়েছে, চাকুরিতে উচ্চপদে, ব্যাবস্থাপনা এবং শিক্ষকতায় নারীর অংশ গ্রহণ যথেষ্ট বেড়েছে৷
ছবি: DW/R. Duerr
৯. ইন্দোনেশিয়া
মূলত অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নারীর সুযোগ-সুবিধা পর্যবেক্ষন ও বিশ্লেষণ করেই ‘গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ ইনডেক্স’ প্রকাশ করে আসছে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম৷ এসব বিবেচনায় এশিয়ার সেরা দশ দেশের মধ্যে নবম অবস্থানে রয়েছে ইন্দোনেশিয়া৷ লিঙ্গবৈষম্য দূরীকরণে সাম্প্রতিক উন্নতির ধারাবাহিকতা ধরে রেখে দেশটি বেতনবৈষম্য কমানো, রাজনীতিতে সুযোগ বৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য উন্নতি করেছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Rante
৮. মিয়ানমার
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ইনডেক্সে নতুন সংযোজন মিয়ানমার৷ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রোহিঙ্গা নির্যাতনের জন্য বেশি আলোচিত-সমালোচিত দেশটি মাধ্যমিক ও টারশিয়ারি পর্যায়ের শিক্ষায় নারী-পুরুষের বৈষম্য কমিয়ে এনেছে৷ তবে সংসদে এবং চাকরিক্ষেত্রে উচ্চপদে নারীর সুযোগ এখনো কম বলে মিয়ানমারের সমালোচনাও করেছে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম৷
ছবি: Soe Than Win/AFP/Getty Images
৭. থাইল্যান্ড
মন্ত্রীত্বের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বও নারীরা এখন বেশি পাচ্ছে বলে দেশটির প্রশংসা করেছে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম৷ এছাড়া প্রযুক্তিনির্ভর কাজে এবং অন্য অনেক পেশায় নারী-পুরুষের বেতনবৈষম্য দূর করেছে থাইল্যান্ড৷ এ কারণেই তাদের সপ্তম স্থানে রাখা হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
৬. ভিয়েতনাম
সাম্প্রতিক সময়ে মন্ত্রীত্বের মতো দায়িত্বে নারীর সুযোগ না বাড়িয়ে বরং কমিয়ে দিয়েছে ভিয়েতনাম৷ তারপরও অনেক চাকরিতে বেতনবৈষম্য কমিয়ে এবং শিক্ষায় নারীর অংশ গ্রহণ বাড়ানোর সুবাদে এশিয়ার সেরা দশ দেশের তালিকায় ষষ্ঠ স্থান পেয়েছে তারা৷
ছবি: DW/Aya Bach
৫. সিঙ্গাপুর
অর্থনীতিতে নারীর অংশ গ্রহণ আরো বেড়েছে৷ কায়িক শ্রমনির্ভর কাজেও নারীরা এগিয়ে আসছেন আগের চেয়ে বেশি হারে৷ স্বাস্থ্য খাতেও বৈষম্য দূর করে প্রশংসা কুড়িয়েছে সিঙ্গাপুর৷
ছবি: picture-alliance/PYMCA/Photoshot/J. Manning
৪. লাওস
আফ্রিকার বাইরে একমাত্র দেশ লাওস, যারা টানা দ্বিতীয় বছরের মতো কায়িক শ্রমনির্ভর কাজে বেতনবৈষম্য দূর করেছে, নারীর অংশগ্রহণও বাড়িয়েছে৷ তবে নিরক্ষরতা দূরীকরণে সাম্প্রতিক সময়ে কিছুটা অবনতির ফলে অনেক ক্ষেত্রে একই কাজে নারী-পুরুষের বেতনবৈষম্য কিছুটা বেড়েছে৷
ছবি: Reuters/J.Silva
৩. মঙ্গোলিয়া
লিঙ্গ বৈষম্য দূর করায় উন্নতি দেখিয়ে সারা বিশ্বের মধ্যে ৫৩ তম স্থান পেয়েছে এশিয়ার এই দেশ৷ তবে এশিয়ার সেরা দশে তারা রয়েছে তৃতীয় স্থানে৷ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে মঙ্গোলিয়ার উন্নতিও প্রশংসনীয়, তবে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম বলছে, বাংলাদেশের উন্নতি সেই তুলনায় অনেক বেশি৷
ছবি: picture-alliance/Fischer
২. বাংলাদেশ
গত বছরের তুলনায় অনেক বেশি উন্নতি করে বিশ্বের সব দেশের মধ্যে এবার ৪৭তম স্থানে উঠে এসেছে বাংলাদেশ৷ এক বছরে লিঙ্গবৈষম্য শতকরা ৭২ ভাগ কমিয়ে এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে দেশটি৷কিছু ক্ষেত্রে প্রত্যাশিত উন্নতি না হলেও আইনসভায়, চাকরিক্ষেত্রের উচ্চপদ এবং ব্যবস্থাপনার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে এই এক বছরে বাংলাদেশ চোখে পড়ার মতো উন্নতি সাধন করেছে বলে মনে করে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম৷
ছবি: Harun Ur Rashid Swapan H
১. ফিলিপাইন্স
এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র ফিলিপাইন্সই বিশ্বের সব দেশের তালিকায় সেরা দশে স্থান পেয়েছে৷ স্বাভাবিকভাবেই এশিয়ার সেরা দশের সর্বোচ্চ স্থানটিও তাদের৷ সার্বিকভাবে বাংলাদেশ যেখানে শতকরা ৭২ ভাগ লিঙ্গবৈষম্য দূর করেছে, সেখানে ফিলিপাইন্স করেছে শতকরা ৭৯ ভাগ৷শিক্ষাক্ষেত্রে নারী-পুরুষের অংশ গ্রহণে ব্যবধান শূন্যে নামিয়ে এনেছে তারা৷
ছবি: imago/AFLO
10 ছবি1 | 10
বিচারপতিরা রায়ে বলেছেন, মহিলাদের শারীরিক ক্ষমতা, তাদের ভূমিকা ও কৃতিত্ব নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করাটা শুধু মহিলাদের অপমান করা নয়, ভারতীয় সেনারও অপমান৷ লে, উধমনগরে ক্যাপ্টেন তানিয়া শেরগিল, ক্যাপ্টেন মধুমিতার মতো মহিলা অফিসারদের কৃতিত্বের কথা তুলে ধরে সর্বোচ্চ আদালত বলেছে, মহিলারাও পুরুষদের মতো সমানভাবে সক্রিয় ও দক্ষ সেনা হতে পারেন৷
বিশিষ্ট চিকিৎসক সুব্রত কুণ্ডুও সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে একমত। ডয়চে ভেলেকে তিনি জানিয়েছেন, ''এখন উন্নত প্রযুক্তির যুগ। যুদ্ধক্ষেত্রে যে কামান ব্যবহার করা হয়, যে ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করা হয়, তা মেয়েরা অনায়াসে চালাতে পারেন। এ ক্ষেত্রে শারীরিক দিক দিয়ে তাঁরা পুরুষদের থেকে পিছিয়ে থাকবেন না৷ লড়াইয়ের ময়দানে মেয়েদের সফল হওয়ার পথে কোনও শারীরিক বাধা আসবে না৷ তা ছাড়া সেনাতে তো শুধু ফিট পুরুষ ও মেয়েদেরই নেওয়া হয়৷''
সেনাতে লিঙ্গ বৈষম্য দূর করার রায় দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট৷ তাতে পরিবর্তন কতটা হয়, কত দিনের মধ্যে হয় সেটাই দেখার৷