স্মার্টফোনের এই যুগে সেল্ফি তোলাটা যেন একটা আসক্তি৷ আর এই আসক্তি হতে পারে বিপজ্জনক৷ ভারতে গত কয়েক বছরে সেল্ফি তুলতে গিয়ে মৃত্যুর ঘটনা বেড়েই চলেছে৷
বিজ্ঞাপন
গত সপ্তাহে ভারতের রাজস্থানে বিশাল এক সাপের সঙ্গে সেল্ফি তোলার শখ হয়েছিল এক ব্যক্তির৷ সেল্ফি তোলার সময় সাপটা ঐ ব্যক্তির কাঁধে ছোবল মারে৷ ঐ ব্যক্তির ভাগ্য ভালো থাকায় বেঁচে যান৷ কিন্তু সবার ভাগ্য কি এত সুপ্রসন্ন হয়! ভারত জুড়ে এমন মৃত্যুর বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে৷ তবে কেবল ভারত নয়, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে সেল্ফি তুলতে গিয়ে মৃত্যুর ঘটনা বাড়ছে৷
সেল্ফি যাতে খুব সুন্দর হয় সেজন্য অনেক মানুষ বিপদকে উপেক্ষা করে অনেক জায়গায় বা পরিস্থিতে চলে যায়৷ যেমন রেল লাইনের উপর দাঁড়িয়ে চলন্ত ট্রেনের সঙ্গে সেল্ফি অথবা সমুদ্রের একেবারে গভীরে গিয়ে সেল্ফি বা পর্বতের চূড়ায় উঠে সেল্ফি৷ চলতি বছরের মে মাসে পাঞ্জাবে মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে সেল্ফি তুলতে গিয়ে এক কিশোর ছবির বোতাম টিপতে গিয়ে ভুল করে ট্রিগার টিপে দেয়৷ ফলাফল মৃত্যু৷ জুলাই মাসে এক ব্যক্তি গঙ্গা নদীতে সেল্ফি তুলতে গিয়ে ডুবে যায়, আর তাঁকে বাঁচাতে গিয়ে সাত বন্ধু নদীতে ডুবে প্রাণ হারায়৷ সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তেলেঙ্গানায় একটি পাথরের উপর দাঁড়িয়ে সেল্ফি তোলার চেষ্টা করছিল ছয় ছাত্রী৷ এক ছাত্রী সেখান থেকে লেকে পড়ে যায়, বাকিরা তাকে বাঁচাতে গিয়ে মারা যায়৷
নতুন দিল্লির সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক সঞ্জয় শ্রীবাস্তব ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘ভারতে সেল্ফি তোলার যেন হিড়িক পড়েছে৷ তরুণ প্রজন্ম একে অপরকে ‘ইমপ্রেস', মানে মুগ্ধ করতে সেল্ফি তোলে৷ এমনকি বিপদেরও পরোয়া করে না তারা৷'
সবাই বিখ্যাত হতে চায়
সাম্প্রতিক এক গবেষণা বলছে, ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সিদের মধ্যে সেল্ফি তোলার প্রবণতা বেশি৷ মানুষের আচার-আচরণ নিয়ে কাজ করেন কুলদ্বীপ সিং৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আমাদের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করছে৷ বড় বড় শহরগুলোতে তরুণ প্রজন্ম মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করতে আগ্রহী৷ তারা প্রত্যেকেই বিখ্যাত হতে চায়৷ আর সে কারণেই সেল্ফি তোলে৷''
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মিডিয়া সংস্থা নিউজগ্রাম বলছে, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই বিপজ্জনক স্থানে সেল্ফি তোলার হিড়িক বাড়ছে৷ তাই কেবল বিপজ্জনক স্থানে বা পরিস্থিতিতেই নয়, বিষধর সাপ এমনকি প্রাণীর সঙ্গে সেল্ফি তুলতে আগ্রহী তারা৷ সংস্থাটি বলছে, ‘এর ফলে প্রায়ই ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটছে, আহতও হচ্ছে অনেকে৷ সবচেয়ে দুঃখজনক হলো এই ধরনের সেল্ফি মৃত্যু ডেকে আনছে৷'
সেল্ফি হাঙরের চেয়েও বিপজ্জনক, তবুও হিড়িক চলছে
চলছে সেল্ফির যুগ৷ তাই খেতে বসেও মানুষ সেল্ফি তোলে৷ দুর্ঘটনাও ঘটে অনেক৷ আজকাল হাঙরের আক্রমণে যত মানুষ মারা যায় তারচেয়ে বেশি মারা যায় সেল্ফি তুলতে গিয়ে৷ তবু মানুষ কতভাবে সেল্ফি তোলে, কত রকমের বিপদে পড়ে!
ছবি: Colourbox
সেল্ফি হাঙরের চেয়েও বিপজ্জনক
এক জরিপ অনুযায়ী ২০১৫ সালে হাঙরের আক্রমণে এ পর্যন্ত মারা গেছে মোট ৮ জন মানুষ, অন্যদিকে সেল্ফি তুলতে গিয়ে মৃত্যু হয়েছে কমপক্ষে ১২ জনের৷ তাই কয়েকদিন আগে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের খবরেই শিরোনাম ছিল, ‘‘হাঙরের চেয়ে বেশি মানুষ হত্যা করে সেল্ফি৷’’ সেল্ফির নেশা সত্যিই বড্ড বিপজ্জনক, কখনো কখনো হাঙরের চেয়েও বিপজ্জনক!
ছবি: Getty Images/Scott Tuason
সেল্ফির কারণে মৃত্যু
সেল্ফি তুলতে গিয়ে মৃত্যুর ঘটনা অহরহই ঘটছে৷ কয়েকদিন আগে তাজমহল দেখতে গিয়ে সেল্ফি তোলার ইচ্ছে হয় ৬৬ বছর বয়সি এক ভদ্রলোকের৷ সিঁড়ি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সেল্ফি তুলতে গেলেন, পা পিছলে পড়েই তাঁর ভবলীলা সাঙ্গ! হাতে বন্দুক নিয়ে সেল্ফি তুলতে গিয়ে ট্রিগারে চাপ দিয়ে বসায় এক লোক মারা গেছেন – এ খবরও বেশি পুরোনো নয়৷ সেল্ফি তোলার ব্যাপারে তাই সবাইকে সতর্ক করার কথা ভাবতে শুরু করেছে কয়েকটি দেশের সরকার৷
ছবি: DW
সাবধানে সেল্ফি তুলুন
রাশিয়ায় গত জানুয়ারিতে প্রস্রাব করার সময় হাতে পিনখোলা গ্রেনেড নিয়ে সেল্ফি তুলতে গিয়েছিলেন এক তরুণ৷ সেল্ফি তোলা শেষ হওয়ার আগেই গ্রেনেডটি বিস্ফোরিত হলো৷ সঙ্গে সঙ্গেই মারা গেলেন দুই তরুণ৷ তারপর মে মাসে এক কিশোর রেলপথের ব্রিজে সেল্ফি তুলতে গিয়ে অসতর্কতাবশত বৈদ্যুতিক তারে হাত দিয়ে দেয়৷তাকেও বাঁচানো যায়নি৷ আগামীতে রাশিয়ার পথে পথে নাকি লেখা থাকবে, ‘‘একটি সেল্ফি আপনার মৃত্যুও ডেকে আনতে পারে৷’’
ছবি: Fotolia/nenetus
হজে গিয়েও সেল্ফি
গত কয়েক বছরে পবিত্র হজে হাজিদের মাঝেও সেল্ফি তোলার হিড়িক বেড়েছে৷ হজ সেরে তাই কিছুটা স্বস্তি নিয়েই মিশরের কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ রশিদ বললেন, ‘‘আমি যখন প্রার্থনা করছি তখনও অনেকে সেল্ফি তুলছিল৷ এমন হলে তো মনযোগ নষ্ট হয়ে যেতে পারে৷’’ মিশরের অনেক ইসলামি চিন্তাবিদও হজের সময় সেল্ফি তোলার প্রবণতার কঠোর সমালোচনা করেছেন৷ছবিতে এক দম্পতিকে হজ করতে গিয়ে সেল্ফি তুলতে দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Al-Shaikh
নগ্ন হয়ে সেল্ফি
শিশু-কিশোররাও দেদার সেল্ফি তুলছে৷ ব্রিটেনের তিন শিশু নগ্ন অবস্থাতেই সেল্ফি তুলে মেয়েদের পাঠিয়ে পড়েছে বিপদে৷ বিবিসি-র খবর অনুযায়ী, তিনজনের বয়সই ১৪ বছরের কম বলে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়নি, মামলাও হয়নি৷ তবে পুলিশের খাতায় তাদের নাম লেখা থাকবে আগামী ১০ বছর৷ এই ১০ বছরে তারা আর কোনো অপরাধে জড়ায় কিনা তা লক্ষ্য করবে পুলিশ৷ নগ্ন হয়ে সেল্ফি তুলে কাউকে পাঠানোকে অপরাধ হিসেবেই গণ্য করে ব্রিটেনের পুলিশ৷
ছবি: picture-alliance/dpa/W. Steinberg
তবুও সেল্ফি, চামচ দিয়েও সেল্ফি...
এত কিছুর পরও সেল্ফি তোলা কমছে না৷ বরং সবাই যাতে আরো বেশি করে সেল্ফি তোলে সেই ব্যবস্থাই করে চলেছে আধুনিক প্রযুক্তি৷ তাই এতদিন খাওয়ার সময় সেল্ফি তুলতে না পেরে যারা বিরক্ত হতেন, তাদের জন্যও এসে গেছে বিশেষ ধরণের চামচ৷ সেই চামচ দিয়ে খেতে খেতেই সেল্ফি তোলা যায়৷ চামচটির নাম ‘সিনামন টোস্ট ক্রাঞ্চ সেল্ফি স্পুন’৷
ছবি: Colourbox
6 ছবি1 | 6
নিরাপদ সেল্ফি
ভারতে, সেল্ফি তোলার জন্য স্মার্টফোনের বিক্রি হু হু করে বেড়েই চলেছে৷ আগামী বছরে এই বিক্রি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে স্মার্টফোনের বিক্রিকে ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে৷ ২০১৬ সালের শেষ নাগাদ ভারতে স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা দাঁড়াবে ২২ কোটিরও বেশি৷ তাই সরকার জনসাধারণকে স্মার্টফোন ব্যবহারে সচেতন করে তুলতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে৷ বিশেষ করে পর্যটন এলাকাগুলোতে স্মার্টফোন ব্যবহারে বিশেষ বিশেষ দিক নির্দেশনা দেয়ার পরিকল্পনা করছে সরকার৷
আপনি কি সেলফির প্রতি আসক্ত? কিংবা আপনি কি একে হাস্যকর মনে করেন? আনাস মোডামানির কিন্তু ভাগ্য বদলে গেছে এক সেলফির কারণে৷ দেখুন কিভাবে:
ছবি: Anas Modamani
আঙ্গেলা ম্যার্কেলের সঙ্গে সাক্ষাৎ
বার্লিনে এক শরণার্থী শিবিরে থাকার সময় আনাস মোডামানি একদিন শুনলেন যে, জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল তাদের দেখতে আসবেন এবং তাদের সঙ্গে কথাও বলবেন৷ ১৯ বছর বয়সি সিরিয়ান তরুণ, যিনি কিনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যাপক ভক্ত, সুযোগটা হাতছাড়া করেননি৷ তিনি তখন ভাগ্য বদলের স্বপ্ন নিয়ে ম্যার্কেলের সঙ্গে একটি সেলফি তোলেন৷
ছবি: Anas Modamani
ইউরোপে পালিয়ে আসা
দামেস্কে যখন তাঁদের বাড়ির উপর বোমা পড়ে, তখন মোডামানি এবং তাঁর বাবাম ও ভাইবোনেরা গরিয়া নামক একটি ছোট্ট শহরে চলে যান৷ সেখান থেকে ইউরোপের পথে যাত্রা করেন তিনি৷ প্রথমে লেবানন, এরপর তুরস্ক হয়ে গ্রিসে৷
ছবি: Anas Modamani
বিপজ্জনক যাত্রা
মোডামানি যাত্রাপথে প্রায় মরতে বসেছিলেন৷ আরো অনেক শরণার্থীর মতো, একটা রাবার বোটে করে তুরস্ক থেকে গ্রিস আসতে হয়েছিল তাঁকে৷ মোডামানি জানান, নৌকাটি অতিরিক্ত বোঝাই ছিল এবং এক পর্যায়ে সমুদ্রে তলিয়ে যায়৷ তিনিও প্রায় ডুবে যাচ্ছিলেন৷ কিন্তু ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান৷
ছবি: Anas Modamani
পাঁচ সপ্তাহ পায়ে হাঁটা
গ্রিস থেকে পায়ে হাঁটা পথে মেসিডোনিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন মোডামানি৷ হাঙ্গেরি এবং অস্ট্রিয়ায় তিনি হেঁটেছেন অনেকটা পথ৷ এরপর ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে পৌঁছান তাঁর চূড়ান্ত গন্তব্য মিউনিখে৷ জার্মানিতে আসার পর তিনি বার্লিনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন৷ তখন থেকেই তিনি বার্লিনেই আছেন৷
ছবি: Anas Modamani
রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়ার আশায়
বার্লিনে পৌঁছানোর পর মোডামানি বেশ ক’টা দিন কাটিয়েছেন লাগেসো শরণার্থী কেন্দ্রের সামনে৷ তিনি জানান, সেখানকার অবস্থা বেশ জটিল, বিশেষ করে শীতের সময়৷ এক পর্যায়ে তাঁকে বার্লিনের স্পানডাও অঞ্চলের শরণার্থী কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেয়া হয়৷ তিনি শরণার্থী হিসেবে তাঁর অবস্থা সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন৷ আর ম্যার্কেলের সঙ্গে সেলফি তাঁকে সেই সুযোগ করে দিয়েছে৷
ছবি: Anas Modamani
অবশেষে এক পরিবারের সন্ধান
মোডামানি জানিয়েছেন, চ্যান্সেলর ম্যার্কেলের সঙ্গে তোলা সেলফি জীবন বদলে দিয়েছে৷ সেই ছবি ইন্টারনেটে প্রকাশের পর গণমাধ্যমের নজর পড়ে তাঁর দিকে এবং একটি জার্মান পরিবার তাঁকে আশ্রয় দেয়ার সিদ্ধান্তে নেয়৷ গত দু’মাস ধরে জার্মান পরিবারের সঙ্গে আছেন তিনি৷ আর সেই পরিবার তাঁকে পরিবারের সদস্যদের মতোই সহায়তা করছে৷
ছবি: Anas Modamani
বাড়ির কথা মনে পড়ে
জার্মান পরিবারের সঙ্গে বসবাসের পর থেকে বেশ ভালোই আছেন মোডামানি৷ জার্মান ভাষা শিখছেন এখন৷ তাঁর বেশ কিছু বন্ধুও হয়েছে৷ জার্মানিতে পড়াশোনা করতে চান তিনি৷ তবে তাঁর আপাতত লক্ষ্য হচ্ছে জার্মানিতে রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়া৷ কেননা তাহলে নিজের পরিবারকে জার্মানি নিয়ে আসা সহজ হবে তাঁর জন্য৷
ছবি: Anas Modamani
শরণার্থীদের সম্পর্কে নেতিবাচক মানসিকতা
জার্মানিতে একটি উন্নত ও নিরাপদ জীবনের আশা মোডামানি৷ তবে শরণার্থীদের সম্পর্কে জার্মানির বর্তমান মনোভাব নিয়ে কিছুটা শঙ্কিত তিনি৷ তাঁর আশঙ্কা, শরণার্থীদের সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব ভবিষ্যতে আরো বাড়তে পারে৷ সেক্ষেত্রে তা শরণার্থী বিষয়ক আইনের উপর প্রভাব ফেলবে৷ ফলে তাঁর আবেদন হয়ত বাতিল হবে৷ আর নিজ পরিবারকে জার্মানিতে আনার স্বপ্ন হয়ত স্বপ্নই থেকে যাবে৷