ভারত: অনুব্রতর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পুলিশের গড়িমসি
৭ জুন ২০২৫
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমে তৃণমূলের দাপুটে নেতা অনুব্রতর বিরুদ্ধে পুলিশকে টেলিফোনে গালিগালাজ করার অভিযোগ উঠেছে৷ এই সংক্রান্ত একটা অডিও ক্লিপ ভাইরাল হয়, যার সত্যতা যাচাই করেনি ডিডাব্লিউ৷ মামলা রুজু করলেও বিষয়টিকে কি লঘু করে দেখাতে চাইছে পুলিশ প্রশাসন? এমন অভিযোগ তুলছে বিরোধীরা৷
অনুব্রতর বিরুদ্ধে মামলা
তৃণমূল নেতার বিরুদ্ধে পুলিশ যে ধারায় মামলা করেছে, তার একাধিক জামিন অযোগ্য ধারা৷ ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ২২৪ নম্বর ধারায় কর্তব্যরত সরকারি কর্মীকে হুমকি দেয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে তার বিরুদ্ধে৷ ৩৫১ নম্বর ধারা অর্থাৎ ভয় দেখানোর অভিযোগও এনেছে পুলিশ৷ এ দুটোই জামিনযোগ্য ধারা। তবে দুটি জামিন অযোগ্য ধারাতেও অনুব্রতর বিরুদ্ধে মামলা রুজু হয়েছে৷ এর একটি ৭৫ নম্বর ধারা৷ এ ক্ষেত্রে অভিযোগ যৌন হেনস্থার৷ অন্যটি ১৩২ নম্বর ধারা অর্থাৎ সরকারি কাজে বাধা দেয়া৷
জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা রুজুর পরে অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করা হলে এর সপক্ষে আদালতে প্রমাণ পেশ করতে হয়৷ কিন্তু অনুব্রতর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারির মতো কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হয়নি৷ তিনি আদালত থেকে আগাম জামিন নেননি৷ এমনকি, তিনি একাধিকবার পুলিশি তলবের পরেও হাজিরা দিতে টালবাহানা করেছেন৷ অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে হাজিরা এড়িয়েছেন অনুব্রত।
অবশ্য এক সপ্তাহ পর গত বৃহস্পতিবার (৫ জুন) পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়েন তৃণমূল নেতা৷ বোলপুরের এসডিপিও অফিসে গিয়ে তিনি হাজিরা দেন৷ যদিও তার বিরুদ্ধে উঠা অভিযোগ খারিজ করে দিয়েছেন অনুব্রত৷
পুলিশ সূত্র অনুযায়ী, জিজ্ঞাসাবাদের সময়ে অনুব্রত দাবি করেন, তিনি আইসিকে ফোন করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু রাতে নয়৷
তার বক্তব্য, তিনি ঘুমের ওষুধ খেয়ে রাতে ঘুমিয়ে পড়েন৷ কাউকে ফোন করেন না৷ ভাইরাল হওয়া অডিও ক্লিপে কণ্ঠস্বর তার নয়, এমনটাও দাবি করেছেন তিনি৷ অনুব্রতর বক্তব্য, ওটা তার গলা নয়৷ গলা নকল করে তাকে ফাঁসানো হয়েছে৷
কিন্তু ওই অডিওটি ভাইরাল হওয়ার পর ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চেয়েছিলেন এই তৃণমূল৷ ক্ষমা চাওয়ার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, দল বলেছে বলেই তিনি ক্ষমা চেয়েছেন৷ দাবি করেছেন, তিনি দলের অনুগত সৈনিক৷
ওই অডিও অনুযায়ী, বোলপুর থানার আইসি লিটন হালদারকে ফোন করে অকথ্য গালিগালাজ করা হয়৷ এমনকি পুলিশ আধিকারিকের মা ও স্ত্রী সম্পর্কেও অত্যন্ত অশালীন মন্তব্য করতে শোনা গেছে৷ এ নিয়ে অভিযোগ জানানোর পরে পাল্টা চাপে পড়েছেন পুলিশ কর্মকর্তা লিটনও৷
এই আধিকারিকের বিরুদ্ধে শুরু হয়েছে বিভাগীয় তদন্ত৷ অনুব্রতসহ বোলপুরের বহু মানুষ আইসির বিরুদ্ধে বালি মাফিয়াদের সঙ্গে যোগসাজশ ও তোলাবাজির অভিযোগ করেছেন৷ এই অভিযোগে শুরু হয়েছে বিভাগীয় তদন্ত৷
প্রশ্ন উঠেছে, অনুব্রতকে কাঠগড়ায় তোলার জন্যই কি লিটনকে নিশানা করা হচ্ছে? আইসির সঙ্গে অনুব্রতর বিরোধ চলছিল৷ তৃণমূল নেতার অভিযোগ ছিল, আইসি বালি মাফিয়াদের সঙ্গে যুক্ত৷ এমনকি, যে কেউ অভিযোগ দায়ের করতে গেলে টাকা চান আইসি৷ এমন অভিযোগ তুলে অনুব্রতের অনুসারীরাও বোলপুর নাগরিক মঞ্চের নামে থানা ঘেরাও করেন৷ ওই দিনই অনুব্রতর সঙ্গে আইসির কথোপকথনের অডিও ক্লিপ ভাইরাল হয়৷
যা বলছেন আইনজীবীরা
আইনজীবী জয়ন্তনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘অনুব্রত মণ্ডলের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে, সেক্ষেত্রে কড়া ব্যবস্থা না নিলে পুলিশকে ফের নিশানা করা হবে৷ কোনো সাধারণ মানুষ মদ্যপ অবস্থায় পুলিশকে হেনস্থা করতে পারে? তখন পুলিশ কি তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে না? তাহলে তৃণমূল নেতার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে এত গড়িমসি কেন?''
এই আইনজীবী আরো বলেন, ‘‘অথচ বিজেপি নেতা সজল ঘোষ বা তৎকালীন কংগ্রেস নেতা কৌস্তভ বাগচীকে গ্রেপ্তারের সময়ে সক্রিয়তা দেখা গিয়েছিল৷ শিক্ষকদের অবস্থান তুলতেও পুলিশ প্রশাসন কার্যকরী ভূমিকা নিয়েছে৷ অনুব্রতর ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয়তা কেন, এ প্রশ্ন উঠবেই৷''
তৃণমূল নেতা ও আইনজীবী বৈশ্বানর চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘অডিও ভাইরাল হওয়ার পরে তৃণমূল কংগ্রেস এই মন্তব্যের নিন্দা জানিয়েছে। তাকে ক্ষমা চাইতে বলেছে। কিন্তু বিজেপির মন্ত্রী কর্নেল সোফিয়া কুরেশিকে সন্ত্রাসবাদীর বোন বলার পরে বিজেপি কী ব্যবস্থা নিয়েছে? অনিল বসু যখন মমতা বন্দোপাধ্যায়কে চুলের মুঠি ধরে বার করে দেবেন বলেছিলেন, সিপিএম কী ব্যবস্থা নিয়েছিল? অনুব্রতর বিরুদ্ধে পুলিশ তদন্ত চালাচ্ছে। তদন্তের বিষয়ে পুলিশ বলবে, তৃণমূল নয়। পুলিশ তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। যদি তার জবাবে সন্তুষ্ট না হয়, প্রয়োজনে হেফাজতে নিতে পারে৷''
অনুব্রত মণ্ডলকে সমর্থন জানিয়ে বীরভূমের তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সভাপতি বিক্রমজিৎ সাউ একটি ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেন৷ তার বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ নেয় তৃণমূল কংগ্রেস৷ ভিডিও ভাইরাল হওয়ার আট ঘণ্টার মধ্যে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়্৷ প্রশ্ন উঠেছে, মন্তব্যকে সমর্থনের জন্য যদি এই ব্যবস্থা নেয়া হয়, তাহলে যিনি এই মন্তব্যের জন্য অভিযুক্ত, তার বিরুদ্ধে কেন তৃণমূল শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিল না?
বৈশ্বানর বলেন, ‘‘ওই ছাত্রনেতাকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করেছে৷ অনুব্রতকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে৷ কিন্তু মধ্যপ্রদেশের বিজেপি নেতা ও মন্ত্রী পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদের সম্মুখীন হননি৷ একই বিষয়ে ঘটেছিল অনিল বসুদের ক্ষেত্রেও৷''
আইনজীবী ও সাংসদ বিকাশ ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘কাউকে গালমন্দ করাটা অনৈতিক, অশোভন৷ কিন্তু আইনের চোখে খুব একটা অপরাধ নয়৷ অনুব্রত আসলে এমন ভাষাতেই কথা বলেন৷ পুলিশ এই ভাষা শুনতে অভ্যস্ত বলে আধিকারিক তার কথা শুনে গিয়েছেন৷ আপনাকে কেউ এই ভাষায় কথা বললে ফোন কেটে দিতেন৷''
তার মতে, ‘‘জামিন অযোগ্য ধারা থাকলেই কাউকে গ্রেপ্তার করতে হবে, এমন আইনি বাধ্যবাধকতা নেই। যে অভিযোগ তোলা হয়েছে, তার বাস্তব ভিত্তি নেই। কী করে যৌন হেনস্থা হয়? কুৎসিত ভাষা বলেছেন যেটাকে হেনস্থা বলা যায় না। একজন পুলিশ আধিকারিকের সঙ্গে শাসক দলের নেতা যে আচরণ করেছেন, সে জন্য পুলিশমন্ত্রীর কঠোর ব্যবস্থা নেয়া উচিত ছিল৷ কিন্তু তিনি নীরব থেকেছেন৷''
এর আগে সিবিআই হেফাজাতেও নেয়া হয়েছিল এই তৃণমূল নেতাকে৷ ওইসময়ে তৈরি করা ছবিঘর:
অনুব্রতর ক্ষেত্রে গোপনীয়তার অধিকার সংক্রান্ত যুক্তি খাড়া করেছে তৃণমূল। দলের মুখপাত্র অরূপ চক্রবর্তী বলেন, ‘‘গোপনীয়তার অধিকার ভারতীয় নাগরিকের মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে৷ যা ফৌজদারি বা দেওয়ানি আইনের ঊর্ধ্বে৷ অনুব্রত যে গালিগালাজ করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে, সেটা ফৌজদারি অপরাধ৷ অনুমতি ছাড়া অনুব্রতর কল রেকর্ড করে মৌলিক অধিকার ভঙ্গ করা হয়েছে৷''
এই যুক্তি খারিজ করে আইনজীবী ফিরদৌস শামীম বলেন, ‘‘দু'জন ব্যক্তির মধ্যে, ধরা যাক এ ও বি–র মধ্যে কথোপকথন হচ্ছে৷ তারা ভারতকে বোমা দিয়ে উড়িয়ে দেয়ার ব্যাপারে কথা বলছে৷ সেই কথোপকথনের অডিও কি প্রকাশ্যে আনা হবে না? এ ব্যাপারে পুলিশকে সহযোগিতা করা হবে না? অনুব্রতর গোপনীয়তার অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে বলে আইনের সম্পূর্ণ অপব্যাখ্যা করা হচ্ছে৷''
শামীম ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘এর আগেও অনুব্রত মণ্ডল পুলিশকে নিয়ে অনেক কু–কথা বলেছেন। এ সব বলার মধ্যে দিয়ে একটা জিনিস প্রমাণিত হচ্ছে যে, অপরাধ তার অভ্যাস। পুলিশকে গালাগালি দেয়ার ক্ষেত্রে আপনি বলতে পারেন যে, এখানে অপরাধের মাত্রা কম। অপরাধ যার স্বভাব, তার বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া উচিত। সেটা পুলিশ করছে না। ফলে অনুব্রত স্বভাবগত অপরাধী রয়ে যাচ্ছেন৷''
পুলিশ তদন্তের স্বার্থে আইসির দুটি মোবাইল ফোন হেফাজতে নিলেও অনুব্রতর ফোন নেয়া হয়নি৷ এ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে৷ শামীমের বক্তব্য, "যারা বারবার আইন ভাঙেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সংস্থান নিশ্চিতভাবে আইনে আছে। কিন্তু, পুলিশ ঠিকঠাক পদক্ষেপ করছে না বলেই এতটা সমালোচনা হচ্ছে। পুলিশ তো এখনো পর্যন্ত নমুনা সংগ্রহ করতে পারেনি। অনুব্রত এবং ওসির ফোন নেয়া, ভয়েস স্যাম্পেল নেয়া ইত্যাদি সাধারণ তদন্তমূলক কার্যকলাপ পুলিশ এখনো করে উঠতে পারেনি।"
অনুব্রত মণ্ডলের বিরুদ্ধে পুলিশ কঠোর পদক্ষেপ নেবে না, এমন ভবিষ্যদ্বাণী ডিডাব্লিউর সঙ্গে কথোপকথনে আগেই করেছিলেন রাজ্যের সাবেক পুলিশকর্তা নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, "আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা পুলিশ প্রশাসনের কর্তব্য। সেক্ষেত্রে ত্রুটি দেখা যাচ্ছে অনেক আগে থেকেই। অনুব্রত এর আগে পুলিশকে বোমা মারার কথা বলে অব্যাহতি পেয়েছেন। এখনও তিনি শাসক দলের আস্থাভাজন। তাই তার বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না৷''
উল্লেখ্য, এর আগে গরুপাচার কাণ্ডে বোলপুরের বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন তৃণমূল নেতা অনুব্রত মণ্ডল৷ ওই সময়ে ডিডাব্লিউর তৈরি করা ছবিঘরটি দেয়া হলো এখানে৷