1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান
ধর্মভারত

ভারতে হিজাব খুলে নিগ্রহ: নেপথ্যে কোন মানসিকতা

১৯ এপ্রিল ২০২৫

ভারতের উত্তরপ্রদেশে নারীর হিজাব খুলে নিগ্রহ করার ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। নিজের এলাকাতেই নিগ্রহের শিকার হয়েছেন তরুণী।

মোবাইল ফোন হাতে হিজাব পরিহিত এক নারী
মুজাফফরনগরের ঘটনাতে মুসলিম ধর্মাবলম্বী কয়েকজনের হাতেই লাঞ্ছিত হয়েছেন হিজাব পরিহিত এক নারীছবি: Mayank Makhija/NurPhoto/IMAGO

ভারতের সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য উত্তরপ্রদেশের মুজাফফরনগরের ঘটনায় দেশজুড়ে হইচই পড়ে গিয়েছে। এর পর প্রশ্ন উঠেছে, এমন ঘটনার পেছনে ঠিক কী ধরনের মানসিকতা কাজ করে?

কী ঘটেছিল মুজাফফরনগরে?

চলতি সপ্তাহে মুজাফফরনগরের একটি জনবহুল এলাকা দর্জিওয়ালা গলিতে ঘটনাটি ঘটে। ভাইরাল ভিডিওতে দেখা গিয়েছে, এক তরুণীকে ঘিরে ধরেছে কয়েকজন। তারা তরুণীকে লক্ষ্য করে নানা ধরনের মন্তব্য করছে। ঘেরাটোপের মধ্যে পড়ে অসহায় নারী আর্তনাদ করছেন। অল্পবিস্তর ধাক্কাধাক্কি চলছে। এদের কয়েকজন এই ঘটনা মোবাইল ক্যামেরায় বন্দি করছিল।

সেই সময়ে দেখা যায় ভিড়ের মধ্যে থাকা এক ব্যক্তি তরুণীর মাথা থেকে হিজাব টেনে খুলে দিচ্ছে। ভিড়ের আক্রমণের সামনে বিশেষ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেননি তরুণী। তাকে বাঁচাতেও কেউ এগিয়ে আসেননি।

খবর পেয়ে পুলিশ দ্রুত সেই এলাকায় আসে। থানায় তরুণীর দায়ের করা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সেখান থেকে ছয় জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

ধৃতদের নাম সরতাজ, শাদাব, উমর, আর্শ, শোয়েব ও শামি। তরুণী অভিযোগ জানানোর পরে সকলের পরিচয় সামনে আসে। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০ বছর বয়সি ওই তরুণী স্থানীয় খালপাড় এলাকার বাসিন্দা। শচীন নামে এক যুবকের সঙ্গে তিনি সেখান দিয়ে যাচ্ছিলেন।

তরুণীর মা একটি ব্যাংকে কাজ করেন। যুবক সেই ব্যাংকেরই কর্মী। ঋণ সংক্রান্ত কোনো একটি কাজে শচীনের সঙ্গে তার মেয়েকে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন ওই নারী। শচীন তরুণীকে মোটর বাইকে চাপিয়ে নিয়ে আসেন। এরপরই তাদের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার মুখে পড়তে হয়।

পুলিশ এই ঘটনার তদন্ত করছে।

ভারতের উত্তরপ্রদেশ রাজ্যে কট্টর হিন্দুত্ববাদী মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার ক্ষমতায় রয়েছে। ২০১৭ সালে তিনি মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নেয়ার আগেও এ রাজ্যে মুসলমানদের উপর আক্রমণের ঘটনা সামনে এসেছে।

২০১৫ সালে দাদরিতে মোহাম্মদ আখলাকের হত্যা দেশকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। আখলাকের কাছে গোমাংস আছে, এই অভিযোগ তুলে একদল দুষ্কৃতী বাড়িতে হামলা চালিয়ে তাকে হত্যা করে। পরে দেখা যায় আখলাকের বাড়িতে আদৌ গোমাংস ছিল না। যোগী ক্ষমতায় আসার পর বার বার সংখ্যালঘু নিপীড়নের অভিযোগ উঠেছে।

তবে মুজাফফরনগরের ঘটনায় সকলে বিস্মিত এই কারণে, এক্ষেত্রে সংখ্যালঘু তরুণী নিজ সম্প্রদায়ের মানুষের হাতে নিগৃহীত হয়েছেন।

বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ তনভীর নাসরিন বলেন, "এই ঘটনায় নিগৃহীতা ও নিগ্রহকারী উভয়ই মুসলমান ধর্মাবলম্বী। যারা নিগ্রহ করেছে তারা অন্য সম্প্রদায়ের মানুষ হলে আমরাই ঘটনার একটা ভিন্ন অর্থ খোঁজার চেষ্টা করতাম। এর দুটো দিক আছে। এর মধ্যে একটি অবশ্যই সাম্প্রদায়িক। নিগ্রহকারীরা ওই তরুণীর প্রতিবেশী। অন্য ধর্মের তরুণ সঙ্গে থাকায় তারা কোন প্রণয়ঘটিত সম্পর্কের কথা অনুমান করেছে। তাই মেয়েটির উপর চড়াও হয়েছে। এটা খুবই ঘৃণ্য ব্যাপার।"

সার্বিকভাবে নারীর প্রতি হীন মানসিকতা প্রকাশিত হয়েছে: অধ্যাপক সৈয়দ তনভীর নাসরিন

This browser does not support the audio element.

তার মতে, "এতে শুধু সম্প্রদায় নয়, সার্বিকভাবে নারীর প্রতি হীন মানসিকতা প্রকাশিত হয়েছে। এখানে মেয়েটিকে নিশানা করা হয়েছে। তার সম্প্রদায় মনে করছে, তরুণী কী করবেন, আচরণ কী হবে, সেটা তার সম্প্রদায়ের পিতৃতান্ত্রিক কর্তারা নির্ধারণ করে দেবে। তরুণী কোন প্রয়োজনে, কার সঙ্গে কোথায় গিয়েছিলেন, সেজন্য অন্য কারো কাছে জবাব দিতে তিনি বাধ্য নন। ভারতে আইন আছে, সমাজে শৃঙ্খলা রয়েছে। সে সবকিছুকে অতিক্রম করে কয়েকজন পুরুষ একটি নিরপরাধ মেয়েকে প্রকাশ্যে আক্রমণ করছে, এটা অত্যন্ত নিন্দাজনক।"

আইএসএফ বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকী বলেন, "বোরখা, হিজাব পরে অনেক নারী এখন কর্মক্ষেত্রে যান। তাদের উপরে আক্রমণ নেমে আসছে। এর আগে গোমাংস খাওয়ার অভিযোগে উত্তরপ্রদেশে পিটিয়ে খুন করা হয়েছিল আখলাককে। যোগী সরকারের কাছে আমার অনুরোধ, যারা নারী নিগ্রহ করেছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হোক, যাতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি না হয়। নাগরিক যাতে তার অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে, সেটা সরকারকে দেখতে হবে। এসব ঘটনায় আন্তর্জাতিক স্তরে দেশের সম্মান ক্ষুণ্ন হচ্ছে। তাই যুদ্ধবিধ্বস্ত প্যালেস্টাইনের তুলনায় ভারতের মানুষ কম সুখে আছে, এটা সমীক্ষায় উঠে এসেছে।"

'ধর্ম নিয়ে উন্মাদনা' উসকে দিচ্ছে এমন ঘটনা?

অতীতেও হিজাবকে কেন্দ্র করে বিতর্ক হয়েছিল ভারতে।

২০২২ সালে দক্ষিণ ভারতীয় রাজ্য কর্নাটকের স্কুলে হিজাব পরে আসা নিষিদ্ধ করা হয়। হিজাব আদৌ ইসলাম ধর্ম–সংস্কৃতির কোনও অংশ কি না, এ নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে ওঠে। হিজাব বাতিলের সেই সিদ্ধান্তের নেপথ্যে ছিল বিজেপি নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকার। অর্থাৎ এ সব অভিযোগ ছিল মূলত হিন্দু জাতীয়তাবাদী শক্তির বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে যারা সংখ্যালঘুদের ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিল বলে অনেকেরই মত। সেদিক থেকে মুজাফফরনগরের ঘটনা ব্যতিক্রমী।

নারী অধিকার আন্দোলনের কর্মী, অধ্যাপক শাশ্বতী ঘোষ ডিডাব্লিউকে বলেন, "পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে, জীবিকার প্রয়োজনে অন্য ধর্মের কারো সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন বা বন্ধুত্ব করা যাবে না! মুজফফরনগরের ক্ষেত্রে অভিযুক্তরা মুসলমান সম্প্রদায়ের। তারা সংখ্যালঘু বলেই হয়তো নিজেদের সুরক্ষার ব্যাপারে বেশি আতঙ্কিত থাকেন। তাই এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। মেয়েটির প্রতি অসহিষ্ণুতা দেখানো হয়েছে, পাছে তরুণী যদি তার ধর্মের বাইরে গিয়ে কিছু করে ফেলেন। অর্থাৎ এক্ষেত্রে লাভ জিহাদের উল্টোটা। অন্য সম্প্রদায়ের মানুষ নয়, নিজের সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা নারীর হিজাব খুলে তাকে বেআব্রু করে দিচ্ছে, এটাই সবচেয়ে আশ্চর্যের।"

তার বক্তব্য, "মেয়েদের যে উপার্জন দরকার, সব নারীকে বসিয়ে খাওয়ানোর মতো মাথার উপরে পুরুষ নেই, এটা এই সমাজ মানতে চাইছে না। যারা নীতিপুলিশি চালায়, তারা মেয়েদের উপর শাস্তির খাঁড়া নামিয়ে আনছে, যদি তারা জীবিকার প্রয়োজনে কোনো পুরুষের সঙ্গে যোগাযোগ করে। কিছুদিন আগে ট্রেনে এক পুরুষের সঙ্গে কথা বলার জন্য নারীর গ্রামে সালিশি সভা বসানো হয়েছিল, তিনি কেন কথা বলেছেন! এই মেয়েরা সংখ্যালঘু হলে তাদের উপর শাস্তির খাঁড়া আরো নিষ্ঠুরভাবে নেমে আসছে।"

মানবাধিকার কর্মী রঞ্জিত শূর ডিডাব্লিউকে বলেন, "ধর্ম ধর্ম করে দেশে একটা উন্মাদনা তৈরি করেছেন ধর্মগুরু থেকে রাজনীতিকরা। এর শিকার হচ্ছে কমবয়েসী ছেলেমেয়েরা। ফলে একজন নারী ভিন্ন ধর্মাবলম্বী কোনো পুরুষের সঙ্গে কাজের সূত্রে যুক্ত হলেও অনেকে সেটা সহ্য করতে পারছে না। যদি কোনো নারী ভিন্ন সম্প্রদায়ের কোনো পুরুষের সঙ্গে ঘুরতেও যান, তাহলেও এভাবে লাঞ্ছনা করার অধিকার জন্মায় না। এটা ধর্মীয় উন্মাদনা থেকে তৈরি হয়েছে। হিন্দুদের ক্ষেত্রে মনুবাদী সংস্কৃতি আর মুসলমানদের ক্ষেত্রে মৌলবাদী ভাবনার ফলে এমন ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটছে। এরা মানবাধিকার কেন, নারীর অধিকার, জীবনের অধিকার, কোনো কিছুর তোয়াক্কা করছে না।"

কিন্তু নারীরা কীভাবে তাহলে সুরক্ষিত থাকতে পারবেন?

তনভীর বলেন, "এই ভিডিওটা অত্যন্ত আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে আমার মধ্যে। নিরাপদ কীভাবে থাকা সম্ভব, সে প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। ক্যারাটে বা জুডো শিখে, হাতে লঙ্কার গুঁড়ো নিয়ে ঘুরে বেড়িয়ে আসলে কিছু হবে না। লঙ্কার গুঁড়ো নিয়ে যদি ঘুরতে হয়, তাহলে ধরে নিতে হবে সমাজ নারীর জন্য অসুরক্ষিত। এর প্রতিকার প্রশাসনকে করতে হবে। যেখানে এমন নিগ্রহ ঘটবে, সেখানে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।"

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ